লক্ষণ দেখা দেওয়ার ১০ বছর আগেই রক্ত পরীক্ষায় মিলবে রোগের পূর্বাভাস

রক্তে থাকা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আগাম জানিয়ে দেবে স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ অবস্থাছবি: জ্যাকব ওয়াকারহাউসেন/গেটি

এক ফোঁটা রক্ত পরীক্ষা করে শরীরের বর্তমান অবস্থা জানা এখন খুব সহজ। যে কোনো হাসপাতালে গেলে সহজেই এই পরীক্ষা করে স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা যায়। তবে সাধারণ পরীক্ষা থেকে শুধু বর্তমান স্বাস্থ্যের অবস্থা জানা যায়। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, রক্তে থাকা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ অবস্থা আগাম জানিয়ে দেবে।

রক্ত নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষণা থেকে ভবিষ্যতের রোগ সম্পর্কে জানার এক নতুন উপায় পেয়েছেন গবেষকেরা। এই পরীক্ষায় মাত্র আঙুলের এক ফোঁটা রক্ত দিয়েই রোগের আগাম লক্ষণ জানা যাবে। এমনকি লক্ষণ প্রকাশের দশ বছর আগেই বলা যাবে ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে।

ইউকে বায়োব্যাংকের রক্ত নিয়ে একটি বড় প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এই পরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবীর রক্তে প্রায় ২৫০ ধরনের প্রোটিন, শর্করা, চর্বি এবং অন্যান্য যৌগের মাত্রা মাপা হয়েছিল।

মেটাবোলিক প্রোফাইল থেকে প্রতিটি মানুষের শরীরের ভেতরের কার্যক্রমের বিস্তারিত চিত্র পাওয়া গেছে। যেখানে রোগীর চিকিৎসা রেকর্ড ও মৃত্যুর তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডিমেনশিয়ার মতো নানা রোগের ঝুঁকি অনেক আগেই অনুমান করতে পারছেন।

মেটাবোলিক প্রোফাইল হলো আমাদের রক্তে থাকা নানা ধরনের অণু বা রাসায়নিক উপাদানের বিস্তারিত মানচিত্র। মেটাবোলিক প্রোফাইল হলো আমাদের রক্তে থাকা নানা ধরনের অণু বা রাসায়নিক উপাদানের বিস্তারিত মানচিত্র। এই উপাদানগুলোর মধ্যে থাকে শর্করা, চর্বি, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, হরমোনের পূর্বধাপ, ইউরিয়ার মতো বর্জ্য পদার্থ, শক্তি উৎপাদনের অণু ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
মেটাবোলিক প্রোফাইল হলো আমাদের রক্তে থাকা নানা ধরনের অণু বা রাসায়নিক উপাদানের বিস্তারিত মানচিত্র। এই উপাদানগুলোর মধ্যে থাকে শর্করা, চর্বি, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন ইত্যাদি।

আমাদের শরীর ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, কোন অঙ্গ কতটা সুস্থ, আর কোনো রোগের আগে শরীরের ভেতরে কী ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তা জানার উপায় হলো এই মেটাবোলিক প্রোফাইল।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার গবেষক জয় এডওয়ার্ডস-হিকস বলেছেন, ‘এটা আমাদের গবেষণার জন্য এক বড় পরিবর্তন বয়ে আনবে। রোগের কার্যকর পূর্বাভাস পেলে রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। শুধু রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করা হবে, এই ধারণার পরিবর্তন হবে।'

এই পরীক্ষার ফলে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। আঙুলের এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আগেই রোগের সংকেত পাওয়া গেলে চল্লিশ বছর বয়সেই একজন ব্যক্তিকে সতর্ক করা সম্ভব হবে। জানানো সম্ভব হবে, আপনার স্বাস্থ্য এদিকে যাচ্ছে, তাই জীবনযাপনে এই পরিবর্তনগুলো আনা দরকার।

ইউকে বায়োব্যাংক নাইটিঙ্গেল হেলথের সঙ্গে মিলে শত শত গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক মেটাবোলাইটের মাত্রা মেপেছে। যেমন শর্করা, অ্যামিনো অ্যাসিড, চর্বি, হরমোন তৈরির পূর্ব উপাদান, ইউরিয়ার মতো বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়েছে। খাবার, পানীয় বা ওষুধ ভাঙতে শরীর এই উপাদানগুলো ব্যবহার করে। পাশাপাশি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ শক্তি ব্যবহার করার সময়, ক্ষত সারাতে বা নতুন টিস্যু তৈরি করতে অণুগুলো ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন
আঙুলের এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আগেই রোগের সংকেত পাওয়া গেলে চল্লিশ বছর বয়সেই একজন ব্যক্তিকে সতর্ক করা সম্ভব হবে।

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের মেটাবোলিক প্রোফাইল তৈরি করা যায়। এই প্রোফাইলে রোগের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যায়। কোনো অঙ্গ ঠিকমতো কাজ না করলে প্রোফাইলে পরিবর্তন আসে। যেমন লিভার অসুস্থ হলে অ্যামোনিয়া বাড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন বাড়ায়। মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ল্যাকটেট বাড়ে। ক্যানসারে গ্লুকোজ গ্রহণ বেড়ে যায়।

এই মেটাবোলিক প্রোফাইল থেকে মানুষের জেনেটিক তথ্যগুলোও জানা যায়। মানুষ কোথায় থাকে, কী খায়, কেমন জীবনযাপন করে, দূষণ ও মানসিক চাপ কেমন, সবকিছুর তথ্য এই প্রোফাইলের মাধ্যমে জানা সম্ভব। কিংস কলেজ লন্ডনের জুলিয়ান মুৎস বলেছেন, ‘এই মেটাবোলিক প্রোফাইলগুলোতে মানুষের জেনেটিক প্রবণতা, এর ফল আর পরিবেশগত প্রভাব একসঙ্গে ধরা পড়ে। এতে একজন মানুষের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার একটি স্ন্যাপশট পাওয়া যায়।’

গবেষকেরা আগে অল্প কিছু মেটাবোলিক প্রোফাইল দেখার সুযোগ পেতেন। এবার ৫ লাখ মানুষের সম্পূর্ণ প্রোফাইল হাতে পাওয়ার পরে এই প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এখন রোগের আগাম সংকেত পাওয়া আরও সহজ ও নির্ভরযোগ্য হবে। এমনকি বিরল রোগের ক্ষেত্রেও আগাম তথ্য জানা যাবে।

মুৎস ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অনুমান করতে এই প্রোফাইল ব্যবহার করেন। পরীক্ষাটি যদি ১০–১৫ বছর আগেই জানাতে পারে যে কারও ঝুঁকি বেশি, তাহলে চিকিৎসকেরা দ্রুত জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারেন।

আরও পড়ুন
লিভার অসুস্থ হলে অ্যামোনিয়া বাড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন বাড়ায়। মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ল্যাকটেট বাড়ে। ক্যানসারে গ্লুকোজ গ্রহণ বেড়ে যায়।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নাজাফ আমিন ও তাঁর সহকর্মীরা ৫ লাখ প্রোফাইলের প্রাথমিক ডেটা পেয়েছিলেন। তাঁরা দেখেছেন, পুরুষ ও নারীর বার্ধক্য প্রক্রিয়া আলাদা। তাই বয়স–সম্পর্কিত রোগ, যেমন ক্যানসারের ধরনেও পার্থক্য আছে। তিনি বলেন, ‘এবার আমরা ওষুধ ব্যবহারে নারী-পুরুষের ভিন্নতা আরও গভীরভাবে দেখব। এতে বোঝা যেতে পারে, লিঙ্গভেদে ওষুধ কতটা ভিন্নভাবে কাজ করে।'

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের মেটাবোলিক প্রোফাইল তৈরি করা যায়
ছবি: অ্যান্ড্রু ব্রুকস / গেটি ইমেজেস

ইউকে বায়োব্যাংক ২০০৬ সালে স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ শুরু করে। অনুমোদিত বিজ্ঞানীরা এখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জীবনযাপন, জিন, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ইত্যাদির যোগসূত্র খুঁজে পান। এখন পূর্ণ মেটাবোলিক প্রোফাইল যুক্ত হওয়ায় গবেষণা আরও সমৃদ্ধ হবে।

ইউকে বায়োব্যাংকের প্রধান বিজ্ঞানী প্রফেসর নাওমি অ্যালেনের মতে, ‘মেটাবোলাইট নিয়ে গবেষণা রোগের আগাম সতর্কতা খুঁজে বের করা, রোগ কীভাবে শুরু হয় ও বাড়ে তা বোঝা এবং চিকিৎসা কতটা কাজ করছে, তা পর্যবেক্ষণে অসাধারণ শক্তিশালী একটি উপায়।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন