দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি – ৫

মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।

অধ্যায় এক

মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়

৪. বদলে যাওয়া সমাজ

প্রথাগতভাবে ব্রাহ্মণদের মধ্যে সন্ন্যাসী ভিক্ষুকদের কখনোই ব্যর্থ মানুষ হিসেবে দেখা হতো না। যারা জাগতিক মায়া ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে হাঁটত, তাদের একধরনের সম্মান দেওয়া হতো। ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির গভীরে এই ত্যাগের বা বৈরাগ্যের একটা ধারা সবসময়ই বহমান ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিত ড্যানিয়েল ইনগেলস তাঁর দ্য ব্রাহ্মণ ট্র্যাডিশন প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গত দেড় শ বছর ধরে পশ্চিম ইউরোপের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে শিল্পকলা যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, ভারতের সম্ভ্রান্ত শ্রেণির কাছে বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিকতা বহু শতাব্দী ধরে ঠিক তেমনই গুরুত্ব পেয়ে আসছে।’ মানুষ নিজেরা সন্ন্যাসী হতে পারুক বা না পারুক, অন্তত এই আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানাত বা মৌখিকভাবে হলেও সমর্থন দিত।

এই ঐতিহ্যের কারণে জাগতিক সাফল্যের পেছনে পাগলের মতো ছুটলে মানুষ ভ্রূ কুঁচকাত। বরং মনের ও আত্মার দিক থেকে সমৃদ্ধ জীবনকেই প্রশংসা করা হতো, তা যতই অভাব-অনটনের হোক না কেন। এমনকি ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোও তাদের ঘরবাড়ি এমনভাবে সাজাত, যা পশ্চিমা বা অন্য ধনী ভারতীয়দের তুলনায় ছিল একেবারেই সাদামাটা। আসবাবপত্র ছিল নামমাত্র। মেঝেও থাকতো ফাঁকা। এর পেছনে ছিল এক ধরনের মার্জিত সরলতা। অনেক বছর পর এক দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ এই ঐতিহ্যকে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘সাদামাটা জীবন, কিন্তু উচ্চচিন্তা’ হিসেবে।

ড্যানিয়েল ইনগেলসের দ্য ব্রাহ্মণ ট্র্যাডিশন প্রবন্ধের প্রথম পাতা

কিন্তু রামানুজন যখন বড় হচ্ছিলেন, তখন সময় পাল্টাচ্ছিল। ব্রাহ্মণরা তখনো পুরোহিত, গুরু, তার্কিক, কবি, সংস্কৃত পণ্ডিত এবং সন্ন্যাসী হিসেবে হিন্দু সমাজে বিরাজমান ছিলেন ঠিকই; কিন্তু তাদের সেই পুরোনো ধ্যানী স্বভাব তখন নতুন রূপ নিচ্ছিল। আধ্যাত্মিকতা বদলে যাচ্ছিল জাগতিক পেশাদারিত্বে। ঠিক একই সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ইহুদিরা যেমন পেশাজীবী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছিল, তারাও তেমনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছিল।

গোঁড়া ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত কুম্বকোনমে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে একজন লিখতে ও পড়তে পারত। দক্ষিণ ভারতের আর কোনো জায়গায় শিক্ষার হার এত বেশি ছিল না।

রামানুজনের জন্মের পরের আদমশুমারিতে দেখা যায়, দক্ষিণ ভারতের ছয় লাখ পুরুষ ব্রাহ্মণের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ সরকারি চাকরি, শিক্ষকতা বা ছোটখাটো পেশায় নিয়োজিত ছিল। কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে তারাই ছিল সংখ্যাগুরু। এক প্রজন্মের মধ্যেই ১৯১৪ সালের দিকে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৬৫০ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে ৪৫২ জনই ছিল ব্রাহ্মণ! অর্থাৎ, জনসংখ্যার অনুপাতে তাদের যতটুকু হওয়ার কথা, তারা ছিল তার দশ গুণেরও বেশি।

আগে ব্যবসায়ী বা আইনজীবীদের মতো পুরোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসত তাদের নিজস্ব নির্দিষ্ট কিছু জাত থেকে। কিন্তু ব্রিটিশরা এসে দালাল, এজেন্ট, শিক্ষক, সরকারি আমলা, সাংবাদিক, লেখক এবং সরকারি করণিকদের নিয়ে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলে। আর এই পদগুলোই তখন ব্রাহ্মণরা দখল করতে শুরু করে।

গোঁড়া ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত কুম্বকোনমে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে একজন লিখতে ও পড়তে পারত। দক্ষিণ ভারতের আর কোনো জায়গায়—হয়তো তাঞ্জোর জেলা সদর আর মাদ্রাজ শহর ছাড়া—শিক্ষার হার এত বেশি ছিল না। কুম্বকোনমের ব্রাহ্মণদের মধ্যে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রতি একধরনের ঝোঁক ছিল। তারা মগজের কসরত করতে ভালোবাসত। এক ইংরেজ পর্যবেক্ষক তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এরা তাদের দক্ষতা ও বুদ্ধির সূক্ষ্মতার জন্য বিখ্যাত।’

রামানুজনের বাবা-মা যখন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ছিলেন না, তখনো তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির একেবারে তলানীতেই পড়ে ছিলেন। তাঁরা ইংরেজি জানতেন না, যদিও নিজেদের মাতৃভাষা তামিলে নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু রামানুজনের বন্ধুরা আসত তুলনামূলক সচ্ছল পরিবার থেকে। আর তাদের লক্ষ্য ছিল আইনজীবী, প্রকৌশলী বা সরকারি কর্মকর্তা হওয়া।

আর এই পথে হাঁটতে গিয়ে তাদের সবার সামনে একটাই সাধারণ রাস্তা খোলা ছিল, ইংরেজি ভাষা।

কিন্তু ১৯০০ সালের শুরুর দিকে ঠিক এখনকার মতোই ভারতে ইংরেজি ছিল ক্ষমতার ভাষা। এটি ছিল শাসকদের ভাষা। সরকারি কাজকর্ম, নথিপত্রসহ সব চলত এই ভাষায়।

রামানুজনের মাতৃভাষা ছিল তামিল। এটি দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের অংশ, যার মধ্যে আছে মালয়ালম, কানাড়ি এবং সুরেলা তেলুগু ভাষা। ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তামিল ভাষার প্রশংসা করতেন এর পরিষ্কার যুক্তির জন্য। কেউ একজন একবার বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি ভাষা, যা আইনজীবী ও ব্যাকরণবিদদের দ্বারা তৈরি।’ মাদ্রাজ থেকে শুরু করে উত্তরে নীলগিরি পাহাড়ের পশ্চিম পর্যন্ত, আর দক্ষিণে উপমহাদেশের শেষ প্রান্ত কন্যাকুমারিকা এবং উত্তর শ্রীলঙ্কায় এই ভাষা প্রচলিত ছিল। তামিল পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক ভাষা ছিল না। এর ছিল নিজস্ব সমৃদ্ধ সাহিত্য, যা উত্তরের হিন্দি ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং যার ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কবিতার ছন্দ মনে করিয়ে দিত প্রাচীন গ্রিক কবিতার কথা। প্রায় দুই কোটি মানুষ তখন এই ভাষায় কথা বলত।

কিন্তু ১৯০০ সালের শুরুর দিকে ঠিক এখনকার মতোই ভারতে ইংরেজি ছিল ক্ষমতার ভাষা। এটি ছিল শাসকদের ভাষা। সরকারি কাজকর্ম, নথিপত্রসহ সব চলত এই ভাষায়। ভারতে যেখানে ডজনখানেক আলাদা আলাদা ভাষা প্রচলিত ছিল, সেখানে এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছিল ইংরেজি।

অবশ্য পুরো ভারতের খুব কম মানুষই ইংরেজি জানত। এমনকি অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত তামিল ব্রাহ্মণ পুরুষদের মধ্যেও মাত্র ১১ শতাংশ ইংরেজিতে দক্ষ ছিল। তাই চাহিদা ও জোগানের নিয়ম মেনেই যারা ইংরেজি বলতে ও পড়তে পারত, তারা অন্যদের চেয়ে অনেক দ্রুত এগিয়ে যেত। একজন সামান্য কেরানিও যদি একটু-আধটু ইংরেজি জানত, তবে তার বেতন কয়েক টাকা বেড়ে যেত। সোজা কথায়, বড় কোনো পেশায় ঢোকার টিকিটই ছিল এই ইংরেজি ভাষা।

চলবে…