ভয়ংকর মাদক হেরোইন: কী, কেন, কতটা ক্ষতিকর

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, অর্থাৎ ১৯৯০ সালের দিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছিল মরফিন। মূলত তীব্র ব্যথা থেকে রোগীকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহৃত হচ্ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই নেশাদ্রব্য হিসেবেও এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যার মধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ ছিলেন মরফিনের নেশায় আসক্ত। মরফিনের ওভারডোজে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এত মানুষের মরফিনে আসক্ত হওয়ার পেছনের কারণ ছিল দুটি। প্রথমটি হলো, মরফিন দিয়ে খুব সহজেই নেশা করা সম্ভব। আর দ্বিতীয়টি হলো মরফিনের সহজলভ্যতা। বর্তমানে কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউই মরফিন কিনতে না পারলেও তখনকার দিনে মরফিন সংগ্রহে কোনো বাধানিষেধ ছিল না। ফলে যে কেউ যেকোনো ফার্মেসি থেকে মরফিন সংগ্রহ করতে পারত।

মরফিনে আসক্তের সংখ্যা এত বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেন মার্কন নীতিনির্ধারকেরা। মরফিনের মতো অমূল্য একটি ওষুধকে নিষিদ্ধ করা যেহেতু মোটেও সম্ভব নয়, তাই মরফিনের সহজলভ্যতা কীভাবে কমানো যায়, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেন তাঁরা।

নীতিনির্ধারকেরা যেভাবে চিন্তা করেন, বিজ্ঞানীরা অবশ্য সেভাবে চিন্তা করবেন না। মরফিন সহজলভ্য নাকি দুর্লভ, এ নিয়ে তাঁরা মোটেও মাথা ঘামালেন না। মরফিনের এই ক্ষতিকর দিকের কথা চিন্তা করে তাঁরা মরফিনের বিকল্প কিছু খুঁজতে শুরু করেন। তাঁরা এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করতে চাইলেন, যার মধ্যে মরফিনের ব্যথানাশক গুণটি থাকবে, কিন্তু নেশায় আসক্ত হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। মরফিনের অণু নিয়ে বিজ্ঞানীরা রীতিমতো ধস্তাধস্তি শুরু করেন, কীভাবে এটিকে কিছুটা পরিবর্তন করে আরেকটু ভালো কিছুতে রূপান্তর করা যায়।

আরও পড়ুন
তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যার মধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ ছিলেন মরফিনের নেশায় আসক্ত। মরফিনের ওভারডোজে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছিলেন হাজার হাজার মানুষ।

সে সময় প্রতিবছর রসায়নবিদেরা আগের বছরের থেকে উন্নতি করছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুটা ছিল রসায়নের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, জৈব যৌগের স্বর্ণযুগ। রসায়নবিদেরা তখন জৈব যৌগ নিয়ে যা ইচ্ছা তা–ই করতে পারছিলেন। কার্বনের এই যৌগগুলোকে তাঁরা নিজেদের মতো পরিবর্তন করে তৈরি করছিলেন বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী পদার্থ। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় তাঁরা আবিষ্কার করছিলেন কীভাবে চিনি তৈরি হয়, কীভাবে জীবদেহে খাদ্য হজম হয়, কীভাবে জীবের মুখনিঃসৃত লালা কাজ করে। মানুষ যেভাবে তাপ দিয়ে লোহাকে বিভিন্ন আকারে আনতে পারে, ঠিক সেভাবেই যেন তাঁরা অণু-পরমাণুকে এক আকৃতি থেকে ভিন্ন আকৃতিতে রূপান্তর করছিলেন। বিজ্ঞানীরা মনে করতে লাগলেন, তাঁরা যা ইচ্ছা তা–ই করতে পারবেন।

কিন্তু তাঁদের এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে মরফিন।

বিজ্ঞানাগারে প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়ে থাকেন। আর স্বাভাবিকভাবেই সব পরীক্ষা কখনো সফল হয় না, অনেক পরীক্ষা হয় ব্যর্থ। ১৮৭৪ সালে লন্ডনের একজন রসায়নবিদ মরফিনের সঙ্গে সামান্য একটু অ্যাসিটাইল (Acetyl) গ্রুপের সংযোগ ঘটিয়ে দেখতে চান এতে মরফিনের মধ্যে কী পরিবর্তন আসে। কিন্তু তাঁর এই পরীক্ষা ব্যর্থ হিসেবেই পরিগণিত হয়। কারণ, মরফিন ও অ্যাসিটালের এই মিশ্রণ যখন প্রাণিদেহে (ইঁদুর) প্রয়োগ করা হয়, তখন ইঁদুরটির দেহে কোনো পরিবর্তনই দেখা যায় না। মিশ্রণটি অল্প পরিমাণে প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হচ্ছিল না, বেশি পরিমাণে প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। তাই তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। এই পরীক্ষা নিয়ে তিনি ছোট একটি জার্নাল লেখেন এবং অন্য কাজে মনোযোগ দেন।

তখন মরফিন নিয়ে আরও অনেক বিজ্ঞানী অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, তৎকালীন সেরা রসায়নবিদেরা তাঁদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়েও মরফিন নিয়ে কিছু করতে পারছিলেন না। আফিম, কোডিন, থেবাইনের মতো অ্যালকালয়েডের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁরা বিভিন্ন যৌগ তৈরি করতে পারলেও মরফিনের কোনো বিকল্প পাওয়া যাচ্ছিল না।

আরও পড়ুন
১৮৭৪ সালে লন্ডনের একজন রসায়নবিদ মরফিনের সঙ্গে সামান্য একটু অ্যাসিটাইল (Acetyl) গ্রুপের সংযোগ ঘটিয়ে দেখতে চান এতে মরফিনের মধ্যে কী পরিবর্তন আসে।

এ অবস্থা চলে প্রায় দুই দশক। ১৮৯০ সালের শেষ দিকে জার্মানির একটি রং প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, দ্য বায়ার কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আরও কয়েকটি শাখা খুলবে। তখন বায়ার কোম্পানির বেতনভুক্ত কিছু রসায়নবিদ ছিলেন, যাঁদের মূল কাজ ছিল খনিজ আলকাতরা (একপ্রকার উচ্ছিষ্ট) থেকে কৃত্রিম রঙের মতো মূল্যবান পদার্থ প্রস্তুত করা। কিন্তু সে সময় এমন প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব রসায়নবিদ ছিলেন এবং তাঁরাও সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। আর এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় জার্মানিতে রং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে যেতে লাগল। এ অবস্থা দেখে বায়ার কোম্পানি টাকা রোজগারের অন্য একটি পথ বেছে নেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ওষুধের বাজারে প্রবেশ করবে। পাশাপাশি ক্লোরাল হাইড্রেটের আবিষ্কার তাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা উপলব্ধি করে ল্যাবরেটরিতেই জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধ তৈরি করা সম্ভব।

শুরুতে রং প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়া ছিল খুব সাধারণ। তারা কাজ শুরু করে আফিম নিয়ে। এর অণুকে বিভিন্নভাবে বদলে অন্য কিছুর সঙ্গে সংযোজনের মাধ্যমে তারা আরও মূল্যবান কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে। কারণ, যদি মূল্যবান কিছু আবিষ্কার করা যায়, তাহলে সেটার স্বত্ব কিনে নিয়ে চড়া দামে বাজারে তা বিক্রি করা সম্ভব।

খুব দ্রুত বায়ার কোম্পানি সাফল্য পায়। ফেলিক্স হফম্যান নামের প্রতিষ্ঠানের তরুণ এক রসায়নবিদ, অ্যাসিটাইল গ্রুপ নিয়ে কাজ করার সময় আবিষ্কার করে হালকা ব্যথানাশক ও জ্বর উপশমের অব্যর্থ এক ওষুধ। বায়ার কোম্পানি একে ‘বায়ার অ্যাসপিরিন’ নামে বাজারজাত করে। একবার সফল হওয়ার পর হফম্যানের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়, সে অ্যাসিটাইল গ্রুপের সঙ্গে এবার মরফিনের সংযোগ ঘটায়, ঠিক লন্ডনের সেই বিজ্ঞানীর মতো। আর ফলাফল হয় আগের মতোই—মরফিনের তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু লন্ডনের ওই বিজ্ঞানী হাল ছেড়ে দিলেও হাল ছাড়ে না বায়ার কোম্পানি। তারা হফম্যানের প্রস্তুত করা ওই নতুন পদার্থ নিয়ে আরও গবেষণা করতে থাকে। তারা প্রথমে প্রাণিদেহে এটি প্রয়োগ করে এবং ওই নতুন পদার্থ মানবদেহে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মী রাজি হন এটি গ্রহণ করতে।

আরও পড়ুন
বায়ার কোম্পানির বেতনভুক্ত কিছু রসায়নবিদ ছিলেন, যাঁদের মূল কাজ ছিল খনিজ আলকাতরা (একপ্রকার উচ্ছিষ্ট) থেকে কৃত্রিম রঙের মতো মূল্যবান পদার্থ প্রস্তুত করা।

মানবদেহে এটি প্রয়োগের ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য! যাঁরা এটি গ্রহণ করেছিলেন, সেই কর্মীরা জানান, হফম্যানের এই ওষুধ সেবনের পর তাঁদের দারুণ এক অনুভূতি হয়। শুধু দারুণ বললে ভুল হবে, তাঁরা নিজেদের আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে করেন এবং খুবই আনন্দবোধ করেন। হফম্যানের আবিষ্কৃত পদার্থটি গ্রহণের পর নাকি তাঁদের নিজেকে ‘হিরোইক (Heroic)’ বলে মনে হতে থাকে।

বায়ার কোম্পানি কর্মীদের থেকে এমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে সদ্য আবিষ্কৃত এই ওষুধ বার্লিনের দুজন চিকিৎসকের হাতে তুলে দেয়। চিকিৎসকেরা বেশ কিছু রোগীকে ওই ওষুধ দেন। আবারও আসে চমকপ্রদ ফল! এই অ্যাসিটাইলেটেড মরফিন সাধারণ মরফিনের মতোই তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়, পাশাপাশি কাশি ও গলাব্যথা উপশম করে। যক্ষ্মা রোগীদের এই ওষুধ দেওয়ার পর তাদের গলা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, খুবই উৎফুল্ল বোধ করা এবং আশাবাদী হয়ে ওঠা, যা চিকিৎসক ও রোগী সবার মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হয়।

বায়ার কোম্পানির কাছে এটুকু শোনাই যথেষ্ট ছিল। তারা এই নতুন ওষুধ বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এর আগে তাদের প্রয়োজন ছিল একটি গালভরা নাম। তাদের মাথায় আসে, যাঁরা এটি গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সবাই একটি কথা বারবার বলেছেন, ‘হিরোইক’। সেই থেকে কোম্পানিটি সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের এই নতুন ওষুধের নাম হবে ‘বায়ার হেরোইন’।

বায়ার হেরোইনকে মার্কেটে প্রচারের সময় বায়ার কোম্পানি দাবি করে যে তারা পরীক্ষায় দেখেছে, এটি মরফিনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি কার্যকর এবং মরফিনের মতো মোটেও আসক্তিকর ওষুধ নয়। অর্থাৎ তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, হেরোইন মরফিনের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং এটি কোনো মাদক নয়, এ দুটি তথ্য সবাইকে বিশ্বাস করানো।

আরও পড়ুন
অ্যাসিটাইলেটেড মরফিন সাধারণ মরফিনের মতোই তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়, পাশাপাশি কাশি ও গলাব্যথা উপশম করে। যক্ষ্মা রোগীদের এই ওষুধ দেওয়ার পর তাদের গলা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়।

খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় বায়ার হেরোইন। যেহেতু এটি গ্রহণে কাশি উপশম হয় বলে একটি ধারণা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, শুরুতে কাশি ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য চিকিৎসকেরা সবাইকে হেরোইন সেবনের পরামর্শ দেন। রোগীরা আনন্দের সঙ্গে মরফিনের বদলে হেরোইন গ্রহণ করতে থাকেন। হেরোইনের ব্যবসা করে বড় অঙ্কের টাকা রোজগার শুরু করে বায়ার কোম্পানি।

কিন্তু আরও দুই দশক আগে এই ফর্মুলা এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী প্রস্তুত করে দেখিয়েছিলেন, ফলে বায়ার কোম্পানির পক্ষে হেরোইনের স্বত্ব কিনে নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিভিন্ন কোম্পানি হেরোইন বাজারজাত করা শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সব বয়সী মানুষের জন্য বাজারে হেরোইনমিশ্রিত লজেন্স বিক্রি শুরু হয়। বায়ার কোম্পানি যখন দেখে, তারা এই ওষুধের স্বত্ব নিজেদের নামে নিতে পারবে না, তারা ধীরে ধীরে হেরোইনের ব্যবসা থেকে সরে যেতে থাকে। যেহেতু ‘বায়ার অ্যাসপিরিন’ গোটা পৃথিবীতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়, তারা শুধু এর মাধ্যমে অনেক টাকা রোজগার করতে থাকে। ফলে হেরোইন নিয়ে তারা আর মাথা না ঘামানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ইতিমধ্যে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ১৯০৬ সালে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য হেরোইনের অনুমোদন দেয় এবং এ–ও জানিয়ে দেয় যে মরফিনের বিকল্প হিসেবে হেরোইন ব্যবহার করা সম্ভব।

কিন্তু চিকিৎসকেরা অচিরেই উপলব্ধি করলেন, বায়ার কোম্পানি হেরোইন সম্পর্কে যা যা বলেছে, তা আদৌ সঠিক নয়। প্রথমত, হেরোইন গ্রহণে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার যে তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সম্পূর্ণ ভুল। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো, এটি মোটেও মরফিনের কোনো বিকল্প নয়; বরং এটি মরফিনের চেয়ে আরও বহু গুণ বেশি আসক্তির। ক্রমে মরফিনের বদলে হেরোইনে আসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট, অফিস আদালত—সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে হেরোইনে আসক্ত মানুষের সংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে যায় ছিনতাই, খুনের মতো অপরাধের সংখ্যা। সাংবাদিকেরা সরব হয়ে ওঠেন হেরোইন নিয়ে। তাঁদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে কীভাবে মানবদেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে হেরোইন এবং কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায় একটি জীবন।

আরও পড়ুন
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ১৯০৬ সালে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য হেরোইনের অনুমোদন দেয় এবং এ–ও জানিয়ে দেয় যে মরফিনের বিকল্প হিসেবে হেরোইন ব্যবহার করা সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডর রুজভেল্ট। মরফিন ও হেরোইনের মতো ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব দেখে তিনি এগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে প্রথমবারের মতো একটি কার্যকর অ্যান্টি–ড্রাগ আইন পাস হয়, যার নাম ‘হ্যারিসন অ্যাক্ট’। হ্যারিসন অ্যাক্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলো যেসব ওষুধ, যেগুলোর অবাধ ব্যবহারে মানবদেহের ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে, সেগুলোর উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা। এই আইন পাসের ফলে অবাধে হেরোইন ও মরফিন বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়্গ পড়ে যায়। ঠিক কতবার চিকিৎসকেরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে মরফিন বা হেরোইনের নাম লিখছেন, তার হিসাব তাঁরা রাখতে বাধ্য হলেন।

এ আইনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। যেহেতু মানুষ আর সহজে এই ওষুধগুলো কিনতে পারছিল না, তাই তাঁদের মুনাফাও ধীরে ধীরে অনেক কমে যায়। তাঁরা এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করেন। দাবি করেন, এই আইন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করার শামিল। কিন্তু কোনো লাভ হয় না, সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আর ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হয়ে যায় হেরোইন।

আরও পড়ুন
হ্যারিসন অ্যাক্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলো যেসব ওষুধ, যেগুলোর অবাধ ব্যবহারে মানবদেহের ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে, সেগুলোর উৎপাদন, বিতরণ ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা।

তবে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে অচিরেই বৈধ ওষুধ থেকে হেরোইন পরিণত হয় মাদকে। মাদক ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ লুফে নেন। তাঁরা শুরু করেন অবৈধভাবে হেরোইনের উৎপাদন। তরল হেরোইন পরিবহন করা একটু কঠিন বলে তাঁরা হেরোইনকে পাউডার আকারে বিক্রি করতে শুরু করেন। ফলে ছোট ছোট প্যাকেটে করে বিক্রি হওয়া এই হেরোইন পুলিশের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে পড়ে অত্যন্ত কঠিন।

আগে যেখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা রোগী পরিচয়ে ভর্তি হতেন হাসপাতালে, হ্যারিসন অ্যাক্টের বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরা পরিচিত হন অপরাধী হিসেবে এবং তাঁদের আবাসস্থল হয় জেলখানা।

যুক্তরাষ্ট্র এই পথে হাঁটলেও যুক্তরাজ্য বেছে নেয় একটি ভিন্ন পথ। তারা মাদকাসক্ত ব্যাক্তিদের রোগী হিসেবে দেখে, জেলে না নিয়ে তাদের হাসপাতালে ভর্তির দিকেই বেশি জোর দেয়।

হেরোইনের প্রভাব মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হলেও সে সময়ের জন্য এটি ছিল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। তবে এটা মাদক। কোন ধরনের মাদক কোনভাবেই গ্রহণ করা উচিত নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: টমাস হ্যাগার/টেন ড্রাগস

আরও পড়ুন