শ্রদ্ধাঞ্জলি
মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা যাঁর নামে
১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। পাশাপাশি তিনি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিনে বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন একজন রেনেসাঁ মানুষ। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতেন, কিন্তু সাহিত্য ও সংগীতেও ছিল তাঁর আগ্রহ। রাগসংগীতের ধ্বনিবিজ্ঞান আর ফরাসি সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করতেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর মধ্যে কোয়ান্টাম সংখ্যায়ন ছাড়াও রয়েছে বর্ণালিবিজ্ঞান, রসায়ন, পরিসংখ্যানবিদ্যা, একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব, তাত্ত্বিক বলবিদ্যা, থার্মোলুমিনাসেন্স, এমনকি আয়নমণ্ডল নিয়ে গবেষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জৈব রসায়নের ওপর একটি ল্যাব স্থাপন করেছিলেন, আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেছিলেন এক্স-রে গবেষণাগার। এই উদ্যোগগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি অন্য গবেষকদের কাজে সাহায্য করেছেন। তবে নিজে যে পরীক্ষামূলক কাজগুলো করেছেন, সেগুলোর সব কটা নিয়ে গবেষণাপত্র সেভাবে লিখে যাননি। কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর তাঁর কাজ চারটি প্রবন্ধে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এই যুগান্তকারী কাজটির ব্যাপারে তিনি বিস্তারিতভাবে সর্বজনবোধ্য কোনো কিছু লিখে যাননি।
সত্যেন বসু তাঁর সংখ্যায়ন তত্ত্বে কীভাবে উপনীত হলেন, সেটির ঐতিহাসিক পটভূমি এবং পরবর্তী ক্রমবিকাশ নিয়ে অধ্যাপক পার্থ বসু এস. এন. বোস কালেক্টেড সায়েন্টিফিক পেপারস (১৯৯৪) বইতে একটি খুব গভীর আলোচনা করেছেন। এই ক্রমবিকাশে দুটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য। সত্যেন বসু ফোটন কণার যে কৌণিক ভরবেগ আছে, তা হয়তো অনুমান করেছিলেন। আরেকটি হলো, তিনি ভেবেছিলেন, পরমাণুর ভেতর উচ্চ শক্তির কক্ষপথের ইলেকট্রন তার কক্ষপথ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিচু শক্তির কক্ষপথে স্থানান্তরিত হয় না, এতে বাইরের আপতিত বিকিরণের একটা ভূমিকা আছে। এ নিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর হয়তো একটা মতবিরোধ ছিল। আইনস্টাইনের মতে, পরমাণু থেকে আলোক নির্গমনের দুটি পদ্ধতি। একটি হলো ইলেকট্রনের স্বতঃস্ফূর্ত স্থানান্তর, অপরটি হলো আপতিত বিকিরণে উদ্দীপিত ইলেকট্রনের নিচু শক্তির কক্ষপথে স্থানান্তর। বর্তমান বিজ্ঞান বসুর অবস্থানকেই কিছুটা প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনা হবে সত্যেন বসুর ১৯২৪-এ লেখা প্রথম প্রবন্ধটি নিয়ে, যেটির জন্য তাঁর নাম বিজ্ঞানে চিরদিনের মতো স্থান পেয়েছে।
