বার্ধক্য কি ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব

মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের কোষগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন আমরা আর তরুণদের মতো দ্রুত কাজ করতে পারি না। আমাদের শরীরের কর্মক্ষমতা কমে যায়। একে আমরা বলি বার্ধক্য। কিছু গবেষকের মতে, ভ্রূণের প্রথম কোষ গঠনের সময় থেকেই বার্ধক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে সবার সমান গতিতে বার্ধক্য আসে না। প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে বার্ধক্যের বয়স আলাদা। কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে আমরা বুঝি, কে বুড়ো হয়ে গেছেন, আর কে তরুণ। ত্বকে বলিরেখা, সাদা বা ধূসর চুল এবং হাত ও মুখে বয়সের দাগ দেখে আমরা বুঝতে পারি, তাঁদের বয়স হয়েছে।

বয়স শরীরের প্রতিটি অংশকে প্রভাবিত করে। এমনকি শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িয়ে যায়। কাজ করার ক্ষমতা, শারীরিক সক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতাতেও আসে পরিবর্তন। 

আরও পড়ুন

বার্ধক্য কেন হয়

আমাদের শরীরের সব কোষই শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। বছরের পর বছর কোষগুলোর বিভাজিত হওয়ার গতি কমে যায়। কোষ কাজ করা কমিয়ে দেয়। ঝিল্লিগুলো হয়ে যায় শক্ত। এ কারণে কোষে পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না। পাশাপাশি কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো বর্জ্য পদার্থও কোষ থেকে বের হতে বাঁধা পায়। শরীরে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সুস্থ হতে বেশি সময় লাগে।

আমরা যাকে ‘বার্ধক্য’ বলি, তার বেশিরভাগটাই ঘটে কোষ এবং ডিএনএর অণুগুলোর ক্ষতির কারণে। কান এবং নাকের আকার বদলে যেতে দেখা যায়। তরুণাস্থি নরম হয়ে ঝুলে যায় এই অঙ্গগুলোর। ফলে বয়স্কদের নাক এবং কান তরুণদের চেয়ে বড় দেখায়। পেশি এবং হাড়ের ভর কমে যায়। ফলে শক্তি কমে। এ কারণে বুড়োদের দেখতে খাটো মনে হয়।

বয়স্কদের মস্তিষ্কে মাইলিন নামে চর্বিযুক্ত পদার্থ ক্ষয় হতে থাকে। ফলে নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ কমে যায়। তাই স্মৃতি মনে রাখা বা নতুন স্মৃতি তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রোজেরিয়া নামে একটি বিরল জেনেটিক রোগ আছে। এই রোগে মানুষ খুব অল্প বয়সে বৃদ্ধ হয়ে পড়ে। দুই বছর বয়সের আগেই মানুষ বুড়ো দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা টাক হয়ে যেতে পারে। এই শিশুদের অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যায়। ত্বকে দেখা দেয় বলিরেখা। এই রোগটি একটি জিনের পরিবর্তনের কারণে হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ শিশুর মধ্যে প্রোজেরিয়া শনাক্ত হয়।

আরও পড়ুন

ত্বকে কেন বলিরেখা পড়ে

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হলো ত্বকে বলিরেখা দেখা দেওয়া। বিশেষ করে চোখ, মুখ এবং কপালে বলিরেখা স্পষ্ট হয়। ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং চামড়া ঝুলে যেতে শুরু করে।

বয়স্কদের ত্বক তরুণদের ত্বকের তুলনায় শুষ্ক। কম তৈলাক্ত এই ত্বক আর্দ্রতা ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারে না। ত্বকের মাঝের স্তর হলো ডার্মিস। এই স্তর পাতলা হয়ে যায়। ডার্মিসে থাকা তন্তু সময়ের সঙ্গে শিথিল হয়ে গেলে ত্বকের ওপরের অংশ আর মসৃণ থাকে না। এভাবে বলিরেখা তৈরি হয়।

বার্ধক্যের পাশাপাশি কিছু অভ্যাসের কারণেও বলিরেখা দ্রুত তৈরি হতে পারে। যেমন, দূষণ, সিগারেট এবং ই-সিগারেটে থাকা বিষাক্ত পদার্থ ত্বককে পানিশূন্য করে। ত্বকের কোষে অক্সিজেন সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলেও তৈরি হয় বলিরেখা।

পাশাপাশি সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ত্বকের কোলাজেন প্রোটিন ভেঙে বলিরেখা সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ফটোএজিং।

আরও পড়ুন

বুড়োরা কেন কানে কম শোনে, চোখে কম দেখে

বুড়ো লোকদের মধ্যে অনেকেই চোখে কম দেখেন বা কানে কম শোনেন। জিনগত কারণে এটি ঘটতে পারে। পরিবেশের কারণে এই পরিবর্তন দ্রুততর হতে পারে।

বয়সের কারণে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার প্রেসবিকিউসিস নামে একটি লক্ষণ আছে। অন্তকর্ণের কোষের ক্ষতি হলে দুই কানের শ্রবণশক্তি কমে যায়। ককলিয়ার (অন্তকর্ণের একটি তরলে ভরা কাঠামো) মধ্যে থাকা ছোট ছোট লোমগুলো শব্দ পরিবহনে সাহায্য করে। এই লোমগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ে যায়। একসময় এটি আর নতুন করে তৈরি হয় না। ফলে শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। কানের পর্দা বা মধ্যকর্ণের ছোট হাড়গুলোর স্বাভাবিক ক্ষয়ও শ্রবণশক্তি দুর্বল করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে কানের ময়লা বেশি আঠালো হয়ে কানের পথ আটকে দিতে পারে।

দৃষ্টিশক্তিও বয়স বাড়লে খারাপ হয়ে যায়। ৪০ বছর বয়সের পর চোখের অশ্রুগ্রন্থি থেকে কম অশ্রু তৈরি হয়। এছাড়া, পেশিগুলো চোখকে আগের মতো নড়াতে পারে না। ফলে বয়স বাড়লে আমরা পাশের দিকে কম দেখতে পাই। চোখের চারপাশের চর্বি কমে গিয়ে চোখ কোটরের ভেতর ঢুকে যায়। আলো প্রবেশ করতে বাঁধা পায়। ফলে আমরা কম দেখি।

এছাড়া চোখের লেন্সের স্থিতিস্থাপকতাও কমে যায়। একে বলে প্রেসবায়োপিয়া। এর ফলে কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধা হয়। চোখের লেন্সের প্রোটিনগুলো ভেঙে গেলে লেন্স হলুদ এবং ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। একে বলে চোখে ছানি পড়া। আপনি নিশ্চয়ই বহু মানুষের চোখে ছানি পড়ার কথা শুনেছেন।

আরও পড়ুন

বার্ধক্য কি হঠাৎ করে আসে

বার্ধক্য মানুষের সারা জীবন ধরেই ঘটে। তবে এর গতি একেক সময়ে একেকরকম। কিছু সময়ে বার্ধক্য হঠাৎ বেড়ে যায়। এর বিখ্যাত উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০০৮ সালে তিনি যখন প্রথম নির্বাচিত হন, তাঁর সব চুল ছিল কাঁচা। এরপর দুই মেয়াদে আট বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন শেষ দেখা যায়, তাঁর চুলগুলো সব ধূসর হয়ে গেছে। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে।

২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্তের উপাদানগুলো দেখে বার্ধক্যের গতি অনুসন্ধান করেন। গবেষকরা ১৮-৯৫ বছর বয়সী ৪ হাজার ২০০ জন মানুষের  রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন এবং বার্ধক্যের পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করেন। দেখা যায়, গড়ে বার্ধক্য তিনটি সময়ে বেড়ে যায়—৩৪, ৬০ এবং ৭৮ বছর বয়সে।

কয়েক বছর পর বিজ্ঞানীরা মানবদেহের অন্যান্য অণুগুলো দেখেও বার্ধক্যের গতি বের করেন। তারা মাইক্রোবায়োম বা দেহে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং ভাইরাসের সমষ্টির পরিবর্তন পরীক্ষা করেন। গবেষকেরা দেখতে পান, বার্ধক্য দুইটি সময়ে অনেক বাড়ে। প্রায় ৪৪ বছর এবং প্রায় ৬০ বছর বয়সে। এই পরিবর্তনগুলো পুরো স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। হৃদরোগ-সম্পর্কিত অণুগুলোতে এ সময়ে বড় পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন আরও নাটকীয় হয় ৬০ বছর বয়সে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত কমতে শুরু করে। সংক্রমণ ও রোগের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ দুর্বল হতে থাকে। 

আরও পড়ুন

বার্ধক্য কি ঠেকানো সম্ভব

সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী শি চিন পিংয়ের একটি আলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা একে অপরকে বলেছেন, সামনে মানুষ অনেকদিন বাঁচবে। অমরত্বও পেতে পারে। তাঁদের এই মত অনুযায়ী মনে হতে পারে, বার্ধক্য বুঝি ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু বর্তমানে যে তথ্য আমাদের জানা আছে, সে অনুযায়ী মানবদেহের সব কোষই বৃদ্ধ হয় এবং মারা যায়। তাই বার্ধক্য পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায় না বা বয়স কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে বার্ধক্যকে কিছুটা ধীর গতির করা যেতে পারে। জীবনযাপনে কিছুটা পরিবর্তন আনলে বয়সজনিত ক্ষতি কমতে পারে।

দৌড় বা সাঁতারের মতো ব্যায়াম বার্কক্যকে ধীর করতে পারে। সপ্তাহে কয়েকবার ব্যায়াম করলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। নিয়মিত ব্যায়াম করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসও প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

অনেকে বিশ্বাস করেন, তাঁরা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে নিজেদের বার্ধক্য নিরাময় করতে পারবেন। যেমন তরুণদের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে নিজেদের শরীরে প্রবেশ করালে বয়স বাড়বে না। তবে এই ধারণাকে সমর্থন করার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। বিজ্ঞানীরা কিছু ওষুধ এবং ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছেন বার্ধক্য ধীর করার জন্য। এই দিয়ে বার্ধক্যের প্রভাব কমানো হয়তো সম্ভব হবে। তবে বিষয়গুলো নিয়ে এখনও পরীক্ষা চলছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স