আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, পরমাণু মোটেও অবিভাজ্য কণা নয়, বরং একে আরও ক্ষুদ্র এককে ভাঙা সম্ভব।
একসময় পরমাণুকে ভাবা হতো কোনো পদার্থ বা বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণা বা একক। প্রাচীনকালের গ্রিক পণ্ডিতরা মনে করতেন, কোনো পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে একসময় এমন এক পর্যায় আসবে, যখন তাকে আর ভাঙা যাবে না। সেটাই হবে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা। মানে পদার্থের অবিভাজ্য কণা। গ্রিক ভাষায় যাকে বলা হতো অ্যাটম। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতরা ওই অবিভাজ্য কণার নাম দিয়েছিলেন পরম অণু। সংক্ষেপে পরমাণু।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, পরমাণু মোটেও অবিভাজ্য কণা নয়, বরং একে আরও ক্ষুদ্র এককে ভাঙা সম্ভব। যেমন পরমাণুকে ভাঙলে পাওয়া যাবে অতিপারমাণবিক কণা প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। প্রোটন ও নিউট্রনের অবস্থান পরমাণুর কেন্দ্রে। আর এই কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন কণারা। আবার প্রোটন ও নিউট্রনও শেষ কথা নয়। এ দুটি কণাকে ভাঙলে পাওয়া যাবে আরও ক্ষুদ্র কণা, যাদের বলা হয় কোয়ার্ক। সে না হয় হলো, কিন্তু একটি পরমাণু আসলে কত বড়? এককথায় উত্তর দিতে গেলে, একটা পরমাণুর ব্যাস ০.১ থেকে ০.৫ ন্যানোমিটার। অনেকেই হয়তো জানেন, এক ন্যানোমিটার হলো এক মিটারের এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ভাগের একভাগ মাত্র। আরেকভাবে বলা যায়, ১×১০-১০ মিটার থেকে ৫×১০-১০ মিটার। এভাবে বললে পরমাণুটা কত ছোট, তা বোঝা কঠিন। কাজেই আমাদের চেনাজানা কোনো কিছুর উপমা ব্যবহার করলে বুঝতে হয়তো অনেকের জন্য সুবিধা হতে পারে।
পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ছোট্ট প্রোটন কণা। ধরা যাক, আপনার আকার একটা প্রোটনের সমান। তাহলে গোটা পরমাণুটার আকার হবে আপনার চেয়ে অবশ্যই অনেক অনেক বড়।
মানুষের চুলের পুরুত্বের সঙ্গে তুলনা করলে একটা পরমাণু প্রায় ১০ লাখ ভাগ ক্ষুদ্র। অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ পরমাণু একসঙ্গে জড়ো করলে একটা চুলের সমান পুরুত্ব পাওয়া যাবে। আর ১০ কোটি পরমাণুকে সারিবদ্ধ করে সাজালে আপনার হাতের আঙুলের নখের সমান হতে পারে। কিংবা ৫০ লাখ হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত করলে, তা একটা আলপিনের মাথায় এঁটে যাবে। অবশ্য এ নিয়ে মতভেদও আছে। অনেকের মতে, আলপিনের মাথায় আঁটানো যাবে প্রায় ১ কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু।
আরেকটা উদাহরণ দিই। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ছোট্ট প্রোটন কণা। ধরা যাক, আপনার আকার একটা প্রোটনের সমান। তাহলে গোটা পরমাণুটার আকার হবে আপনার চেয়ে অবশ্যই অনেক অনেক বড়। সেটা কত বড়? আপনার তুলনায় প্রায় এক লাখ গুণ বড়। বিপরীতে, আপনি যদি স্বাভাবিক আকৃতির মানুষ হন, তাহলে পরমাণুর আকার হবে খুব ছোট। তখন এই খুদে কণার আকার হবে আপনার চেয়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ভাগ ছোট। অর্থাৎ পরমাণু এত ছোট যে তা খালি চোখে দেখা যায় না। এমনকি আমাদের বানানো সবচেয়ে উন্নতমানের অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ দিয়েও একক পরমাণু দেখা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।
বিজ্ঞানের ভাষায়, পরমাণুর প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ ভাগই ফাঁকা। সে হিসেবে পরমাণুর এই শূন্যস্থান যদি কোনোভাবে চুপসানো সম্ভব হতো, তাহলে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে একটা চিনির দানার মধ্যে আঁটানো সম্ভব।
পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে ঠাসাঠাসা অবস্থায় থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। একটা নিউক্লিয়াসের আকার প্রায় ১০-১৫ মিটার। অর্থাৎ এটি গোটা পরমাণুর আকারের পায় ১০-৫ (বা ১/১০০,০০০) ভাগ। একটা পরমাণুকে যদি ফুটবল মাঠের সমান বলে কল্পনা করেন, তাহলে নিউক্লিয়াসের আকার হবে ওই মাঠে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট মটরদানার সমান। ওখানেই পরমাণুর সিংহভাগ ভর মজুত থাকে। এতে বোঝা যায়, পরমাণুর অধিকাংশ জায়গা আসলে ফাঁকা। বিজ্ঞানের ভাষায়, পরমাণুর প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ ভাগই ফাঁকা। সে হিসেবে পরমাণুর এই শূন্যস্থান যদি কোনোভাবে চুপসানো সম্ভব হতো, তাহলে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে একটা চিনির দানার মধ্যে আঁটানো সম্ভব।
অনেকে কথাটাকে উদ্ভট কল্পনা বলে উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু কথাটা শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তবেও সত্য। মহাবিশ্বেই তার উদাহরণ রয়েছে। সেটি হলো নিউট্রন তারা। অতিভারী নক্ষত্রদের বিবর্তনের শেষ পরিণতি এই তারা। এসব নক্ষত্রের বাইরের স্তর সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর তার ভেতরের স্তর প্রচণ্ড মহাকর্যীয় টানে কেন্দ্রের দিকে হুড়মুড় করে চুপসে যেতে থাকে। এর ফলেই নিউট্রন তারার জন্ম হয়। এরকম একটা নিউট্রন তারার আকার হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্ট পবর্তের মতো হতে পারে, কিন্তু তার ভর হতে পারে আমাদের সূর্যের সমান। নিউট্রন তারা থেকে একটা চিনির দানা যদি তুলে আনতে পারেন, তাহলে তার ওজন হবে বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার সমান। অর্থাৎ প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের সমান।
হিলিয়ামে তো হাইড্রোজেনের চেয়ে প্রোটন সংখ্যা একটি বেশি, ইলেকট্রন সংখ্যাও একটি বেশি, তাহলে এরকম হওয়ার কারণ কী?
আগেই বলেছি, মৌলিক পদার্থ ভেদে পরমাণুর আকার বিভিন্ন। কাজেই হালকা মৌলের চেয়ে ক্রমান্বয়ে ভারী মৌলগুলো আকারে বড় হয়। পর্যায় সারণির প্রথম মৌল হাইড্রোজেনে একটি মাত্র প্রোটন এবং একটি মাত্র ইলেকট্রন থাকে। এর পরের মৌলগুলোতে একইসঙ্গে প্রোটন ও ইলেকট্রন সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই পরের মৌলগুলোর আকার ও ভরও বাড়তে থাকে। কিন্তু এখানেই মজার একটা ব্যতিক্রম রয়েছে। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে হাইড্রোজেনের চেয়ে হিলিয়াম পরমাণুর আকার বড় হওয়ার কথা। কিন্তু ঘটনা আসলে উল্টো। মানে হিলিয়ামের চেয়ে হাইড্রোজেনের আকার বড়।
যেমন হাইড্রোজেনের পারমাণবিক ব্যাস প্রায় ৫১×১০-১২ মিটার, অন্যদিকে হিলিয়ামের ব্যাস ৩১×১০-১২ মিটার। প্রশ্ন আসতে পারে, হিলিয়ামে তো হাইড্রোজেনের চেয়ে প্রোটন সংখ্যা একটি বেশি, ইলেকট্রন সংখ্যাও একটি বেশি, তাহলে এরকম হওয়ার কারণ কী? আসলে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন—দুটো পরমাণুতেই ইলেকট্রন একই কক্ষপথে থাকে। ইলেকট্রন বেশি থাকার কারণে হিলিয়ামের কার্যকর নিউক্লিয়ার চার্জ বেড়ে যায়। তাতে হিলিয়ামে নিউক্লিয়াসের আকর্ষণও বেশি থাকে। সে কারণেই হাইড্রোজেনের তুলনায় হিলিয়ামের ইলেকট্রনের কক্ষপথ নিউক্লিয়াসের বেশি কাছে থাকে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: ইনফিনিটি ইন দ্য পাম অব ইউর হ্যান্ড/ মার্কাস চোন ও উইকিপিডিয়া