ধারাবাহিক
দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি – ৪
মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।
অধ্যায় এক
মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়
৩. এক ব্রাহ্মণ বালকের বেড়ে ওঠা
হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরাই ছিলেন জ্ঞানের ধারক, শিক্ষক এবং জীবনযাপনের ব্যাখ্যাকার। কুম্বকোনমের রাস্তায় কিংবা মন্দিরের ভেতরে তাঁদের দেখলেই চেনা যেত। কপালের ওপরের দিকের চুল এমনভাবে কামানো থাকত যে মনে হতো অকালেই বুঝি টাক পড়ে গেছে। কপালে চন্দন বা রঙের ফোটা দিয়ে আঁকা থাকত স্পষ্ট জাতের চিহ্ন। মাথার পেছনে ছোট্ট পনিটেলের মতো টিকি, আর খালি গায়ে আড়াআড়িভাবে পরা সাদা সুতোর পৈতে। কুম্বকোনম ছিল এই প্রথাগত হিন্দুধর্মের শক্ত ঘাঁটি।
দক্ষিণ ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র চার শতাংশ ছিল ব্রাহ্মণ। কিন্তু বাকি হিন্দুদের কাছে তাঁরা ছিলেন ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র। ব্রিটিশরা আসার আগে ধনী ব্যক্তিরা ব্রাহ্মণদের জমি, বাড়ি বা সোনা দান করে পুণ্য অর্জন করতেন এবং পাপ মোচন করতেন বলে বিশ্বাস করা হতো। ব্রাহ্মণরাই ছিলেন মন্দিরের পুরোহিত, জ্যোতিষী, গুরু এবং পবিত্র আইন ও বেদের ব্যাখ্যাকার পণ্ডিত। বিয়ে থেকে শুরু করে শেষকৃত্য; জীবনের প্রতিটি ধাপে তাঁরা ছিলেন অপরিহার্য। ভারতীয় বর্ণপ্রথায় তাঁদের স্থান ছিল সবার ওপরে।
সে সময় ব্রিটিশ লেখকরা ভারত নিয়ে বই লিখলে তাতে বর্ণপ্রথার ভয়াবহতা তুলে ধরতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাঁরা লিখতেন পূর্বজন্মে পাপ করার শাস্তি হিসেবেই মানুষকে নিচু জাতে জন্ম নিতে হয়। তাঁদের বর্ণনায় চারটি জাতের কথা থাকত। সবার ওপরে ব্রাহ্মণ। এরপর ক্ষত্রিয় বা যোদ্ধা; বৈশ্য বা ব্যবসায়ী এবং সবশেষে শূদ্র বা সেবক। এর বাইরে পঞ্চম একটি দল ছিল অস্পৃশ্য বা অন্ত্যজ শ্রেণি। তারা বর্ণপ্রথারও বাইরে। প্রথম তিন জাতের মানুষেরা পবিত্র সুতো বা পৈতে পরার অধিকার পেত। এই সুতোই তাদের দুবার জন্ম নেওয়া মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিত। শূদ্ররা পৈতে পরতে পারত না, তবে মন্দিরে ঢুকতে পারত। কিন্তু অস্পৃশ্যদের সেই অধিকারটুকুও ছিল না। তারা গ্রামের কুয়ো থেকে পানি নিতে পারত না। প্রথা অনুযায়ী, এমনকি তাদের ছায়া যদি কোনো ব্রাহ্মণের ওপর পড়ত, তবে সেই ব্রাহ্মণকে স্নান করে শুদ্ধ হতে হতো।
হিন্দু ধর্মের সব মানুষই পুনর্জন্ম আর কর্মফলের তত্ত্বে বিশ্বাস করত। রামায়ণ-মহাভারতের একই গল্প শুনত এবং লালন করত একই মূল্যবোধ।
তবে জাত-পাতের এই পুঁথিগত বিভাজন দক্ষিণ ভারতে পুরোপুরি খাটত না। কারণ দক্ষিণে ক্ষত্রিয়দের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। তা ছাড়া, এই তত্ত্বে ভারতের হাজার হাজার উপজাত বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া হতো। একেকটি উপজাতের নিজস্ব নিয়ম ছিল। কে কার সঙ্গে খাবে বা কাকে বিয়ে করবে, তাও ছিল নিয়মে। এই ভাগগুলো মূলত পেশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। যেমন কৃষিজীবী, নাপিত, তাঁতি বা ছুতোরদের আলাদা জাত ছিল। মানুষ আসলে এই উপজাত বা জাতির মাধ্যমেই পরিচিত হতো। রামানুজন ছিলেন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ; তাঁর নামের আয়েঙ্গারই বলে দিত তিনি কোন গোত্রের।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিবের এই দেবকুলে বৈষ্ণবরা—ব্রাহ্মণদের প্রতি চারজনের একজন—বিষ্ণুকেই তাদের ভক্তির মূল কেন্দ্র মনে করত। এর ভেতরেও আবার ভাগ ছিল। ঈশ্বরের কৃপা পেতে মানুষের নিজের চেষ্টার কতটা প্রয়োজন, তা নিয়ে মতভেদ ছিল তেঙ্গলাই এবং বেদগলাই শাখার মধ্যে। এই পার্থক্যটা অনেকটা খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টান্ট কিংবা লুথারান আর মেথডিস্টদের পার্থক্যের মতো। আর পশ্চিমাদের মতোই এই পার্থক্যগুলো যতটা না ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে, তার চেয়ে বেশি ছিল স্টাইল, সুর, আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐতিহাসিক ঘটনার জের ধরে।
হিন্দু ধর্মের সব মানুষই পুনর্জন্ম আর কর্মফলের তত্ত্বে বিশ্বাস করত। রামায়ণ-মহাভারতের একই গল্প শুনত এবং লালন করত একই মূল্যবোধ। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, বৈষ্ণব ব্রাহ্মণরা কখনোই শৈব ব্রাহ্মণদের বিয়ে করত না। শিবের উপাসকদের বলা হয় শৈব ব্রাহ্মণ। প্রত্যেক গ্রুপের নিজস্ব মন্দির ও শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। রামানুজন তাঁর কপালে যে তিলক বা চিহ্ন পরতেন, তা ছিল একটা চওড়া সাদা ‘U’ আকৃতির দাগ। এর মাঝখান দিয়ে একটা লাল রঙের লম্বালম্বি দাগ টানা হতো। একে বলে নামম। এটি ছিল শৈবদের কপালের তিনটি আড়াআড়ি সাদা দাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
জাত-পাতের দেওয়াল সবচেয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়াত খাবার সময়ে। একজন ব্রাহ্মণ কেবল অন্য ব্রাহ্মণের সঙ্গেই খেতেন এবং কেবল অন্য ব্রাহ্মণের হাতে রাঁধা খাবারই মুখে তুলতেন। শহরের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে যদি ব্রাহ্মণ রাঁধুনি থাকত, তবে সেটা বড় করে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হতো। বাড়ির বাইরে গেলে একজন ব্রাহ্মণ খাবারের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে খেতেন না। তীর্থযাত্রায় গেলে ব্রাহ্মণ পরিবারগুলো রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেত, তবুও অজানা কারও হাতের রান্না মুখে দিত না।
কলাপাতার ঠিক মাঝখানে ভাত দেওয়া হতো। পাতাটা হতো বেশ বড়; সতেজ, সবুজ, আর মাঝখানে শক্ত শিরদাঁড়া। পাতার চারপাশে সাজানো থাকত কড়া স্বাদের ফলের আচার বা সবজি...
বেশিরভাগ সময় একজন ব্রাহ্মণ পুরুষের খাবার রাঁধতেন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু স্বামী কখনোই স্ত্রীর সঙ্গে বসে খেতেন না। ইংরেজরা এই প্রথাকে খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধী ও জঘন্য বলে মনে করত। বাড়ির মহিলারা পুরুষ ও শিশুদের জন্য খাবার রেঁধে রুপা, তামা বা পিতলের বাসনে পরিবেশন করতেন। চিনামাটির বাসনকে যথেষ্ট পবিত্র মনে করা হতো না। পুরুষরা খাওয়ার সময় মহিলারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে খাবার বেড়ে দিতেন, আর পুরুষরা ভাবলেশহীনভাবে খেয়ে উঠে যেতেন। হাত-মুখ ধোয়ার পর মহিলারা রান্নাঘরে গিয়ে যা অবশিষ্ট থাকত, তা-ই খেতেন।
রামানুজন মেঝেতে বসে খেতেন। সামনে থাকত গোল ধাতব থালা কিংবা কলাপাতা। খাওয়া শেষে কাগজের প্লেটের মতো সেই পাতা ফেলে দেওয়া হতো। তিনি হাত দিয়ে খেতেন। তবে পশ্চিমাদের মতো রুটি দিয়ে ঝোল বা খাবার তুলে খাওয়া নয়। উত্তরের প্রধান খাবার ছিল গম, কিন্তু দক্ষিণের ছিল ভাত। সেখানে রুটির চল ছিল না। তাই রামানুজন ঠিক সেভাবেই খেতেন, যেভাবে পশ্চিমা শিশুদের খেতে বারন করা হয় কিন্তু তারা সেভাবেই খায়। অর্থাৎ আঙুল দিয়ে।
কলাপাতার ঠিক মাঝখানে ভাত দেওয়া হতো। পাতাটা হতো বেশ বড়; সতেজ, সবুজ, আর মাঝখানে শক্ত শিরদাঁড়া। পাতার চারপাশে সাজানো থাকত কড়া স্বাদের ফলের আচার বা সবজি, মশলাদার ফলের চাটনি, আলু আর ডাল দিয়ে তৈরি ঘন স্যুপ বা সাম্বার এবং দই। সাধারণ দিনে অল্প কিছু পদ থাকলেও উৎসবের দিনে ডজনখানেক পদও থাকত। রামানুজন ডান হাতের আঙুল দিয়ে ভাতের সঙ্গে অন্য পদগুলো মাখাতেন। তারপর চার আঙুল আর বুড়ো আঙুল দিয়ে সেই মাখানো ভাত দলা পাকিয়ে মুখে পুরে দিতেন।
দক্ষিণ ভারতীয় খাবার ছিল সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। যদিও সবসময় বেশি ঝাঁঝালো স্বাদের হতো না। তবে খাবার কখনোই বিস্বাদ লাগত না; তরকারিগুলো হতো ঝাল ও মশলাদার, আর অন্যগুলো হয়তো খুব মিষ্টি। ভাত আর দই পুষ্টির পাশাপাশি ওই কড়া মশলার ঝাল কমাতে সাহায্য করত। নারকেল আর কাঁচকলা ছিল প্রধান ফল, সঙ্গে আম আর পেয়ারা তো ছিলই।
যদিও অনেকে ব্রাহ্মণদের অহংকারী বলে মনে করত, কিন্তু ব্রাহ্মণরা নিজেরা গর্ববোধ করতেন এই ভেবে যে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব লোকটিও অন্যদের চেয়ে বেশি পরিষ্কার এবং পবিত্র।
রামানুজন যে মাংস খেতেন না, সেটা কিন্তু কোনো কষ্টকর ত্যাগ স্বীকার ছিল না। প্রায় সব ব্রাহ্মণের মতোই তিনি ছিলেন কট্টর নিরামিষভোজী। তবে মাংস তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল, এ কথা বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হবে না। একজন গোঁড়া ইহুদি বা মুসলমানকে যেমন শুকরের মাংস না খাওয়ার জন্য আলাদা করে নিষেধ করতে হয় না, ব্যাপারটা ছিল তেমনই; ওটা খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অন্যরা মাংস খেত, তিনি খেতেন না। মাংস খাওয়ার কথা ভাবলেই হয়তো তাঁর বমি চলে আসত। এমনকি তাঁর কিছু বন্ধু বিটরুটের মতো সবজিও এড়িয়ে চলত, কারণ এর লাল রং রক্তের কথা মনে করিয়ে দিত।
ব্রাহ্মণ জীবনের এই সব নিয়মকানুন—কী করা যাবে আর কী যাবে না—রামানুজন ঠিক ততটাই স্বাভাবিকভাবে শিখেছিলেন, যতটা স্বাভাবিকভাবে তিনি হাঁটতে বা কথা বলতে শিখেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানী জি. মরিস কার্সটেয়ার্স এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘শিশু যেমন নিজের শরীর পরিষ্কার রাখতে শেখে, ঠিক তেমনি তাকে শেখানো হতো নিচু জাতের মানুষের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে। ভুলবশত যদি ছোঁয়া লেগে যেত, তবে মা বা দাদি তাকে ডেকে নিয়ে স্নান করাতেন এবং কাপড় বদলে দিতেন। একসময় নিচু জাতের মানুষের স্পর্শ লাগলে তাদের ঠিক তেমনই অনিচ্ছাকৃত ঘৃণা লাগত, যেমনটা মলমূত্রের গন্ধ বা স্পর্শ লাগলে মানুষের হয়।’
প্রতিদিন সকালে একজন হিন্দু পুরুষকে এক দীর্ঘ ও বিস্তারিত পরিচ্ছন্নতা পর্ব পার করতে হতো। মলত্যাগের পর তিনি কেবল বাঁ হাত দিয়ে পানি ব্যবহার করে নিজেকে পরিষ্কার করতেন। এরপর সম্ভব হলে কাবেরীর মতো কোনো পবিত্র নদীতে স্নান করতেন। তা না হলে খুব সতর্কভাবে কান, চোখ ও নাক পরিষ্কার করতেন। জলপানের সময় তিনি কখনোই গ্লাস বা পাত্র ঠোঁটে লাগাতেন না, বরং ওপর থেকে মুখে পানি ঢেলে খেতেন। খাওয়ার পর তিনি নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে উঠে যেতেন এবং সাড়ম্বরে হাতে পানি ঢেলে ধুয়ে নিতেন। ইংরেজ পর্যটকেরা ভারতের নোংরা পরিবেশ আর আধুনিক স্যানিটেশনের অভাব দেখে নাক সিটকাতেন ঠিকই, কিন্তু হিন্দু জীবনে, বিশেষ করে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে খুঁতখুঁতে পরিচ্ছন্নতাবোধ ছিল, তা ছিল অতুলনীয়।
যদিও অনেকে ব্রাহ্মণদের অহংকারী বলে মনে করত, কিন্তু ব্রাহ্মণরা নিজেরা গর্ববোধ করতেন এই ভেবে যে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব লোকটিও অন্যদের চেয়ে বেশি পরিষ্কার এবং পবিত্র। তাঁরা গর্ব করতেন কারণ সবচেয়ে কম শিক্ষিত ব্রাহ্মণও হিন্দুধর্মের পবিত্র ভাষা সংস্কৃত কিছুটা হলেও জানে; সমাজ তাঁদের শ্রদ্ধা করে এবং মেধা ও পেশাগত দিক থেকে তাঁরা অন্যদের চেয়ে সেরা। এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁদের মধ্যে এক সর্বজনীন বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণরা সত্যিকার অর্থেই ঈশ্বরের নির্বাচিত মানুষ। রামানুজনও যে তা বিশ্বাস করতেন না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
