বুদ্ধির ব্যায়াম
কীভাবে ব্রিজ পার হবে
চারজন মানুষ। একটি টর্চ। সর্বোচ্চ দুজন একসঙ্গে ব্রিজ পাড়ি দিতে পারবে। অন্ধকারে ব্রিজ পাড়ি দিতে সময় লাগে যথাক্রমে ১, ২, ৫ ও ১০ মিনিট। ১৭ মিনিটের মধ্যে পাড়ি দিতে হবে ব্রিজটি। কীভাবে?
উল্লাস গণিতপ্রেমী। সবসময় গণিত নিয়ে আলোচনা করার জন্য মনটা উসখুস করে। কিন্তু জুতসই কাউকে পায় না। বন্ধুরাও ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে চায় না ও গণিতের কারণে। সুযোগ পেলেই হলো। শুরু করে গণিতের ইতিহাস। তাই ওর ধারেকাছে কেউ ঘেঁষতে চায় না। বেচারা কী আর করবে! ও ভাবছে কোনো একটি ল্যাবে ইন্টার্নশিপ করবে। যোগাযোগ করেছে দেশের বেশ কয়েকটি নামকরা ল্যাবে। কিন্তু সুযোগ মেলেনি। অবশেষে গত সপ্তাহে ওর কপাল খুলেছে। একটি ল্যাব যোগাযোগ করেছে ওর সঙ্গে। একটা সুযোগ দিতে চায়। আজ উৎসাহিত উল্লাস যাচ্ছে সেই ল্যাবে।
ল্যাবটা চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ের চূড়ায়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। এমনিতে সুযোগ পাওয়া যায় না। আর একটা সুযোগ পেয়ে তা হাতছাড়া করতে চায় না ও। সাতপাঁচ না ভেবে রওনা দিয়েছে পাহাড়ের সেই ল্যাবের উদ্দেশ্যে। অনেক চড়াই উতরাই পেড়িয়ে পৌঁছে গেছে ল্যাবের প্রায় কাছাকাছি। সামনে একটা ব্রিজ। এটা পেরোতে পারলেই পৌঁছে যাবে ল্যাবে। তবে সমস্যা হলো, ব্রিজটা অনেক পুরানো। কাঠের তৈরি। দড়ি দিয়ে কাঠের টুকরো বেঁধে বেঁধে বানানো হয়েছে ব্রিজটি। সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় আরকি। কিন্তু উল্লাস ভয় না পেয়ে উঠে পড়লো ব্রিজে। মিনিটখানেকের মধ্যে ব্রিজ পেরিয়ে চলে গেল ল্যাবের সামনে। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল ল্যাবের দরজার দিকে। উল্লাস বুঝতে পারছে না, এই নির্জনে কেন একটা ল্যাব বানিয়ে বসে আছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা কী নিয়ে গবেষণা করছে, তাও উল্লাস জানে না। শুধু জানে, এই ল্যাবে গণিত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ পাবে। ব্যস ওতেই হবে। বেশি না ভেবে সোজা চলে এসেছে এখানে। পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
দরজার সামনে যেতেই বয়স্ক একজন দারোয়ান উল্লাসকে ভেতরে নিয়ে গেল। একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেল। উল্লাস অপেক্ষা করছে। ১০ মিনিট … ২০ মিনিট…। না, কারো সাড়াশব্দ নেই। কিছুটা বিরক্ত হলো। উঠে পায়চারি শুরু করেছে। হঠাৎ ওর চোখ গেল একটি মেশিনের দিকে। এগিয়ে গেল। একটি মাত্র বাটন মেশিনে। বুঝতে পারছে না কী ওটা। হঠাৎ দারোয়ান ও ল্যাব সহকারী চলে আসায় চমকে ওঠে উল্লাস। আর তাতেই ঘটে বিপত্তিটা। বাটনে চাপ লেগে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগে প্রিয়ন্তি নামের ল্যাব সহকারী চিৎকার করে ওঠেন। চিৎকারের কারণ অবশ্য বুঝলো না উল্লাস।
তবে আপনাদের জানিয়ে রাখি। এই ল্যাবে বিজ্ঞানীরা প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করছেন বহুদিন। সচরাচর কেউ এখানে আসেন না। ল্যাবের প্রধান গবেষক গিল হার্ভের সঙ্গে ২৫ বছর বয়সী প্রিয়ন্তি এখানে কাজ করেন। কিছু প্রাণীদের পরীক্ষা করতে গিয়ে সেগুলো ভয়ংকর জম্বিতে পরিণত হয়েছে। সেগুলোকে আটকে রাখা হয়েছে একটি কক্ষে। কিন্তু উল্লাস ভুলে ওই বাটনে চাপ দিয়ে জম্বিদের দরজাটা খুলে দিয়েছে।
