এবার মহাকাশে আটকে পড়েছেন চীনের তিন নভোচারী

চীনের শেনঝৌ-২০ মিশনের তিন নভোচারী ওয়াং জি, চেন ঝংরুই এবং চেন ডং।ছবি: গেটি ইমেজ

মহাকাশে নভোচারীদের আটকে পড়ার ঘটনা যেন থামছেই না! গত বছর জুনে নাসার দুই নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানের ত্রুটির কারণে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আটকে পড়েছিলেন। আট দিনের মিশন পরিণত হয়েছিল দীর্ঘ নয় মাসের অপেক্ষায়।

আর এখন সেই একই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হলেন আরও তিনজন নভোচারী। এবার চীনের তিয়াংগং মহাকাশ স্টেশনে আটকা পড়লেন তিন তাইকোনট। চীনের নভোচারীদের তাইকোনট বলে।

কী ঘটেছে স্পেস স্টেশনে

চীনের শেনঝৌ-২০ মিশনের তিন নভোচারী হলেন ওয়াং জি, চেন ঝংরুই এবং চেন ডং। চলতি বছর এপ্রিল মাস থেকে তাঁরা তিয়াংগং স্টেশনে ছিলেন। তাঁদের ছয় মাসের মিশন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য ৩১ অক্টোবর শেনঝৌ-২১ মিশনে নতুন ক্রুরা স্টেশনে পৌঁছেও যান।

পুরোনো ক্রুদের বাড়ি ফেরার তারিখ ছিল ৫ নভেম্বর, বুধবার। সবকিছু যখন ঠিকঠাক, বিপত্তি ঘটল ঠিক তখন। চীনের ম্যানড স্পেস এজেন্সি তাদের সামাজিক মাধ্যম উইবোতে এক বিবৃতিতে জানায়, পৃথিবীতে ফেরার জন্য নভোচারীরা যে ক্যাপসুলটি ব্যবহার করতেন, সেটিতে মহাকাশী বর্জ্য বা স্পেস জাঙ্ক আঘাত হেনেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এই ঘোষণার পর, নভোচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৫ নভেম্বরের সেই প্রত্যাবর্তন মিশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ক্যাপসুলটিতে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে বা নভোচারীরা কবে ফিরতে পারবেন, সে সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

আরও পড়ুন
চীনের শেনঝৌ-২০ মিশনের তিন নভোচারী হলেন ওয়াং জি, চেন ঝংরুই এবং চেন ডং। চলতি বছর এপ্রিল মাস থেকে তাঁরা তিয়াংগং স্টেশনে ছিলেন। তাঁদের ছয় মাসের মিশন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
পৃথিবীর চারপাশে আছে অনেক মহাকাশীয় বর্জ্য

স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশীয় বর্জ্য কী

এই মহাকাশ বর্জ্য ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে উঠছে। সত্যি বলতে, আমরা মানুষ প্রজাতি হিসেবে বড্ড অগোছালো। পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথকেও আমরা পরে পরিষ্কার করব বলে রেখে দিয়েছি। এই আবর্জনাগুলো হলো পুরোনো স্যাটেলাইট বা রকেটের ভাঙা টুকরো। এগুলো ঘণ্টায় হাজার হাজার মাইল বেগে ছুটে বেড়ায় মহাকাশে। এর ভয়েই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বেশ কয়েকবার জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সরিয়ে নিয়েছিল। শুধু এই ছুটে আসা বর্জ্যের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য। এমনকি চীনের এই তিয়াংগং স্টেশনের একটি সোলার প্যানেলও ২০২৩ সালে আবর্জনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আরও পড়ুন

দুঃস্বপ্নের নাম কেসলার সিনড্রোম

বিজ্ঞানীদের মনে এই আবর্জনা নিয়ে সবচেয়ে বড় যে ভয়টি কাজ করে, তার নাম কেসলার সিনড্রোম। ১৯৭০-এর দশকে নাসার বিজ্ঞানী ডন কেসলার প্রথম এই তত্ত্বটি দেন। তত্ত্বের মূল কথা হলো, এটা এমন এক পরিস্থিতি যেখানে পৃথিবীর কক্ষপথে এত বেশি মহাকাশীয় বর্জ্য জমে যায় যে একটির সঙ্গে আরেকটির সংঘর্ষে আরও হাজারো টুকরো ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলো আবার নতুন নতুন সংঘর্ষ ঘটাতে থাকে। ফলে এই সংঘর্ষের একটা চেইন রিঅ্যাকশন শুরু হয়। ধরুন, একটি বর্জ্যের আঘাতে একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস হলো। সেই ধ্বংসের ফলে হাজার হাজার নতুন বর্জ্যের টুকরো তৈরি হলো। সেই টুকরোগুলো আবার অন্য স্যাটেলাইটকে আঘাত করল, যা থেকে তৈরি হলো আরও লাখ লাখ টুকরো!

এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে একসময় পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথ আবর্জনায় এতই ভরে যাবে যে, আমাদের জিপিএস বা যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এমনকি সবচেয়ে খারাপ যে ভয়টা, আমরা হয়তো পৃথিবীতেই আটকা পড়ব। মহাকাশে নতুন কোনো রকেট পাঠানোই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। গ্র্যাভিটি মুভির সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মতোই!

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানীদের মনে এই আবর্জনা নিয়ে সবচেয়ে বড় যে ভয়টি কাজ করে, তার নাম কেসলার সিনড্রোম। ১৯৭০-এর দশকে নাসার বিজ্ঞানী ডন কেসলার প্রথম এই তত্ত্বটি দেন।

আটকে পড়াই যেন নিয়তি!

আশ্চর্যজনকভাবে মহাকাশে আটকে পড়ে অনেকেই রেকর্ড করেছেন! নাসার ফ্রাঙ্ক রুবিও ঠিক এভাবেই তার ক্যাপসুলে উল্কাপিণ্ডের আঘাতে আটকে পড়েছিলেন এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে ৩৭১ দিন মহাকাশে কাটিয়ে আমেরিকান হিসেবে রেকর্ড গড়েন।

আর এখন শেনঝৌ-২০-এর কমান্ডার চেন ডং এই অনাকাঙ্ক্ষিত দেরির কারণে, মহাকাশে সবচেয়ে বেশি দিন কাটানো চীনা নভোচারী হিসেবে নিজের রেকর্ডকে আরও বাড়িয়ে চলেছেন। তবে মহাকাশে সবচেয়ে বেশি দিন থাকার বিশ্বরেকর্ডটি রুশ নভোচারী ওলেগ কোনোনেঙ্কোর। তিনি মোট ১ হাজার ১১১ দিন কাটিয়েছেন!

সৌভাগ্যবশত, এই ধরনের বিপদের জন্য সব মহাকাশ সংস্থারই ‘প্ল্যান-বি’ প্রস্তুত থাকে। তদন্তে যদি দেখা যায় যে, শেনঝৌ-২০ ক্যাপসুলটি সত্যিই নভোচারীদের জন্য আর নিরাপদ নয়, তবে সেটিকে যাত্রী ছাড়াই পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে আটকে পড়া এই শেনঝৌ-২০ ক্রুরা তাদের স্টেশনে থাকা নতুন ক্রুদের জন্য আসা ক্যাপসুলটি ধার নেবেন এবং সেটা ব্যবহার করে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। এরপর চীন মাটি থেকে আরেকটি নতুন ও খালি ক্যাপসুল পাঠাবে শেনঝৌ-২১-এর ক্রুদের ফিরিয়ে আনার জন্য। সুতরাং, নভোচারীরা নিরাপদে ফিরে আসবেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কবে, কীভাবে ফিরবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এই অতিরিক্ত সময়টা তাঁদের মহাকাশ স্টেশনেই কাটাতে হবে!

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও আইএফএল সায়েন্স

আরও পড়ুন