সাবান কীভাবে তেল-ময়লা দূর করে

সাবান মানুষের জীবন এতটা দখল করে ফেলেছে যে এখন ‘পরিষ্কার’ আর ‘সাবান’ শব্দ দুটি সমার্থক বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। আর তা হবে নাই-বা কেন! প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের প্রথম যে জিনিসটার সঙ্গে দেখা হয়, সেটা হলো সাবান। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, গোসল করা—সবখানেই চলে সাবানের একচ্ছত্র রাজত্ব। তাই টিভি, পত্রিকা, অনলাইন, রাস্তার বিলবোর্ড—সবখানেই মুখ ঢেকে যায় সাবানের চটকদার বিজ্ঞাপনে। কোনো কোনো সাবান নাকি ত্বকের ভাষা বোঝে, কোনোটা দেয় ২৪ ঘণ্টা সুরক্ষা, আবার কোনোটায় আছে লেবুর শক্তি—এরকম নানা বিজ্ঞাপনী স্লোগানে ডুবে আছে চারপাশ।

আসল কথা সেটা নয়। কথা হলো, কোনো কিছু পরিষ্কার করতে আমরা সাবান ব্যবহার করি কেন? ময়লা সাফ করতে সাবান কাজ করে কীভাবে? কেন সাবান দিয়ে হাত থেকে তেল-চর্বি পরিষ্কার করা যায়, কিন্তু শুধু পানি দিয়ে করা যায় না?

সাবানের রাসায়নিক নাম সোডিয়াম স্টিয়ারেট। এটি আসলে একটি বিশেষ ধরনের অণু, সাধারণ পদার্থের মতো নয়। সাবানকে একজন মানুষের মধ্যে থাকা দুটি আলাদা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ দ্বৈত ব্যক্তিত্বের ওই মানুষের মতো সাবানেরও দুটি অংশ রয়েছে, যেগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা। যেমন সাবানের একদিকে রয়েছে এমন এক অংশ, যা পানি প্রচণ্ড ভালোবাসে। একে বলা হয় হাইড্রোফিলিক বা পানিপ্রেমী অংশ (রসায়নের পাঠ্যবইতে অবশ্য লেখা হয় ‘পানি-আকর্ষী’ অংশ)। অন্যদিকে রয়েছে একটা তেলের অংশ। এটি লম্বা লেজের মতো, যা তেল বা চর্বির সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে, কিন্তু পানি এড়িয়ে চলে। একে বলা হয় হাইড্রোফোবিক বা পানিবিদ্বেষী অংশ।

সোডিয়াম স্টিয়ারেট

সাবানের তেলের এই লম্বা লেজটি আসলে কার্বন পরমাণুর বেশ বড় একটি শিকল। এর সঙ্গে জুড়ে থাকে হাইড্রোজেন পরমাণু। একেকটা শিকলে ১০ থেকে ৩০টি কার্বন পরমাণু থাকতে পারে। শিকলটাকে একটা সাপের মতো লম্বা লেজের মতো ভাবা যায়, যার মাথায় রয়েছে একটি বিশেষ অংশ। সেই অংশটাকে সামাজিক বলা যায়। কারণ এরা পানির সঙ্গে মিশতে বা বন্ধুত্ব করতে চায়।

আরও পড়ুন

তেল আর পানি যে মেশে না, সে কথা সবারই জানা। কিন্তু কেন মেশে না? এর পেছনে রয়েছে একটি চমৎকার বৈজ্ঞানিক কারণ। আসলে পানির অণুগুলো একে অপরের সঙ্গে খুব শক্তভাবে আঁকড়ে থাকে। এরা যেন একদল ভালো বন্ধুর মতো, সব সময় একসঙ্গে থাকতে চায়। বিচ্ছেদ পছন্দ করে না। আর হাইড্রোজেন বন্ধনের কারণে তাদের এই বন্ধন শক্তিশালী।

সাবানের জাদুটা আসলে এখানেই। সাবান যখন পানিতে মেশে, তখন এর পানিপ্রেমী মাথাটি ঢুকে যায় পানির মধ্যে, আর তেলপ্রেমী লেজটি থেকে যায় পানির বাইরে। এভাবে পানির উপরিভাগ আর পানির অণু দিয়ে গঠিত থাকে না, বরং সাবানের তেলযুক্ত লেজ দিয়ে ঢেকে যায়।

এদিকে তেলের অণুগুলোও নিজেদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু গোল বাধে দুই ভিন্নধর্মী দলকে একত্রে মেশাতে গেলে। পানি আর তেল একসঙ্গে মেশানোর চেষ্টা করা হলে পানির অণুগুলো তেলের অণুর চেয়ে নিজেদের দিকেই বেশি আকৃষ্ট থাকে। ফলে তেল আলাদা হয়ে যায়। কেউ কারো সঙ্গে মিশতে চায় না। একই কারণে হাতে তেল বা চর্বি লেগে গেলে শুধু পানি দিয়ে ধুলে তা পরিষ্কার হয় না। কারণ পানি তো তেলের সঙ্গে মেশেই না, বরং তেলের চারপাশ দিয়ে সরে সরে যায়।

একই কারণে পানি এবং বাতাসও একসঙ্গে মেশে না। আবার পানি ও বালিকণাও একসঙ্গে মেশে না। কারণ বালির সঙ্গে পানি যতটা আটকাতে পারে, তার চেয়ে বালির অণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে অনেক বেশি আটকে থাকতে পারে।

পানির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যাকে বলে সারফেস টেনশন বা পৃষ্ঠটান। পানির উপরিভাগের অণুগুলোর মধ্যকার আকর্ষণ বলই পৃষ্ঠটান। এ বলের কারণে পানি ফোঁটা ফোঁটা বা গোল হয়ে থাকে। এই সারফেস টেনশনের কারণেই কিছু পোকামাকড় পানির ওপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে যেতে পারে। এই বলের কারণে ওই পোকার জন্য পানির উপরিভাগে যেন একটি অদৃশ্য পর্দা তৈরি হয়।

সারফেস টেনশন বেশি হলে পানি সহজে ছড়িয়ে যেতে পারে না। এটি গোল ফোঁটার মতো থেকে যায়। কিন্তু কোনোভাবে সারফেস টেনশন যদি কমানো যায়, তাহলে পানি ফোঁটায় পরিণত হওয়ার বদলে আরও ভালোভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং যেকোনো জিনিস ভেজাতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, কম পৃষ্ঠটান যুক্ত পানি, স্বাভাবিক পানির চেয়ে বেশি ‘ভেজা’। কারণ এ ধরনের পানি যেকোনো জিনিসকে সহজে ভিজিয়ে ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন

সাবানের জাদুটা আসলে এখানেই। সাবান যখন পানিতে মেশে, তখন এর পানিপ্রেমী মাথাটি ঢুকে যায় পানির মধ্যে, আর তেলপ্রেমী লেজটি থেকে যায় পানির বাইরে। এভাবে পানির উপরিভাগ আর পানির অণু দিয়ে গঠিত থাকে না, বরং সাবানের তেলযুক্ত লেজ দিয়ে ঢেকে যায়। ফলে পানির সারফেস টেনশন অনেক কমে যায়। পানি তখন আরও ‘ভেজা’ হয়ে ওঠে। তখন আপনার হাতের সব খাঁজে, কাপড়ের সব তন্তুর মধ্যে সহজেই পৌঁছাতে পারে পানি।

কিন্তু আরেকটা জাদু ঘটে যখন আপনার হাতে তেল থাকে এবং সেটা সাবান দিয়ে ধুতে থাকেন। এ সময় সাবানের অণুগুলো তেল আর পানির মাঝখানে একটি সেতুর কাজ করে। সাবানের তেলপ্রেমী লেজ তেলের মধ্যে ঢুকে যায়, আর পানিপ্রেমী মাথা পানির মধ্যে থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতেও এই ধরনের দ্বিমুখী অণু পাওয়া যায়। আমাদের শরীরের কোষের দেয়াল তৈরি হয় ফসফোলিপিড নামক একধরনের অণু দিয়ে, যার একদিকে পানিপ্রেমী মাথা আর অন্যদিকে তেলপ্রেমী লেজ রয়েছে।

হাত ঘষতে শুরু করলে তেলের বড় ফোঁটাগুলো ভেঙে ছোট ছোট ফোঁটায় পরিণত হয়। প্রতিটি ছোট ফোঁটার চারপাশে সাবানের অণু একটি সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করে। এই সুরক্ষা বেষ্টনীর কারণে ছোট ফোঁটাগুলো আর একসঙ্গে মিশে বড় ফোঁটা হতে পারে না। এভাবে ঘষতে ঘষতে তেলের ফোঁটাগুলো এত ছোট হয়ে যায় যে সেগুলো আর আপনার হাতে লেগে থাকতে পারে না। সাবানের অণু দিয়ে ঘেরা এই ছোট্ট তেলের কণাগুলো তখন পানির সঙ্গে সহজেই বাইরে চলে যেতে পারে।

সাবান তৈরির পদ্ধতিটাও চমৎকার। এটি তৈরি হয় তেল বা চর্বি থেকে। কিন্তু শুধু তেল দিয়ে তো সাবান হয় না। এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষ পদার্থ, যাকে বলা হয় লাই বা সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড। লাই খুব শক্তিশালী ক্ষার। এটি পানিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এত ভালোবাসে যে পানির সঙ্গে মিশলে প্রচুর তাপ বের হয়। পানি গরম হয়ে যায়।

তেল বা চর্বি আসলে তিনটি ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে গ্লিসারিনের সমন্বয়। লাই তেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করলে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো গ্লিসারিন থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং লাইয়ের সঙ্গে মিশে সাবান সোডিয়াম স্টিয়ারেট তৈরি করে।। আর উপজাত হিসেবে তৈরি হয় গ্লিসারিন। এভাবে তৈরি হওয়া সাবানে লাইয়ের সোডিয়াম অংশ ফ্যাটি অ্যাসিডের লম্বা কার্বন শিকলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। সোডিয়াম পানিপ্রেমী হয়ে ওঠে, আর ফ্যাটি অ্যাসিডের অংশ তেলপ্রেমী থেকে যায়।

আরও পড়ুন

আজকের দিনে সাবান তৈরির পদ্ধতি অনেক উন্নত হয়েছে। শুধু পরিষ্কার করার জন্যই নয়, সাবানে এখন যোগ করা হয় সুগন্ধি, ময়েশ্চারাইজার, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। কিন্তু মূল নীতি একই—তেলপ্রেমী আর পানিপ্রেমী অংশের সমন্বয়। লিকুইড সাবান, বার সাবান, ডিটারজেন্ট—সবগুলোতেই এই একই নীতি কাজ করে। শুধু অণুর গঠনে কিছুটা পার্থক্য থাকে।

মজার ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতেও এই ধরনের দ্বিমুখী অণু পাওয়া যায়। আমাদের শরীরের কোষের দেয়াল তৈরি হয় ফসফোলিপিড নামক একধরনের অণু দিয়ে, যার একদিকে পানিপ্রেমী মাথা আর অন্যদিকে তেলপ্রেমী লেজ রয়েছে। এমনকি ডিমের কুসুমেও রয়েছে লেসিথিন নামক একটি প্রাকৃতিক সাবানের মতো পদার্থ। এই কারণেই ডিম দিয়ে মেয়োনিজ তৈরি করা যায়—তেল আর ভিনেগার মিশিয়ে।

আধুনিক যুগে আমরা সাবানের পরিবেশগত প্রভাব নিয়েও সচেতন হয়ে উঠেছি। ঐতিহ্যবাহী সাবান প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি হওয়ার কারণে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কিছু আধুনিক ডিটারজেন্টে এমন রাসায়নিক থাকে, যা পানিতে মিশে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি করতে পারে। এ কারণে এখন বায়োডিগ্রেডেবল সাবান তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রকৃতিতে সহজেই ভেঙে যায় এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।

সাবান তৈরির পদ্ধতিটাও চমৎকার। এটি তৈরি হয় তেল বা চর্বি থেকে। কিন্তু শুধু তেল দিয়ে তো সাবান হয় না। এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষ পদার্থ, যাকে বলা হয় লাই বা সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড। লাই খুব শক্তিশালী ক্ষার।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সাবানের জগতেও আসছে নতুন নতুন উদ্ভাবন। এখন এমন সাবান তৈরি হচ্ছে যা শুধু পরিষ্কার করে না, বরং ত্বকের যত্নও নেয়। কিছু সাবানে যোগ করা হচ্ছে প্রোবায়োটিকস, যা ত্বকের উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে এমন সাবানও তৈরি হচ্ছে, যা অতি সূক্ষ্মভাবে ময়লা পরিষ্কার করতে পারে। এমনকি গবেষণা চলছে এমন সাবান নিয়ে, যা বিভিন্ন রোগের জীবাণু চিহ্নিত করে সেগুলোকে নির্দিষ্টভাবে ধ্বংস করতে পারবে।

ছোট্ট সাবানের টুকরো আসলে মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এটি শুধু আমাদের পরিচ্ছন্ন রাখে না, বরং অসংখ্য রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা আরও ভালোভাবে বুঝেছি সাবানের গুরুত্ব। পরের বার যখন আপনি সাবান দিয়ে হাত ধুবেন, তখন মনে রাখবেন—এই সহজ কাজটির পেছনে রয়েছে লাখো বছরের বিবর্তন, হাজার বছরের মানুষের অভিজ্ঞতা আর আধুনিক বিজ্ঞানের গভীর জ্ঞান। প্রতিটি সাবানের অণু তার দ্বৈত আচরণ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য।

সূত্র: হোয়াই ইজ মিল্ক হোয়াইট?/ অ্যালেক্সা কোলহো এবং সাইমন কুইলেন ফিল্ড

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন