ড্যাফোডিল অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টারের উদ্যোগে মহাকাশের গভীরে অভিযান

স্টুডেন্ট লাউঞ্জ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। দুপুর ১২টা। ২৯ মে, বৃহস্পতিবার।

সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। বাইরে তাকালেই সবুজের গভীরতা দেখে মন ভালো হয়ে যায়। প্রচণ্ড বাতাস সব উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। এর মধ্যেই ঢুকে পড়লাম লাউঞ্জে।

লাউঞ্জের একপাশে বেগুনি রঙের গোলাকার তাঁবু। এয়ারব্যাগের মতো, বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁবুর পাশে একটা চেয়ার-টেবিলে টিকেট কাউন্টার-কাম-বুথ। পেছনে, দেয়ালে বসানো বড় স্ক্রিনে চলছে মহাকাশবিষয়ক একটা ডকুমেন্টারি। শিক্ষার্থীরা সেই ডকুমেন্টারি দেখছেন, বুথে এসে টিকেট নিচ্ছেন। টিকেটের দাম ১০০ টাকা। কিন্তু তাঁবুর ভেতরে কী ঘটছে?

সেটা দেখার সুযোগ মিলল একটু পরেই। একদল বেরিয়ে এলেন। পরের দলের সঙ্গে আমরা ঢুকে পড়লাম। আমরা মানে আমি (লেখক), সঙ্গে আছেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার, সহসম্পাদক কাজী আকাশ এবং কিশোর আলোর সহযোগী সম্পাদক আদনান মুকিত। ভেতরে প্রায় ৪০ জনের বসার ব্যবস্থা। দেখতে দেখতে পুরোটা ভরে গেল। ব্যবস্থাপক সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেউ ফোনে ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফি করবেন না। কেউ বেরোতে চাইলে হাত তুলবেন, আমি ব্যবস্থা করে দেব। এখন শো শুরু হবে।’

আরও পড়ুন
বৃষ্টির দিন, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিভাগ ছুটিও হয়ে গেছে আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে। তবু এত মানুষ! যাহোক, অ্যাকাডেমিক কোর্সের কথা শুনে ভাবলাম, বিষয়টা জানি।

শুরু হলো। মাথার ওপরে কৃত্রিম আকাশ। সেখানে তারার মেলা বসেছে। সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ, গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে মহাকাশের গহীনে অভিযানে চললাম আমরা। আসলে ডকুমেন্টারি দেখানো হচ্ছে। এর কোনোটি নাসার বানানো, বেশির ভাগই ইংরেজিতে, তবে একটি বাংলা তথ্যচিত্রের দেখাও মিলল। আকাশে তারার দল ছুটে বেড়াচ্ছে, কখনো নাসার মহাকাশযানে করে ছুটে বেড়াচ্ছি মঙ্গলে; আবার এক পর্যায়ে সাবমেরিনে করে পানির নিচেও ঢুঁ দেওয়া হলো। সে আরেক রোমাঞ্চকর যাত্রা। সব মিলে প্রায় ৩০ মিনিটের শো শেষ করে আমরা বেরিয়ে এলাম।

অভিনব এ আয়োজনের পেছনে আছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টার। এটা আসলে একটা ভ্রাম্যমাণ প্ল্যানেটারিয়াম। ক্রিয়েটিভ উইংস নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই সেবা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টারের উদ্যোগে তাদের আজকের এই আয়োজন। পরিকল্পনা অনুসারে ৩টি শো হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দর্শকের চাহিদা পূরণের জন্য ৪টি শো করতে হলো। এক পর্যায়ে টিকেট কাউন্টার বন্ধই করে দিতে হলো, তাঁবুর ভেতরে জায়গা এবং আরও শো করার সময়ের অভাবে। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে।

বৃষ্টির থামার নাম নেই। এর মধ্যেই আমরা সেখান থেকে চললাম অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টারের পরিচালক আরিফ আহমেদের অফিসে। এই উদ্যোগের পেছনের গল্পটা শোনার ইচ্ছা। এই সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত আছেন রম্য লেখক ও উন্মাদ সম্পাদক সম্পাদক কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। যুক্ত আছেন বিজ্ঞান বক্তা আসিফসহ আরও অনেকে। অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টার চালুর পর ইতিমধ্যে এক বছর হয়ে গেছে। এতদিনে তাঁরা নিজেদের পরিকল্পনায় কতদূর এগোলেন, জানতে চাই তাও।

আরও পড়ুন
আমাদের এখানে টেলিস্কোপ আছে, সন্ধ্যার পর অনেকে এসে আকাশ দেখেন। কিন্তু সবাই তো সে সময় আসতে পারেন না। তা ছাড়া টেলিস্কোপ সেটআপ করা, গ্রহগুলোকে ট্র্যাক করার কাজটাও সময়সাপেক্ষ।

প্রথমে আহসান হাবীবের মুখে শুনলাম এই ভ্রাম্যমাণ প্ল্যানেটারিয়াম শোর বিস্তারিত। তিনি বললেন, ‘আমরা একটা স্থায়ী প্ল্যানেটারিয়াম করার কথা ভেবেছি। শিক্ষার্থীদের অনেকেই মহাকাশবিজ্ঞানে আগ্রহী, কিন্তু তাদের এই আগ্রহ ওভাবেই থেকে যায়। তাদের আরও কৌতূহলী করে তোলার পাশাপাশি একটা অ্যাকাডেমিক কোর্সও চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কোর্সের কারিকুলামটি তৈরি করছেন বিজ্ঞানবক্তা আসিফ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কৌতূহল মেটানোর পাশাপাশি সেটা আরও উসকে দেওয়া যায় কীভাবে? এই চিন্তা থেকেই প্ল্যানেটারিয়ামের কথা ভাবা। আমাদের এখানে টেলিস্কোপ আছে, সন্ধ্যার পর অনেকে এসে আকাশ দেখেন। কিন্তু সবাই তো সে সময় আসতে পারেন না। তা ছাড়া টেলিস্কোপ সেটআপ করা, গ্রহগুলোকে ট্র্যাক করার কাজটাও সময়সাপেক্ষ। সব মিলে প্ল্যানেটারিয়াম ভালো সমাধান হতে পারে। কিন্তু এতে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। তার আগে জানা প্রয়োজন, প্ল্যানেটারিয়াম করলে শিক্ষার্থীরা কতটা আগ্রহী হয়ে দেখবে। সেটা বুঝতেই এই পরীক্ষামূলক আয়োজন। শিক্ষার্থীদের যে আগ্রহ আমরা দেখলাম, তাতে শিগগিরই স্থায়ী প্ল্যানেটারিয়াম করার উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ বলেই মনে হচ্ছে।’

আগ্রহ আসলেই দেখার মতো। বৃষ্টির দিন, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিভাগ ছুটিও হয়ে গেছে আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে। তবু এত মানুষ! যাহোক, অ্যাকাডেমিক কোর্সের কথা শুনে ভাবলাম, বিষয়টা জানি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন বিজ্ঞানবক্তা আসিফ। বললেন, ‘বিজ্ঞানের ইতিহাসটা সবারই জানা উচিৎ। পাশাপাশি মহাকাশবিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সুযোগ চায় অনেকেই। কিন্তু সেই সুযোগ বাংলাদেশে অনার্স পর্যায়ে তেমন নেই। এসব মাথায় রেখেই আমরা কোর্সটা ডিজাইন করছি। সব এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তাই বিস্তারিত বলছি না। তবে আশা করছি, কোর্সটা শিক্ষার্থীদের কৌতূহল মেটাতে পারবে। উচ্চতর পড়াশোনার একটা ভালো প্রস্তুতি হবে এর মধ্য দিয়ে।’

একটু পেছনে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন এই পর্যায়ে। ড্যাফোডিলের অ্যাস্ট্রোফিজিকস সেন্টার আসলে কেন চালু হয়েছিল, সেই কথাটাও একটু বলা প্রয়োজন। পরিচালক আরিফ আহমেদের কাছে ২০২৪ সালে এপ্রিলে শুনেছিলাম এই সেন্টার চালুর পেছনের কাহিনি। বিজ্ঞানচিন্তাকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে খুব আগ্রহী। এটা যাচাই করতে আমরা একটা জরিপ চালিয়েছিলাম আনুষ্ঠানিকভাবে। জানতে চেয়েছিলাম, মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স করার সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়বেন কি না। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সেখানে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম একটা বিভাগ থাকলে কিন্তু অনেকে পড়ত। তবে সেটা তো চট করে করা যাবে না। তাই আমরা শুরুটা করেছি আউটরিচ থেকে।’

আরও পড়ুন
আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২৫ সালের মে মাসে জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত ডাইচেস জাদুঘরে শুরু হয় প্রথম আধুনিক প্ল্যানেটারিয়ামের যাত্রা। সেই উপলক্ষ্য উদ্‌যাপনের পাশাপাশি নিজেদের স্থায়ী একটি প্ল্যানেটারিয়াম করার চিন্তা থেকেই আমরা এ আয়োজন করেছি।

সেই ধারায়ই অ্যাকাডেমিক কোর্সের এই পরিকল্পনা। পাশাপাশি সেন্টারে একটি ১০ ইঞ্চি অ্যাপারচার টেলিস্কোপ বসানো হয়েছে। টেলিস্কোপটি আনা হয়েছে ভারতের দিল্লি থেকে। এর সাহায্যে শিক্ষার্থীরা রাতের আকাশে নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ এবং গ্যালাক্সি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত হওয়ায় সেখান আলোক দূষণ খুব কম। সব মিলে এটি শিক্ষার্থী ও আকাশ পর্যবেক্ষণে আগ্রহীদের জন্য দারুণ এক সুযোগ হয়ে এসেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্ল্যানেটারিয়াম নির্মাণের এই পরিকল্পনা।

এ নিয়ে আরিফ আহমেদ বললেন, ‘আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২৫ সালের মে মাসে জার্মানির মিউনিখে অবস্থিত ডাইচেস জাদুঘরে শুরু হয় প্রথম আধুনিক প্ল্যানেটারিয়ামের যাত্রা। সেই উপলক্ষ্য উদ্‌যাপনের পাশাপাশি নিজেদের স্থায়ী একটি প্ল্যানেটারিয়াম করার চিন্তা থেকেই আমরা এ আয়োজন করেছি। শিক্ষার্থীদের যে ইতিবাচক সাড়া আমরা পেলাম, তা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক এবং আশাজনক।’

কিন্তু ক্রিয়েটিভ উইংস কী মনে করে এরকম একটি উদ্যোগ নিল? কেন বানাল ভ্রাম্যমাণ প্ল্যানেটারিয়াম? ক্রিয়েটিভ উইংসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আসলাম শিকদার জানালেন, স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছে এই প্ল্যানেটারিয়াম নিয়ে যেতে চান তাঁরা। বললেন, ‘স্কুলের শিক্ষার্থীদের শৈশবেই এদিকে আগ্রহী করে তুলতে চাই আমরা। মহাবিশ্বের বিস্ময়কর জগৎটা দেখে যেকোনো মানুষ মুগ্ধ হন, কৌতূহলী হন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৈশবে এই কৌতূহল উসকে দেওয়া গেলে তারা প্রশ্ন করতে চাইবে, আরও জানতে চাইবে। এভাবেই হয়তো বিজ্ঞানে আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে তারা। পাঠ্যবইয়ের বাইরে, নানা ধরনের বিনোদনের মাঝে এই বিজ্ঞানময় বিনোদন, বিজ্ঞানের আনন্দটা যদি তারা বুঝতে পারে, তাহলে হয়তো নিজের আগ্রহেই ওরা এসব নিয়ে আরও জানতে চাইবে।’ পাশাপাশি তিনি জানালেন, এই চিন্তাধারাটা শুধু ব্যবসায়িক নয়। ‘আমরা যে ফি-টা নিই, সেটা শুধু শো পরিচালনার খরচটা ওঠাতে, বাড়তি লাভের জন্য নয়। ফি দেখেই তো বুঝেছেন। আমরা বেশ কিছু স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ইতিমধ্যে আমরা ইংরেজি মিডিয়াম কিছু স্কুলে শো করেছি এবং ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। আমরা চাই, আরও বেশি স্কুল আমাদের এই সুযোগটা দিক। এটা শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো হবে বলেই আমাদের ধারণা।’

আরও নানারকম গল্পে-আলাপে সময়টা ভালোই কেটে গেল। প্রকৃতির আর মন ভালো হলো না। কিন্তু আমাদের মন বেশ ভালো। এরকম উদ্যোগগুলো অনেক বড় কিছু হয়তো না, তবে আমাদের জন্য, বিজ্ঞানে আগ্রহীদের জন্য, শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দের। অনুপ্রেরণার।

আরও পড়ুন