প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কে কি নতুন নিউরন তৈরি হয়

গর্ভাবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কে বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরন তৈরি হয়। শৈশবে তৈরি হয় আরও কিছু নিউরন। বিশ শতকের বেশিরভাগ সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মস্তিষ্কে যত কোষ তৈরি হয়, তা সারাজীবনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু গত কয়েক দশকে একাধিক গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কে কি সত্যিই নতুন নিউরন তৈরি হতে পারে?

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, শৈশবের পরেও মস্তিষ্ক কোষ গঠন করতে পারে। এর শক্ত প্রমাণও আছে। তবে সবাই এই ধারণার সঙ্গে একমত নন।

মস্তিষ্কে কোষ গঠনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউরোজেনেসিস। গবেষকেরা প্রথমে জন্মের পর বিভিন্ন বয়সী ল্যাব প্রাণীর নিউরোজেনেসিস পর্যবেক্ষণ করেন। এই প্রাণীর তালিকায় আছে ইঁদুর, ছুঁচো ও পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুরের মস্তিষ্কে নতুন নিউরন তৈরি হতে দেখা গেছে। ইঁদুরের মস্তিষ্কের সাবভেন্ট্রিকুলার জোন ও হিপোক্যাম্পাসে নিউরন তৈরি হয়। সাবভেন্ট্রিকুলার জোন ঘ্রাণ বা গন্ধ নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে হিপোক্যাম্পাস স্মৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীর নিউরোজেনেসিস শনাক্ত করতে অনেক গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা মানুষের ওপর প্রয়োগযোগ্য নয়। যেমন, রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রেসার ইনজেকশন। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের কোথায় নতুন নিউরন গঠিত হচ্ছে, তা ধারণা নিতে পারেন বিজ্ঞানীরা।

গবেষকদের মতে, এই নিউরোজেনেসিস মস্তিষ্কের প্লাস্টিসিটি বা অভিযোজন ক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইঁদুরের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জীবনযাপনের কিছু ব্যাপার নিউরন তৈরিতে মস্তিষ্ককে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন, উদ্দীপনামূলক পরিবেশে বসবাস ও নিয়মিত শরীরচর্চা। অন্যদিকে, আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত ইঁদুরের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিউরোজেনেসিস বাধা পায়। তবে এই ফলাফল মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।

আরও পড়ুন

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নিউরোজেনেসিস!

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক হংজুন সং বলেন, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নিউরোজেনেসিস সম্পর্কিত বেশিরভাগ ধারণা এসেছে প্রাণী গবেষণা থেকে। এই জ্ঞান সরাসরি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয় গবেষকেরা।’

প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীর নিউরোজেনেসিস শনাক্ত করতে অনেক গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তা মানুষের ওপর প্রয়োগযোগ্য নয়। যেমন, রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রেসার ইনজেকশন। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের কোথায় নতুন নিউরন গঠিত হচ্ছে, তা ধারণা নিতে পারেন বিজ্ঞানীরা। তবে ট্রেসারগুলো ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া এই পদ্ধতিতে প্রাণীটিকে ইথানাইজ করার পর মস্তিষ্কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়।

জার্মানির ড্রেসডেনের সেন্টার ফর রিজেনারেটিভ থেরাপিজের অধ্যাপক গার্ড কেমপারম্যান বলেন, ‘এ কারণে জীবিত মানুষের মস্তিষ্কে নিউরোজেনেসিস পরিমাপ করার কোনো সরাসরি উপায় নেই।’

মস্তিষ্কে কোষ গঠনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় নিউরোজেনেসিস। গবেষকেরা প্রথমে জন্মের পর বিভিন্ন বয়সী ল্যাব প্রাণীর নিউরোজেনেসিস পর্যবেক্ষণ করেন। এই প্রাণীর তালিকায় আছে ইঁদুর, ছুঁচো ও পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক ইঁদুরের মস্তিষ্কে নতুন নিউরন তৈরি হতে দেখা গেছে।

তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা মানুষের নিউরোজেনেসিস ট্র্যাক করতে রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রেসার পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পেরেছেন। যেমন প্রাণীর নিউরোজেনেসিস গবেষণায় ব্যবহৃত রেডিওঅ্যাকটিভ ট্রেসার অণু মাঝেমধ্যে মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর টিউমার বৃদ্ধি ট্র্যাক করতে চিকিৎসকেরা ব্যবহার করেন। এই তেজস্ক্রিয় অণুগুলো সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতিকর হলেও ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির চেয়ে সুবিধা বেশি।

১৯৯৮ সালে নেচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার রোগীদের মৃত্যুর পর তাদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করেন। তাঁদের রিপোর্টে বলা হয়, ক্যান্সার কোষ চিহ্নিত করার পাশাপাশি ট্রেসার অণুগুলো হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরন চিহ্নিত করেছিল। এ গবেষণা থেকে বোঝা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও নতুন নিউরন তৈরি হতে পারে। এ গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীদের বয়স ছিল ৫৭-৭২ বছর।

আরও পড়ুন

২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় মানুষের নিউরোজেনেসিস অনুসন্ধানে ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এমন একটা পদ্ধতি হলো রেডিওকার্বন ডেটিং। সাধারণত এই পদ্ধতির সাহায্যে কোনো কিছুর বয়স নির্ধারণ করা হয়। রেডিওকার্বন ডেটিং কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ নামে দুটি ভিন্ন ধরনের কার্বন বা কার্বন আইসোটোপের আপেক্ষিক অনুপাত তুলনা করে কোনো নমুনার বয়স নির্ধারণ করে। কিন্তু মানুষের নিউরোজেনেসিস গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কোষের ডিএনএর ভেতরে থাকা কার্বন-১৪ আইসোটোপের ঘনত্বের দিকে নজর দেন।

গ্লুটামেটারজিক অ্যাস্ট্রোসাইট কোষ থেকে নিউরোট্রান্সমিটার নির্গত হয় বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে
ছবি: নিউরোসায়েন্স নিউজ

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-১৪ এর মাত্রা বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা সেই সুযোগ কাজে লাগান। কারণ, কার্বন খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল এবং তা থেকে যায় ডিএনএতে। একটি নিউরনের ডিএনএতে কতটা কার্বন-১৪ আছে, তা থেকে সেই কোষটির গঠনের সময় অনুমান করা যায়। কারণ, একটি নির্দিষ্ট কোষে কার্বন-১৪-এর পরিমাণ কোষটি তৈরির সময় বায়ুমণ্ডলে আইসোটোপের ঘনত্বের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে সেই কোষের জন্মকাল মোটামুটিভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। কোষটি জন্মের পরই তৈরি হয়েছিল কিনা, তাও এই পদ্ধতিতে বোঝা সম্ভব।

সবাই এই প্রমাণের সঙ্গে একমত নন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারির অধ্যাপক আর্তুরো আলভারেজ-বুয়েলা বলেন, তিনি শিশু ও কিশোরদের মধ্যে নতুন নিউরন তৈরি হতে দেখেছেন।

এরকম একটি গবেষণায় ১৯-৯২ বছর বয়সী মানুষের পোস্টমর্টেম ব্রেন টিস্যু বিশ্লেষণ করা হয়। এই রেডিওকার্বন গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্কদের হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরন শনাক্ত করা হয়েছিল। তবে গবেষণার রিপোর্ট দারুণ হলেও এই পদ্ধতি এত জটিল ছিল যে এখনো কেউ তা সফলভাবে পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি।

তবে নতুন নিউরনের অস্তিত্ব পরোক্ষভাবে শনাক্ত করারও উপায় আছে। যেমন, কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিন শুধু নিউরন তৈরির সময় পাওয়া যায়। অধ্যাপক কেমপারম্যান ও অন্যান্য গবেষকেরা এই মার্কারগুলো বিশ্লেষণ করে আরও প্রমাণ পেয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কেও নিউরোজেনেসিস ঘটে। এ ব্যাপারে কেমপারম্যান বলেন, ‘নিউরোজেনেসিসের জন্য অনেক ধরনের মার্কার আছে। এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা বিভিন্ন রকম। টিস্যু সেকশন মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে নিউরনের বিকাশজনিত নির্দিষ্ট প্যাটার্নও খুঁজে বের করা যায়।’

আরও পড়ুন

তবে আগেই বলেছি, সবাই এই প্রমাণের সঙ্গে একমত নন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারির অধ্যাপক আর্তুরো আলভারেজ-বুয়েলা বলেন, তিনি শিশু ও কিশোরদের মধ্যে নতুন নিউরন তৈরি হতে দেখেছেন। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই প্রমাণ খুব দুর্বল। তিনি মনে করেন, এখানে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা গবেষকদের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে নিউরোজেনেসিসের লক্ষণের ধারণা দিতে পারে। যেমন, কিছু ল্যাব নতুন নিউরন ট্র্যাক করতে যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে তা অন্য কোষের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। যেমন মস্তিষ্কের গ্লিয়া কোষ বিভিন্ন উপায়ে নিউরনের কার্যকারিতায় সাড়া দেয়। ফলে নতুন নিউরন বাড়লেও মনে হতে পারে তা বাড়ছে না।

তিনি রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতিকে সৃজনশীল উল্লেখ করে জানান, ‘নতুন গঠিত কোষগুলো আসলেই নিউরন, নাকি অন্য কোনো কোষ তা এই পদ্ধতিতে নিশ্চিত হওয়া যায় না।’

এরকম একটি গবেষণায় ১৯-৯২ বছর বয়সী মানুষের পোস্টমর্টেম ব্রেন টিস্যু বিশ্লেষণ করা হয়। এই রেডিওকার্বন গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্কদের হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরন শনাক্ত করা হয়েছিল।

তবে তিনি এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত এই গবেষণা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারপরও সত্যিই যদি এটা ঘটে থাকে, তাহলেও খুব অল্পসংখ্যক কোষ তৈরি হয়।’

অন্যদিকে কেমপারম্যান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কে নতুন নিউরন তৈরি হয়। তার মতে, ‘সমালোচনামূলক গবেষণার চেয়ে ইতিবাচক গবেষণার সংখ্যা বেশি এবং এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও মান বেশ ভালো।’

তবে সত্যিই যদি নতুন নিউরন তৈরি হয় ও তা কার্যকরভাবে মস্তিষ্কে যুক্ত হয়, তাহলে এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে উঠতে পারে। যেমন মস্তিষ্কের আঘাত বা নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডার।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন