মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়ার দাবি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের

MACS J0416 গ্যালাক্সি ক্লাস্টারছবি: নাসা

সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রথম নক্ষত্রগুলোর সন্ধান পেয়েছে বলে দাবি করেছে। এই নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়ার জন্য এতদিন বিজ্ঞানীরা চাতক পাখির মতো চেয়ে ছিলেন। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর যখন মহাবিশ্ব ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল, তখন প্রথম যে নক্ষত্রের জন্ম হয়, সেই নক্ষত্রের আলো নাকি ধরা দিয়েছে টেলিস্কোপে!

এই আবিষ্কার শুধু রোমাঞ্চকরই নয়, এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে, কীভাবে গ্যালাক্সিগুলো তৈরি হয়েছিল। চলতি বছর অক্টোবরে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি বেশ আলোড়ন ফেলেছে বৈজ্ঞানিক মহলে।

যে নক্ষত্রগুলোর কথা বলছি, এদের নাম পপুলেশন থ্রি স্টার। বিগ ব্যাং ঘটার কয়েক কোটি বছর পরে এই নক্ষত্রগুলো জন্ম নিয়েছিল বলে মনে করা হয়। মহাবিশ্বে তখন আয়রন বা কার্বনের মতো কোনো ভারী ধাতু ছিল না। ছিল শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। 

তবে এই নক্ষত্রগুলো আমাদের সূর্যের মতো শান্ত-শিষ্ট ছিল না। এরা ছিল সূর্যের চেয়ে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ গুণ ভারী এবং কোটি গুণ বেশি উজ্জ্বল! এগুলো ডার্ক স্টার হলে অন্তত ১০ লাখ গুণ ভারী হবে। কিন্তু সাধারণ পপুলেশন-থ্রি স্টার হলে হবে কয়েক শ গুণ ভারী। এতদিন এগুলো শুধুই খাতায়-কলমে ছিল, বাস্তবে কেউ দেখেনি।

আরও পড়ুন
বিগ ব্যাং ঘটার কয়েক কোটি বছর পরে পপুলেশন থ্রি স্টার নক্ষত্রগুলো জন্ম নিয়েছিল বলে মনে করা হয়। মহাবিশ্বে তখন আয়রন বা কার্বনের মতো কোনো ভারী ধাতু ছিল না।

কোথায় মিলল এদের খোঁজ

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ইউনিভার্সিটি অব টলেডোর জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী এলি ভিসবাল এবং তাঁর দল দাবি করছেন, তাঁরা পৃথিবী থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে LAP1-B নামের এক গ্যালাক্সিতে এই আদি নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছেন।

কীভাবে বুঝলেন এগুলোই প্রথম নক্ষত্র

বিজ্ঞানীরা কীভাবে নিশ্চিত হলেন, এগুলোই পপুলেশন-থ্রি নক্ষত্র? আসলে তাঁরা কয়েকটা জিনিস খেয়াল করেছেন।

প্রথমত, নক্ষত্রগুলোর স্পেকট্রাম বা বর্ণালি  দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। স্পেকট্রাম বলতে বোঝায়, নক্ষত্র কোন কোন রঙের আলো শোষণ করছে আর কোনগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে বোঝা যায়, নক্ষত্র কী দিয়ে তৈরি। এই নক্ষত্রগুলোর স্পেকট্রামে দেখা গেছে, এতে প্রচুর উচ্চশক্তির ফোটন কণা আছে। তবে নেই কোনো ভারী ধাতু। এটাই হুবহু পপুলেশন-থ্রি নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।

দ্বিতীয়ত, স্পেকট্রাম থেকে বোঝা গেছে, নক্ষত্রগুলো অসম্ভব বড়। প্রতিটা নক্ষত্র প্রায় ১০০ সৌরভরের সমান। মানে আমাদের সূর্যের চেয়ে একশ গুণ ভারী ওগুলো। এটাও ওই তত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায়।

এর পাশাপাশি আরও তিনটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ হয়েছে। নক্ষত্রগুলো এমন পরিবেশে তৈরি হয়েছে যেখানে শুধু হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছিল, অন্য কোনো ভারী পদার্থ ছিল না। এগুলো এমন ছোট্ট গুচ্ছে তৈরি হয়েছে, যেখানে মাত্র কয়েকটা বিশাল তারা আছে। আর নক্ষত্রগুলোর ভরের বণ্টন যেভাবে আছে, সেটা গাণিতিক হিসাবের সঙ্গে মিলে যায়।

আরও পড়ুন
স্পেকট্রাম থেকে বোঝা গেছে, নক্ষত্রগুলো অসম্ভব বড়। প্রতিটা নক্ষত্র প্রায় ১০০ সৌরভরের সমান। মানে আমাদের সূর্যের চেয়ে একশ গুণ ভারী ওগুলো।

আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী যেভাবে সাহায্য করল

এখন মজার ব্যাপার হলো, এই তারাগুলো এত দূরে যে সাধারণভাবে দেখা প্রায় অসম্ভব। তাহলে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দেখল কীভাবে? এখানে কাজে এলো আলবার্ট আইনস্টাইনের একটা তত্ত্ব, যেটা তিনি একশ বছরেরও বেশি আগে বলেছিলেন।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, গ্যালাক্সির মতো খুব ভারী কোনো বস্তু তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। এখন যদি ঠিক এমন সময়ে আরেকটা দূরবর্তী বস্তু পেছনে থাকে, তাহলে সেই বস্তুর আলো সামনের ভারী বস্তুর তৈরি বাঁক দিয়ে যাওয়ার সময় বিকৃত হয়ে যায়। ফলে দূরের বস্তুটাকে অনেক বড় দেখায়, অনেকটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মতো। এই ঘটনাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং। মাঝেমধ্যে এটাকে আইনস্টাইন রিংও বলে।

ঠিক এমনটাই ঘটেছে এখানে। MACS J0416 নামে একটা কাছের ক্লাস্টারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লেন্স হিসেবে কাজ করে LAP1-B গ্যালাক্সি। মানে লেন্স হিসেবে কাজ করে সামনের MACS J0416 ক্লাস্টারটি, আর পেছনের LAP1-B গ্যালাক্সিটি দেখা যায়। ফলে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সেটা দেখতে পেরেছে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আরেকটা বিশেষত্ব হলো এর ২১ ফুট চওড়া আয়না। এত বড় আয়নায় অনেক বেশি আলো ধরতে পারে। আর এই টেলিস্কোপ ইনফ্রারেড রশ্মি দেখার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার কারণে দূরের তারাগুলো থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। সেগুলো আলট্রাভায়োলেট থেকে রূপান্তরিত হয় ইনফ্রারেডে। জেমস ওয়েব এই ইনফ্রারেড আলোই ধরতে পারে।

আরও পড়ুন
MACS J0416 নামে একটা কাছের ক্লাস্টারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লেন্স হিসেবে কাজ করে LAP1-B গ্যালাক্সি। মানে লেন্স হিসেবে কাজ করে সামনের MACS J0416 ক্লাস্টারটি।

আগেও কি এমনটা দেখা গিয়েছিল

আসলে এর আগেও মনে করা হয়েছিল, জেমস ওয়েব পপুলেশন-থ্রি নক্ষত্র দেখেছে। ২০২৪ সালের মার্চে একটা গবেষণায় বলা হয়েছিল, GN-z11 নামে একটা গ্যালাক্সিতে এরকম তারা পাওয়া গেছে। সেগুলো মহাবিশ্ব সৃষ্টির মাত্র ৪৩০ মিলিয়ন বছর পরে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, LAP1-B এর আবিষ্কারই একমাত্র, যেটা পপুলেশন-থ্রি নক্ষত্রের সঙ্গে সবগুলো বৈশিষ্ট্য মিলে যায়। তাই এটাই সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ।

কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ

আপনি হয়তো ভাবছেন, এত পুরনো কিছু নক্ষত্র খুঁজে পাওয়ায় কী এমন লাভ? আসলে লাভ অনেক। প্রথমত, পপুলেশন-থ্রি তারাগুলো যে ছোট্ট ডার্ক ম্যাটার কাঠামোয় তৈরি হয়েছিল, সেগুলোই পরে বড় বড় গ্যালাক্সির ভিত্তি হয়ে গেছে। মানে এই নক্ষত্রগুলো বুঝলে আমরা বুঝতে পারব, গ্যালাক্সিগুলো কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ সত্যিই অসাধারণ কাজ করতে পারছে। মহাবিশ্বের একদম শুরুর দিকের ইতিহাস উন্মোচন করতে পারছে।

MACS J0416 গ্যালাক্সি ক্লাস্টার
ছবি: নাসা

তৃতীয়ত, এটা আমাদের নিজেদের সম্পর্কেও শেখায়। পৃথিবী, সূর্যসহ সবকিছুই তো তৈরি হয়েছে সেই আদিম তারাগুলো থেকে। প্রথম তারাগুলো যখন মরে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল, তখন সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল কার্বন, অক্সিজেন, লোহা ও সোনার মতো ভারী পদার্থ। এগুলো থেকেই পরে তৈরি হয়েছে নতুন নক্ষত্র ও গ্রহ।

এই আবিষ্কার শুরু মাত্র। বিজ্ঞানীরা এখন আরও বেশি করে খুঁজবেন এরকম প্রাচীন নক্ষত্র। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে আরও গভীরে তাকাবেন মহাবিশ্বের দিকে, আরও পেছনে যাবেন সময়ের।

হয়তো শিগগিরই আমরা জানতে পারব, মহাবিশ্বে প্রথম আলো জ্বলেছিল ঠিক কীভাবে। কীভাবে অন্ধকার থেকে আলোর জন্ম হলো। কীভাবে সেই আদিম হাইড্রোজেন গ্যাসের মেঘ থেকে তৈরি হলো প্রথম নক্ষত্র, প্রথম গ্যালাক্সি!

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন