বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল? দেখে নিন একনজরে

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. নতুন রং আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা

বিজ্ঞানীরা নতুন এক রঙের দেখা পেয়েছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, বার্কলে ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিনের একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন এমন রং, যা আগে কেউ দেখেনি। তাঁরা এই রংটির নাম দিয়েছেন ‘ওলো’। তবে এই রং আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। অর্থাৎ এটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাবো না।

বিজ্ঞানীরা ‘ওজ’ নামে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে ওলো রং দেখা যায়। গত ১৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই রং দেখতে হলে চোখের রেটিনায় লেজার লাইট ফেলতে হবে। এখন পর্যন্ত পাঁচজন মানুষ ওলো রং দেখেছেন। তাঁরা সবাই বলেছেন যে এটি দেখতে সবুজ-নীল বা টিল রঙের মতো। গবেষকরা জানিয়েছেন, ওজ এমন একটি প্রযুক্তি, যা আমাদের দেখার জন্য রেটিনার মধ্যে একরকম মাইক্রোস্কোপের মতো কাজ করে। যেটা অতি অল্প মাত্রার লেজার আলোকে আমাদের চোখের নির্দিষ্ট আলোকসংবেদী কোষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। তখনই এই রঙের দেখা মেলে।

বিজ্ঞানীরা যে ওলো রঙের কথা বলছেন, এর অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। তবে এই বিশেষ শেডটি আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টিসীমার বাইরে হওয়ায় আমরা এটি দেখতে পাইনি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শুধু ওলো নয়, মহাবিশ্বে এমন আরও অসংখ্য শেড বা রং থাকতে পারে যা আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে।

২. যে স্যাটেলাইট বিশ্বের ১.৫ ট্রিলিয়ন গাছের ওজন মাপবে

বিশ্বের রেইনফরেস্টগুলোকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। পৃথিবীতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বনভূমি কোটি কোটি টন কার্বন শোষণ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় তা ভূমিকা রাখে। তবে দেড় ট্রিলিয়নেরও বেশি গাছ পৃথিবীর ঠিক কতটা কার্বন শোষণ করে ও জমা করে রাখে, তা সঠিকভাবে মাপা এতদিন সম্ভব হয়নি। গত ২৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ইসা জানিয়েছে, গবেষকরা সফলভাবে একটি নতুন কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছেন। স্যাটেলাইটটি বিশেষভাবে পৃথিবীর বনভূমি পর্যবেক্ষণ এবং বনাঞ্চল কীভাবে পৃথিবীর কার্বন চক্রকে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজ করবে।

ইসা আরও জানিয়েছে, বায়োমাস নামে এই উপগ্রহটি নিউ গিনির কৌরুতে অবস্থিত ইউরোপের স্পেসপোর্ট থেকে একটি রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়। উৎক্ষেপণের এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এটি। উৎক্ষেপণের প্রায় ৭৫ মিনিট পর, ইসার উপগ্রহ নিয়ন্ত্রকরা বায়োমাসের প্রথম সংকেত পান। প্রায় ১২ মিটার চওড়া একটি প্রতিফলকের মাধ্যমে স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর বনাঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করবে। স্যাটেলাইটটিকে দেখতে কিছুটা ছাতার মতো। মূল রিসিভারটি ছাতার সঙ্গেই ঝুলে রয়েছে বলে মনে হয়। গবেষকরা আশা করছেন, ছয় মাসের মধ্যে প্রথম মানচিত্র তৈরি করতে পারবে স্যাটেলাইটি। পরের পাঁচ বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যাবে এটি। স্যাটেলাইটি এখন প্রায় ৬৬৬ কিলোমিটার ওপর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।

পৃথিবীর বনভূমি গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৮ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ও সংরক্ষণ করে, যা গ্রহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে ইসা জানিয়েছে, বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বন উজাড় ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে সঞ্চিত কার্বন পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাচ্ছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনে কারণ। গ্রহের আনুমানিক ১.৫ ট্রিলিয়ন গাছ ঠিক কতটা কার্বন ধারণ করে এবং মানুষের কার্যকলাপ সেই ধারণক্ষমতাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্যের পেতে এই ধরনের স্যাটেলাইট এই প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাঠানো হয়েছে।

৩. বিশ্বের সবচেয়ে ছোট পেসমেকার

বিজ্ঞানীরা চালের দানার আকারের একটি পেসমেকার তৈরি করেছেন। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট  পেসমেকার। আলোর সাহায্যে চলবে এটি। তবে এ যন্ত্রটা কাজ করবে সাময়িক বা অস্থায়ী হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রক হিসেবে। ডিভাইসটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে অনায়াসে স্থাপন করা যাবে মানবদেহে। কাজ শেষে দ্রবীভূত হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। গত ২ এপ্রিল নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম এই পেসমেকার তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী। এই পেসমেকার লম্বায় মাত্র ৩.৫ মিলিমিটার, চওড়ায় ১.৮ মিলিমিটার এবং পুরুত্বে প্রায় ১ মিলিমিটার। চালের দানার চেয়েও ছোট এই ডিভাইসটি আকারে ক্ষুদ্র হলেও প্রচলিত পেসমেকারের মতোই কার্যকর বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।

যদিও মানুষের দেহে এর পরীক্ষা শুরু হতে এখনো কয়েক বছর বাকি। বিজ্ঞানীরা এই তারহীন পেসমেকারটিকে একটি ‘বৈপ্লবিক অগ্রগতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে এটি।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে: বিশ্বের সবচেয়ে ছোট পেসমেকার

৪. সন্ধান মিলল সবচেয়ে প্রাচীন পিঁপড়ার জীবাশ্ম

ব্রাজিলের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন পিঁপড়ের জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন। ডাইনোসরদের যুগে প্রায় ১১ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে এই প্রাগৈতিহাসিক পিঁপড়াটির বাস ছিল। বিজ্ঞানীরা একে বলছে হেল অ্যান্ট, মানে নরকের পিঁপড়া। প্রাগৈতিহাসিক এই পিঁপড়ার প্রজাতির নাম ভলকানিদরিস ক্রেটিনসিস (Vulcanidris cratensis)। শিকার ধরার জন্য এর ছিল এক অসাধারণ কৌশল। এদের চোয়াল ছিল কাস্তের মতো। ওপরের দিকে বাঁকানো চোয়াল দিয়ে শিকার ধরত। এই চোয়ালে শিকারকে গেঁথেও ফেলতে পারত বলে মনে করা হয়। পিঁপড়ার প্রজাতিগুলোর মধ্যে এমন চোয়াল ও শিকারের পদ্ধতি অনন্য। নতুন আবিষ্কৃত এই হেল অ্যান্টের প্রজাতিটি ব্রাজিলের ক্রাটো কনজারভাট-ল্যাজারস্ট্যাট নামে ভূতাত্ত্বিক স্তরের চুনাপাথরে সংরক্ষিত ছিল। ব্রাজিলের সাও পাওলো ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরের গবেষক অ্যান্ডারসন লেপেকো জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি যখন সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরে সংরক্ষিত জীবাশ্মের সংগ্রহ পরীক্ষা করছিলেন, তখনই এই অসাধারণ পিঁপড়ার নমুনাটি তাঁর নজরে আসে। গত ২৪ এপ্রিল কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে: খুঁজে পাওয়া গেছে ১১ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে পিঁপড়ার জীবাশ্ম

৫. বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো তৈরি করলেন ব্ল্যাকহোল বোমা

সম্প্রতি প্রথমবারের মতো গবেষণাগারে ব্ল্যাকহোল বোমা তৈরি করেছেন যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হেনড্রিক উলব্রিখ্ট ও তাঁর দল। রজার পেনরোজের দেওয়া ধারণার ওপর ভিত্তি করে এ উদ্ভাবন করেন তাঁরা। এতে শক্তিকে প্রতিফলক পৃষ্ঠের সাহায্যে আটকে রাখা হয়। বিস্ফোরণ ঘটলে তাই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। তাঁদের তৈরি মডেলটি অবশ্য খুবই ছোট, খেলনার মতো। তাই, বিপদ হওয়ার বড় কোনো শংকা নেই। গবেষকদের এ আবিষ্কারের মূল রহস্যটা অবশ্য শক্তির উৎসকে ঘিরে। তাঁরা যে পদ্ধতিতে শক্তি জমা করছেন, সেটি সত্যিকারের ব্ল্যাকহোলের মতোই কাজ করে। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলো প্রায় একই। তাই বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এ ব্ল্যাকহোল প্রকৃত ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণন ও নানা রহস্য বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ব্ল্যাকহোল বোমার এ গবেষণা ভবিষ্যতে ব্ল্যাকহোলের আচরণ এবং শক্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে জানা যেতে পারে মহাবিশ্বের অজানা অনেক রহস্যের সমাধান।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে: প্রথমবারের মতো ব্ল্যাকহোল বোমা তৈরি হলো গবেষণাগারে

৬. বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে এনেছেন ১২ হাজার বছর আগের বিলুপ্ত হওয়া নেকড়ে

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া নেকড়ের একটি প্রজাতির ফিরিয়ে এনেসেন। ডায়ার নেকড়ে ফিরিয়ে আনার কাজটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লসোল বায়োসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা। এটিই ‘বিশ্বের প্রথম সফলভাবে ডি-এক্সটিংকশন বা বিলুপ্ত প্রাণীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা প্রাণী’। ডায়ার নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম এনোসিয়ন ডিরাস (Aenocyon dirus)। একসময় নেকড়ে প্রজাতিটি উত্তর আমেরিকায় বিচরণ করত। ক্লসোল বায়োসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত এবং ৭২ হাজার বছর পুরনো একটি খুলি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে। তা থেকে তাঁরা তিনটি শাবক পরীক্ষাগারে জন্ম দিয়েছেন। ডায়ার নেকড়ের দুটি পুরুষ ছানা জন্ম নেয় গত বছর ১ অক্টোবর। আর নারী ছানাটি জন্মে এই বছর ৩০ জানুয়ারি। তবে ডায়ার উলফের শাবকগুলোর আচরণ অন্যান্য নেকড়ে প্রজাতির থেকে বেশ আলাদা।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে: না, গেম অব থ্রোনসের ডায়ার উলফ ফিরে আসেনি!

৭. বৃদ্ধ বয়সে আবার গজাবে দাঁত

বৃদ্ধ বয়সে দাঁত হারানোর দিন সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। লন্ডনের কিংস কলেজের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো পরীক্ষাগারে সফলভাবে মানুষের দাঁত তৈরি করতে পেরেছেন। দীর্ঘ এক দশকের গবেষণায় তাঁরা এমন একটি বিশেষ উপাদান আবিষ্কার করেছেন যা দাঁত গজাতে কাজ করবে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে: বুড়ো বয়সের ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতও আবার গজাবে: নতুন গবেষণা

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট, লাইভ সায়েন্স, সিএনএন, নিউ সায়েন্টিস্ট, বিবিসি সায়েন্স, সিবিএস নিউজ, বিজ্ঞানচিন্তা