ভাষা
মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব
আমরা জানি, মানুষ মাতৃভাষার মাধ্যমে সবচেয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা ও মনের কথা প্রকাশ করতে পারে। এর পেছনে কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনে একুশের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি চলুন, জেনে নিই বিজ্ঞানের চোখে মাতৃভাষার গুরুত্ব।
ভাষা শুধু কিছু শব্দের সমষ্টি নয়। এর সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন-কল্পনা—সবকিছু জড়িত। ভাষা ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা বা মনে মনে কল্পনা করা যায় না। আমরা হয়তো লক্ষ করেছি একমাত্র মানুষই ভাষা জানে। মনের ভাব প্রকাশ করার এই ক্ষমতা আর কোনো প্রাণীর নেই। কেন নেই? কারণ তাদের স্বরযন্ত্র থাকলেও মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তাভাবনার কাজ সম্পন্ন করে, তার সঙ্গে এর সংযোগ নেই। মানুষের আছে। তাই মানুষ কথা বলতে পারে। ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে।
মানুষ মাতৃভাষার মাধ্যমেই কেবল সবচেয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা ও মনের কথা প্রকাশ করতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করেছেন। মাতৃভাষার এত গুরুত্ব এই জন্য যে, পূর্ণাঙ্গ শিশু হিসেবে জন্মলাভের আগে থেকেই তার মধ্যে মাতৃভাষার ভিত্তি রচিত হতে থাকে। মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেল বিভক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় নার্ভসেল। এই সেলগুলোই পর্যায়ক্রমে স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম গঠনে সাহায্য করে এবং এ সময়ই স্পর্শানুভূতির প্রারম্ভিক সূচনা ঘটে। এই নার্ভসেলগুলোই মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য অঙ্গগুলো (ভাইটাল অর্গানস) গঠনের কাজ শুরু করে। মাতৃগর্ভে পঞ্চম বা ষষ্ঠ সপ্তাহে মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জু গঠিত হতে শুরু করে। মস্তিষ্ক গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যে শিশুটি জন্ম নিতে যাচ্ছে তার সঙ্গে মায়ের চিন্তাভাবনা ও আবেগ-অনুভূতির আত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয়।
মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে সে অনেক বেশি চৌকস হয়। চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। সব ক্ষেত্রে অনায়াসে সে এগিয়ে যেতে পারে। তার ব্যক্তিত্ব সকলকে আকৃষ্ট করে। শুধু তা-ই নয়, মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়লে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বাড়ে।
শিশু জন্মলাভের পর থেকে দেখে মা তার সঙ্গে কথা বলছে। এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে বুঝতে পারে মায়ের কোন কথায় সে হেসে আনন্দ প্রকাশ করবে, কোন কথায় আপত্তি জানাবে। শিশু কথা বলতে শেখার আগে থেকেই কার্যত মনের ভাব বিভিন্ন ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে।
এখানেই মাতৃভাষার গুরুত্ব। শিশু মাতৃভাষা সবচেয়ে সহজে আয়ত্ত করে এবং এটা তার একেবারে আপন ভাষা। সুতরাং মাতৃভাষায় একজন শিশু সবচেয়ে ভালোভাবে জানতে, বুঝতে ও চিন্তাভাবনা করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে সে অনেক বেশি চৌকস হয়। চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। সব ক্ষেত্রে অনায়াসে সে এগিয়ে যেতে পারে। তার ব্যক্তিত্ব সকলকে আকৃষ্ট করে। শুধু তা-ই নয়, মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়লে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, মাতৃভাষায় ১০ শতাংশ দক্ষতা বাড়লে ০.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়ে।
যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করে তার পক্ষে অন্য একটি বা দুটি বিদেশি ভাষা শেখা অনেক সহজ হয়। এর ফলে সে সহজে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করতে পারে।
এ জন্য দেখা যায় ইউরোপ-আমেরিকায় স্কুলে শিশুদের মাতৃভাষার পাশাপাশি আরও দুটি ভাষার শেখার ওপর বেশি জোর দেয়। এতে শিশুর জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। সে আরও বেশি স্মার্ট হয়। তার চিন্তার গতি খুব দ্রুত হয়।
মাতৃভাষার জন্য আমরা জীবন উত্সর্গ করেছি। আজ ৬৬ বছর পরও আমরা অমর একুশে উদ্যাপন করি। ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে প্রভাতফেরি করি। আমাদের মাতৃভাষার জন্য জীবন উত্সর্গ ও মহান ত্যাগ স্বীকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছি। এটা কিন্তু সাময়িক কোনো আবেগের কারণে নয়। অবশ্য সে সময় মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে উঠেছিল মূলত রাজনৈতিক কারণে। পাকিস্তানি শাসক-শোষকেরা আমাদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ-শাসন চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চিরকাল তাদের পদাবনত করে রাখতে চেয়েছিল। সে জন্যই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আর্থসামাজিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির শীর্ষে যেতে হলে প্রথমে দরকার মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন। তাই মাতৃভাষার জন্য আমরা জীবন উত্সর্গ করেছি। আজ ৬৬ বছর পরও আমরা অমর একুশে উদ্যাপন করি। ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে প্রভাতফেরি করি। আমাদের মাতৃভাষার জন্য জীবন উত্সর্গ ও মহান ত্যাগ স্বীকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে উদযাপিত হয়।
