বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল? দেখে নিন একনজরে

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতি মুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. এআই দিচ্ছে নিখুঁত আবহাওয়া পূর্বাভাস

আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও নিখুঁতভাবে পেতে মাইক্রোসফট একটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল বানিয়েছে। এই মডেল বাতাসের গুণগত মান, আবহাওয়ার প্যাটার্ন বা ধরন, জলবায়ুর জন্য বাড়তি যেসব ঝড় হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় (ট্রপিক্যাল) অঞ্চলে—সেগুলো বর্তমান বৈশ্বিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের চেয়েও ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারে। পাশাপাশি এটি সে অনুযায়ী আরও নিখুঁত পূর্বাভাসও দিতে পারে।

এই মডেলের নাম দেওয়া হয়েছে অরোরা। মডেলটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি। কিন্তু পরীক্ষা করার জন্য এ মডেল ব্যবহার করে ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস বের করা হয়েছে। মডেলটি সাধারণ আবহাওয়ার পাশাপাশি হারিকেন ঝড়ের গতিপথ আরও নিখুঁতভাবে অনুমান করেছে। এই মডেলের খরচও তুলনামূলক কম। বিশ্বখ্যাত নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বিষয়টি উঠে এসেছে।

এই উন্নত প্রযুক্তির পেছনে ভূমিকা রেখেছে জাপানি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী স্যুকুরো মানাবে, জার্মান বিজ্ঞানী ক্লাউস হাসেলমান এবং ইতালীয় বিজ্ঞানী জর্জিও পারিসির গবেষণা। ফিজিক্যাল কমপ্লেক্স সিস্টেম বা জটিল ভৌত ব্যবস্থা নিয়ে বৈপ্লবিক কাজ করার জন্য তাঁরা ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসব্যবস্থা। তবু এই মডেলও অনেক ক্ষেত্রে নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারে না।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: বৈশ্বিক আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের চেয়েও নিখুঁত পূর্বাভাস দিচ্ছে এআই

২. বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর নতুন প্রযুক্তি

মিথেন গ্যাস নিয়ে আলোচনা করছেন আবেদ চৌধুরী

জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী ও তাঁর দল কারভুলেরিয়া ফাঙ্গি (Curvularia Fungi) নামে এক বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক ছত্রাক উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি গবাদিপশুর হজম প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন মিথেন গ্যাস ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম। ২০২৫ সালের মার্চে নেদারল্যান্ডসের বায়োটেকনোলজি রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত হয় গবেষণাপত্রটি।

পৃথিবী দিন দিন গরম হয়ে উঠছে। এর প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এর জন্য দায়ী বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং জলীয় বাষ্পের মতো গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকে যায়। এগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাবে পরিচিত। এসব গ্যাসের কারণেই পৃথিবীর দিন দিন উষ্ণ হয়ে উঠছে। এর মধ্যে অন্যতম মিথেন গ্যাস। অনেক ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে মিথেন তৈরি করে। এই ব্যাকটেরিয়া জলাভূমি ও প্রাণীদের অন্ত্রে বাস করে। তবে মিথেন আসে গবাদিপশু, অর্থাৎ গরু, ছাগল আর মহিষের পেট থেকে। জাবর কাটা এই প্রাণীগুলোর হজম প্রক্রিয়ার সময় ঢেকুর, নিঃশ্বাস ও বর্জ্য ত্যাগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে।

বৈশ্বিকভাবে প্রতিবছর এ ধরনের গবাদিপশু থেকে নির্গত হয় প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন মিথেন। বাংলাদেশের গবাদিপশু খাত থেকেও প্রতিবছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য মিথেন নির্গত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গবাদি পশু থেকে মিথেন নির্গমন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: ক্ষতিকর মিথেন নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর নতুন প্রযুক্তি

৩. প্রথম এআই হাসপাতাল চালু হলো চীনে

স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত হাসপাতাল চালু করেছে চীন। হাসপাতালটির নাম দেওয়া হয়েছে এজেন্ট হাসপাতাল। ভার্চুয়াল এই মেডিকেল সেন্টারটি বানিয়েছে চীনের চিংহুয়া ইউনিভার্সিটি। এই মেডিকেল সেন্টারে কাজ করছে ১৪ জন এআই ডাক্তার এবং ৪ জন এআই নার্স।

এজেন্ট হাসপাতাল বিশ্বের প্রথম হাসপাতাল যেখানে কোনো ডাক্তারের সহায়তা ছাড়াই রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। এই হাসপাতাল মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ১০ হাজার রোগীকে সহায়তা দিতে পারবে। এই পরিমাণ রোগীকে সেবা দিতে সাধারণ ডাক্তারদের বছরের পর বছর সময় লাগে। চীনা গবেষকরা আশা করছেন, যে সব দেশে জনসংখ্যা বেশি, সে সব দেশে এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এআই ডাক্তাররা দ্রুত সেবা দেওয়ার পাশাপাশি নির্ভুলভাবে চিকিৎসা করতে পারবে। লার্জ ল্যাংগুয়েজে মডেল (LLM) ব্যবহার করছে এআই ডাক্তাররা। এজেন্ট হাসপাতালের এআই ডাক্তাররা যুক্তরাজ্যের মেডিকেল লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ৯৩ শতাংশের বেশি স্কোর করেছে, যা অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের রোগ নির্ণয়ের সক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি। রোগীর চিকিৎসার বাইরেও এজেন্ট হাসপাতাল এআই শিক্ষার্থীদের জন্য একটা অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: চীনে চালু হলো প্রথম এআই হাসপাতাল

৪. সীসাকে স্বর্ণে পরিণত করলেন বিজ্ঞানীরা

সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের পদার্থবিজ্ঞানীরা অ্যালিস নামে একটি পরীক্ষায় চালান। বিজ্ঞানীরা সীসার পরমাণু একে অপরের দিকে তীব্র গতিতে ছুঁড়ে মারেন। উদ্দেশ্য ছিল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরের অবস্থার একটা প্রতিরূপ তৈরি করা। এই সংঘর্ষে সবসময় সরাসরি ধাক্কা লাগে না। বেশিরভাগ সময় সীসার পরমাণুগুলো খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। একে বলে নিয়ার-মিস বা প্রায় সংঘর্ষ হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে কণাগুলো একে অপরের প্রতি প্রবল বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল প্রয়োগ করে। প্রায় সংঘর্ষের সময় প্রচণ্ড বিদ্যুৎচুম্বকীয় বলের প্রভাবে কোনো পরমাণুর প্রোটন বেরিয়ে যেতে পারে। আর ঠিক তিনটি প্রোটন বেরিয়ে গেলেই সীসার পরমাণু বদলে যাবে স্বর্ণে! অ্যালিস পরীক্ষার সময় বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৮৯ হাজার স্বর্ণের পরমাণু তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে তৈরি হচ্ছে থ্যালিয়াম আর পারদ। সীসা থেকে একটা পরমাণু কমলে তৈরি হয় থ্যালিয়াম, আর দুটি কমলে পারদ। যদিও এই স্বর্ণ খুব সামান্য। এতই সামান্য যে এই স্বর্ণ দিয়ে গহনা তো দূরের কথা, ধূলিকণাও তৈরি করা যাবে না।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: সীসাকে স্বর্ণে পরিণত করলেন বিজ্ঞানীরা

৫. নাসার নতুন টেলিস্কোপ তৈরি করছে মহাকাশের ত্রিমাত্রিক ম্যাপ

সম্পূর্ণ মহাকাশের ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরি করছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এ জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে স্পিয়ারএক্স টেলিস্কোপ। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত ১ মে থেকে টেলিস্কোপটি মহাকাশের ছবি তোলা শুরু করেছে। টেলিস্কোপটি আগামী দুই বছর প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৬০০টি করে ছবি তুলবে। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ২৬ লাখ ২৮ হাজার ছবি তুলতে পারবে টেলিস্কোপটি। এভাবে বিশাল মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্যালাক্সি ও মহাকাশীয় বস্তুর ছবি তুলে বানানো হবে ত্রিমাত্রিক ম্যাপ।

বর্তমানে টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার উঁচুতে রয়েছে। স্পিয়ারএক্স টেলিস্কোপটি আমাদের গ্রহের চারপাশে উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরতে থাকবে। প্রতিদিন প্রায় ১৪.৫ বার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে। ঘোরার সময় আকাশের একটা নির্দিষ্ট অংশের অংশের ছবি নেবে। এতে মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই স্পিয়ারএক্স পুরো মহাকাশের অন্তত একবার ছবি তুলতে পারবে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: মহাকাশের ত্রিমাত্রিক ম্যাপ তৈরি করছে নাসার নতুন টেলিস্কোপ

৬. বিশ্বের বৃহত্তম সোলার টেলিস্কোপের তোলা ছবি

বিশ্বের বৃহত্তম সোলার টেলিস্কোপের তোলা সূর্যের নতুন ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এই ছবিতে সূর্যের পৃষ্ঠকে অভূতপূর্ব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। ছবিটির আগুনেপৃষ্ঠ দেখে মনে হচ্ছে আগুনের চোখ। বিজ্ঞানীরা ছবিটি তুলেছেন মার্কিন জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন ড্যানিয়েল কে. ইনোয়ে সোলার টেলিস্কোপের নতুন ভিজিবল টিউনেবল ফিল্টারের (ভিটিএফ) সাহায্যে। টেলিস্কোপে যুক্ত করা পঞ্চম ও সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র এটা। এটাই এই টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি।

বিশ্বের বৃহত্তম সোলার টেলিস্কোপ সূর্যকে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপ থেকে। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভিটিএফ সূর্যের পৃষ্ঠে কী ঘটছে তার একটি ত্রিমাত্রিক দৃশ্য তৈরি করতে পেরেছে। ছবিতে সূর্যের ভেতরের দিকের বায়ুমণ্ডল ঠিক কেন্দ্রের কাছাকাছি কিছু অন্ধকার দাগ দেখা গেছে। এই দাগগুলোকে বলা হয় ‘সানস্পটস’। প্রতিটি দাগ এত বড় যে সেগুলোর আকার প্রায় পৃথিবীর একেকটি মহাদেশের সমান। ছবির প্রতি পিক্সেল প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকার। বিজ্ঞানীরা জানান, টেলিস্কোপটি ৪৪ বছর ধরে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এটি সূর্যের প্রায় ১১ বছরের সৌর চক্রের চারটি পর্যায় পর্যবেক্ষণ করবে। ওপরের ছবিতে সৌরপৃষ্ঠে যে বিশাল সানস্পটস দেখা যাচ্ছে, এর বিস্তার ৬২৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সায়েন্স এলার্ট, নেচার, ওয়ার্ল্ড ডে হেলথ, ইনহেলথ একাডেমি, দ্য কনভার্সেশন, পপুলার সায়েন্স, লাইভ সায়েন্স, সিএনএন, নিউ সায়েন্টিস্ট, বিবিসি সায়েন্স, বিজ্ঞানচিন্তা