১৯২১ সালে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগ দিলেন, তারপর কিছুটা মেঘনাদ সাহার উৎসাহে ‘কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ’ (blackbody radiation) নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শুরুই হয়েছিল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের একটি সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে। কৃষ্ণবস্তুটি কী? এটি হলো একটি আদর্শায়িত কালো বস্তু, যা সব আপতিত তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ শুষে নেবে, কিন্তু নিজে তার তাপমাত্রা অনুযায়ী আলো বিকিরণ করবে—একটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে নয়, বরং বিভিন্ন তরঙ্গের বর্ণালিতে। ১৮৫৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্শফ আমাদের আদর্শায়িত কৃষ্ণবস্তুর ধারণাটি দিয়েছিলেন। একটি চুল্লিকে কালো রং করে, তাপ কুপরিবাহী বস্তু দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে, তাতে শুধু একটা গর্ত (গর্তটির দেয়ালও কালো রঙের হবে) রাখতে হবে। ওই গর্ত থেকে বিকিরণ বের হওয়ার একটা পথ থাকতে হবে (চিত্র ১)। এর ফলে বাইরে থেকে আসা সব আলোকতরঙ্গ সেই গর্তে বা ভেতরের প্রকোষ্ঠের কালো রঙে শোষিত হয়ে যাবে, অন্যদিকে চুল্লি থেকে উদ্ভূত বিকিরণ বাইরে দেখা যাবে।
যদিও আদর্শ কৃষ্ণবস্তুর একটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকৃতি আছে, কিন্তু খুব সাধারণভাবে বললে, প্রতিটি বস্তুই কমবেশি কৃষ্ণবস্তু—সূর্য, আমাদের চারদিকের সব জিনিস, এমনকি আমাদের দেহের বিকিরণকেও কৃষ্ণবস্তুর বর্ণালি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে, ধ্রুপদি বা চিরায়ত পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব অনুযায়ী, বস্তুর তাপ থাকলেই তা থেকে বিকিরণ বের হবে। আর বস্তুর তাপমাত্রা যত বেশি হবে, তত উচ্চ শক্তিতে এবং পরিমাণে সেই বস্তু আলো বিকিরণ করবে।
২ নম্বর চিত্রে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কৃষ্ণবস্তুর বর্ণালি দেখানো হচ্ছে—x-অক্ষে কম্পাঙ্ক এবং y-অক্ষে বিকিরণের পরিমাণ, ঔজ্জ্বল্য বা প্রাবল্য (Intensity)। আলোর তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে, তার শক্তিও তত বেশি হবে। আর মোট প্রাবল্যের সর্বোচ্চ মানটি ডান দিকে, অর্থাৎ বেশি কম্পাঙ্কের দিকে সরবে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন, কৃষ্ণবস্তুর ভেতরে যে গহ্বর আছে, সেখানে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় (চিত্র ১)। ওই সময়ে পরমাণু ও এর মধ্যে ইলেকট্রনের অবস্থান সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা বলতেন, দেয়ালে অবস্থিত একধরনের দোলক (Oscillator) থেকে তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। এই দোলক যে কম্পাঙ্কে দুলবে, সেই কম্পাঙ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হবে। একেকটি কম্পাঙ্কের জন্য একেকটি তরঙ্গ। যেসব তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ ওই গহ্বরে সৃষ্টি হবে, সেগুলোকে স্থির তরঙ্গ (Standing Wave) হতে হবে, যেখানে তাদের তড়িৎক্ষেত্রের (বা ভেক্টরের) মান গহ্বরের দেয়ালে শূন্য হবে (চিত্র ১)। একটি নির্দিষ্ট আকারের গহ্বরে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের কয়টি তরঙ্গের উপস্থিতি সম্ভব? আমরা যদি সেই সংখ্যাটি জানি, তবে সেটিকে তরঙ্গের গড় শক্তি দিয়ে গুণ করলে বিকিরিত প্রাবল্যের মানটি পাওয়া যেতে পারে। এটি যেহেতু একটি ত্রিমাত্রিক গহ্বর, সে জন্য গণনাটি একটু জটিল; এই মানটিকে ‘স্বাধীনতার মাত্রা’ বা ‘ডিগ্রি অব ফ্রিডম’ বলা হয়। একে দশার পরিমাণও বলা যায় এবং সেটির মান তরঙ্গের কম্পাঙ্কের বর্গের (~ f 2) সমানুপাতিক।
কীভাবে সেটা গণনা করা যাবে, তার মধ্যে না গিয়ে চূড়ান্ত ফলটি লিখছি—একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের পরিক্ষেপে (যেমন f থেকে f + df) এই দশার মানটি হলো 8πf 2/c3। এখানে c হলো আলোর গতিবেগ। খুব সরলভাবে কি এই রাশিটির ব্যাখ্যা করা যায়? মনে করুন, ১০০ থেকে ১২০০ মানের কম্পাঙ্কের মধ্যে যদি ৫টি তরঙ্গের উপস্থিতি সম্ভব হয়, তাহলে আমি যদি ৫-কে প্রতিটি তরঙ্গের শক্তি দিয়ে গুণ করি, তবে ওই তরঙ্গদের মোট শক্তির ঘনত্ব (বা প্রাবল্য) পাওয়া যাবে, যেটা ২ নম্বর চিত্রে y-অক্ষে দেখানো হয়েছে। র্যালে-জিন্সের রাশিটিতে তরঙ্গের গড় শক্তি ধরা হয়েছে kT (এখানে k বোলজম্যান ধ্রুবক ও T হলো তাপমাত্রা), কাজেই মোট প্রাবল্য হবে 8πf 2 kT/c3। তরঙ্গের কম্পাঙ্ক নিরবচ্ছিন্ন, এই ধারণার ওপর নির্ভর করে, কম্পাঙ্কের মানের ওপর ইন্টিগ্রেশন করে গড় শক্তি kT পাওয়া গিয়েছিল।
র্যালে-জিন্সের রাশি দিয়ে পরীক্ষালব্ধ বর্ণালিটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। দেখা গেল, কম্পাঙ্কের মান কম হলে সেটি পরীক্ষালব্ধ মানের সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু উঁচু কম্পাঙ্কে তা মেলে না। এটি তখনকার দিনে অতিবেগুনি বিপর্যয় (Ultraviolet catastrophe) বলে আখ্যায়িত করা হতো। বিপর্যয় কেন? কারণ, অতিবেগুনি আলোর কম্পাঙ্কে র্যালে-জিন্স রাশিটির মানটি প্রায় অসীম হয়ে যাচ্ছিল (চিত্র ২)। এরপর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ১৯০০ সালে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দেখালেন, তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণকে নিরবচ্ছিন্ন না ধরে যদি ছোট ছোট পৃথক অংশের (কোয়ান্টা বা কোয়ান্টাম) মিলিত ফল হিসেবে ধরা যায়, তবে এমন একটি রাশি পাওয়া যাবে, যেটি কৃষ্ণবস্তুর বর্ণালিকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। প্রতিটি কোয়ান্টার শক্তি হবে hf, যেখানে h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক।
প্ল্যাঙ্ক অনুমান করলেন, তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ hf, 2hf, 3hf, … এ রকম কোয়ান্টা দিয়ে গঠিত এবং সেগুলোকে সিরিজ বা ধারায় যোগ করে দেখালেন যে কোয়ান্টার গড় শক্তি kT নয় বরং hf/(ehf/kT-1)। কীভাবে প্ল্যাঙ্ক এটি আহরণ করলেন, তা আজকের আলোচনার বাইরে রাখতে হবে। তবে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয়—এই সমস্যায় প্ল্যাঙ্ক এনট্রপির ধারণা ব্যবহার করেছিলেন। শক্তিকে (বা কণাদের) কত বেশি ‘উপায়ে’ বিন্যস্ত বা বিতরণ করা যায়, এনট্রপি সেটার পরিমাপক। একটা বদ্ধ সিস্টেম ক্রমাগত বেশি এনট্রপির দিকে যাবে এবং তাপীয় সাম্যাবস্থায় সর্বোচ্চ এনট্রপিতে থাকবে। এই কণা বা শক্তিরা সর্বোচ্চ এনট্রপিতে থাকবে—এই নীতি অবলম্বন করে প্ল্যাঙ্ক দেখালেন, বিচ্ছিন্ন কোয়ান্টাম কণাদের শক্তিকে hf দিয়ে বর্ণনা করা যায়।
প্ল্যাঙ্কের পদ্ধতি কোয়ান্টাম (বিযুক্ত বা পৃথক অর্থে) ধারণাকে প্রথম সামনে নিয়ে এল, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীই এই পদ্ধতিটি নিয়ে পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। কারণ, প্ল্যাঙ্ক তাঁর রাশিটি আহরণ করতে ধ্রুপদি বিজ্ঞানের সঙ্গে নতুন কোয়ান্টাম বিজ্ঞান মিশিয়েছিলেন। ধ্রুপদি বিজ্ঞান কোনটি? খেয়াল আছে, কৃষ্ণবস্তুর গহ্বরে কত ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে, তা গণনা করা হয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ কম্পাঙ্কের ইন্টিগ্রেশন দিয়ে। এটা হলো ধ্রুপদি বা সনাতন পদ্ধতি। অথচ প্ল্যাঙ্ক শক্তি গণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করলেন একক বিচ্ছিন্ন কণার কোয়ান্টাম ধারণা। গণনার ক্ষেত্রে বিকিরণ একই সঙ্গে তরঙ্গ ও কণা হতে পারে না। হয় তাকে অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গ হিসেবে ভাবতে হবে, না হলে পৃথক কণা হিসেবে গণ্য করতে হবে। এই যে অসামঞ্জস্য, সেটা পরবর্তী ২০ বছর ডিবাই, আইনস্টাইন, নাটানসন, কামেরলিঙ্গ ওনেস, পাউলি এ রকম আরও দু-একজন বিজ্ঞানী দূর করার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু পুরোপুরি সফল হলেন না। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে মেঘনাদ সাহা ঢাকায় এলেন এবং সত্যেন বসুর সঙ্গে প্ল্যাঙ্ক পদ্ধতির যৌক্তিক অসামঞ্জস্য দূর করতে এসব বিজ্ঞানীর গবেষণা নিয়ে আলোচনা করলেন। তত দিনে মেঘনাদ সাহা আলোর কোয়ান্টাম চরিত্রকে তাঁর গবেষণায় ব্যবহার করছিলেন, বিশেষত আলোর কণার যে ভরবেগ p = hf/c আছে, এই ধারণাটি।
এর দুই মাসের মধ্যে সত্যেন বসু প্ল্যাঙ্কের রাশিটি প্রণয়ন করলেন কোনো যৌক্তিক অসামঞ্জস্য ছাড়াই। ৪ জুন ১৯২৪ সালে আইনস্টাইনকে একটি গবেষণাপত্র পাঠালেন একটি চিঠিসহ, ‘এটি সম্বন্ধে আপনি কী মনে করেন, তা জানতে আমি উদ্বিগ্ন আছি। আপনি লক্ষ করবেন যে প্ল্যাঙ্কের সূত্রের 8πf 2/c3 সহগটি আমি সনাতনী তড়িৎ-গতিবিদ্যার ওপর নির্ভর না করেই নির্ণয় করেছি; আমি কেবল ধরে নিয়েছি, দশা-স্থানে একেবারে প্রাথমিক অঞ্চলের আয়তন হলো h3….’
এটি একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। প্ল্যাঙ্ক ধরে নিয়েছিলেন, কৃষ্ণবস্তুর দেয়াল একধরনের দোলক তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং সেই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক দোলকের কম্পাঙ্কের সমান। ১৯২৪ সালের মধ্যে অবশ্য দোলকগুলো যে পরমাণু, তা বোঝা গিয়েছিল। সত্যেন বসু দোলকের ধারণার মধ্যেই গেলেন না; বরং ধরে নিলেন, কৃষ্ণবস্তুর গহ্বর আলোর কোয়ান্টাম কণিকা (বর্তমানে আমরা যাকে ফোটন বলি) দিয়ে ভর্তি। এরপর বের করলেন একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের পরিক্ষেপে (f থেকে f + df) কটি অবস্থান (বা কটি দশায়) ওই কণাগুলো নিতে পারে। এর জন্য ব্যবহার করলেন কোয়ান্টার ত্রিমাত্রিক ভরবেগ px, py, pz এবং ত্রিমাত্রিক স্থান x, y, z। ত্রিমাত্রিক ভরবেগের মান হলো p = hf/c। এই হিসাবে কতগুলো দশা থাকতে পারে? এই পদ্ধতিতে df কম্পাঙ্কের পরিক্ষেপে এবং V স্থানিক ঘন আয়তনে সত্যেন বসু পেলেন 4πf 2/c3Vdf মানটি। এরপর একটি আলোর কণার দুটি পোলারাইজেশন (কৌণিক ভরবেগের কারণে) দশার জন্য শেষোক্ত রাশিটিকে ২ দিয়ে পূরণ করলেন (চিত্র ৩, সমীকরণ ১)। চন্দ্রশেখর রামনের একটি পেপার থেকে আমরা জানতে পারি, সত্যেন বসুর মূল গবেষণাপত্রে ২ দিয়ে পূরণ করার ব্যাপারে ওপরের ব্যাখ্যাটি দেওয়া ছিল, কিন্তু আইনস্টাইনের অনুবাদে সেই ব্যাখ্যাটি বাদ পড়ে। পরে প্রমাণিত হয় যে ফোটন কণার দুটি কৌণিক ভরবেগ আছে, একটি ফোটনের গতির দিকে, অন্যটি গতির বিপরীতে।
এর পরের পদক্ষেপে সত্যেন বসু ব্যবহার করলেন নতুন সংখ্যায়ন পদ্ধতি। এতে একটি কোয়ান্টাম আলোক কণাকে অন্য একটি আলোক কণা থেকে আলাদা করা সম্ভব নয় (তারা অভিন্ন) এবং একটি কোয়ান্টাম দশায় একাধিক কণা থাকতে পারে। ৩ নম্বর চিত্রের (২) নম্বর রাশিটি দেখাচ্ছে NS কোয়ান্টাকে As সংখ্যক দশায় বা খোপে কতভাবে বণ্টন করা সম্ভব (এখানে As সংখ্যার মানকে (১) নম্বর সমীকরণ দিয়ে পাওয়া যায়)। এখানে s হলো একটি শক্তির স্তর (df)। বসু p0 সংখ্যক খোপে শূন্য কোয়ান্টা, p1 সংখ্যক খোপে একটি, p2 সংখ্যক খোপে দুটি কোয়ান্টা—এভাবে জিনিসটা ব্যাখ্যা করেছেন। এগুলো যোগ করলে যে NS সংখ্যক কোয়ান্টা পাওয়া যাবে, সেটা (৩) নম্বর সমীকরণে দেখানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, ২টি খোপ আছে, যেখানে কোনো কোয়ান্টা নেই, ৩টি খোপে ১টি কোয়ান্টা এবং ৪টি খোপে ২টি করে কোয়ান্টা আছে। তাহলে মোট কোয়ান্টার পরিমাণ হলো ০×২ + ১×৩ + ২×৪ = অর্থাৎ মোট ১১টি কোয়ান্টা এই শক্তিস্তরে রয়েছে। যদি কোনো নির্দিষ্ট শক্তির (বা কম্পাঙ্কের) পরিব্যাপ্তিতে ১০০০টি কোয়ান্টা থাকে এবং ওই ব্যাপ্তিতে (বা স্তরে) যদি ১০টি দশা বা খোপ থাকে তবে প্রতিটিতে ০ থেকে আরম্ভ করে ১০০০টি পর্যন্ত কোয়ান্টা থাকতে পারে। অর্থাৎ একটি খোপে কতগুলো কোয়ান্টা থাকবে, তার ওপর বাধানিষেধ নেই।
৩ নম্বর চিত্রের (১) নম্বর অভিব্যক্তিটি একটি নির্দিষ্ট df (বা শক্তির) পরিক্ষেপ বা পরিব্যাপ্তির জন্য, এর পরবর্তী df-এর জন্যও একই বণ্টন প্রযোজ্য। আবার প্রতিটি নির্দিষ্ট বণ্টনের জন্য অন্য df-গুলোর সব বণ্টন সম্ভব। অর্থাৎ প্রথম df-এর জন্য W-এর মান ১০ আর পরেরটির জন্য ৫ হলে, দুটি মিলিয়ে ১০×৫ = ৫০টি উপায়ে কোয়ান্টাগুলো ছড়িয়ে থাকতে পারে। কাজেই s যদি df সারি বা ধারার সংখ্যা হয়, তবে প্রথমটির জন্য s = ১ এবং দ্বিতীয়টির জন্য s = ২ হবে। এভাবে বহুসংখ্যক s-এর গুণফল আমাদের সামগ্রিক বিতরণের মানটি দেবে, এটা (৪) নম্বর সমীকরণে দেখানো হয়েছে।
৩ নম্বর চিত্রের (২) নম্বর সমীকরণ একেবারে নতুন নয়, বোলজম্যানও এ রকম একটি সংখ্যায়ন ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু সেখানে কোয়ান্টার বা প্রভেদশূন্য কণার ধারণা ছিল না। পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী লাডিসলাস নাটানসন ১৯১১ সালে অবশ্য একই রূপের পরিসংখ্যান প্রণয়ন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজটি সামগ্রিকভাবে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণকে কোয়ান্টাম দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখার কারণে উপেক্ষিত থাকে। আর সত্যেন বসু নাটানসনের কাজটি সম্বন্ধে যে অবগত ছিলেন, এ রকম কোনো ধারণা পাওয়া যায় না (তাঁর ছাত্র অধ্যাপক পার্থ ঘোষ তা-ই মনে করেন, রেফারেন্সে ওনার লেখাটি দেখতে পারেন)।
বর্তমান কোয়ান্টাম তত্ত্বের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রণয়ন করতে (৪) নম্বর সমীকরণ ব্যবহার করা হয় না; বরং (৫) নম্বরটি ব্যবহৃত হয়। এটার ব্যাখ্যায় বলা যায়, N-সংখ্যক প্রভেদশূন্য কোয়ান্টাকে যখন P-সংখ্যক নির্দিষ্ট খোপে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি খোপে যদি কতসংখ্যক কোয়ান্টা থাকবে, তার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকে তাহলে (৫) নম্বর সমীকরণটি ব্যবহার করা যায়। যদি N-এর মান ১ থেকে অনেক বড় হয়, তখন (৪) এবং (৫) নম্বর সমীকরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আমরা জানি কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণে কোয়ান্টা বা ফোটনের সংখ্যা বিশাল, কাজেই এই দুটি সমীকরণ মূলত একই।
(৫) নম্বর সমীকরণটি নিয়ে একটু বিশদভাবে বলি। ধরা যাক, আমাদের তিনটি শক্তির স্তর আছে, E1, E2, E3। প্রথম E1 স্তরটিতে আবার ৩টি কোয়ান্টা, ২টি দশা বা খোপে, অবস্থান করছে। এর মানে ওই ৩টি কোয়ান্টার বণ্টন ৪টি উপায়ে হতে পারে—(০, ৩), (৩, ০), (১, ২), (২, ১)। (৫) নম্বর সমীকরণ অনুযায়ী (৩ – ১ + ২)!/((৩!)(২ -১)!) = ৪টি উপায়ই পাওয়া যাবে। এবার ধরা যাক E2-তে ৪টি কোয়ান্টা আছে, ৩টি খোপের মধ্যে। তাহলে সেখানে মোট বিতরণের সংখ্যা হবে (৪ – ১ + ৩)!/((৪!)(৩ -১)!) = ১৫টি। তারপর ধরা যাক, E3-তে ৫টি কোয়ান্টা আছে ৩টি দশাতে। সেখানে বণ্টনসংখ্যা হবে (৫ – ১ + ৩)!/((৫!)(৩ -১)!) = ২১টি। তাহলে এই তিনটি শক্তিস্তরে ৪ × ১৫ × ২১ = ১,২৬০টি উপায়ে কোয়ান্টাগুলো ছড়িয়ে থাকতে পারে।
যেকোনো বিচ্ছিন্ন বা পৃথক সিস্টেম স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি তাপীয় সাম্যাবস্থায় উপনীত হয়, যেখানে এনট্রপির মান সর্বাধিক। কাজেই এর পরের পদক্ষেপটি ছিল (৪) নম্বর সমীকরণে (অথবা ৫ নম্বরে) যে সিস্টেমটি পাওয়া গেছে, তার এনট্রপির সর্বোচ্চ মান নির্ধারণ করা। এনট্রপির মান নির্ধারণের জন্য বোলজম্যান একটি সমীকরণ দিয়ে গিয়েছিলেন S = kln (W) , যেখানে k হলো বোলজম্যানের ধ্রুবক, আর W হলো (৪) অথবা (৫) নম্বর সমীকরণ অনুযায়ী বণ্টনসংখ্যা, অর্থাৎ কতভাবে কোয়ান্টারা বিভিন্ন দশায় থাকতে পারে। সেই সর্বাধিক মানটি পাওয়ার জন্য সত্যেন বসু দুটি সংরক্ষণ নীতির ভিত্তিতে ক্যালকুলাস এবং ল্যাগ্রাঞ্জ মাল্টিপ্লায়ার পদ্ধতি (তত দিনে এটি ছিল একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি) ব্যবহার করেছিলেন। দুটি সংরক্ষণ নীতির একটি ছিল সিস্টেমে মোট শক্তি সংরক্ষিত থাকবে এবং অপরটি হলো মোট কোয়ান্টা সংখ্যা সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু বসু শুধু প্রথমটি ব্যবহার করে (২) নম্বর চিত্রে প্ল্যাঙ্ক যে রাশিটি প্রণয়ন করেছিলেন (২ নম্বর চিত্রে), তা পেলেন। কোয়ান্টা সংখ্যার সংরক্ষণ যে তাঁর গণনায় লাগেনি, সেটি প্রমাণ করে যে কোয়ান্টা বা ফোটনসংখ্যা সংরক্ষিত থাকে না। কারণ, পারমাণবিক বিকিরণ ও শোষণে একটি ফোটন থেকে একাধিক ফোটন কিংবা একাধিক ফোটন থেকে একটি বা কোনো ফোটন না–ও পাওয়া যেতে পারে।
সত্যেন বসুর এই কাজটির প্রকৃত উদ্ভাবনী দিকটি হলো কোয়ান্টা কণাকে এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যেন তারা প্রভেদশূন্য, একে অপর থেকে পার্থক্য করা যায় না। এই প্রভেদশূন্যতার মূল ভিত্তিটাই হলো বিভিন্ন কোয়ান্টাগুলো বণ্টন করার সময় কোন কোয়ান্টা কোন দশায় যাবে, তা নির্দিষ্ট না করে শুধু প্রতি দশায় কতটি কোয়ান্টা যাবে, তার ওপর মনোযোগ দেওয়া।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সত্যেন বসুর এই কাজের দুটি দিক আছে—একটি হলো কোয়ান্টাম কণার ভরবেগ ও স্থানের ওপর ভিত্তি করে দশার ঘনত্ব বের করা, অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে কোয়ান্টাম কণাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে (ধ্রুপদি তরঙ্গবিজ্ঞানের ওপর নয়), আর দ্বিতীয়টি হলো ওই কণাদের শক্তি নির্ণয়ের জন্য একটি নতুন সংখ্যায়ন তত্ত্ব দেওয়া। এই দ্বিতীয় অংশের জন্যই তিনি বিখ্যাত, যাকে আমরা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বলি। কিন্তু আইনস্টাইন যখন তাঁর গবেষণাপত্রটি অনুবাদ করেন, তখন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে তাঁর সুপারিশপত্রে আইনস্টাইন শুধু প্রথম অবদানটির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
১৯২৫ সালে আইনস্টাইন সত্যেন বসুর পরিসংখ্যান ব্যবহার করলেন গ্যাসীয় অণুর ওপর এবং ধারণা করলেন চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো বোস কণার মতো আচরণ করবে, অর্থাৎ একটি অভিন্ন কোয়ান্টাম দশায় থাকবে। বস্তুর এই অবস্থাকে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (অতিঘনীভূত অবস্থা) বলা হয়। ২.১৭ কেলভিন তাপমাত্রার নিচে তরল হিলিয়াম এ ধরনের একটি অতি তরল অবস্থায় উপনীত হয়, যখন তার সব পরমাণুই সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে থাকে, তাদের স্পিনের মান শূন্য হয় এবং তারা সান্দ্রতা হারিয়ে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় তিনজন বিজ্ঞানীকে, যাঁরা রুবিডিয়াম ও সোডিয়াম পরমাণুর গ্যাসে এ অবস্থাটি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বর্তমানে যেসব কণার কোয়ান্টাম স্পিন পূর্ণ সংখ্যা, সেগুলোকে সত্যেন বসুর সম্মানে বোসন কণা বলে অভিহিত করা হয়, এরা সবাই বোস সংখ্যায়ন মেনে চলে। পল ডিরাক ১৯৪০ সালে ‘বোসন’ নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। ফোটন W এবং Z বোসন, গ্লুয়ন—এদের সবার স্পিন ১, আবার হিগস কণা, পাই মেসন—এদের স্পিন ০। এরা সবাই বোসন কণা।
সত্যেন বসু তাঁর পরিসংখ্যান প্রণয়ন করেছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উষালগ্নে। শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ ফাংশন বা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব তখনো প্রণীত হয়নি। এই কাজটি তিনি করেছিলেন, বিজ্ঞান গবেষণার মূল কেন্দ্রগুলো থেকে বহুদূর থেকে, বিশ্বের সার্বিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মৌলিক অবদান রাখার প্রত্যয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে তিনি এই কালজয়ী প্রবন্ধ লেখেন, সেটি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গৌরবময় ঐতিহ্য। ১৯৬৪ সালে লাইফ ম্যাগাজিন দ্য সায়েন্টিস্ট নামে একটি বই প্রকাশ করে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা কেমন করে একটি সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি সৃষ্টি করছেন, তা নিয়ে আলোচনা ছিল। ওই বইটি আমাদের ঢাকার বাসায় ছিল, সেখানে সত্যেন বসুর একটি লক্ষণীয় দুর্লভ ছবি ছিল। সেই ১৯৬৮ সালে, আমার স্কুলছাত্র অবস্থায়, বিদেশি একটি বইয়ে, বাঙালি এক বিজ্ঞানীর ছবি দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। সেই বিস্ময়, তাঁর কাজ সম্বন্ধে আজ লিখতে গিয়ে, আজও কাটেনি।
লেখক: অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
গ্রন্থসূচি: Partha Ghose, Bose Statistics : A historical perspective, S. N. Bose Collected Scientific Papers (1994), S N Bose National Centre for Basic Sciences, Calcutta
*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত