রিখটার স্কেলে যেভাবে ভূমিকম্পের মাত্রা ও ক্ষতির পরিমাণ মাপা হয়

ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে পরিমাপ করা হয়রয়টার্স ফাইল ছবি

নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৭। ভূমিকম্প হলেই কিছুক্ষণের মধ্যে এমন খবর চারপাশে শোনা যায়। এই রিখটার স্কেল আসলে কী? কীভাবে কাজ করে এটি? ভূকম্পন মাপার অন্য কোনো স্কেল কি নেই?

কয়েক দশক ধরে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপে রিখটার স্কেল গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভূমিকম্পের শক্তি এবং এর ধ্বংসাত্মক মাত্রা বুঝতে এই স্কেলটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৩৫ সালে চার্লস এফ. রিখটার এবং বেনো গুতেনবার্গ স্কেলটি তৈরি করেন। সেই থেকে এটি ভূকম্পনবিদ্যায় মূল ভিত্তি। এই স্কেলের সাহায্যেই বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ ভূমিকম্পের শক্তি বুঝতে পারেন।

যেভাবে এল রিখটার স্কেল

মার্কিন ভূমিকম্পবিজ্ঞানী চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার এবং তাঁর সহকর্মী জার্মান ভূমিকম্পবিজ্ঞানী বেনো গুতেনবার্গ রিখটার স্কেল বানান। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ভূমিকম্পে নির্গত শক্তিকে পরিমাপ করার একটি উপায় বের করা। যেকোনো শক্তিরই নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। ভূমিকম্পে যে শক্তি কাজ করে, তার মাত্রা পরিমাপের আদর্শ কোনো স্কেল বা পরিমাপক ছিল না। ১৯৩৫ সালে এই দুই বিজ্ঞানী সেই অভাব পূরণে সফল হন। এরপর বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস রিখটারের নামে স্কেলটির নামকরণ হয়।

রিখটার স্কেল একটি লগারিদম-ভিত্তিক স্কেল। অর্থাৎ, স্কেলটি গণিতের লগারিদম মেনে কাজ করে। সহজ কথায়, প্রতি এক মাত্রা বাড়লে কম্পন বা ঝাঁকুনি ১০ গুণ বেড়ে যায়। এই স্কেল ভূমিকম্পে সৃষ্ট তরঙ্গের উচ্চতা বা প্রশস্ততা পরিমাপ করতে পারে। এমন পরিমাণগত পরিমাপ দিয়ে ভূমিকম্পের মাত্রা বা আকার নির্ধারণ করা সহজ হয়।

আরও পড়ুন
১৯৩৫ সালে চার্লস এফ. রিখটার এবং বেনো গুতেনবার্গ স্কেলটি তৈরি করেন। সেই থেকে এটি ভূকম্পনবিদ্যায় মূল ভিত্তি।

এই যন্ত্র থেকে পাওয়া মাত্রা দেখা যায় লেখচিত্রে। একে বলা হয় সিসমোগ্রাফ। রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় তরঙ্গের বিস্তার পরিমাপে লগারিদম ব্যবহৃত হয়। ৩-৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে বলে মধ্যম মানের ভূমিকম্প। এই মাপের ভূমিকম্প মাপার জন্যই রিখটার স্কেল তৈরি করা হয়েছিল। শুরুতে শুধু দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় হওয়া ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হতো এই যন্ত্রের সাহায্যে।

সিসমোগ্রাফ
ছবি: ম্যাট্রিক্স

স্কেলটি সাধারণত মাত্রা ১-১০ পর্যন্ত হিসেব করতে পারে। তবে তাত্ত্বিকভাবে এর কোনো উচ্চসীমা নেই। বাস্তবে ৮.৬ মাত্রার ওপরে কোনো ভূমিকম্প রিখটারে রেকর্ড করা হয়নি। যেমন, ১৯৬০ সালে চিলিতে হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা এই স্কেলে ছিল ৮.৬। পরে বিজ্ঞানীরা দেখলেন এই পরিমাপ ঠিক নয়।

বিশাল ভূমিকম্পগুলোর প্রকৃত শক্তি পরিমাপ করতে পারে না রিখটার স্কেল। তাঁরা চিলির ভূকম্পনের মাত্রা পরিমাপ করলেন মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেলে। এবার মাত্রা পাওয়া গেল ৯.৫।

বর্তমানে আধুনিক মোমেন্ট মাত্রা পদ্ধতির সঙ্গে রিখটার স্কেলে পাওয়া মাত্রার তুলনা করে ফল নিরূপণ করা হয়। ৩-৭ মাত্রার মধ্যম কম্পনে এই দুই পদ্ধতিতে প্রায় একই ফল পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন
স্কেলটি সাধারণত মাত্রা ১-১০ পর্যন্ত হিসেব করতে পারে। তবে তাত্ত্বিকভাবে এর কোনো উচ্চসীমা নেই। বাস্তবে ৮.৬ মাত্রার ওপরে কোনো ভূমিকম্প রিখটারে রেকর্ড করা হয়নি।

যেভাবে কাজ করে লগারিদম

লগারিদম হলো গণিতের বিশেষ পদ্ধতি। এর সাহায্যে বোঝা যায়, একটি ছোট সংখ্যাকে কতবার গুণ করলে একটা বড় সংখ্যা পাওয়া যাবে! এবার দেখা যাক, কীভাবে এই স্কেলটি লগারিদম নিয়ে কাজ করে।

তরঙ্গের প্রশস্ততা: ভূকম্পনে তৈরি কাঁপুনি সিসমোগ্রাফে যে ঢেউ তৈরি করে, সেগুলোর প্রশস্ততাই তরঙ্গের প্রশস্ততা। রিখটার স্কেল সাধারণ লগারিদম মেনে কাজ করে। এর ভিত্তি ১০। অর্থাৎ, ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ তরঙ্গ উচ্চতা দেখে তার ১০-ভিত্তিক লগ নেওয়া হয়। এ জন্যই এই স্কেলের সাহায্যে মধ্যম মানের ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা যায়।

রিখটার স্কেলে প্রতি এক ইউনিট বাড়লে তীব্রতা বাড়ে ১০ গুণ। যেমন—৪.৫ মাত্রার চেয়ে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের হিসাবটা হবে এমন:

ধরি, প্রথমটির মাত্রা M1 = 4.5

দ্বিতীয় মাত্রা M2 = 5.5

তাহলে তীব্রতার মাত্রা হবে = 10 × (M2 - M1) = 10 × (৫.৫ - ৪.৫) = ১০ × ১ = ১০।

অর্থাৎ ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। শক্তির দিক থেকে হিসেবটা একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে এক ইউনিট (M) বাড়লে শক্তি বাড়ে ৩১.৬ গুণ। এটি আসে E ∝ 10 × 1.5M সম্পর্ক থেকে। তাই, 10 × (1.5 × 1) = 31.6। তাই মাত্রা ছোট হলেও অনেক সময় ভূমিকম্পের শক্তি বা তীব্রতা বেশি হয়।

আরও পড়ুন
ভূকম্পনে তৈরি কাঁপুনি সিসমোগ্রাফে যে ঢেউ তৈরি করে, সেগুলোর প্রশস্ততাই তরঙ্গের প্রশস্ততা। রিখটার স্কেল সাধারণ লগারিদম মেনে কাজ করে। এর ভিত্তি ১০।

প্রাথমিক রিখটার স্কেলের সীমাবদ্ধতা ভূমিকম্পের মানসম্মত বা আদর্শ পরিমাপে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয় এই স্কেল। সহজ হয় ভূমিকম্পের তুলনা ও বিশ্লেষণ। তবে শুরুতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল স্কেলটির। বেশি মাত্রার ভূমিকম্প নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে পারত না স্কেলটি।

বড় ভূমিকম্পের তরঙ্গের পরিমাপ করার পর পাওয়া মানগুলো কাছাকাছি জমাট বা গুচ্ছাকারে থাকে। একে বলা হয় স্যাচুরেশন। মানে যন্ত্রের কাঁটা আর ওপরে উঠতে পারে না বা আটকে যায়। ফলে কিছুক্ষেত্রে ভূমিকম্প বেশি মাত্রার হলেও স্কেলে আসে তার চেয়ে কম।

এছাড়াও ১৯৩৫ সালের রিখটার স্কেলের মূল পদ্ধতি কেবল নির্দিষ্ট ধাঁচের সিসমোগ্রাফ ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে পৃথিবীর সব অঞ্চলের ভূমিকম্প একই নির্ভুলতায় মান দিতে পারত না। আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা ছিল, এটি শুধু সর্বোচ্চ তরঙ্গের উচ্চতা দেখে মাত্রা নির্ধারণ করত। ফলে কম্পনে মোট কত শক্তি মুক্ত হয়েছে, ফল্ট কত বড়, কোথায় কী পরিমাণ ফাটল আছে, তা জানা যেত না।

এসব সীমাবদ্ধতায় কাঁটিয়ে রিখটার স্কেল আপডেট করা হলো। আগের রিখটার স্কেলের দুর্বলতাগুলো সংশোধনে নামেন বিজ্ঞানী রিখটার ও গুতেনবার্গ। পাওয়া যায় আরও উন্নত দুটি স্কেল। বডি-ওয়েভ ম্যাগনিটিউড স্কেল ও সারফেস-ওয়েভ ম্যাগনিটিউড স্কেল।

আরও পড়ুন
৯৩৫ সালের রিখটার স্কেলের মূল পদ্ধতি কেবল নির্দিষ্ট ধাঁচের সিসমোগ্রাফ ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে পৃথিবীর সব অঞ্চলের ভূমিকম্প একই নির্ভুলতায় মান দিতে পারত না।

প্রথম স্কেলটি পৃথিবীর ভূ-গর্ভে প্রাথমিক পি তরঙ্গ ও মাঝারি এস তরঙ্গ গণনা করে। এর পরিসীমা এক হাজার কিলোমিটার। দ্বিতীয় স্কেল পৃথিবীর পৃষ্ঠ বরাবর প্রবাহিত লাভ ও রেলে তরঙ্গগুলোর মাত্রা গণনা করে। এই স্কেলটিতে কেন্দ্রস্থল ও সিসমোগ্রাফের অবস্থানের মধ্যে দূরত্বের কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। তবে এই দুই স্কেলও শেষপর্যন্ত ৮ মাত্রার ওপরে স্যাচুরেশন সমস্যায় ভুগতে শুরু করে।

মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল বৈজ্ঞানিকভাবে রিখটার স্কেলের থেকে নির্ভুল হিসাব দেয়। কিন্তু রিখটার স্কেল এত পরিচিতি পেয়েছে যে, সংবাদমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ ভূমিকম্পের মাত্রা বলতে এখনো রিখটার স্কেল নামটাই ব্যবহার করে।

১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে জাপানি ভূমিকম্পবিজ্ঞানী হিরু কানামোরি এবং মার্কিন ভূমিকম্পবিজ্ঞানী থমাস সি. হ্যাঙ্কস মিলে তৈরি করেন আধুনিক এক স্কেল। নাম মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল। একবিংশ শতাব্দির শুরুতেই ভূমিকম্প পরিমাপে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই স্কেল।

ভূপৃষ্ঠ ছোট-বড় অনেক টেকটোনিক প্লেটে গড়া। এসব প্লেট পৃথিবীর অভ্যন্তরের উত্তপ্ত ম্যাগমা প্রবাহের কারণে ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। প্লেটগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, দূরে সরে যায় বা পাশ ঘেঁষে আসে। এই নাড়াচাড়া বেশি মাত্রায় হলে ভূপৃষ্ঠে ফাটল বা ফল্ট তৈরি হয়। ফল্টে জমে থাকা চাপ ও টান শিলার শক্তিকে অতিক্রম করলেই ভাঙনের শুরু হয়। তখন জমে থাকা শক্তি সিসমিক তরঙ্গ বা ভূমিকম্প তরঙ্গ হিসেবে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। একেই আমরা বলি ভূমিকম্প।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

সূত্র: ব্রিটানিকা, মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসি

আরও পড়ুন