বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল? দেখে নিন একনজরে
প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে সেগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।
১. নতুন প্রজাতির তৃণভোজী ডাইনোসর
সম্প্রতি জীবাশ্মবিদরা আজ থেকে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন বছর আগে ক্রিটেসিয়াস যুগে বসবাসকারী ইগুয়ানোডন ডাইনোসরের একটি নতুন প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন। মাঝারি আকারের এই নতুন প্রজাতিটির নাম দেওয়া হয়েছে ক্যারিওসেকাস বোকাগেই (Cariocasecus bocagei)। জীবাশ্মটি ২০১৬ সালে পর্তুগালের আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইগুয়ানোডনরা ছিল তৃণভোজী বা গাছপালাখেকো ডাইনোসরদের একটি বড় দল। সেপ্টেম্বরে জার্নাল অব সিস্টেম্যাটিক প্যালিওন্টোলজিতে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।
বেলজিয়ামের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসের জীবাশ্মবিদ ও এই গবেষণার প্রধান লেখক ফিলিপ্পো বার্তোজ্জো জানান, তাঁরা প্রথমে একটি ২০ ইঞ্চি শিলা খুঁজে পান। এই শিলার মধ্যে জীবাশ্মযুক্ত দাঁতের একটি রেখা দেখা যাচ্ছিল। এরপর ওই অঞ্চলে তাঁরা আরও কিছু হাড় খুঁজে পান। সেই নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, তাঁরা যে কঙ্কালটি পেয়েছেন তা পূর্ণাঙ্গ আকারের না। বরং একটি অল্পবয়সী ডাইনোসরের ছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নতুন এই প্রজাতির মুখের ও চোয়ালের গঠন অন্য কোনো পরিচিত প্রজাতির ইগুয়ানোডন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখান থেকেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এটি একটি নতুন প্রজাতি। বিজ্ঞানীরা আরও খেয়াল করে দেখেছে, এর গালের হাড় চোয়ালের ওপরের হাড়ের সঙ্গে এমনভাবে মিশে বা যুক্ত হয়ে আছে, যা প্রাচীন প্রাণীদের মধ্যে বিরল। মুখের এই বিশেষ গঠনই ক্যারিওসেকাস বোকাগেই ডাইনোসরকে এর সমসাময়িক অন্য সব তৃণভোজী ডাইনোসরের থেকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করেছে।
২. পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাকটেরিয়া
প্রাচীন ম্যামথের দাঁত ও হাড় বিশ্লেষণ করে দশ লাখ বছরেরও বেশি আগের জীবাণু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেল জার্নালে এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা জানান, এই নমুনাগুলো থেকে পাওয়া ডিএনএ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মাইক্রোবিয়াল ডিএনএ। কারণ, লাখ লাখ বছর পরে কোনো জীবের ডিএনএ অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ম্যামথের মজবুত দাঁত ও হাড় এই প্রাচীন জীবাণুগুলোর ডিএনএকে রক্ষা করতে পেরেছে।
ম্যামথের শরীরে ৩১০টি ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। তবে এর মধ্যে অনেক ব্যাকটেরিয়া ছিল, যেগুলো ম্যামথ মারা যাওয়ার পর এদের শরীরের টিস্যুতে মিশে গিয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীরা প্রথমে সেসব জীবাণুর ডিএনএ বাদ নমুনা থেকে দেন। ফলে ম্যামথগুলো যখন জীবিত ছিল, তখন এদের শরীরের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো নিয়ে গবেষণা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মিলল ম্যামথের দাঁতে।
৩. বিশ্বের প্রথম এআই মন্ত্রী
ইউরোপের ছোট্ট দেশ আলবেনিয়ায় মানুষের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি বটকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন এই এআই মন্ত্রীর নাম রাখা হয়েছে ডিয়েলা। আলবেনীয় ভাষায় এই নামের অর্থ ‘সূর্যের নারী রূপ’। চলতি বছর মে মাসের নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এদি রামা। নির্বাচনে জেতার চার মাসের ভেতর ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ডিয়েলাকে নিজের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে এটি আসলে একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। কারণ, আলবেনিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, একজন মন্ত্রীকে অবশ্যই ১৮ বছর বয়সী এবং মানসিকভাবে সুস্থ নাগরিক হতে হবে, যা ডিয়েলা নামে এই এআই বটের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।
মানুষের বদলে চ্যাটবটকে সরকারি কাজে নিয়োগ দেওয়ার প্রধান ও শক্তিশালী কারণ হলো, এর ব্যক্তিগত কোনো লোভ-লালসা নেই। মানুষের মতো ক্ষমতা বা অর্থের প্রতি এর কোনো আকর্ষণ তৈরি হয় না। কারণ এই এআই কেবল বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ফলে এর পক্ষে সরকারি তথ্য ফাঁস করা বা কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খুব কম। মূলত এই কারণেই আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা এই এআইকে নিয়োগ দিয়েছেন দুর্নীতি ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের সব সরকারি কেনাকাটায় যাতে একফোঁটাও দুর্নীতি না থাকে। এই কাজে তাঁরা একটি আন্তর্জাতিক দলের সঙ্গে কাজ করছেন, যারা সরকারি কেনাকাটার জন্য বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ এআই মডেল তৈরি করবে।
৪. সৌরজগতের বাইরে ৬ হাজার এক্সোপ্লানেটের খোঁজ
সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা সৌরজগতের বাইরে ছয় হাজারের বেশি নতুন এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহের সন্ধান নিশ্চিত করেছে। ৬ হাজার গ্রহ খুঁজে পাওয়া বিশাল ব্যাপার। তবে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতেই আছে প্রায় একশ বিলিয়ন গ্রহ। এই বিশাল সংখ্যার তুলনায় ৬ হাজার খুবই কম। তবুও এই আবিষ্কার আমাদের জন্য এক অসাধারণ সাফল্য। কারণ, পৃথিবী থেকে অন্যান্য নক্ষত্রগুলো এত দূরে যে এদের চারপাশে থাকা গ্রহগুলো খুঁজে বের করা সত্যিই খুব কঠিন। এই গ্রহগুলো অনেক সময় নিজেদের নক্ষত্রের তীব্র আলোয় ঢাকা পড়ে থাকে। বিশাল সার্চলাইটের পাশে ছোট্ট একটি মশা খুঁজে বের করার মতো ব্যাপার আরকি। আর এ কারণেই এতগুলো গ্রহ খুঁজে পাওয়া এক অসাধারণ সাফল্য।
মাত্র তিন বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার। ৩০ বছর ধরে সৌরজগতের বাইরে খোঁজ চালিয়ে এই বিশাল সংখ্যক গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে আরও এমন অনেক গ্রহের খোঁজ মিলবে। আমাদের প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, মহাকাশে নতুন নতুন গ্রহ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়ছে।
ভবিষ্যতে আরও বেশি বহিঃসৌরগ্রহ খোঁজার জন্য বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু নতুন মহাকাশ অভিযান চালাবেন। এর মধ্যে ২০২৬ সালে ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি উৎক্ষেপণ করবে প্লেটো নামে একটি মহাকাশযান। ওটার কাজ হবে সূর্যের মতো নক্ষত্রের চারপাশে থাকা পাথুরে গ্রহ খুঁজে বের করা। এরপর ২০২৮ সালে চীন তাদের আর্থ ২.০ মিশন শুরু করবে। এটি পৃথিবীর আকারের গ্রহ খুঁজতে সাহায্য করবে।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: সৌরজগতের বাইরে ৬ হাজার এক্সোপ্লানেটের খোঁজ পেয়েছে নাসা।
৫. মাত্র ৩ মিনিটে জোড়া লাগবে ভাঙা হাড়
চীনে বিজ্ঞানীরা এমন এক যুগান্তকারী ‘হাড়ের আঠা’ আবিষ্কার করেছেন, যা হাড় ভাঙার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এতদিন ফ্র্যাকচার সারাতে ধাতব প্লেট বসানোর মতো কষ্টকর অস্ত্রোপচার ও সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লাগত। সেখানে চীনা গবেষকদের তৈরি এই ‘বোন-০২’ নামের আঠা মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হাড়ের জোড়া লাগিয়ে দিতে পারে। এই আঠা তৈরি করা হয়েছে ঝিনুক থেকে। সাধারণ আঠা রক্তের উপস্থিতিতে কাজ করে না, কিন্তু এই আঠা রক্তসমৃদ্ধ পরিবেশেও চমৎকারভাবে কাজ করে। এই বিশেষ ক্ষমতা থাকার কারণেই এটি কয়েক মিনিটের মধ্যে হাড়ের টুকরোগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে জোড়া লাগাতে সক্ষম।
চায়না সায়েন্স ডেইলি রিপোর্ট অনুযায়ী, এই আবিষ্কারের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে একটি পরীক্ষামূলক চিকিৎসা চালানো হয়েছে। কব্জির ফ্র্যাকচারে আক্রান্ত একজন রোগীকে আঠাটি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে তাঁর কব্জি জোড়া লেগে যায়। আর তিন মাসের ফলো-আপে দেখা যায়, এই নতুন পদ্ধতিতে রোগীর ফ্র্যাকচার কোনো জটিলতা ছাড়াই পুরোপুরি সেরে গেছে। এই দ্রুত ও কম আক্রমণাত্মক পদ্ধতিটি অর্থোপেডিক রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি কষ্ট এবং জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন কমিয়ে আনবে বলে আশা করছে চীনা বিজ্ঞানীরা।
৬. পৃথিবীর নতুন আধা চাঁদ
প্রতিনিয়ত অসংখ্য ছোট গ্রহাণু বা মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীর পাশ দিয়ে চলে যায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই সৌরজগতের বাইরের। তবে কিছু কিছু ছোট গ্রহাণু পৃথিবীর কাছাকাছি একটু বেশি সময় ধরে থেকে যায়। যাদের জ্যোতিঃবিজ্ঞানীরা নাম দেন ‘আধা চাঁদ’ বা কোয়াসি-মুন। সম্প্রতি তেমনই এক নতুন কোয়াসি-মুন বা আধা চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। নতুন আবিষ্কৃত এই কোয়াসি চাঁদটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘২০২৫ পিএন৭’। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির রিসার্চ নোটস জার্নালে।
কিন্তু একে আধা চাঁদ বলার কারণ কী? এ সম্পর্কে জানতে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: পৃথিবীর নতুন চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা!
৭. মঙ্গল গ্রহে মিলল প্রাচীন জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পারসিভারেন্স রোভার মঙ্গলে প্রাণের সন্ধানে গবেষণা চালাচ্ছে। এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত বছর রোভারটি ৬ বর্গফুটের একটি দাগযুক্ত শিলার সন্ধান পেয়েছিল। দেখতে তীর আকৃতির এই শিলাটির নাম দেওয়া হয় ‘চেয়াভা ফলস’। এটি এমন একটি স্থানে পাওয়া গেছে, যা একসময় জেজেরো গর্তে প্রবাহিত একটি প্রাচীন নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পাওয়া ব্রাইট অ্যাঞ্জেল নামে পরিচিত একটি পাথরের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাথরটি জৈব যৌগ দিয়ে পূর্ণ। জৈব যৌগ মানে হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু মৌলিক উপাদান। এছাড়াও, পাথরের ভেতর দিয়ে একসময় পানি প্রবাহিত হয়েছিল, সে প্রমাণও মিলেছে। এর মধ্যে চিতাবাঘের মতো দাগের কিছু চিহ্নও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই দাগগুলো এমন কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার থেকে হয়েছে, যা প্রাচীন অণুজীব থেকে তৈরি। এসব কারণে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে প্রাচীন জীবনের উপস্থিতি সম্পর্কে খুব আশাবাদী।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: মঙ্গল গ্রহে মিলল প্রাচীন জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ, জানাল নাসা।