ধারাবাহিক
আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - শেষ পর্ব
মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের বিস্ময়-আগ্রহ পুরকালের। পৌরাণিক যুগ থেকেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভান্ডার। আধুনিক যুগে এসে আমূলে বদলে গেছে মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। মানুষ এখন অনন্ত মহাবিশ্বের গভীর থেকে গভীরে ডুব দিতে চায়। কতটুকু সফল সে চেষ্টায়? ইতিহাস আর বিজ্ঞানের খেরোখাতায় চোখ রাখা যাক।
হেমন্তের আকাশ
বাংলায় বর্ষা এখন শরৎ পর্যন্ত বিস্তৃত, আর শীত যেন এক নিষ্প্রভ হেমন্ত। অথচ হেমন্তেরই হওয়া উচিত ছিল এক মায়াবী ঋতু। উত্তরের দেশে গাছের পাতায় তখন রং বদলায়, আর বাংলায় জলবিষুবের (Autumnal Equinox) পরে আসত নানা শারদীয় উত্সব। ঘরে উঠত নতুন ধান, মাঠে নামত কুয়াশা। এর মধ্যে কিছু কিছু যে এখনো হয় না তা নয়। তবু হেমন্তকে আমরা যেন আর ছুঁতে পারি না। তাকে নিয়ে আর জীবনানন্দের মতো কাব্য করা হয় না। কিন্তু হেমন্তের রাতের আকাশ আগের মতোই আছে, শুধু তাকে দেখতে হলে শহরের আলোর বাইরে যেতে হবে। গ্রীষ্মের দেনেব, অভিজিৎ ও আলটেয়ারকে নিয়ে গঠিত উজ্জ্বল ত্রিভুজ এখন হেলে পড়ছে পশ্চিমে। অক্টোবর, নভেম্বর মাসে আকাশে তেমন জ্বলজ্বলে তারা নেই। এ সময়ে মাথার ওপরে থাকবে পেগাসাসের বর্গক্ষেত্র। কেমন করে চেনা যাবে সেটাকে? প্রথমে শুরু করা যাক সপ্তর্ষি দিয়ে। দিগন্তে শোয়া এই তারকাসমষ্টির কাছ থেকে ধ্রুবতারার মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছে যাব ওপরে ক্যাসিওপিয়ায় (চিত্র ১)।
ক্যাসিওপিয়া থেকে আমরা যাব পেগাসাসের বর্গক্ষেত্রে (চিত্র ২)। এটি ঠিক বর্গক্ষেত্র নয় এবং এর একটি তারা, আলফারেটজ, পেগাসাস নক্ষত্রমণ্ডলেরও নয়, বরং অ্যান্ড্রোমিডা মণ্ডলের প্রধান তারা। পেগাসাস থেকে কী করে আমাদের সবচেয়ে কাছের বড় গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডাকে চিহ্নিত করা যাবে, সেটা ৩ নম্বর চিত্রে দেখানো হয়েছে।
পেগাসাসের বর্গক্ষেত্রের দক্ষিণের দুটি তারা, প্রথম মানের ফোমেলহাউট বা মত্স্যমুখ ও দ্বিতীয় মানের ডিফডা বা তিমিরকে বাংলাদেশের আকাশ থেকে সহজেই দেখা যাবে (চিত্র ২)। ডিফডার পূর্ব দিকে বলতে গেলে কোনো উজ্জ্বল তারাই নেই, একে সিটাস-এরিডানাস শূন্যতা বলা হয়। এই শূন্যতা পার হয়ে যে তারাটি আকাশে জ্বলজ্বল করে সেটি হলো কালপুরুষের রাইজেল বা বাণরাজা।
হেমন্তের আকাশের সর্ব দক্ষিণের তারা হচ্ছে আখেরনার বা নদীমুখ (চিত্র ৫)। ৬৯ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত নদীমুখ আকাশের অষ্টম উজ্জ্বল তারা। মত্স্যমুখ বা ফোমেলহাউট, ১৬তম উজ্জ্বল, দক্ষিণ আকাশে অনেক সহজেই দেখা যায়, নদীমুখের দেখা পাওয়া কঠিন। শৌখিন জ্যোতির্বিদেরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারেন।
অ্যানড্রোমিডা গ্যালাক্সি (M31)
ছায়াপথের বাইরে যে গ্যালাক্সিটিকে খালি চোখে দেখা যাবে সেটি হচ্ছে অ্যানড্রোমিডা (M31)। আগেই উল্লেখ করেছি, হেমন্তের সময় কোনো অন্ধকার স্থান থেকে পেগাসাসের বিশাল চতুষ্কোণকে চিহ্নিত করে এই গ্যালাক্সির নির্দেশ পাওয়া যেতে পারে। এই গ্যালাক্সিটি আকারে ও ভরে আমাদের ছায়াপথের মতোই, হয়তো একটু বড়। বাইনোকুলার বা দুরবিন দিয়ে দেখলে এর কুণ্ডলী বাহুগুলো দেখা যাবে না, কিন্তু এটির উজ্জ্বল ব্যাপ্ত কেন্দ্র খুব সহজেই চোখে পড়বে। M31-এর দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই গ্যালাক্সি থেকে যে আলো আমরা আজ দেখছি, তা প্রায় আড়াই মিলিয়ন বা ২৫ লাখ বছর আগে তার যাত্রা শুরু করেছিল। এমন হতে পারে এই ‘মুহূর্তে’ সেই গ্যালাক্সির কোনো গ্রহের কোনো শৌখিন জ্যোতির্বিদ আমাদের এই গ্যালাক্সির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রতিভাত হবে আজ থেকে ২৫ লাখ বছর আগের ছায়াপথ, যখন মানুষের পদার্পণ ঘটেনি এই পৃথিবীতে। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের গ্যালাক্সির দিকে ছুটে আসছে এবং মনে করা হয় আজ থেকে চার বিলিয়ন বা চার শ কোটি বছর পরে এটির সঙ্গে আমাদের গ্যালাক্সির সংঘর্ষ হবে। দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষের ফলে নক্ষত্ররা একে অপরকে সরাসরি আঘাত করে না, বরং তাদের সম্মিলিত মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে তাদের কক্ষপথ প্রভাবিত হয়। শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুটি গ্যালাক্সি মিশে যায়।
অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখার সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। রাত ৯-১০টায় তখন মাথার ওপরে উঠে আসবে পেগাসাসের চতুর্ভুজ (চিত্র ৩)। চতুর্ভুজের এক কোনায় একটা উজ্জ্বল তারা হচ্ছে আলফারেটজ বা আলফা অ্যান্ড্রোমিডা, সেখান থেকে যেতে হবে ডেলটা অ্যান্ড্রোমিডা নামে একটি ম্লান তারায়, তারপর রেখাটা বাড়িয়ে দিয়ে পৌঁছাতে হবে বেটা অ্যান্ড্রোমিডা নামে তারাটিতে। এবার ওপরে ওঠার পালা। বেটা থেকে ওপরে উঠে মিউ, আর মিউ থেকে আর একটু ওপরে উঠলে নিউ। নিউয়ের একটু ডান দিকেই আবছাভাবে ছড়িয়ে আছে M31 (চিত্র ৪)।
গ্যালাক্সিটির দিকে সরাসরি না তাকিয়ে একটু পাশের দিকে চোখ রাখলে সেটাকে আর একটু ভালো দেখা যাবে।
লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও অধ্যাপক, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
* লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত
এই ধারাবাহিক পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। বইয়ের নাম আকাশ পর্যবেক্ষণের নোটবই।
