সৌরচক্রের কথা

শিল্পীর কল্পনায় সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহ

পৃথিবীতে প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় আলো ও শক্তির যোগান আসে সূর্য থেকে। শুধু পৃথিবী নয়, সৌরজগতের সাতটি গ্রহ ও প্রায় শ খানেকের বেশি উপগ্রহও সূর্যের শাসনে আবদ্ধ। এই সৌররাজের বুকে উৎপন্ন তাপ ও আলো পৌঁছে যায় অন্যসব গ্রহে। তবে সূর্য যে বৈদ্যুতিক বাতির মতো শুধু তাপ আর আলো তৈরি করছে, বিষয়টা কিন্তু তা নয়।

সূর্যের আলো ও তাপ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। মহাকর্ষের প্রচণ্ড চাপে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস জোড়া লেগে তৈরি হয় হিলিয়াম অণু। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মোট ভরের চেয়ে নতুন তৈরি হওয়া হিলিয়ামের ভর হয় কিছুটা কম। এই কিছুটা ভরই আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমীকরণ, E=mc2 অনুসারে পরিণত হয় শক্তিতে। এই শক্তি আমরা পাই তাপ ও আলো হিসেবে। এই পুরো বিষয়টিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। ক্রমাগত ফিউশন বিক্রিয়া ঘটছে সূর্যের কেন্দ্রে। নক্ষত্রটির ব্যাপ্তি বিশাল। ফলে, নিউক্লীয় বিক্রিয়া ঘটার পাশাপাশি এখানে ঘটছে হাজারও রকম ঘটনা। বাড়ছে-কমছে সূর্যের সক্রিয়তা। এই সক্রিয়তা হ্রাস-বৃদ্ধির কথা আলোচনা করতে যে শব্দটি প্রচুর ব্যবহৃত হয়, সেটা হলো সোলার সাইকেল বা সৌরচক্র।

সৌরচক্র মূলত সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের চক্রাকার পরিবর্তনের নাম। চক্রাকার এই পরিবর্তনের জন্য সময় লাগে গড়ে ১১ বছরের মতো। এই চক্র চলাকালীন সময়ে সূর্যের মেরু পরিবর্তিত হতে থাকে। অর্থাৎ সূর্যের দক্ষিণ ও উত্তর মেরু একে অন্যের সঙ্গে জায়গা বদল করে। পরে আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। পৃথিবীও এই কাজটি করে। অর্থাৎ মেরু বদল পৃথিবীতেও হয়, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন লম্বা সময়। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ৩ লাখ বছর।

মেরু বদল পৃথিবীতেও হয়, কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন লম্বা সময়। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ৩ লাখ বছর।
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
বর্তমানে সূর্য এরকম একটি সৌরচক্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে উচ্চশক্তির আয়নিত কণা, এক্সরে ও গামা বিকিরণ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে আছড়ে পড়ার পরিমাণ বেড়েছে। সেজন্য বেতার তরঙ্গ ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনাও ঘটেছে অতি সম্প্রতি।

সৌরচক্রের কোন অবস্থায় আছে সূর্য, তা খুব সহজেই বোঝা যায় সৌরকলঙ্কের সংখ্যা দেখে। সৌরকলঙ্ক হলো সূর্যের গায়ে ফুটে ওঠা কালো কালো দাগ। মূলত তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় সৌরপৃষ্ঠের কিছু কিছু অঞ্চল দেখতে কালো হয়। এগুলোকেই বলে সৌরকলঙ্ক। এর পেছনে দায়ী সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র। এই চৌম্বকক্ষেত্র সৌরচক্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

১১ বছর সৌরচক্রের গড় সময়কাল। সবসময় যে ১১ বছর পরপরই সূর্যের মেরু পরিবর্তন হয়, তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ঘটে যায় ৮ বছরের মধ্যেই। কখনো আবার লেগে যায় ১৪ বছর। সময় ভিন্নতার মতো, সব সৌরচক্রে সূর্যের অবস্থাও একরকম থাকে না। অর্থাৎ সৌরচক্রকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার সুযোগ নেই।

সূর্য যখন সবচেয়ে কম সক্রিয় থাকে, তখন থেকে শুরু হয় সৌরচক্র। এ সময় সূর্যের গায়ে দাগ বা সৌরকলঙ্কের পরিমাণ খুব কম থাকে। এসব সৌরকলঙ্ক স্থায়ীও হয় না বেশি সময়। এদের এ সময় পাওয়া যায় সূর্যের বিষুবরেখার আশেপাশে। এই সময়টাকে ইংরেজিতে বলে সোলার মিনিমাম। অর্থাৎ এটি সূর্যের সর্বনিম্ন সক্রিয় অবস্থা।

পরপর কয়েকটি সৌরচক্রে কী পরিমাণ সৌরকলঙ্ক দেখা যাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে মাপা হয় সূর্যের গড় সক্রিয়তা। সাধারণত গড়ে কয়েকটি সৌরচক্রে যে পরিমাণ সৌরকলঙ্ক দেখা যায়, পরপর কয়েকটি সৌরচক্রে সৌরকলঙ্কের গড় পরিমাণ তার চেয়ে কম হলে তাকে বলে গ্র্যাণ্ড সোলার মিনিমাম (সঠিক বাংলা নেই)। বলা যায়, সূর্য দীর্ঘসময় ধরে সর্বনিম্ন সক্রিয় দশা পার করছে। এরকম ঘটনা শেষবার ঘটার প্রমাণ মেলে ১৬৪৫ থেকে ১৭১৫ সালের মধ্যে। এ সময় সূর্যের সক্রিয়তা একটানা সর্বনিম্ন দশা পার করেছে। খাতা কলমে এ ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছিল, মণ্ডার (Maunder) মিনিমাম। এ সময় সূর্যের গায়ে গড়ে ৫০টিরও কম সৌরকলঙ্ক দেখা গিয়েছিল বলে জানা যায়। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও কমে যায় খানিকটা। বিজ্ঞানীরা এ সময়টাকে বলেন লিটল আইস এজ। মানে, আইস এজ বা বরফ যুগের সামান্য আঁচ পেয়েছিল সে সময়ের মানুষ। সূর্যের কম সক্রিয়তা এর পেছনের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। তবে, সে সময় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। নিয়মিত হারে উৎপন্ন ছাই ছড়িয়ে পড়ছিল বায়ুমণ্ডলে। এই ছাইকেও এজন্য দায়ী করেন অনেকে। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সূর্যের সক্রিয়তা কমা-বাড়ার বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনে সামান্য ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন
সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তির বিকিরণকে আটকে দেয় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও বায়ুমণ্ডল
আরও পড়ুন

সৌরচক্রের মাঝামাঝি সময়ে সূর্যের সক্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময় বেড়ে যায় সৌরকলঙ্কের সংখ্যা ও এদের স্থায়িত্ব। বিষুবরেখা থেকে যথেষ্ট দূরে তৈরি হয় এসব সৌরকলঙ্ক।

সূর্যের সক্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে যায় সৌরঝড়। সোলার ফ্লেয়ার বা সৌরশিখার নিঃসরণও বেড়ে যায়। যাঁরা ভাবছেন, সৌরশিখা কী, তাঁদের জন্য বলি। সৌরকলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা উচ্চশক্তির বিকিরণকে বলা হয় সৌরশিখা। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে ঘটে করোনাল ম্যাস ইজেকশন—সৌরপৃষ্ঠ থেকে প্রচণ্ড প্লাজমা ও চৌম্বকক্ষেত্রের নির্গমন।

দুটোই প্রাণ ও প্রযুক্তির ওপরে প্রভাব ফেলে। সমস্যা দেখা দেয় কৃত্রিম উপগ্রহে। এসব উপগ্রহ যোগাযোগসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মিতই। তা ছাড়া উচ্চশক্তির বিকিরণ আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে থাকা নভোচারীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে যখন স্পেসস্যুট পরে নভোযানের বাইরে, মহাশূন্যে থাকেন তাঁরা, তখন ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। এসব ছাড়াও সূর্যের সক্রিয়তা বাড়ার কারণে বেড়ে যায় পৃথিবীর মেরুজ্যোতি। এ ছাড়া পৃথিবীর ভেতরে খুব একটা সমস্যা হয় না। এ জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানানো উচিৎ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও বায়ুমণ্ডলকে।

বর্তমানে সূর্য এরকম একটি সৌরচক্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে উচ্চশক্তির আয়নিত কণা, এক্সরে ও গামা বিকিরণ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে আছড়ে পড়ার পরিমাণ বেড়েছে। সেজন্য বেতার তরঙ্গ ব্ল্যাকআউটের মতো ঘটনাও ঘটেছে অতি সম্প্রতি। আরোরা বা মেরুজ্যোতির পরিধিও বেড়েছে একই কারণে। দক্ষিণ মেরুর জ্যোতি ছড়িয়ে পড়েছে পেনসিলভানিয়া, আইওয়া এবং ওরিগন পর্যন্ত।

সামনের বছরগুলোতে সৌরশিখার আঘাত আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আগামী ২০২৫ সালের দিকে বর্তমান সৌরচক্র তার মাঝামাঝি সীমায় পৌঁছাতে পারে। এরপর কমতে শুরু করবে সৌরশিখার পরিমাণ ও শক্তি। তবে এ নিয়ে জনসাধারণের দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ওয়ার্ল্ড-অ্যাটলাস