লিজ মাইটনার: ফিশন বিক্রিয়ার পথিকৃৎ

বিজ্ঞানী লিজ মাইটনারছবি: উইকিপিডিয়া

এক সময় ধারণা করা হয়েছিল, পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়মই বুঝি আবিষ্কার হয়ে গেছে। কারও কিছুই আর করার নেই। এমনই এক ধারণার প্রতিফলন ঘটেছিল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের জীবনে। ১৬ বছর বয়সে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়তে গেলে পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষক তাঁকে এরকম একটি কথাই বলেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাতেই চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়মকানুন ভেঙে পড়ে এবং শুরু হয় কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের যাত্রা। ফলে আমরা পাই প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক।

১৮৭৯ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি নিচ্ছিলেন প্ল্যাঙ্ক। ঠিক সেই সময় জন্মগ্রহণ করেন—লিজ মাইটনার, অটো হ্যান, আলবার্ট আইনস্টাইন এবং ম্যাক্স ভন লাউ। এরাই পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানের কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। সে সময় বিশ্বের ভৌত নিয়মকানুনগুলো ছিল বর্তমানের তুলনায় অনেক দূরের। কিছুটা অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন। তখন বস্তু বলতে বোঝাতো জমাট বাঁধা বিন্দুর ভর বা মাস পয়েন্ট। এই ধারণাগুলো ছিল আমাদের ভৌতজগতের ভিত্তি। বিন্দু ভরের কাজ ছিল পদার্থবিজ্ঞানের গতির সূত্রাবলি নির্ধারণ করা। তবে ওপরের চার বিজ্ঞানীই পদার্থবিজ্ঞানের এসব সনাতন নিয়মের গণ্ডি পেরিয়ে নতুন নিয়মের ভিত্তি গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা হয়ে ওঠেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মাইটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালে, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। সেখানে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল এবং ব্যক্তিগত শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন ১৯০১ সালে। পদার্থবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র ও রসায়নবিদ্যার ওপর পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে মাইটনার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হয় পরমাণু বিজ্ঞানী অটো হানের সঙ্গে। সেটা ১৯০৭ সালের কথা। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছেন ৩০ বছর। ১৯০৮ সালে মাইটনার এবং হান যৌথ প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয় উৎপাদক অ্যাকটিনিয়াম-সি। ১৯০৯ সালে মাইটনার হানের সহায়তায় তাঁদের যৌথ কাজের ওপর বিবরণ লিখে পাঠান জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে। ফলে তিনি এমিল ফিশার ইনস্টিটিউট থেকে তাঁর কর্মক্ষেত্রে সব সুবিধা পাওয়ার অনুমতি পান। অথচ এমিল ফিশার ইনস্টিটিউটে প্রথমে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি নারী হওয়ার অপরাধে। তারপরও প্লাংকের ব্যক্তিগত চেষ্টায় তিনি পরমাণু বিজ্ঞানী অটো হানের কার্পেন্টারি শপে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে বোঝাতে পারেন যে জ্ঞান-বিজ্ঞান শুধু পুরুষদের জায়গা নয়, এখানে নারীরাও কাজ করে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন
মাইটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালে, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। সেখানে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল এবং ব্যক্তিগত শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন ১৯০১ সালে।

১৯১২ সালে প্রথমে অটো হান, পরে লিজ মাইটনার রসায়নের জন্য বার্লিনের কাইজার উইলহ্যাম ইনস্টিটিউটের সদস্যপদ পান। পরে এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয়েছিল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট। ১৯১৪ সালে তিনি রেডিও অ্যাক্টিভিটি বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এখানে প্ল্যাঙ্কের সহকারী হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁরা একটি নতুন মৌল আবিষ্কারে করেন। এই বিরল মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ৯১। তাঁরা এর নাম দেন প্রোটেক্টিনিয়াম। শিক্ষা সংক্রান্ত প্রুশিয়ান মিনিস্ট্রি বিভাগ থেকে অধ্যাপক পদও পান। ১৯২২ সালে তিনি আলফা ও বিটা বিকিরণের মধ্যকার সম্পর্ক অনুসন্ধান করেন এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ভেনিয়া লেজেন্ডি’ উপাধি পান। ১৯২৬ সালে মাইটনার বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নিযুক্ত হলেও ১২ বছরের মাথায় জার্মানি ত্যাগ করে তাঁকে দেশান্তরিত হতে হয়।

বিজ্ঞানী লিজ মাইটনার এবং অটো হান
ছবি: স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটশন/সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

ভাবতে অবাক লাগে, মাইটনারের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেতে ১৫ বছর সময় বেশি লেগেছিল। অথচ তাঁর তিন বন্ধু ম্যাক্স ভন লাউ, অটো হান এবং আলবার্ট আইনস্টাইন একাডেমিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। তাঁরা মাইটনারের ১৫ বছর আগেই সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেয়েছিলেন। কেননা সেই সময় প্রুশিয়াতে এ ধরনের পরীক্ষায় নারীদের কখনো অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হতো না। তাই মিটনার তাঁর যোগ্যতা প্রমাণে তেজস্ক্রিয়তার মূল অংশ বিটা রশ্মির বর্ণালির ওপর একটি থিসিস জমা দেন। তাছাড়া ম্যাক্স ভন সুইজারল্যান্ডের শিক্ষা অনুষদে সুপারিশমূলক একটি পত্র লিখে পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, যেহেতু মাইটনার বিশ্বে এমন একজন নেতৃত্বস্থানীয় গবেষক, অতএব তাঁকে তার যথার্থ সম্মান ও সুযোগ দেওয়া খুব জরুরি। অবশেষে বহু চেষ্টা ও কষ্টের পর পদমর্যাদাক্রমে তিনি ওই প্রাতিষ্ঠানিক অনুষদে নিজের স্থান অধিকার করেন। তাঁর বিষয় ছিল মহাজাগতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কসমিক প্রোসেস বা তেজস্ক্রিয়ার তাৎপর্য। অথচ একটি সংবাদপত্র ব্যঙ্গ করে তা প্রচার করলো ‘কসমেটিক প্রক্রিয়া’ শিরোনামে।

আরও পড়ুন
১৯১৪ সালে লিজ মাইটনার রেডিও অ্যাক্টিভিটি বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এখানে প্ল্যাঙ্কের সহকারী হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন।

মাইটনার সম্পর্কে হান বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠানের বাইরে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল প্রশ্নাতীত! উচ্চবিত্ত সমাজের একজন আত্মপ্রকাশকারী তরুণী হিসেবে যে ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন ছিল, তিনি তা পাননি। তিনি বেশ গম্ভীর ও লাজুক ছিলেন। পেশাগত কোনো উপলক্ষ্য ছাড়া জীবনে মাইটনারের সঙ্গে কখনো খাবার খাইনি। ঘুরতেও বের হইনি। তবে পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলো গভীরভাবে আলোচনা করার জন্য আমরা শুধু কার্পেন্টারি শপে দেখা করতাম’।

অবশ্য তখন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের বাড়িতে যে সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করা হতো, সেখানে প্রায়ই তাঁদের দেখা হতো। সেই সঙ্গীত সন্ধ্যা উপভোগের জন্য প্লাঙ্কের বাড়িতে আরও অনেক বিজ্ঞানীর আসতেন। আইনস্টাইনও আসতেন। মাইটনার নিজেও কার্পেন্টারি শপে গবেষণাকালীন সময়গুলোর কথা প্রায়শই বলতেন, ‘যখন আমাদের নিজস্ব কাজের ধারা ভালোভাবে অগ্রসর হতো, তখন আমরা একই শব্দ, একই ছন্দ কিন্তু ভিন্ন নোট বা স্বরে গান গাইতাম। মূলত, ব্রামসের রচিত সঙ্গীতই পরিবেশন করা হতো। আমি শুধু গুন গুন করতে পারদর্শী ছিলাম। কিন্তু হ্যানের ছিল অসাধারণ কণ্ঠস্বর। মোটকথা আমরা ছিলাম নবীন, সুখী এবং ভাবনাহীন।

১৯২৮ সালে মাইটনার এলেন রিচার্ডস প্রাইজ পান। ১৯২৯ সালে তিনি বিটা ক্ষয় ধর্মের সূক্ষ্ম পরিমাপে সক্ষম হন এবং কঠিন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের সূচনা করেন। এ ধরনের বিকিরণ তেজস্ক্রিয় নিউক্লীয় রূপান্তরকে চিহ্নিত করে। ইহুদি হওয়ায় ১৯৩৩ সালে তাঁকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়। কাইজার উইলহেম ইনস্টিটিউটের রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসাবেও কাজ করেছেন মাইটনার। ১৯৩৬ সালে শেষের দিকে ম্যাক্স ভন লাউ প্রস্তাব করেন, হান ও মাইটনারকে একসঙ্গে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, ১৯৩৮ সালে ৬০ বছর বয়সে মাইটনার যখন জার্মানির নাৎসিদের হাত থেকে পালিয়ে যান, তখন তিনি বহন করেছিলেন ছোট্ট ব্যাগ এবং পদার্থবিজ্ঞানের জন্য গভীর অনুরাগ। এর আট বছর পর অটো হ্যান, ফ্রিটজ স্ট্রাসম্যানের সঙ্গে নিউক্লিয়ার বিভাজনের ওপর সম্মিলিত আবিষ্কারকে উপস্থাপন করা হয় হানের একক কাজ হিসেবে। এ কাজের জন্য হান একাই নোবেল পুরস্কার পান।

আরও পড়ুন
১৯২৮ সালে মাইটনার এলেন রিচার্ডস প্রাইজ পান। ১৯২৯ সালে তিনি বিটা ক্ষয় ধর্মের সূক্ষ্ম পরিমাপে সক্ষম হন এবং কঠিন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের সূচনা করেন।

১৯৩৮ সালে হান খেয়াল করেন, কীভাবে নিউট্রনের আঘাতে ইউরেনিয়াম বিশ্লিষ্ট হয়ে বেরিয়ামে পরিণত হয়। ফলে সম্ভব হয়েছিল চেইন বা শৃঙ্খল বিক্রিয়ার, যা পরমাণুর অকল্পনীয় শক্তিকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি, কিন্তু মাইটনার ঠিকই বুঝেছিলেন এর তাৎপর্য। তিনি হানকে কাজ করে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আইনস্টাইনের একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমি নিজেকে পরমাণুশক্তির জনক মনে করি না। এটা শৃঙ্খল বা চেইন বিক্রিয়া আবিষ্কারের ফলেই বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এটা অটো হান বার্লিনে আবিষ্কার করেছিলেন এবং নিজেই তাঁর আবিষ্কারের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। এর সঠিক ব্যাখ্যা দেন লিজ মাইটনার। নীলস বোরের কাছে এই সংবাদ দেওয়ার জন্য তিনি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসেন’।

মিটনারের কাছ থেকে পাওয়া খবরই নীলস বোর বহন করে নিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। সেখানকার বর্বর রাজনীতিবিদেরা একই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটালো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পরমাণু ফেলে। সেটা আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা ঘটায় এবং প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ। ধ্বংস হয়ে যায় দুটি নগরী।

১৯৩০ সালে ল্যাবে কর্মরত লিজ মাইটনার
ছবি: জার্মান প্যাটেন্ট অ্যান্ড ট্রেড মার্ক অফিস

১৯৪৬ সালে অর্ধেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ক্যাথোলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি। এ সময় তিনি টেকনিক্যাল কলেজে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে মাইটনার অফিসিয়ালভাবে অবসরের পর নোবেল ইনস্টিটিউট ত্যাগ করেন এবং সুইডিশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনে নিজের জন্য একটি ছোট গবেষণাগার নির্মাণ করেন। একটি এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর স্থাপন করেছিলেন সেখানে। ১৯৬০ সালে মাইটনার যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের আর্ট ও বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ পান। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে এক আত্মীয়ের কাছে চলে আসেন।

১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর কেমব্রিজে মারা যান মাইটনার। কিছুদিন পর পালিত হয় তাঁর ৯০ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর সম্মানে একটি মৌলিক পদার্থের নামকরণ করা হয় মাইটনারিয়াম।

আজ লিজ মাইটনারের জন্মদিন। এইদিনে তাঁর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

আরও পড়ুন