ডেঙ্গুর প্রকোপ কেন কমে-বাড়ে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ২১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ১ হাজার ৪৪৭ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। আর ২০২১ সালের তুলনায়, প্রায় সাড়ে ১৪ গুণ। এ বছর এ পর্যন্ত ১৩ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এত বেশি মানুষ কেন আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে?

ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে টার্গেট কোষ হলো আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ ও ডেনড্রাইটিক কোষ

সাধারণ সর্দি-কাশির প্রকোপ বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেড়ে যায়। প্রতিবছর আরও কিছু অসুখে এমনটি হতে দেখা যায়। তাহলে ডেঙ্গু (ডেঙ্গি) কেন কোনো বছর একেবারে কম আর কোনো কোনো বছরে খুবই মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে?

ডেঙ্গু ভাইরাসের একেকটি কণা বা ভিরিয়নও অন্য সব ভাইরাসের মতো প্রোটিন ক্যাপসিডের মোড়কে একটুখানি জেনেটিক বস্তু (এ ক্ষেত্রে আরএনএ)। সেই ক্যাপসিড ঘিরে অবশ্য লিপিড বা চর্বিনির্মিত একটা এনভেলপও থাকে। ভাইরাসের আবরণীর ফাঁকে ফাঁকে থাকে ই এবং এম প্রোটিন। অভিব্যক্তির ধারায় এসব প্রোটিন গঠনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অথচ গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসের আদি প্রকরণ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত চারটি প্রকরণ DENV1, DENV2, DENV3 ও DENV4-এর উদ্ভব ঘটেছে। অভিব্যক্তি থেমে নেই। সম্প্রতি ডেঙ্গুর পঞ্চম সেরোটাইপ DENV5 আবিষ্কৃত হয়েছে, যেটি সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য খুবই অপর্যাপ্ত।

যেকোনো ভাইরাস চাইলে যেকোনো কোষে ঢুকে পড়তে পারে না। ভাইরাসের এনভেলপ (কিংবা তা না থাকলে ক্যাপসিড) এমন কিছু প্রোটিন ধারণ করে, যা এক ধরনের চাবি হিসেবে কাজ করে। আর কোষের ঝিল্লির বাইরের দিকেও থাকে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন, যেগুলো কাজ করে তালা হিসেবে। যে চাবির সঙ্গে যে তালা খাপ খায়, সে চাবি দিয়ে তো সে তালাই খুলবে, অন্য তালা নয়। কোনো ভাইরাসের বাইরের স্তরের প্রোটিন যে কোষের বাইরের দিককার প্রোটিনের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে বন্ধন তৈরি করতে পারে, সে কোষ হলো সেই ভাইরাসের টার্গেট। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে টার্গেট কোষ হলো আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ ও ডেনড্রাইটিক কোষ।

ডেঙ্গু হলেই যে সবাই সব সময় মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, এমন নয়। এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসের প্রতিটি প্রকরণের বিরুদ্ধে আমাদের দেহ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়িত সমাধান দেয় অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা। প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে কনড্রিকথিস শ্রেণিভুক্ত (হাঙর প্রভৃতি চোয়ালবিশিষ্ট তরুণাস্থিময় মাছ) জীবে প্রথম উদ্ভূত এ ব্যবস্থা কিন্তু আগে থেকে থাকা সহজাত সুরক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। যেমন ডেনড্রাইটিক কোষ যখন কোনো কিছু খেয়ে হজম করে, সে জিনিসের ছোট ছোট টুকরা (antigen) তার নিজের কোষঝিল্লির বাইরের দিকে লাগিয়ে রেখে এক রকমের প্রদর্শনী করতে থাকে। একে বলে অ্যান্টিজেন উপস্থাপন (antigen presentation)। অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোষ, যেমন লিম্ফোসাইট সেই উপস্থাপিত টুকরার সঙ্গে নিজের কোষঝিল্লির বিশেষ প্রোটিনের সংযোগ স্থাপন করতে পারলে উদ্দীপ্ত হয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেই টুকরার আসল বাহকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে পারে। আমাদের দেহের অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা এ রকম প্রায় ১ থেকে ১০ কোটি (107-108) প্রকারের ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিজেন আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে এবং সেগুলোর প্রতিটির বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রতিটি প্রকার অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে তত প্রকার প্রোটিন দরকার। আর প্রত্যেক প্রকার প্রোটিন তৈরির সংকেত দেওয়ার জন্য কমপক্ষে একটি করে জিন দরকার। কিন্তু মানুষের জিনের সংখ্যা তো সাকল্যে ২০ হাজারের মতো।

আরও পড়ুন
ডেঙ্গু মশা

এ সমস্যার সমাধান বের করে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পান জাপানের সুসুমু তোনেগাওয়া। তিনি দেখান, গুটিকয় জিন নিজেদের মধ্যে বিন্যাস-সমাবেশ ঘটিয়ে লক্ষ-কোটি ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরির সংকেত দিতে পারে। অর্জিত সুরক্ষার অন্যতম কোষ লিম্ফোসাইটগুলো যখন কেবল জন্মায়, তখন সেগুলোর মধ্যে উল্লিখিত জিনগুলোর ওলটপালট ঘটে অনেকটা র‌্যানডমভাবে। তাই কোনো একটি বিশেষ অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর মতো প্রোটিন তৈরি হয় মাত্র গুটিকয় (10-1000) লিম্ফোসাইটের মধ্যে। বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইটের ক্ষেত্রে সেই প্রোটিনকে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) বলে। এ রকম হতে পারে যে হয়তো সেই অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে জীবনে কখনো আসা হলো না কিংবা প্রকৃতিতে হয়তো সেই অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মতো অ্যান্টিজেন নেই। কিন্তু যদি এমন কোনো অ্যান্টিজেন দেহে ঢোকে, যেটা লিম্ফোসাইটের সিলেবাসে ‘কমন’ পড়েছে, অর্থাৎ লক্ষাধিক প্রকারের অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের মধ্যে কোনো একটির সঙ্গে তা সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেই বিশেষ প্রোটিন ধারণকারী গুটিকয় লিম্ফোসাইট শাঁই শাঁই করে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে এবং ওই অ্যান্টিজেন ও তার বাহককে আক্রমণ করতে থাকে।

প্রাথমিকভাবে কোনো একটা অ্যান্টিজেনকে প্রতিহত করা সম্ভব হলে পরে দেখা যায়, শরীরে সেই অ্যান্টিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে, এমন বেশ কিছু লিম্ফোসাইট রয়ে গেছে, যেগুলো একই অ্যান্টিজেন দিয়ে পরবর্তী সময়ে শরীর আবারও আক্রান্ত হলে বেশ দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে পারে। সেগুলোকে বলে মেমোরি সেল। প্রথমবারে লিম্ফোসাইটগুলো উদ্দীপ্ত হতে ও সংখ্যা বৃদ্ধি করতে যতটা সময় নিয়েছে, দ্বিতীয়বারে তার অর্ধেকের কম সময়ের মধ্যে আরও তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে এই পূর্বপ্রস্তুতির কারণে। এ জন্য প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্ষেত্রে তার যেকোনো সেরোটাইপের জন্য নির্ধারিত আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডিসমূহ (উপযুক্ত বি-লিম্ফোসাইট কর্তৃক নিঃসৃত) পরীক্ষায় ধরা পড়তে জ্বরের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পাঁচ-ছয় দিন লাগে। তবে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের বেলায় তা একেবারে প্রথম বা দ্বিতীয় দিন থেকে পজিটিভ আসতে পারে, বিশেষ করে আইজিজি।

দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কেউ যদি প্রথমবারের মতো একই সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হন, তাহলে খুবই ভালো, কেননা দ্বিতীয়বারে তাঁর খুব একটা ভুগতে হবে না। আগে থেকে জমে থাকা মেমোরি সেলগুলো প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করে খুব সহজে ডেঙ্গুকে কাবু করে ফেলবে। যেমন কেউ প্রথমবার DENV2 দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং পরেরবারও DENV2 দিয়ে আক্রান্ত হলেন। প্রথমবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয়বার তিনি হয়তো অসুখটা বুঝতেও পারলেন না। কিন্তু যদি প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বারের সেরোটাইপ হয় ভিন্ন এবং দুটি সংক্রমণের মধ্যে তফাত হয় তিন মাসের বেশি, তাহলে বিপদ আছে। সে ক্ষেত্রে মেমোরি সেলগুলো প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করে ঠিকই, তবে সেটা ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে পর্যাপ্ত বন্ধন তৈরি করতে পারে না। কোনো একটা অ্যান্টিবডি তার নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের যে অংশে দৃঢ়ভাবে আটকে যেতে পারে, সেই অংশকে বলে এপিটোপ। দেখা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের ই প্রোটিনের অন্তত ৩০টি এপিটোপে অ্যান্টিবডি আটকে যেতে পারে। তখনই কেবল ভাইরাসটি নতুন করে আর কোনো কোষে সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। কিন্তু একটি সেরোটাইপের জন্য নির্ধারিত অ্যান্টিবডি অন্য একটি সেরোটাইপের ই প্রোটিনের এত এপিটোপ দখল করতে পারে না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এতে হিতে বিপরীত হয়। কারণ, অ্যান্টিবডির যে দিকটি এপিটোপে লেগে থাকে, তার বিপরীত দিকটি এ ক্ষেত্রে মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ ও ডেনড্রাইটিক কোষে ঢোকার চাবি হিসেবে কাজ করে। ঠিকই ধরেছেন, এগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসের টার্গেট কোষ। কোনো অ্যান্টিবডি ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে গিয়ে না লাগলে এমনিতে যতগুলো ভাইরাস কোষে ঢুকতে পারত, ভিন্ন সেরোটাইপের অ্যান্টিবডির এমন অপর্যাপ্ত বন্ধনের দরুন তার চেয়ে অনেক বেশি ভাইরাস এখন কোষে ঢুকে পড়ে। একে বলে অ্যান্টিবডি ডিপেনডেন্ট এনহান্সমেন্ট বা সংক্ষেপে এডিই, যা ডেঙ্গু ছাড়াও জিকা, ইয়েলো ফিভার, এইচআইভি, এমনকি কোভিডের জীবাণু যে ভাইরাস, তার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তা ছাড়া পরিবর্তিত সেরোটাইপের জন্য নতুন করে সুনির্দিষ্ট ও সঠিক প্রকারের লিম্ফোসাইট আর উদ্দীপ্ত হয় না। কেননা, অধিক পরিমাণে মেমোরি সেল থাকায় সুরক্ষাব্যবস্থা ‘অপচয়’ রোধ করার জন্য তা হতে দেয় না; অর্থাৎ দেহ বোকা বনে যায়। সে ভাবে যে সুরক্ষাব্যবস্থা খুব ভালো সুরক্ষা দিচ্ছে অথচ বাস্তবে ঘটনা ঠিক উল্টো। কোষের ভেতরে ও বাইরে ডেঙ্গু ভাইরাস গিজগিজ করছে। সেগুলোকে প্রতিহত করার জন্য সুরক্ষাব্যবস্থার কোষগুলো থেকে সাইটোকাইন নামক একশ্রেণির রাসায়নিক নিঃসৃত হচ্ছে ক্রমাগত। তাতে ভাইরাসের খুব একটা কিছু হচ্ছে না, তবে সেগুলোর প্রভাবে রোগী তাঁর রক্তনালি থেকে পানি হারাচ্ছেন, প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং কখনো কখনো প্রাণ হারাচ্ছেন।

প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কেন মারাত্মক পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, তা ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে নিশ্চয়ই। গত কয়েক বছরে প্রায় সবাই (বিশেষ করে ঢাকায়) অন্তত একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকেরই তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তাই এবারের সংক্রমণ বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ বা ৩ নম্বর সংক্রমণ। এটিও ডেঙ্গুর এবারকার মাত্রাতিরিক্ত তীব্রতার একটা কারণ হতে পারে। তবে এমনও তো হয় যে কারও প্রথমবার সংক্রমণেই রক্তক্ষরণ (ডেঙ্গি হেমোরেজিক ফিভার) শুরু হলো কিংবা রক্তনালি থেকে পানি হারিয়ে শকে (ডেঙ্গি শক সিনড্রোম) চলে গেলেন। কেউ আবার দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পরও দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এ রকম পার্থক্যের কারণগুলো এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে জিনগত পার্থক্য এর জন্য দায়ী হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হচ্ছে। তা ছাড়া সেরোটাইপ–ভেদে রোগের লক্ষণের তীব্রতার পার্থক্য দেখা যায়। সেরোটাইপ পরীক্ষার জন্য আরএনএ-ভিত্তিক পিসিআর করতে হয়, যা বাংলাদেশের দু–চারটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও হয় না।

আগের সংক্রমণে উৎপাদিত অ্যান্টিবডি, বিশেষ করে আইজিজি যদি যথেষ্ট পরিমাণে রক্তে রয়ে যায়, তাহলে ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে মারাত্মক লক্ষণবিশিষ্ট ডেঙ্গুতে ভোগার আশঙ্কা অনেকখানি বেড়ে যায়। এই অ্যান্টিবডি কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর, এমনকি ৭০ বছর পর্যন্ত রয়ে যেতে পারে বলে প্রমাণ রয়েছে। অভিব্যক্তির নিয়মে গড়ে পাঁচ বছর পরপর কোনো ভৌগোলিক সীমারেখায় ডেঙ্গুর প্রাধান্য বিস্তারকারী সেরোটাইপ পাল্টে যেতে দেখা গেছে। কোনো সেরোটাইপ যখন পপুলেশনে প্রাধান্য পায়, তখন খুব দ্রুত প্রায় সবার শরীরে তার সংক্রমণ ঘটে যায় এবং অনেকে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টি অ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু করে। তখন ভিন্ন কোনো সেরোটাইপ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সুবিধা পায়, যেহেতু প্রাধান্য বিস্তারকারী সেরোটাইপ আর সহজে ছড়াতে পারছে না। এভাবে সময়ের সঙ্গে সেরোটাইপের প্রাধান্য পরিবর্তন হয়। যেমন ঢাকায় ২০১৭ সালে DENV2 ছিল প্রায় ৯১ শতাংশ আর ২০২১-এ DENV3 প্রায় ১০০ শতাংশ। এতে ডেঙ্গুর মারাত্মক উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কয়েক বছর পরপর বেড়ে যায়। আবার এই পরিবর্তনের মধ্যবর্তী সময়ে যখন সেরোটাইপের প্রাধান্য এতটা পাল্টায়নি, সেসব বছরে ডেঙ্গু খুব একটা মারাত্মক থাকে না। তবে গত দুই দশকের সার্বিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই কমা-বাড়ার মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ গড়ে বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মশা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব এর অন্যতম কারণ।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
ব্যাকটেরিয়ার জন্য যেমন আছে বহু অ্যান্টিবায়োটিক, তেমনি ভাইরাসের অসুখের সুনির্দিষ্ট ওষুধ খুব কমই আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে একমাত্র ভরসা

যেসব জীবাণুর ক্ষেত্রে এডিই হয় না, সেগুলোয় এক সেরোটাইপ বা প্রকরণের বিরুদ্ধে উৎপাদিত অ্যান্টিবডি তার অন্যান্য প্রকরণের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেয়। কিন্তু ডেঙ্গুসহ যাঁদের এডিই হয়, সেসব জীবাণুর বেলায় এক প্রকরণের সুরক্ষা অন্য প্রকরণের বেলায় উল্টো অসুখ বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য এসব জীবাণুর বেলায় কয়েক বছর পরপর প্রকোপের এমন ওঠানামা লক্ষ করা যায়। নতুবা প্রতিবছর তা প্রায় একই রকম থাকত। সৌভাগ্যের বিষয়, এইচআইভি কিংবা কোভিড ভাইরাসের বেলায় এডিই হলেও তা ডেঙ্গুর মতো এত তীব্র নয়।

ব্যাকটেরিয়ার জন্য যেমন আছে বহু অ্যান্টিবায়োটিক, তেমনি ভাইরাসের অসুখের সুনির্দিষ্ট ওষুধ খুব কমই আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে একমাত্র ভরসা। টিকা সাধারণত কাজ করে সুরক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে, যাতে ওই বিশেষ জীবাণুর সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি তৈরি হয় কিংবা টিকা হিসেবে অনেক সময় সরাসরি সেই অ্যান্টিবডি অণুগুলো শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ডেঙ্গুর টিকা তৈরির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সব সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি যদি একই সঙ্গে কার্যকর করা না যায়, তাহলে এডিইর কারণে রোগী রোগপ্রতিরোধের বদলে উল্টো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এ জন্য ডেঙ্গাভেক্সিয়া নামে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এফডিএ অনুমোদিত একটি টিকা বাজারে আছে, যেটি একই সঙ্গে চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। এটি ৯-১৬ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাদের ইতিপূর্বে একবার ডেঙ্গু হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এই টিকা মাত্র ২০টি দেশে পাওয়া যায়, যে তালিকায় বাংলাদেশ নেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র:

১. বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি 2021; 15 (2): 23-29,

২. ডেঙ্গুর গাণিতিক মডেল, মেডআর্কাইভ (DOI: 10.1101/2020.09.21.20199190v1),

৩. সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র,

৪. রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা, বাংলাদেশ,

৫. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা