ইলেকট্রন কি লাটিমের মতো ঘোরে

ইলেকট্রনের আকারই একটি বিন্দুর মতো। অনেকটা শূন্যমাত্রিক বিন্দুফাইল ছবি

ইলেকট্রনের মতো অতিপারমাণবিক কণার কি লাটিমের মতো ঘোরা খুবই জরুরি?

জরুরি হতো, যদি রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল ঠিকঠাক হতো। রাদারফোর্ডের মডেলে ইলেকট্রনগুলোকে ঠিকমতো কক্ষপথে থাকতে হয়, তাহলে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে এগুলোকে ঘুরতে হতো। ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াসের মধ্যে পারস্পরিক আকষ৴ণ বজায় রাখাটাই তখন আসল উদ্দেশ্য। এই ভারসাম্যের ষোলো আনা পূর্ণ করতে ইলেকট্রনের আরেকটি ঘূর্ণনও জরুরি। সেটি নিজ অক্ষের ওপর ঘোরা। ঠিক যেমন পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে। কিংবা একটি লাটিম যেমন এর ভেতরে থাকা পেরেকের ওপর ভর দিয়ে ঘোরে, ইলেকট্রনের ঘূর্ণনটা হতো তেমন।

পৃথিবী আর লাটিম এভাবে ঘুরতে বাধ্য, কারণ এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মহাকর্ষ বলের প্রভাবে। মহাকর্ষ বল নিউটনের বলবিদ্যার উৎস। যেমন একটি গাড়ির চাকার ঘূর্ণন বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু মূল প্রভাবক ওই মহাকর্ষ বল। ঘর্ষণ বল বলুন বা ইঞ্জিন থেকে আসা যান্ত্রিক বল—সবই ওই মহাকর্ষ বলের আলাদা রূপভেদ। আর কে না জানে, নিউটনীয় গতিবিদ্যায় কোনো সিস্টেমের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অঙ্ক কষে বলে দেওয়া সম্ভব।

তাই বস্তুর আচরণ ও বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা যায় সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে। কিন্তু খুদে কণাগুলোর জগৎ, যেখানে চলে না নিউটন-আইনস্টাইনের ক্লাসিক্যাল বলবিদ্যার বাহাদুরি, সেখানে এত সহজে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বিচার করলে আপনার কাণ্ডজ্ঞান প্রতারিত হবে নিশ্চিত।

তাহলে ইলেকট্রনের যে স্পিন, সেটি কেমন?

এখানেই আসলে ভুলটা রয়ে গেছে।

ইলেকট্রন-কোয়ার্কের মতো কণার ভর আছে, এগুলোকে আমরা গোলকের মতো চিন্তা করি। আসলেই কি এগুলো গোলক কিংবা বলের মতো?

ইলেকট্রন গোলক কিংবা বল কোনোটার মতোই নয়। এগুলো আসলে বিন্দু কণা, কোয়ান্টাম জগতে বিন্দুকণা জ্যামিতির সাধারণ বিন্দুর মতো কিছুটা, তবে বেশির ভাগটা আবার বিন্দুর সঙ্গে মেলেও না। কোয়ান্টাম জগতে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান অচল, তাই চাইলেই আপনি সেই বিন্দুকে নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারবেন না পুরোপুরি। ভাসা-ভাসা সেই জ্ঞানটাই ঝালাই করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন
রাদারফোর্ডের মডেলে ইলেকট্রনগুলোকে ঠিকমতো কক্ষপথে থাকতে হয়, তাহলে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে এগুলোকে ঘুরতে হতো।

দুই

ফরাসি বিজ্ঞানী লুই দ্য ব্রগলি দেখিয়েছিলেন, যেকোনো গতিশীল বস্তুর তরঙ্গ আছে। আসলে ইলেকট্রনের মতো খুদে কণার জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি৷ পরে হাইজেনবার্গ আর শ্রোডিঙ্গারের মতো বিজ্ঞানীরাও কণাগুলোর জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। ফলে দ্য ব্রগলির বস্তু তরঙ্গের ধারণা আরও পোক্ত হয়। কিন্তু দ্য ব্রগলির ইলেকট্রন একই সঙ্গে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে, এ ব্যাপারটার সমাধান ব্রগলির সমীকরণে ছিল না। শ্রোডিঙ্গারের মডেল সেই ত্রুটি দূর করে।

অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার দেখান, শক্তিস্তরে ইলেকট্রন ঘোরে না। বরং ইলেকট্রনের তরঙ্গ শক্তিস্তরের যেকোনো বিন্দুতে এর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি।

অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার
ছবি: উইকিপিডিয়া

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতিও একই কথা বলে। কোথাও ইলেকট্রন শতভাগ পাওয়া যাবে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে ইলেকট্রনকে যদি কোনো বিন্দুতে নিশ্চিত করে পেতে চান, তাহলে এর গতিবেগ অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

সুতরাং ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে, এ কথা আর খাটে না। আর ইলেকট্রন যদি নিউক্লিয়াসের চারপাশে না ঘোরে, তাহলে নিজ অক্ষের ওপরই বা কেন ঘুরবে?

মোদ্দাকথা, ইলেকট্রনের আকারই একটি বিন্দুর মতো। অনেকটা শূন্যমাত্রিক বিন্দু। কোনো বস্তুকে ঘুরতে হলে এর একটি বস্তুগত ত্রিমাত্রিক আকার দরকার হয়। সেটি যখন নেই, এর ঘোরার প্রশ্নই ওঠে না। আর স্পিন বলতে আমরা যা বুঝি, সেটি ক্রিকেট বলের স্পিন টাইপের মতো কিছু নয়।

ইলেকট্রনের স্পিন কী, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া, আর বহুদিনের ভুল ধারণা সমাধানের জন্য বিখ্যাত ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে সেগুলোর ওয়েবসাইটে—১৯৯৯ সালের ২১ অক্টোবর। তারিখ দেখে ভড়কে যাবেন না, সায়েন্টিফিক আমেরিকান ১৯৯৬ সালে তাদের ওয়েবসাইট লঞ্চ করে। সেই আর্টিকেলের শিরোনাম ছিল, ‘হোয়াট এক্সাক্টলি ইজ দ্য “স্পিন” অব সাব–অ্যাটমিক পার্টিক্যালস সাচ অ্যাজ ইলেকট্রনস অ্যান্ড প্রোটনস? ডাজ ইট হ্যাভ অ্যানি ফিজিক্যাল সিগনিফিক্যান্স, অ্যানালগাস টু দ্য স্পিন অব আ প্ল্যানেট?’

আরও পড়ুন
অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার দেখান, শক্তিস্তরে ইলেকট্রন ঘোরে না। বরং ইলেকট্রনের তরঙ্গ শক্তিস্তরের যেকোনো বিন্দুতে এর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি।

পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে ইলেকট্রনের স্পিনের তুলনা আমরা হরহামেশাই করি। সেটা যে কত ভুল, সেটি দেখানোই ওই আর্টিক্যালের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ম্যাগাজিনটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পাউকিপসির ভাসার কলেজের অধ্যাপক মর্টন টাভেলের উদ্ধৃতি টেনেছে। টাভেল বলেন, চার্জিত কণাগুলো যখন চুম্বকক্ষেত্রের ভেতর চলাচল করে, তখন এগুলোর গতিপথ বিচ্যুত হয়। তখন মনে হয়, এসব কণার সামান্য চুম্বক ধর্ম আছে। চিরায়ত তড়িৎগতিবিদ্যায় এ ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।

ইলেকট্রন যদি নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকে, তাহলে এর কক্ষপথ ক্রমেই ছোট হয়ে আসবে
ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

কোনো চার্জিত বস্তুকে যদি ঘুরতে দেখা যায়, তখন এর চৌম্বক ধর্ম দেখা যায়। কোনো চার্জিত লোহার বলকে যদি বিদ্যুতায়িত করা যায়, তারপর এটিকে যদি ঘোরানো যায় বা কম্পিত করা যায়, তাহলে সেই বস্তুকে ঘিরে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়, গোলকটা তখন চুম্বকের মতো আচরণ করে। আধুনিক বৈদ্যুতিক মোটর এই নীতি মেনেই কাজ করে। টাভেল বলেন, এ কারণেই কণাবিজ্ঞানীরা অতিপারমাণবিক কণার এই বিশেষ ধর্মের নাম দিয়েছিলেন স্পিন। হয়তো তাঁরা ভেবেছিলেন, কণাগুলোর চিরায়ত বলবিদ্যার চার্জিত বস্তুর মতো অতিপারমাণবিক কণাও ঘোরে বলেই সেগুলোর এই চৌম্বক ধর্ম দেখা যায়। তখন থেকেই আসলে কণার এই বিশেষ ধর্মের নাম হয়ে যায় স্পিন। আদতে ইলেকট্রনের মতো কণাগুলো নিজ অক্ষের ওপর এভাবে ঘোরে না। সময় বদলেছে, যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে ইলেকট্রনের এই ঘূর্ণন সে সময় কল্পনা করেছিলেন, সেই ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে। স্পিন টার্মটা এখনো রয়ে গেছে। কণার বিশেষ এক ধর্মকে বোঝাতে এখনো স্পিন শব্দটা ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন
কোনো চার্জিত লোহার বলকে যদি বিদ্যুতায়িত করা যায়, তারপর এটিকে যদি ঘোরানো যায় বা কম্পিত করা যায়, তাহলে সেই বস্তুকে ঘিরে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়, গোলকটা তখন চুম্বকের মতো আচরণ করে।

তিন

কোয়ান্টাম কণার স্পিন ধারণার জনক অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী পাউলি। ১৯২৪ সালে তিনি ইলেকট্রন কণার জন্য স্পিন ধারণা প্রবর্তন করেন। তবে এর আগে দুই জার্মান বিজ্ঞানী অটো স্টার্ন ও ওয়ালথার গারল্যাকের পরীক্ষা থেকে এর আভাস বেরিয়ে আসে। ১৯২২ সালে একটি সফল পরীক্ষা চালান স্ট্রার্ন-গারল্যাক।

পরীক্ষাটা তাঁরা করেছিলেন ইলেকট্রনের ওপর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব দেখার জন্য। আগেই বলা হয়েছে, ইলেকট্রনের মতো চার্জিত কণাগুলোর ওপর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব দেখা যায়। স্টার্ন আর গারল্যাক সেটিই আরেকটু স্পষ্ট করে দেখতে চেয়েছিলেন। এর অবশ্য একটি কারণও আছে। ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দ্য ব্রগলি বা শ্রোডিঙ্গার কারও তত্ত্বই তখন প্রতিষ্ঠিত নয়। হাইজেনবার্গও প্রকাশ করেননি তাঁর অনিশ্চয়তা তত্ত্ব। কোয়ান্টামতত্ত্ববিদেরা তাই ধরেই নিয়েছিলেন, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। এই ঘোরা তখনই বৈধ হবে, যখন সেটি কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি মেনে চলবে।

পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু সংরক্ষণশীলতার নীতি আছে। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় নীতিটা হলো শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি। তারপরেই ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি। ভরবেগ রৈখিক হতে পারে, আবার কৌণিকও হতে পারে। কৌণিক ভরবেগের জন্যও একটি সংরক্ষণশীলতার নীতি থাকবে। এই সংরক্ষণশীলতা ঘূর্ণমান বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতেই যখন ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের ব্যাপারটা নজরে আসে, যেহেতু তখন ইলেকট্রনকে মনে করা হতো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণনশীল কণা, তাই এর কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতা বজায় রাখার জন্য দরকার হয়ে পড়ল নিজ অক্ষের ওপর ঘূর্ণনের। এটিকেই পদার্থবিজ্ঞানীরা নাম দিলেন স্পিন।

আরও পড়ুন
কোয়ান্টামতত্ত্ববিদেরা তাই ধরেই নিয়েছিলেন, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। এই ঘোরা তখনই বৈধ হবে, যখন সেটি কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার নীতি মেনে চলবে।

ইলেকট্রন হলো চার্জিত কণাগুলো যখন চুম্বকে পরিণত হয়। কারণটা আগেই বলেছি। চার্জিত বিদ্যুৎক্ষেত্র তড়িৎ হলে অর্থাৎ কাঁপলে কিংবা ঘুরলে চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। স্টার্ন ও গারল্যাক ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের দিক বের করতে চাইলেন। এ জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন দুটি চুম্বক। একটি চুম্বক ওপর দিকে, আরেকটি চুম্বক নিচের দিকে। ওপরের চুম্বকের দক্ষিণ মেরু নিচের দিকে এবং নিচের চুম্বকের উত্তর মেরু ওপরের দিকে। অর্থাৎ মুখোমুখি রাখা হলো দুটি চুম্বক। দুই চুম্বকের মাঝখানে একটি সরু টানেল বা গলিপথ। সেই গলিপথের ভেতর দিয়ে সিলভার পরমাণুর বিম ছুড়ে মারলেন দুই বিজ্ঞানী।

তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন, সিলভার পরমাণু দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এক ভাগ ওপরের চুম্বকের দিকে বেঁকে যাচ্ছে। আরেক ভাগ বেঁকে যাচ্ছে নিচের চুম্বকের দিকে। তারপর দুই ভাগে ভাগ হয়ে সেই সিলভার বিম গিয়ে পড়ছে সামনে রাখা পর্দার ওপর।

স্টার্ন ও গারল্যাক পরীক্ষা
ছবি: শাটারস্টোক

সিলভার পরমাণুতে ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের দিক থাকার কথা এলোমেলো। কিন্তু চুম্বকক্ষেত্র পেরিয়ে পর্দার ওপর যেভাবে স্তূপ জমেছে, তাতে দেখা যায় কেবল দুটি দিকে ঘোরে ইলেকট্রন।

এমনটা কেন হচ্ছে? কারণ, সিলভার পরমাণু শেষ কক্ষপথে একটি একক ইলেকট্রন থাকে। বহিঃস্থ সেই ইলেকট্রনই চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে সেগুলোর গতিপথ যাচ্ছে বেঁকে।

স্টার্ন আর গারল্যাক দেখলেন, সিলভার পরমাণু গিয়ে সামনের পর্দায় দুটি স্তূপ তৈরি করেছে। যে পরমাণুগুলো ওপরের দিকে বেঁকে গিয়েছিল, সেগুলো একটা স্তূপ তৈরি করেছিল পর্দার ওপর। আবার যে পরমাণুগুলো নিচের দিকে বেঁকে গিয়েছিল, সেগুলো পর্দার নিচের দিকে স্তূপ তৈরি করেছে। দুই স্তূপের মধ৵খানে ফাঁকা। মজার ব্যাপার হলো, দুই স্তূপে পরমাণুর সংখ্যা প্রায় সমান।

আরও পড়ুন
স্টার্ন ও গারল্যাক অবাক হয়ে দেখলেন, সিলভার পরমাণু দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এক ভাগ ওপরের চুম্বকের দিকে বেঁকে যাচ্ছে। আরেক ভাগ বেঁকে যাচ্ছে নিচের চুম্বকের দিকে।

অর্থাৎ চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে ইলেকট্রনগুলো হয় ওপরের দিকে গেছে, নয়তো নিচের দিকে। অথচ ব্যাপারটা অন্য রকম হবে বলে ভেবেছিলেন স্টার্ন আর গারল্যাক। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না, কেন সব সিলভার পরমাণুর মুখ দুই দিকেই বেঁকে যাচ্ছে।

আমরা তো ক্রিকেট বল বা লাটিমের স্পিনের কথা জানি। আবার পৃথিবীর নিজ অক্ষে ২৪ ঘণ্টায় একবার স্পিন বা ঘূর্ণনের কথাও জানি, যার জন্য দিন-রাত হয়। কোনো একটি কেন্দ্র বরাবর ঘূর্ণনকে কৌণিক ভরবেগ বা অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম নামের ভৌত রাশির (যা পরিমাপযোগ্য এবং সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়) সাহায্যে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করা হয়। অক্ষ বরাবর ঘূর্ণনের সঙ্গে একইভাবে স্পিন অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টামকে যুক্ত করা যায়।

যদিও ইলেকট্রনের স্পিনকে বোঝার জন্য এই ক্লাসিক্যাল বা চিরায়ত বর্ণনা সাহায্যকারী; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটিকে এভাবে ভিজ্যুয়ালাইজ করা অথবা এর এই রকম প্রত্যক্ষীকরণ শুধু বোঝার সুবিধার জন্য কোয়ান্টাম ঘটনাকে আসলে এভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।

অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯২৪ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি স্টার্ন আর গারল্যাকের পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড় করালেন তাঁর বিখ্যাত বর্জন নীতি। তিনি বলেন, একই শক্তিস্তরে দুটি ইলেকট্রনের সব কটি কোয়ান্টাম নম্বর এক হতে পারে না। ইলেকট্রনের মোট কোয়ান্টাম সংখ্যা চার—প্রিন্সিপাল বা প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা, অ্যাজিমুথাল বা সহকারী কোয়ান্টাম সংখ্যা, ম্যাগনেটিক বা চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা এবং স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা।

আরও পড়ুন
অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং বলেন, একই শক্তিস্তরে দুটি ইলেকট্রনের সব কটি কোয়ান্টাম নম্বর এক হতে পারে না। ইলেকট্রনের মোট কোয়ান্টাম সংখ্যা চার।

পাউলি বললেন, একই সঙ্গে জোড়ায়-জোড়ায় থাকা ইলেকট্রনগুলোর প্রথম তিনটি কোয়ান্টাম সংখ্যা একই হয়, তাহলে স্পিন কোয়ান্টাম হবে বিপরীত। অর্থাৎ স্পিনের দিকটা হবে পরস্পরের বিপরীত। স্ট্যান আর গারল্যাকের পরীক্ষা থেকে বেরোনো ফলাফল থেকেই স্পিনের দুটি দিক নির্ধারিত হলো, স্পিন আপ আর স্পিন ডাউন। তার মানে একই বিন্দু বা ঘরে থাকা দুটি একটির স্পিন যদি হয় আপ, অন্যটির হবে ডাউন। ১৯২৫ সালে কোয়ান্টাম কণার স্পিন ধারণাটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ওপর দাঁড় করান দুই ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী স্যামুয়েল গৌডস্মিথ ও জর্জ উলহেনবাক।

চার

লাটিমের মতো ঘূর্ণন যদি না-ই হবে, স্পিন তাহলে কী?

স্পিন হলো কোয়ান্টাম কণিকার একটি অভ্যন্তরীণ ধর্ম, যেটা কণার ভেতর চুম্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। তবে এটা বাহ্যিক দৃষ্টিতে কেমন, সেটি আসলে আমরা কখনো জানতে পারব না। কারণ, কণা লেভেলে আমাদের কাণ্ডজ্ঞান ঠিকঠাকমতো কাজ করে না। আরেকটি কথা, স্পিন ধর্ম কিন্তু শুধু ইলেকট্রনের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং সব ধরনের মৌলিক কণার স্পিন আছে। স্পিন আছে প্রোটন-মেসনের মতো ভারী হ্যাড্রন কণাগুলোরও।

লেখক: সাংবাদিক

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন