পাই মেসনের ইতিবৃত্ত
নিউক্লিয়াসের ভেতরের কণাগুলো কেন একত্রে থাকে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছিলেন সবল নিউক্লীয় বলের। আপাতদৃষ্টে প্রশ্নটা সহজ বটে, তবে তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, প্রশ্নটা ওজনদার। পরমাণুতে ইলেকট্রন আর প্রোটনগুলো বাঁধা আছে বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের সুতায়, নিউক্লিয়াসের ভেতরে তাহলে কোন বল কাজ করে?
নিউক্লিয়াসে আছে প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন ধনাত্মক চার্জযুক্ত, কিন্তু নিউট্রন চার্জনিরপেক্ষ। বৈদ্যুতিকভাবে এদের ভেতর কোনো বন্ধন থাকা উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবে এরা থাকে। কীভাবে?
এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়াসের ভেতর অতি শক্তিশালী একধরনের বলের সন্ধান পেয়েছিলেন, যার নাম সবল নিউক্লীয় বল। এই বলের কারণেই নিউট্রন আর প্রোটন পরস্পরের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে। বিদ্যুৎ–চুম্বকীয় বলের জন্য ক্যারিয়ার পার্টিক্যাল, যাকে সরল বাংলায় বলে বাহক কণা, সেটা হলো ফোটন। একটা চার্জিত কণা, আরেকটা কণার কাছে নিজের বৈদ্যুতিক চরিত্রের খবর পৌঁছে দেয় ফোটন বা আলোর কণার সাহায্যে। তেমনি সবল নিউক্লীয় বলের খবর পৌঁছে দেয় কোন কণা? অর্থাৎ সবল নিউক্লীয় বলের বাহক কণা কী?
জাপানি বিজ্ঞানী হেদেকি ইউকাওয়া প্রথম সবল নিউক্লীয় বলের বাহকের সন্ধান দেন। সেটা ১৯৩৪ সালের কথা।
ইউকাওয়া যে মেসন কণার কথা বলেন, তাবৎ মেসন এক রকম নয়। তিন ধরনের মেসনের হদিস দেন তিনি। তিনটার কমন নাম পায়ন—ধনাত্মক পায়ন, ঋণাত্মক পায়ন ও নিরপেক্ষ পায়ন। পায়নের সাধারণ প্রতীক দেওয়া হলো p (পাই)। ধনাত্মক পায়নের প্রতীক হলো p+, ঋণাত্মক পায়নের p- এবং নিরপেক্ষ পায়নের প্রতীক হলো p০।
নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে মেসনের বিনিময় কীভাবে ঘটে, তার একটা নকশাও বাতলে দিলেন ইউকাওয়া। তিনি বলেন, একটা প্রোটন আর একটা নিউট্রনের মধ্যে পায়ন কণা বিনিময় হয়। ফলে তৈরি হয় শক্তিশালী একটা বন্ধন। কীভাবে?
ইউকাওয়া যে মেসন কণার কথা বলেন, তাবৎ মেসন এক রকম নয়। তিন ধরনের মেসনের হদিস দেন তিনি। তিনটার কমন নাম পায়ন—ধনাত্মক পায়ন, ঋণাত্মক পায়ন ও নিরপেক্ষ পায়ন।
একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, দুটো কুকুর একটা হাড় নিয়ে লড়াই করছে। একটা কালো কুকুর এবং অন্য কুকুরটার গায়ের রং সাদা। হাড়ের দুই প্রান্ত কামড়ে ধরে আছে কুকুর দুটো। ধরা যাক, তখন আপনি ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছেন। আপনি জানেন, দুটো কুকুরের গায়ে সমান শক্তি। কোনো লড়াইয়ে কেউ কাউকে হারাতে পারে না। এখন হাড় দুটো কাড়াকাড়ি করতে দেখে আপনার কী মনে হবে? দুই কুকুর দুই দিক থেকে টানছে হাড়টা।
যেহেতু দুটোরই শক্তি সমান, তাই হাড়টা শেষমেশ কেউ কবজা করতে পারছে না। তাই কুকুর দুটোর চেষ্টাই বৃথা। আপনার মনে হবে, তাদের এই ব্যর্থ চেষ্টার কারণে একটা স্থবির ব্যাপার তৈরি হয়েছে। দুই কুকুর আর হাড়—তিনটা জিনিসই স্থির হয়ে আছে।
কিন্তু পদার্থবিদেরা এ ব্যাপারকে ভিন্ন চোখে দেখবেন। পুরো ব্যাপারটা স্থির, এটা তাঁরা মানবেন না। তাঁরা বলবেন, কালো কুকুরটা সব শক্তি দিয়ে হাড়টাকে নিজের দিকে টানছে। খুব কম সময়ের জন্যে হলেও সে জিতে যাচ্ছে, হাড়টাকে নিজের করে নিচ্ছে। কিন্তু সাদা কুকুরটারও শক্তি কম নয়, তাই সে হাড়টা ছাড়ছে না।
কালো কুকুর যখন হাড়টাকে নিজের করে নিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে সাদা কুকুরটা সেটাকে বাধা দিচ্ছে এবং নিজের দিকে টানছে, তখন অল্প সময়ের জন্য কালো কুকুরের কাছ থেকে নিজের করে নিচ্ছে হাড়টা। কিন্তু শক্তি সমান বলে কেউই নিজের দিকে টেনে হাড়টাকে রাখতে পারছে না। দুই দিকেই মুহূর্তের জন্য হাড়টা যাচ্ছে, কিন্তু এত দ্রুত সেটার দখলদার বদল হচ্ছে, সেই ব্যাপারটা আলাদা করে বোঝা কঠিন।
প্রোটন আর নিউট্রনের মধ্যে পায়নের বিনিময়টা আসলে এমনই ঘটছে। খুব কম সময়ের জন্য পায়ন একবার নিউট্রনের দখলে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে আবার প্রোটনের দখলে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কারও কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্য পায়ন হাতছাড়া হচ্ছে না। আর পায়ন টানাটানির কারণে তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে শক্তিশালী একটা বল, সেটাই স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা সবল নিউক্লীয় বল।
খুব কম সময়ের জন্য পায়ন একবার নিউট্রনের দখলে যাচ্ছে, পরমুহূর্তে আবার প্রোটনের দখলে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কারও কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্য পায়ন হাতছাড়া হচ্ছে না।
এতে তো নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে সমস্যার কারণটা জানা গেল। কিন্তু হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছাড়া বেশির ভাগ পরমাণুর নিউক্লিয়াসেই তো একাধিক প্রোটন ও একাধিক নিউট্রন থাকে। প্রোটনগুলোর সব ধনাত্মক চার্জ যুক্ত, তাই এদের মধ্যে বিকর্ষণ বল কাজ করে। তেমনি নিউট্রনের নিজেদের মধ্যে কোনো বল কাজ করে না। প্রোটন আর প্রোটনের মধ্যেও মেসন বিনিময় হয়, তেমনি নিউট্রনগুলোও পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে মেসন বিনিময়ের মাধ্যমে।
প্রোটন-প্রোটনের মধ্যে যে বন্ধন, সেখানে হাড়ের ভূমিকা পালন করে নিরপেক্ষ পায়ন। অর্থাৎ এদের মধ্যেπ0 মেসনের বিনিময় ঘটে। তিন ধরনের মেসনেরই স্পিন শূন্য। প্লাস ও মাইনাস ভর সমান। কিন্তু π০ কিছুটা কম। প্রোটন আর প্রোটনের মধ্যে যখন বন্ধন তৈরি হয়, তখন π০ বিনিময় ঘটে। চার্জ আর স্পিনশূন্য এই কণা প্রোটনদের চার্জ ও স্পিনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। একই ব্যাপার নিউট্রন-নিউট্রন বন্ধনের ক্ষেত্রেও।
এদের মিথস্ক্রিয়াটা হয় এমন
n+π0→ n+π0………….(১)
p+π0→ p+π0………….(২)
সমীকরণের দুই দিকেই একই রকম। কারণ, নিরপেক্ষ মেসন যখন প্রোটন বা নিউট্রনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন এদের চার্জের হেরফের হয় না। কারণ, মেসন চার্জনিরপেক্ষ। আর মেসনের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়া চার্জের সংরক্ষণশীলতা নীতি বজায় রাখতে হয়।
হিসাবটা এমন, একটা প্রোটন নিরপেক্ষ মেসন গ্রহণ করে। তারপর সেই মেসন আরেকটা প্রোটনকে দেয়। সেই প্রোটন মেসনটাকে খুব অল্প সময়ের জন্য নিজের করে নেয়। এক মুহূর্তের ব্যবধানে আবার প্রথম প্রোটনটি দ্বিতীয় প্রোটনের কাছ থেকে মেসনটাকে ছিনিয়ে নেয়। পরক্ষণে আবার দ্বিতীয় প্রোটনটি প্রথমটার কাছ থেকে মেসনটিকে ছিনিয়ে নেয়। মেসন কাড়াকাড়ির ফলে তাদের মধ্যে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার বন্ধন। নিউট্রনগুলোর মধ্যেও একই রকম ঘটনা ঘটে।
প্রোটন-প্রোটনের মধ্যে যে বন্ধন, সেখানে হাড়ের ভূমিকা পালন করে নিরপেক্ষ পায়ন। অর্থাৎ এদের মধ্যেπ0 মেসনের বিনিময় ঘটে। তিন ধরনের মেসনেরই স্পিন শূন্য। প্লাস ও মাইনাস ভর সমান।
এখানে একটা বিষয় বলে রাখা জরুরি। প্রোটন-প্রোটন আর নিউট্রন-নিউট্রন বন্ধনটা অনেকটা এমন হলেও প্রোটনের সঙ্গে নিউট্রনদের মধ্যে যে আকর্ষণ বল বা মিথস্ক্রিয়া, এই ব্যাপারটি নির্বিষভাবে ঘটে না। একে অন্যকে একটা মেসন দিয়ে দিল এবং গ্রহণ করল, ব্যাপারটা তেমন সরল নয়। একটা ঋণাত্মক পায়ন যখন প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন দুটো মিলে তৈরি হয় একটা নিউট্রন কণা।
p + π- → n …... (৩)
নিউট্রন আর প্রোটনের চার্জ এক নয়। প্রোটনের চার্জ +১ আর ঋণাত্মক মেসনের যুক্ত -১। এই দুটো পরস্পরের সঙ্গে যখন যুক্ত হয়, তখন এদের মিলিত চার্জ শূন্য হয়ে যায়। অর্থাৎ একটা চার্জশূন্য কণায় পরিণত হয় সেই মিলিত কণাটি। অর্থাৎ কণা দুটো ভেক বদল করে পরিণত হয় নিউট্রন কণায়। সেই নিউট্রন কণা আবার আরেকটি নিউট্রনের সঙ্গে যুক্ত হয়, ওপরের ২ নম্বর সমীকরণের মতো। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। কারণ, প্রতিটা নিউট্রনের সঙ্গে তখন এসে যুক্ত হয় একটা করে ধনাত্মক মেসন।
তখন নতুন আরেকটা বিক্রিয়া ঘটে, ঠিক নিচের মতো—
n + π+ → p… ... (৪)
এই সমীকরণে দেখা যাচ্ছে, নিউট্রনের সঙ্গে একটা ধনাত্মক প্রোটন যুক্ত হচ্ছে। ফলে নিউট্রন আর চার্জনিরপেক্ষ থাকতে পারছে না। মেসনের ধনাত্মক চার্জ যোগ হয়ে সে বনে যাচ্ছে প্রোটনে। এভাবে নিউট্রনের সঙ্গে ধনাত্মক চার্জ যুক্ত হয়ে তৈরি হচ্ছে প্রোটন। সেই প্রোটন আবার নিরপেক্ষ মেসন বিনিময় করে অন্য প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রোটন-প্রোটন বন্ধন তৈরি করছে।
এখান থেকে একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। নিউক্লিয়াসের মধ্যে এভাবে মেসনদের প্রভাবে প্রতিনিয়ত প্রোটন ভেক বদল করে পাল্টে যাচ্ছে নিউট্রন কণায়। আবার নিউট্রন ভেক বদল বনে যাচ্ছে প্রোটনে। এ ঘটনা খুব দ্রুত ঘটছে, দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। তাই বাস্তবে আসলে কোনো পরিবর্তনই টের পাওয়া যাচ্ছে না।
নিউট্রন আর প্রোটনের চার্জ এক নয়। প্রোটনের চার্জ +১ আর ঋণাত্মক মেসনের যুক্ত -১। এই দুটো পরস্পরের সঙ্গে যখন যুক্ত হয়, তখন এদের মিলিত চার্জ শূন্য হয়ে যায়।
দুই
এই লেখা শুরু থেকে পড়ে আসার পর কি আপনার মনে খটকা লাগছে না? এখানকার সমীকরণগুলো চলছে চার্জকে ব্যালান্স করে। অর্থাৎ প্রোটনের সঙ্গে মেসনের ঋণাত্মক চার্জ যুক্ত হলেই সেটা ভেক বদল করে প্রোটনে পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে নিউট্রনের সঙ্গে মেসনের ধনাত্মক চার্জ যুক্ত হলেই সেটা পরিণত হয়ে যাচ্ছে প্রোটনে। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে ভাবুন তো। পুরো ব্যাপারটা ঠিক ছিল, যদি প্রোটন আর নিউট্রনের ভর সমান হতো। আমরা অবশ্য এমনটা পড়েই বড় হয়েছি, নিউট্রন আর প্রোটনের ভর সমান। আসলে কথাটা হবে ‘প্রায় সমান’, কিন্তু ‘পুরোপুরি সমান’ নয়। প্রোটনের চেয়ে নিউট্রনের ভর সামান্য বেশি। এই বেশিটুকু তাহলে কোথায় যাচ্ছে? দুটো কণার ভর যদি সমান হতো, তাহলে কথা ছিল—চার্জ যোগ–বিয়োগ করেই একে বদলে ফেলা যেত। কিন্তু ভর তো সমান নয়।
সবল নিউক্লীয় বলের ধারণা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন জার্মান কোয়ান্টাম তত্ত্ববিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ বলেছিলেন, সবল নিউক্লীয় বল তৈরি হয় নিউক্লিয়াসের ভেতর কণাদের মধ্যে চার্জ বিনিময়ের মাধ্যমে। তাই ভরের ব্যাপারটাকে হিসাবের বাইরে রেখে মেসনের ধারণা দিয়েছিলেন ইউকাওয়া।
তিন
১৯২০-এর দশকে মৌলিক কণাদের জন্য একধরনের পরিসংখ্যান দাঁড় করান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরে সেটাই ঘষেমেজে আরও উন্নত করেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এই পরিসংখ্যান যেসব কণা মেনে চলে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয় বোসন কণা। ফোটন, গ্লুয়ন, জেড বোসন ও ডব্লিউ কণারা হলো বোসন কণা। এগুলো সব বলবাহী কণা। কাছাকাছি সময়ে আরেকটি পরিসংখ্যান দাঁড় করান ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি ও ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাক। সেটার নাম দেওয়া হয় ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যান যেসব কণা মেনে চলে, তাদের বলা হয় ফার্মিয়ন কণা। এ কালের কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, নিউট্রনসহ সব বস্তুকণার কমন নাম ফার্মিয়ন কণা। মেসনের প্রকৃতি দেখা গেল বোসনের মতোই। তাই মেসনকে ফেলা হলো বোসন শ্রেণির কণার কাতারে।
ইউকাওয়া যখন মেসনের ধারণা দেন, তখন এটাকে মূল কণা বলে মনে করেছিলেন। শুধু এটা কেন, প্রোটন ও নিউট্রনকেও তখন মূল কণা বলে মনে করা হতো। কিন্তু এ ব্যাপারটা ধাক্কা খায় ১৯৫০-এর দশকে। কণা ত্বরক যন্ত্র ব্যবহার করে তখন ভেঙে ফেলা সম্ভব হলো নিউক্লিয়াসকে। ১৯৬০-এর দশকে নিশ্চিত হওয়া গেল, প্রোটন আর নিউট্রন আসলে কোয়ার্ক নামের আরেক ধরনের কণা দিয়ে তৈরি। তখন ধাক্কা খেল মেসন তত্ত্বও। দেখা গেল, মেসনও (পায়নসহ অন্য মেসনগুলোও) আসলে মূল কণিকা নয়। এগুলো বোসন কণা সেটা অবশ্য ঠিক। তাহলে মেসন কী দিয়ে তৈরি?
কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, নিউট্রনসহ সব বস্তুকণার কমন নাম ফার্মিয়ন কণা। মেসনের প্রকৃতি দেখা গেল বোসনের মতোই। তাই মেসনকে ফেলা হলো বোসন শ্রেণির কণার কাতারে।
মেসন কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। দুই ধরনের কোয়ার্ক দিয়ে। এখানে একটা স্ববিরোধী ব্যাপার তৈরি হচ্ছে কিন্তু। মেসনের প্রকৃতি বোসনের মতো, অর্থাৎ এরা বলবাহী কণা। অথচ এরা যেসব কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি, সেগুলো বস্তুকণা, অর্থাৎ ফার্মিয়ন।
বস্তুকণা দিয়ে তৈরি একটা কণা, যেটাকে মেসন নামে ডাকা হচ্ছে, সেটা বোসন কণা কেন?
এটা আসলে মজার ধাঁধা। তবে এর সমাধান আছে। বস্তুকণা দিয়ে তৈরি এর প্রকৃতি বোসনের মতো। বল বহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কোয়ার্কের প্রকৃতির কারণেই মেসন বোসনের মতো আচরণ করে। অনেক রঙের অনেক ফ্লেভারের কোয়ার্ক আছে। সেগুলোর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এদের আচরণ। বোসন আসলে একটা কোয়ার্ক আর একটা অ্যান্টি–কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। এটা আরেকটা বিস্ময়। একই কণা তার অ্যান্টি, অর্থাৎ প্রতিকণা একই সঙ্গে থাকতে পারে না। কণা আর প্রতিকণার পরস্পরের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে উভয় কণাই ভ্যানিশ হয়ে যায়। তৈরি হয় শক্তি।
সুতরাং একটা কোয়ার্ক আর একটা অ্যান্টি–কোয়ার্ক মিলে আরেকটা যৌগিক কণা তৈরি হয় কীভাবে?
ধনাত্মক মেসন একটা আপ কোয়ার্ক আর একটা ডাউন অ্যান্টি–কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। আপ আর ডাউন কী? কোয়ার্ক এক রকম নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোয়ার্ক ছয় রকম। এদের প্রতিটিকে বলা হয় ছয়টা কালার। সত্যিকারের কালার বা রং নয়। একটার সঙ্গে অন্যটার পার্থক্য তৈরির জন্য এই ছয় কালারের অবতারণা। আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ, বটম—এ ছয়টি।
কণা ও প্রতিকণাদের সংঘর্ষে পরস্পরের ধ্বংস হওয়ার যে নীতি আছে, তার কয়েকটা শর্ত আছে। কণাগুলোর ভর একই হতে হবে, স্পিনও হতে হবে এক এবং চার্জ পরস্পরের বিপরীত কিন্তু মানে সমান হবে। যেমন ইলেকট্রন আর পজিট্রন পরস্পরের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ, ইলেকট্রনের ভর আর পজিট্রনের ভর সমান। এদের স্পিনও সমান। চার্জ সমান, কিন্তু ইলেকট্রনের +১ এবং পজিট্রনের -১। তাই ইলেকট্রন আর পজিট্রন পরস্পরের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হয়, শক্তি উৎপন্ন করে।
কিন্তু এই শর্তগুলো পূরণ হয় না মেসনের ভেতরে থাকা কোয়ার্ক ও অ্যান্টি–কোয়ার্কের। আপ কোয়ার্কের ভর ২.২ Mev/c2, চার্জ +২/৩ এবং স্পিন ১/২। অন্যদিকে অ্যান্টি–ডাউন কোয়ার্কের ভর ৪.৭ Mev/c2, চার্জ +১/৩ এবং স্পিন ১/২।
ইলেকট্রনের ভর আর পজিট্রনের ভর সমান। এদের স্পিনও সমান। চার্জ সমান, কিন্তু ইলেকট্রনের +১ এবং পজিট্রনের -১। তাই ইলেকট্রন ও পজিট্রন পরস্পরের সংস্পর্শে এলে ধ্বংস হয়, শক্তি উৎপন্ন করে।
মেসনের দুই সদস্যের স্পিন শর্তটাই কেবল পূরণ হয়। দুটো কণার ভর সমান নয়। চার্জও সমান নয়। আবার চার্জের প্রকৃতি দুটোরই এক। সুতরাং এ শর্তও পূরণ হচ্ছে না। এ জন্য এ দুটি কণা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে ধ্বংস হওয়ার সুযোগ নেই। বরং দুটিতে মিলে ধনাত্মক মেসন কণা তৈরি করে। সেই মেসন নিউট্রন প্রোটনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়।
অন্যদিকে ঋণাত্মক মেসন তৈরি হয় একটা ডাউন কোয়ার্ক আর একটা অ্যান্টি–আপ কোয়ার্ক। এখানেও ডাউন কোয়ার্ক আর অ্যান্টি–আপ কোয়ার্কের চার্জ ও ভর আলাদা। তাই ধ্বংস হয় না। ঋণাত্মক পায়ন নিউট্রন-প্রোটনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়।
অন্যদিকে নিরপেক্ষ পায়ন তৈরি হয় একটি আপ ও একটি অ্যান্টি–আপ কোয়ার্ক দিয়ে অথবা একটি ডাউন ও একটি অ্যান্টি–ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে। এখানে কিন্তু সরাসরি কণা আর প্রতিকণা দিয়ে তৈরি দিয়ে হচ্ছে মেসন। ফলে পরস্পরের সংস্পর্শে এসে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। হয়ও। তারপর নিরপেক্ষ পায়ন তৈরি করতে পারে। কীভাবে? সে কথায় আসছি একটু পরই।
এখন আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা তো বললাম, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পায়নের ভেতর থাকা কোয়ার্কগুলোর মধ্যে ভর আর চার্জের পার্থক্য আছে বলে এরা মেসন তৈরি করতে পারে। সেই মেসন নিউট্রন-প্রোটনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়। তার মানে এই নয় যে মেসনগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজ করে। আসলে মেসনের আয়ু খুব কম। ধনাত্মক আর ঋণাত্মক পায়নের আয়ু ২.৬×১০-৮ সেকেন্ড। কিন্তু অতিপারমাণবিক জগতে এই অল্প সময়ও অনেক বেশি। সেই সময়ের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সংঘটিত হয়ে যায়। নিউট্রন আর প্রোটনের মধ্যে বন্ধন তৈরি। অন্যদিকে নিরপেক্ষ পায়নের আয়ু একেবারেই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না—৮.৪×১০-১৭ সেকেন্ড। কারণ, এরা সরাসরি কণা আর প্রতিকণা দিয়ে তৈরি। তাই সংস্পর্শে আসার ৮.৪×১০-১৭ সেকেন্ডের মধ্যেই এরা ধ্বংস হয়ে যায় এবং এই সময়ের মধ্যে প্রোটন-প্রোটন ও নিউট্রন বন্ধন তৈরি করে ফেলে।