ভয়ানক জম্বিগুলো বাইরে বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বাঁচতে হলে এখনি পালাতে হবে। দৌড় শুরু করেছে চারজনই। রাত নেমেছে। অন্ধকারে পথ দেখা যাচ্ছে না ভালো। হাতের কাছে থাকা দারোয়ানের টর্চটা নিয়েই ওরা বেরিয়ে পড়েছে। প্রধান গবেষক গিল হার্ভের বয়স প্রায় ৭০ বছর। তিনি দ্রুত হাঁটতে পারেন না। ধরাধরি করে তাঁকে ব্রিজ পর্যন্ত আনা হয়েছে। এখন পাড়ি দিতে হবে ওই নড়বড়ে ব্রিজটা। তবে সবাই একসঙ্গে ব্রিজ পাড়ি দিতে পারবেন না। তাতে ব্রিজ ভেঙে যাবে।
সামনের ভয়াবহতা দেখে মাটিতে বসে পড়লেন হার্ভে। এর মধ্যেই হিসেব করে বের করলেন, জম্বিগুলো ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছাতে লাগবে ১৭ মিনিট। তার আগেই ব্রিজ পাড়ি দিয়ে কেটে দিতে হবে ব্রিজের দড়ি। তাহলে জম্বিগুলো আর ওদের ধরতে পারবে না। পড়বে গিয়ে নদীতে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা আছে। ব্রিজের ওপর একসঙ্গে দুজনের বেশি উঠলে দড়ি ছিড়ে নিচে পড়তে হবে। আর নিচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে কুমিরের পেটে। ওদের দলের সবাই এক সময়ে ব্রিজ পাড়ি দিতে পারে না। উল্লাসের ব্রিজটা পাড়ি দিতে সময় লাগবে ১ মিনিট। প্রিয়ন্তির ২ মিনিট ও দারোয়ানের ৫ মিনিট। আর বুড়ো গিল হার্ভের সময় লাগে ১০ মিনিট। সমস্যা আরও আছে। টর্চ ছাড়া তাঁরা ব্রিজ পাড়ি দিতে পারবে না। ভুল জায়গায় পা ফেললেই সোজা কুমিরের পেটে। অর্থাৎ, প্রথমে দুজন টর্চ নিয়ে ব্রিজ পাড়ি দিলেও কোনো একজনকে টর্চ নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। উল্লাস গণিতপ্রেমী মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে সে ব্রিজ পার হওয়ার একটা উপায় বের করে ফেলেছে। সবাইকে নিয়ে কোনো বিপদ ছাড়াই পৌঁছে গেছে ব্রিজের অন্য প্রান্তে। ওর এই বুদ্ধির জোরেই আজ বেঁচে গেছে সবাই। অবশ্য ভুলে বাটনটা চাপ না দিলে এ বুদ্ধি খাটাতে হতো না। যাহোক, আপাতত ওর ভুলটাকে কেউ বড় করে দেখছে না।
এখন আপনাকে সমাধান করতে হবে, উল্লাস কীভাবে সবাইকে নিয়ে ১৭ মিনিটের মধ্যে ব্রিজটা পাড়ি দিল?
সমাধান:
ব্রিজ পাড়ি দিতে যে দুজনের সবচেয়ে কম সময় লাগবে, তাঁরা প্রথমে টর্চ নিয়ে ওপারে যাবে। মানে উল্লাস আর প্রিয়ন্তি। দুজনের ওপারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ২ মিনিট। কারণ উল্লাস এক মিনিটে ওপারে পৌঁছে গেলেও প্রিয়ন্তির লাগবে ২ মিনিট। ওদের দুজনের ওপারে পাড়ি দিতে সময় গেল মোট ২ মিনিট। প্রিয়ন্তি ব্রিজ পাড়ি দেওয়ার পরে উল্লাস তাঁর থেকে টর্চটা নিয়ে ফিরে আসবে দারোয়ান ও গিল গার্ভের কাছে। এতে সময় লাগবে আরও ১ মিনিট। কারণ উল্লাস এক মিনিটেই ব্রিজটি পাড়ি দিতে পারে। তাহলে মোট সময় গেল ৩ মিনিট। হাতে আছে আর ১৪ মিনিট। এরপর টর্চ নিয়ে দারোয়ান ও গিল হার্ভে ধীরেসুস্থে ব্রিজ পাড়ি দিবে। এই দুজনের সময় লাগবে ১০ মিনিট। হাতে সময় থাকবে আর মাত্র ৪ মিনিট। তাঁরা দুজন ব্রিজের ওপারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ন্তি ২ মিনিটে টর্চ নিয়ে উল্লাসের কাছে ফিরে আসবে। হাতে সময় থাকবে আরও ২ মিনিট। এই ২ মিনিটে প্রিয়ন্তি আর উল্লাস আবার প্রথমবারের মতো ব্রিজ পাড়ি দিয়ে চলে যাবে ওপারে।
লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা