১২৫ বছরের পুরোনো হিলবার্টের গাণিতিক রহস্যের সমাধান

আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগের কথা। ১৯০০ সালে প্যারিসের বিখ্যাত সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতবিদদের এক বিশাল সম্মেলন বসেছে। সেখানে ছিলেন তখনকার কিংবদন্তী গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট। তিনি ভবিষ্যতের গণিতবিদদের জন্য মোট ২৩টি অমীমাংসিত সমস্যার একটা তালিকা তৈরি করেন। এগুলো সমাধান করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব ছিল। হিলবার্টের আশা ছিল, আগামী শতাব্দীতে গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাগুলোর সমাধানেই ব্যস্ত থাকবেন।

সেই ২৩টি সমস্যার মধ্যে ছয় নম্বর সমস্যাটি ছিল সবচেয়ে রহস্যময় আর কঠিন। হিলবার্ট চেয়েছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের সব তত্ত্বকে গণিতের একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে। মানে, পদার্থবিজ্ঞানের নানান সূত্র যে সত্যি, তা যেন গণিতের একটি অকাট্য যুক্তি দিয়ে ধাপে ধাপে প্রমাণ করা যায়।

গত ১২৫ বছর কেউ এই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তবে সম্প্রতি একদল গণিতবিদ দাবি করেছেন, তাঁরা এই রহস্য উন্মোচন করেছেন। সত্যিই যদি হিলবার্টের ছয় নম্বর সমস্যার সমাধান হয়, তাহলে তা বিজ্ঞানের জগতে এক বিরাট অর্জন হবে।

এবার আপনাকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুব কাছ থেকে পানি না দেখে একটু দূর থেকে দেখতে হবে। তখন আর পানির প্রত্যেকটা কণাকে আলাদাভাবে দেখা যাবে না।

এবার হিলবার্টের ষষ্ঠ সমস্যার সমাধান দেখা যাক। বিষয়টা বুঝতে হলে আমাদের তরল বা গ্যাসীয় পদার্থের আচরণ সম্পর্কে একটু জানতে হবে। বিজ্ঞানীরা তরল পদার্থের গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি আলাদা তত্ত্ব ব্যবহার করেন। এই তিনটি তত্ত্বের মধ্যে কোনোভাবে সংযোগ প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। মানে তিনটি তত্ত্বকে একসূত্রে গাঁথা যাচ্ছিল না। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সেই সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন। এটা সহজে বোঝার জন্য একটি বহমান নদীকে তিনভাবে দেখতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রথমে তাকাতে হবে অণুর ক্ষুদ্র জগতে। আপনি যদি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নদীর পানি দেখেন, তাহলে দেখবেন কোটি কোটি অণু একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। আর পানির কোণাগুলো বিলিয়ার্ড বলের মতো ছোটাছুটি করছে। এই কণাগুলোর গতিবিধি নিউটনের সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এটা হলো মাইক্রোস্কোপিক বা ক্ষুদ্রতম স্তর।

দ্বিতীয় স্তর হলো মাঝারি জগৎ। মানে, এবার আপনাকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুব কাছ থেকে পানি না দেখে একটু দূর থেকে দেখতে হবে। তখন আর পানির প্রত্যেকটা কণাকে আলাদাভাবে দেখা যাবে না। আর কোণাগুলো আলাদাভাবে দেখা না গেলে তো গণনা করাও সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীরা একটি গড় হিসাব করেন। যেমন, হাজার হাজার কণার মধ্যে একটি কণা কেমন আচরণ করতে পারে, তার একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেন। ১৮৭২ সালে এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ লুডভিগ বোলজম্যান। এই সমীকরণকে বলা হয় বোলজম্যান সমীকরণ। এটা হলো মেসোস্কোপিক বা মাঝারি স্তর।

আর তৃতীয় স্তর হলো আমরা খালি চোখে যা দেখি। মানে খালি চোখে যেভাবে নদীকে দেখি, সেটাই তৃতীয় স্তর। এখানে আমরা কোনো কণা দেখি না, শুধু দেখি পানির স্রোত। এই স্তরের গতিবিধি ব্যাখ্যা করার জন্য রয়েছে অয়লার এবং নেভিয়ার-স্টোকসের সমীকরণ। উড়োজাহাজ কীভাবে বাতাসে ওড়ে বা আবহাওয়া কেমন থাকবে, তা এই সূত্রগুলো দিয়েই হিসাব করা হয়। এটা হলো ম্যাক্রোস্কোপিক বা বড় স্তর।

এই সাফল্য হিলবার্টের ষষ্ঠ সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাধান করেছে। এটা অন্যান্য পদার্থবিজ্ঞানের শাখায়ও অনুরূপ কাজের পথ খুলে দিতে পারে। হয়তো আরও অনেক তত্ত্বের মধ্যে গাণিতিক সংযোগ আবিষ্কৃত হবে ভবিষ্যতে।

এই তিনটি স্তরই আদতে একই নদীর স্রোতকে ব্যাখ্যা করছে। তাই এদের মধ্যে একটি গাণিতিক সংযোগ থাকা উচিত। মানে, নিউটনের কণার সূত্র থেকে ধাপে ধাপে বোলজম্যানের সমীকরণ আসা উচিত, এবং সেখান থেকেই অয়লার ও নেভিয়ার-স্টোকসের সমীকরণে। একটা গাছের মূল থেকে যেমন কাণ্ড বের হয় এবং কাণ্ড থেকে ডালপালা, ঠিক তেমনি।

আরও পড়ুন

কিন্তু গত ১২৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এই সংযোগটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে, ক্ষুদ্র কণার জগৎ থেকে মাঝারি জগতের তত্ত্বটি কীভাবে প্রমাণ করা যায়, তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেউ কেউ অবশ্য কিছু বিশেষ অবস্থায় সংযোগ দেখাতে পেরেছিলেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সমাধান পাওয়া যায়নি।

অবশেষে মিলল সেই সমাধান। চলতি বছর তিন গণিতবিদ এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তাঁরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ দেং এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহের হানি ও শিয়াও মা। তাঁরা একটি নতুন গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করেছেন। সেখানে দেখিয়েছেন, কোটি কোটি ক্ষুদ্র কণার সংখ্যা যখন অসীমের দিকে যায় এবং তাদের আকার চলে আসে শূন্যের কাছাকাছি, তখন সেগুলোর গড় আচরণ ঠিক বোলজম্যান সমীকরণকে অনুসরণ করে।

এই সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল সময়। আগে বিজ্ঞানীরা শুধু এক মুহূর্তের জন্য এই সংযোগ প্রমাণ করতে পারতেন। কিন্তু এই তিন গণিতবিদ দেখিয়েছেন, দীর্ঘ সময় কণাগুলো ছোটাছুটি করলেও এদের গড় আচরণের সূত্র একই থাকে।

এই আবিষ্কারের ফলে পদার্থবিজ্ঞানের তিনটি ভিন্ন তত্ত্বকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে, আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই তরল পদার্থকে দেখি না কেন, তার পেছনের মূল সত্যটি একই এবং তা গাণিতিকভাবে প্রমাণিত। 

আপনি যদি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নদীর পানি দেখেন, তাহলে দেখবেন কোটি কোটি অণু একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। আর পানির কোণাগুলো বিলিয়ার্ড বলের মতো ছোটাছুটি করছে।

এই সাফল্য হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো পরিবর্তন আনবে না। কিন্তু এটি আমাদের বিজ্ঞান ও গণিতের ভিত্তিকে আরও অনেক বেশি মজবুত করবে। বিজ্ঞানীরা এখন আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবেন, তাঁরা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য যে সূত্রগুলো ব্যবহার করছেন, সেগুলো শুধু অনুমান নয়, বরং গণিতের কঠিন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

এই সাফল্য হিলবার্টের ষষ্ঠ সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সমাধান করেছে। এটা অন্যান্য পদার্থবিজ্ঞানের শাখায়ও অনুরূপ কাজের পথ খুলে দিতে পারে। হয়তো আরও অনেক তত্ত্বের মধ্যে গাণিতিক সংযোগ আবিষ্কৃত হবে ভবিষ্যতে।

গবেষেকরা আশা করছেন, এ ধরনের নতুন পদ্ধতি অন্যান্য জটিল সমস্যার সমাধানেও কাজে লাগবে। পদার্থবিজ্ঞানের আরও গভীর রহস্য উন্মোচনের পথ খুলে যেতে পারে এই সমাধানের মাধ্যমে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও নিউ সায়েন্টিস্ট

আরও পড়ুন