প্রাচীনকালে বেঁচে থাকার জন্য গুহায় আশ্রয় নিত মানুষ। সেই মানুষই এখন পৃথিবী ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে দূর মহাকাশে। ওলাবিবি বা কলেরার মতো যমদূতকে পরাস্ত করেছে ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই। শুধু কলেরা কেন, প্রাণঘাতী বহু রোগই আজ পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে তথ্য আদান-প্রদান করা যায় মুহূর্তের মধ্যেই। এসব মোটেও জাদুবিদ্যা নয়, নিখাদ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারিকুরি। মানব সভ্যতার এই চমৎকার ঘটনাগুলো ঘটেছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে, সঙ্গে বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, চিন্তাশীল সমাজ।
একটা সমাজকে চিন্তাশীল করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞান আলোচনার বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ছোটবেলা থেকেই বেশির ভাগ মানুষ বিজ্ঞানকে বড্ড ভয় পান। কারণ, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের সহজ আলোচনা অপ্রতুল। পাঠ্যবইয়ে যে বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, তা সবার কাছে বোধগম্য হয় না সহজে। তবে এ সমস্যা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রচুর মানুষ বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা লিখছেন, বই লিখছেন। সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিজ্ঞানের কঠিন নানা বিষয়। প্রতিবছরই বের হচ্ছে বিজ্ঞানের নতুন বই। এ কাজেরই আরেকটি নতুন সংযোজন বিজ্ঞান লিখন।
প্রাণী বা উদ্ভিদের নানা বৈশিষ্ট্যের কথা লেখা থাকে অতি ক্ষুদ্র ডিএনএতে। জিনিসটা এত ক্ষুদ্র যে মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। সেই ডিএনএ কাঁটাছেড়া করতে বিজ্ঞানীরা এখন ব্যবহার করেন অদৃশ্য কাঁচি—ক্রিসপার-ক্যাস৯ প্রযুক্তি। কোনো জীবের ডিএনএর উপকারী অংশ কেটে অবলীলায় জুড়ে দেন অন্য জীবের ডিএনএতে। কেমন করে? সেটাই গল্পের ছলে ছোট্ট রোহনকে বুঝিয়ে বলছে তার বাবা। ‘অদৃশ্য কাঁচি’ শিরোনামের এ লেখা দিয়ে বইয়ের শুরু।
বইয়ের নাম দেখে এটিকে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা শেখার বই মনে হতে পারে অনেকের। ভুলটা ভাঙবে মলাট ওল্টানোর পর। পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত এ বই আগাগোড়া বিজ্ঞানের বই। গণিত থেকে কম্পিউটার, পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জিনবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, জলবায়ু, পরিবেশ, রোবোটিকস—কী নেই!
এরপর একে একে রসায়নের অ্যাভোগেড্রো সংখ্যা কীভাবে এল, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাতেখড়ি, মহাকাশ থেকে আসা পাথরখণ্ড বা উল্কার নাড়িনক্ষত্র, পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ার্ক, জাদুর বিজ্ঞান, দেশি-বিদেশি মাছের গল্প, ক্যান্সার নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা ইত্যাদি নানা বিষয়ের নানা লেখকের লেখা জায়গা করে নিয়েছে বইটিতে।
মায়েদের সন্তান হওয়ার পর ডিএনএ না মেলার জিনগত জটিলতা ‘কাইমেরা’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সম্পাদক। ‘কাইমেরা: তোমার দেহে বসত করে কয় জনা’ শিরোনামের ওই লেখায় কাইমেরার পরিচয়, এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা, এর প্রভাব ও নিরাময়ের সম্ভাবনা উঠে এসেছে। মোবাইল ব্যবহারের কারণে যে শরীরে কোনো ক্ষতি বা ক্যান্সার হয় না, তার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অভিজিৎ মজুমদার। পৃথিবীর বায়ু প্রবাহ নিয়ে মজার সব তথ্য এসেছে ‘জেট গতিতে পশ্চিমা’ শিরোনামের লেখায়।
বইয়ের নাম দেখে এটিকে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা শেখার বই মনে হতে পারে অনেকের। ভুলটা ভাঙবে মলাট ওল্টানোর পর। পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত এ বই আগাগোড়া বিজ্ঞানের বই। গণিত থেকে কম্পিউটার, পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জিনবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, জলবায়ু, পরিবেশ, রোবোটিকস—কী নেই! বিজ্ঞানের হরেক রকম বিষয় উপজীব্য করে লেখা ছোট-বড় প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ এখানে স্থান পেয়েছে। বাংলা ভাষায় লেখা এসব প্রবন্ধ বেশ তথ্যবহুল। জটিল বিষয়গুলোকে ভেঙে, উদাহরণ দিয়ে সহজ ভাষায় বুঝিয়েছেন লেখকেরা।
একনজরে
বিজ্ঞান লিখন
সম্পাদনা: পঞ্চানন মণ্ডল
প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান
প্রকাশক: প্রান্ত প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: ২০২৪
পৃষ্ঠা: ২৭২
দাম: ৪৫০ টাকা
জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে লেখার পাশাপাশি এখানে স্থান পেয়েছে কুসংস্কার নিয়ে একাধিক লেখা। যেমন শতদ্রু ব্যানার্জীর লেখা ‘তারা পাথর’। আর্মেনিয়ার আস্তখাশেন গ্রামের বাসিন্দারা তারার মতো দেখতে একধরনের পাথর ঘিরে কিংবদন্তির গল্প তৈরি করে। পরে দেখা গেল, এই পাথরগুলো পৃথিবীর বাইরের কোনো জিনিস নয়। এদের জন্ম সমুদ্রে। আসলে জিনিসটা কী, সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন লেখক। তারার মতো জিনিসগুলো লাখো-কোটি বছর আগে সমুদ্রে বসবাস করা জলজপ্রাণী ক্রিনয়েডের ফসিল। সমুদ্র থেকে গ্রামের মধ্যে পাথরগুলো কীভাবে এল, সে রহস্যের সমাধানও আছে এই লেখায়।
রিচার্ড ফাইনম্যান এবং আমাদের সত্যেন বসু—বিজ্ঞান লিখন বইটিতে আছে এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণার কথা। আছে বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রতিকূলতা জয়ের গল্প। এরকম একটি লেখা ‘লরেঞ্জোদের গল্প’।
অ্যাড্রিনোলিউকোডিস্ট্রফি একটি জিনঘটিত দুরারোগ্য রোগ। অন্তত ছোট্ট লরেঞ্জোর যখন এই রোগ ধরা পড়ে, তখন এর কোনো চিকিৎসাই ছিল না। কিন্তু বাবাকে তা বোঝানো সম্ভব হয়নি। লরেঞ্জের একরোখা বাবা কীভাবে পৃথিবী চষে ফেলেছিলেন একমাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্য, সে কথা বলা হয়েছে লরেঞ্জোদের গল্পে। ডাক্তাররা যার আয়ু মাত্র কমাস বেঁধে দিয়েছিলেন, সেই লরেঞ্জোই বিজ্ঞানের কল্যাণে কীভাবে ত্রিশ বছর বেঁচে রইলেন, সে গল্প বিজ্ঞান গবেষণায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।
গড়পড়তা বইটির বিষয়বস্তু আপনার ভালো লাগবে। তবে বইয়ের অলংকরণ কিছুটা আহত করতে পারে। আরও যত্ন নিয়ে কাজগুলো করলে বইটির মান বাড়ত বৈ কমত না। বিজ্ঞানের জটিল সব শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখকেরা।
পঞ্চানন মণ্ডল পেশায় একজন শিক্ষক। কলকাতার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞান জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে তোলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ গ্রুপ ‘বিজ্ঞানকথা’। গ্রুপের মাধ্যমে লেখকেরা বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা মানুষের সামনে তুলে ধরেন। সেসব লেখা থেকে বাছাই করা কিছু লেখা নিয়ে এই বই।
গড়পড়তা বইটির বিষয়বস্তু আপনার ভালো লাগবে। তবে বইয়ের অলংকরণ কিছুটা আহত করতে পারে। আরও যত্ন নিয়ে কাজগুলো করলে বইটির মান বাড়ত বৈ কমত না। বিজ্ঞানের জটিল সব শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখকেরা। তবে বিজ্ঞানের পাঠক নয়, এমন মানুষের কথা বিবেচনা করে এসব পারিভাষিক শব্দের অর্থ টীকা আকারে দিলে আরও ভালো হতো। ছোটখাটো এসব বিষয় বাদ দিলে বইটি সার্থক।
চলতি বছর জানুয়ারিতে বইটি বাজারে এনেছে ঢাকার প্রান্ত প্রকাশন। ২৭২ পৃষ্ঠার এ বইয়ের মুদ্রিত মূল্য ৪৫০ টাকা। বিজ্ঞানের বিচিত্র জগতে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে ডুব দিতে পারেন বিজ্ঞান লিখন-এ। আশা করি, রস আস্বাদনে ব্যর্থ হবেন না। অনলাইন বুকশপের পাশাপাশি বইটি পাওয়া যাবে দেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।