পৃথিবীতে চার প্রজাতির জিরাফ আছে, আগে জানতেন না বিজ্ঞানীরা
২৬০ বছর ধরে জিরাফকে আমরা ভুলভাবে জেনেছি! আগে বিজ্ঞানীরা জিরাফকে একটিমাত্র প্রজাতি হিসেবে ধরতেন। প্রজাতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Giraffa camelopardalis। আফ্রিকার হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তৃণভূমি ও বনাঞ্চলে এই প্রজাতিটি বিচরণ করত।
বিজ্ঞানীরা এখন জিরাফকে ভিন্ন চোখে দেখছেন। গত ২১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN) ঘোষণা করেছে, জিরাফ এখন আর একটি নয়, বরং চারটি ভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত। এখন থেকে সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানীরা প্রতিটি প্রজাতির অবস্থা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করবেন। প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা গেছে, চারটি প্রজাতির মধ্যে তিনটিই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই গবেষণার মূল্যায়নপত্রের লেখক মাইকেল ব্রাউন বলেছেন, ‘জিরাফ মানেই শুধু এক ধরনের জিরাফ নয়। এখন আমাদের চারটি ভিন্ন প্রজাতির জিরাফ আছে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব গল্প আছে। এই গবেষণা আফ্রিকার জিরাফ সংরক্ষণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।’
জিরাফের নতুন চার প্রজাতি
লম্বা গলা দেখে সহজেই অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে জিরাফকে আলাদা করা যায়। কিন্তু এদের নিজেদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। যেমন, ১৮০০-এর দশকে ইউরোপীয় প্রাণিবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জিরাফের চামড়া পরীক্ষা করেন। গায়ের নকশা ও রঙের স্বতন্ত্র ধরন খেয়াল করেছিলেন তাঁরা। ফলে কিছু গবেষক মনে করতেন, এই প্রজাতিতে আট বা নয়টি উপ-প্রজাতি আছে। যাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও এরা একে অপরের সঙ্গে প্রজনন করতে পারে।
তবে নতুন প্রমাণে সেই ধারণা পাল্টে গেছে। ২০২০ সালের একটি ডিএনএ গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান জিরাফেরা চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার বছর আগে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এরা বিবর্তিত হয়েছে। এরপর অবশ্য এদের মধ্যে খুব বেশি প্রজনন ঘটেনি।
আরেকটি গবেষণা হয়েছে ৫১৫টি জিরাফের খুলি নিয়ে। এই গবেষণায় জিরাফের চারটি প্রজাতির মধ্যে শারীরিক পার্থক্যও ধরা পড়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, জিরাফের মাথার শিংয়ের মতো অংশ (যাকে অসিকোন বলে) প্রতিটি দলের মধ্যে ভিন্ন। যেমন উত্তরাঞ্চলের অংশে থাকা জিরাফগুলোর কপালে একটি উঁচু অসিকোন থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জিরাফগুলোর ক্ষেত্রে এটি একটি ছোট ঢিবি বা উঁচুর মতো হয়। জিরাফ বিশেষজ্ঞরা এসব গবেষণা পর্যালোচনা করে একমত হয়েছেন যে, জিরাফ আসলে একটি নয়, চার প্রজাতিতে বিভক্ত।
চার প্রজাতির জিরাফ
প্রকৃতিতে সবচেয়ে বেশি টিকে আছে সাউদার্ন জিরাফ (Giraffa giraffa)। দক্ষিণ আফ্রিকা ও এর আশপাশের দেশগুলোতে এরা বাস করে। জিরাফ কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এদের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার ৮৩৭টি। এরপর আছে মাসাই জিরাফ (Giraffa tippelskirchi)। এদের সংখ্যা কম। এরা পূর্ব আফ্রিকায় বাস করে। আরেকটি প্রজাতি হলো রেটিকুলেটেড জিরাফ (Giraffa reticulata)। এদের বিচরণক্ষেত্র কেনিয়া এবং দক্ষিণ ইথিওপিয়া। নর্দার্ন জিরাফের (Giraffa camelopardalis) প্রজাতিটি জিরাফের মূল নাম ধরে রেখেছে। দক্ষিণ সুদান থেকে নাইজার পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চলে এদের দেখা যায়। এরা টিকে আছে মাত্র ৭ হাজার ৩৭টি। এটিই সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতি।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা জেনেটিক্স বিজ্ঞানী রাসমুস হেলার সতর্ক করে বলেছেন, ‘বিবর্তিত প্রজাতির মধ্যে স্পষ্টভাবে রেখা টানা সবসময় সহজ হয় না। প্রজাতির সংজ্ঞা আর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সববসময় সুন্দরভাবে মেলে না।’
তিনি বলেছেন, ‘এই চারটি প্রস্তাবিত প্রজাতি মাঝেমধ্যে একে অপরের সঙ্গে মিশেছে এবং প্রজনন ঘটিয়েছে। আসলে, রেটিকুলেটেড জিরাফগুলো একটি সংকর প্রজাতি। তাদের বংশগতি নর্দার্ন এবং সাউদার্ন জিরাফের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত। জিরাফকে বোঝা কঠিন। এদের ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে ধরা যায়, আবার একই প্রজাতিও ধরা যায়।
অন্যদিকে অ্যান ইন্নস ড্যাগ ফাউন্ডেশনের সংরক্ষণ বিজ্ঞানী ফ্রেড বারকোভিচ মনে করেন, গবেষকদল জিরাফকে চারটির বদলে আটটি প্রজাতিকে আলাদা করতে পারতেন।
তবে সবচেয়ে বিপন্ন জিরাফ প্রজাতিকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব। উগান্ডায় সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে ডজনখানেক নর্দার্ন জিরাফকে মুর্চিসন ফলস ন্যাশনাল পার্ক থেকে দেশের অন্যান্য অংশে সরিয়ে নিয়েছেন।
সংরক্ষণের নতুন দিক
ব্রাউন বলেন, আইইউসিএন এই বছরের শেষ দিকে নতুন করে স্বীকৃত পাওয়া চারটি প্রজাতির অবস্থা মূল্যায়নের জন্য বিজ্ঞানীদের দল গঠন করবে। নর্দার্ন, রেটিকুলেটেড এবং মাসাই জিরাফের সংখ্যা কম হওয়ায় এদের বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় স্থান দিতে পারে। বিশেষ করে মাত্র ৭ হাজার ৩৭টি প্রাণী নিয়ে নর্দার্ন জিরাফের টিকে থাকা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এরা আবার ক্ষুদ্র জনসংখ্যার দেশগুলোতে ছড়িয়ে আছে। এই দেশগুলোতে আবার লেগে আছে যুদ্ধ। দারিদ্র্যের হার এসব দেশে বেশি।
তবে সবচেয়ে বিপন্ন জিরাফ প্রজাতিকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব। উগান্ডায় সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে ডজনখানেক নর্দার্ন জিরাফকে মুর্চিসন ফলস ন্যাশনাল পার্ক থেকে দেশের অন্যান্য অংশে সরিয়ে নিয়েছেন। জিরাফ কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক স্টেফানি ফেনেসি বলেছেন, ‘যখন আমরা উগান্ডায় কাজ শুরু করি, তখন মাত্র দুটি জিরাফের দল ছিল। এখন সেখানে পাঁচটি দল আছে। এদের সংখ্যা বাড়ছে। জিরাফ নিরাপদ পরিবেশে জায়গা পেলে বেশি প্রজনন করে। তাই সংরক্ষণের আশা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।’