সব কৃষ্ণগহ্বর কি একরকম, নাকি এরও ধরন আছে
মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্যময় বস্তুর নাম ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। এক অর্থে একে বলা চলে মহাকাশের সুগভীর, অতল কুয়ার মতো। এই তলাবিহীন গর্তে কিছু ঢুকলে সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। আসলে কৃষ্ণগহ্বরের মহাকর্ষ টান এতই শক্তিশালী যে তার ভেতরে ঢুকলে যাচ্ছেতাই সব কাণ্ড ঘটে।
গ্যাস, ধূলিকণা, মহাকাশের অন্য যেকোনো বস্তু—সবকিছুই সেখানে চিরতরে হারিয়ে যায়। মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিসীমার তকমা পাওয়া আলোও আটকে যায় কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে। কোনোভাবেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই কৃষ্ণগহ্বরকে সরাসরি চোখেও দেখা যায় না।
কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পড়ে যাওয়া এসব বস্তুর ভাগ্যে কী ঘটে, তা এখনো রহস্যে মোড়া। ব্ল্যাকহোলের রহস্যময় প্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আপনি ব্ল্যাকহোলের ভেতর টেলিভিশন সেট, হীরা বসানো আংটি অথবা আপনার চরম শত্রুকেও ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন, কিন্তু ব্ল্যাকহোলটি শুধু মনে রাখবে তার মোট ভর এবং ঘূর্ণন অবস্থা।’
যাই হোক, সব কৃষ্ণগহ্বর কিন্তু একরকম নয়। তাদের মধ্যেও আছে নানা বৈচিত্র্য, নানা পার্থক্য। এই রহস্যময় বস্তুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিজ্ঞানীরা একে নানা শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রথম ও সহজ শ্রেণিবিভাজনটা করা হয়েছে কৃষ্ণগহ্বরের ভরের ভিত্তিতে। একদিকে আছে স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল এবং আরেক দিকে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। নাম শুনে হয়তো এদের প্রকৃতি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন।
‘আপনি ব্ল্যাকহোলের ভেতর টেলিভিশন সেট, হীরা বসানো আংটি অথবা আপনার চরম শত্রুকেও ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন, কিন্তু ব্ল্যাকহোলটি শুধু মনে রাখবে তার মোট ভর এবং ঘূর্ণন অবস্থা।’
নক্ষত্র থেকে জন্ম যার
স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল বা নাক্ষত্রিক ভরের কৃষ্ণগহ্বর সাধারণত একটি নক্ষত্রের মৃত্যুর পর তৈরি হয়। সাধারণত আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বা তার বেশি ভরের কোনো বিশাল নক্ষত্রের ভাগ্যে এ রকম ঘটে। কোনো বিশাল আকারের নক্ষত্র নিজের নাক্ষত্রিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জ্বালানি (হাইড্রোজেন-হিলিয়াম) ফুরিয়ে ফেলে। তখন নক্ষত্রটির ভারসাম্য ধরে রাখার মতো এর ভেতরে আর কোনো বহির্মুখী চাপ থাকে না।
তাতে তার কেন্দ্রের প্রবল মহাকর্ষ টানে শুরু হয় মহাকর্ষীয় সংকোচন। ফলে নক্ষত্রটি ক্রমেই নিজের কেন্দ্রের দিকে চুপসে যেতে থাকে বা ভেঙে পড়তে থাকে। সেটি চরম ঘন হয়ে পড়ে। এ সময় নক্ষত্রটির বাইরের অংশ প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একে বলা হয় সুপারনোভা।
এ বিস্ফোরণের পর নক্ষত্রটির অবশিষ্ট কেন্দ্রভাগ যদি সূর্যের ভরের তুলনায় প্রায় ৩ গুণের বেশি হয়, তাহলে তার মহাকর্ষীয় সংকোচন চলতেই থাকে। সংকুচিত হতে হতে সেটাই একসময় পরিণত হয় একটি স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোলে।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই কোটি কোটি স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। তবে এগুলো সরাসরি দেখা যায় না। কারণ আগেই বলেছি, কৃষ্ণগহ্বর কোনো আলো বিকিরণ করে না।
দানবীয় কৃষ্ণগহ্বর
ভরের দিক থেকে দ্বিতীয় বড় শ্রেণিটির নাম সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। নাম থেকেই বোঝা যায়, এগুলো অবিশ্বাস্যভাবে ভারী এবং দানবীয় আকৃতির। এসব কৃষ্ণগহ্বরে সূর্যের ভরের লাখ লাখ থেকে কোটি কোটি গুণ পর্যন্ত বস্তু চাপা পড়ে থাকে। এই ধরনের কৃষ্ণগহ্বর সাধারণত গ্যালাক্সির কেন্দ্রস্থলে থাকে।
প্রায় প্রতিটি বড় গ্যালাক্সির হৃদয়ে রয়েছে এমন একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। আমাদের নিজেদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও এমন একটি কৃষ্ণগহ্বর আছে। এর ভর কয়েক লাখ সূর্যের সমান। এ কৃষ্ণগহ্বরের নাম স্যাজিটেরিয়াস এ*।
সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল কীভাবে এত বিশাল হয়, সে রহস্য কিন্তু এখনো পুরোপুরি উদ্ঘাটন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনো গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ছোট ছোট কৃষ্ণগহ্বরগুলো কোটি কোটি বছর ধরে আশপাশের গ্যাস, ধূলিকণা এবং নক্ষত্র গিলে ফেলে বিশাল আকার ধারণ করে। আবার দুটি গ্যালাক্সি যখন একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন তাদের কেন্দ্রের কৃষ্ণগহ্বর দুটিও মিলে গিয়ে একটি অতিদানবীয় কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হয়।
মধ্যম ও ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর
স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল আর সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল ছাড়াও ভরের ভিত্তিতে আরও দুই ধরনের কৃষ্ণগহ্বর আছে। এর মধ্যে রয়েছে এই দুই আকাশ-পাতাল ভরের মধ্যবর্তী ভরের কৃষ্ণগহ্বর। অর্থাৎ এদের ভরসীমা সূর্যের ভরের ৫০ গুণ থেকে ৫০ হাজার গুণ পর্যন্ত হতে পারে। একে বলা হয় ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাকহোল বা মধ্যম ভরের কৃষ্ণগহ্বর। কয়েক দশক আগেও বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর একেবারেই নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে মনে করা হচ্ছে এরা হয়তো আছে, তবে খুবই দুর্লভ।
এ ছাড়া তাত্ত্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা আরেক ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের কথা বলেন। এর নাম মিনি বা মাইক্রো ব্ল্যাকহোল। এরা ভরের দিক দিয়ে অনেক ছোট। এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের ভর একটি গ্রহ কিংবা ইলেকট্রনের ভরের থেকেও অনেক কম হতে পারে। এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর যদি থাকে, তাহলে সেগুলো খুব দ্রুত হকিং রেডিয়েশন নামে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ার কারণে বাষ্পীভূত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবে এ রকম কোনো কৃষ্ণগহ্বরের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কৃষ্ণগহ্বরের শ্রেণিবিভাগ
শুধু ভরই নয়, কৃষ্ণগহ্বরের কিছু ভৌত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেও এদের ভাগ করেছেন বিজ্ঞানীরা। কৃষ্ণগহ্বরের কিছু ভৌত বৈশিষ্ট্য বাইরে থেকে মাপা যায়। সেগুলো হলো মোট ভর, মোট বৈদ্যুতিক চার্জ এবং ঘূর্ণন গতি। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই স্বাধীন। অর্থাৎ এরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল নয়।
চার্জ আর ঘূর্ণনের ওপর ভিত্তি করে কৃষ্ণগহ্বরকে চার ভাগে ভাগ করা যায়:
১. শোয়ার্জশিল্ড ব্ল্যাকহোল: জার্মান পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। এগুলো ঘোরে না এবং এদের কোনো বৈদ্যুতিক চার্জও নেই।
২. কের ব্ল্যাকহোল: এর নামকরণ করা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের গণিতবিদ রয় কেরের নামে। এই কৃষ্ণগহ্বরগুলো ঘোরে, কিন্তু এদের চার্জ নেই।
৩. রাইসনার-নর্ডস্ট্রম ব্ল্যাকহোল: এর নামকরণ করা হয়েছে দুজন পদার্থবিদের নামে। তাঁরা হলেন জার্মান প্রকৌশলী ও পদার্থবিদ হ্যান্স রাইসনার এবং ফিনিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ গুনার নর্ডস্ট্রম। এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর ঘোরে না, কিন্তু এদের বৈদ্যুতিক চার্জ আছে।
৪. কের-নিউম্যান ব্ল্যাকহোল: এর নামকরণ করা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের গণিতবিদ রয় কের এবং মার্কিন পদার্থবিদ এজরা নিউম্যানের নামে। এসব কৃষ্ণগহ্বর ঘোরে এবং চার্জও আছে।
আমাদের মহাবিশ্বে প্রায় সব ব্ল্যাকহোলই ঘোরে, কারণ এরা ঘূর্ণায়মান পদার্থ থেকে তৈরি হয়। আবার প্রায় সব ব্ল্যাকহোলেরই কোনো নিট বৈদ্যুতিক চার্জ থাকে না। কারণ, বিপরীত ধরনের চার্জ একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং নিরপেক্ষ হয়ে যায়। এই কারণে কের ব্ল্যাকহোল, অর্থাৎ ঘূর্ণনশীল কিন্তু চার্জহীন ব্ল্যাকহোল মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। শোয়ার্জশিল্ড, রাইসনার-নর্ডস্ট্রম আর কের-নিউম্যান ব্ল্যাকহোল খুবই বিরল।
