জাপানের প্রথম নিজস্ব কোয়ান্টাম কম্পিউটার

জাপানে তৈরি একটি ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার ‘ওপেন কোয়ান্টাম টুলচেইন ফর অপারেটরস অ্যান্ড ইউজারস’ বা অক্টোপাস (OQTOPUS) ব্যবহার করে কাজ করে এটিছবি: লাইভ সায়েন্স

কোয়ান্টাম কম্পিউটিং জগতে এবারে যুক্ত হলো জাপানের নাম। সম্প্রতি দেশটি নিজেদের তৈরি প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেছে। এটি এখন জাপান ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কোয়ান্টাম ইনফরমেশন অ্যান্ড কোয়ান্টাম বায়োলজিতে (QIQB) গবেষণার কাজ শুরু করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।

ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ২৮ জুলাই চালু করা হয়েছে কম্পিউটারের নতুন এই সিস্টেম। এটি সম্পূর্ণভাবে জাপানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। জাপানে তৈরি একটি ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার ‘ওপেন কোয়ান্টাম টুলচেইন ফর অপারেটরস অ্যান্ড ইউজারস’ বা অক্টোপাস (OQTOPUS) ব্যবহার করে কাজ করে এটি।

১৪ থেকে ২০ আগস্ট ওসাকায় অনুষ্ঠিত এক্সপো ২০২৫-এ জাপানের প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীতে এর মূল কম্পোনেন্ট বা যন্ত্রাংশগুলো দেখানো হয়। সেখানে দর্শনার্থীরা ক্লাউডের মাধ্যমে সিস্টেমটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাধারণ কোয়ান্টাম প্রোগ্রাম চালান। এ ছাড়া ইন্টারঅ্যাকটিভ কিছু যন্ত্রাংশের সাহায্যে দর্শনার্থীদের কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের মতো বিভিন্ন কোয়ান্টাম বিষয় দেখানো হয় এই এক্সপোতে।

এর আগে জাপানের প্রকৌশলীরা বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড কোয়ান্টাম সুপারকম্পিউটার চালু করেন। ২০-কিউবিটের এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের নাম ‘রেইমেই’। দ্রুতগতির দিক থেকে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ সুপারকম্পিউটার ‘ফুগাকু’র সঙ্গে একে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার একটি বিশেষ কোয়ান্টাম চিপের মাধ্যমে অপারেশন চালায়। এর মধ্যে রয়েছে ‘সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট’। এই কিউবিটগুলো অত্যন্ত স্বল্প তাপমাত্রায় কাজ করে। কিউবিটগুলো প্রায় মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠান্ডা করলেও বিদ্যুৎ পরিবহনে কোনো বাধা দেয় না। এই যন্ত্রের প্রধান অংশ, অর্থাৎ কোয়ান্টাম প্রসেসিং ইউনিট (QPU), তৈরি করেছে জাপানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাইকেন (RIKEN)।

আরও পড়ুন

এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্তাংশ। এর মধ্যে রয়েছে রাইকেন কোম্পানির চিপ প্যাকেজ, ম্যাগনেটিক শিল্ড, ইনফ্রারেড বা অবলাল ফিল্টার, ব্যান্ডপাস ফিল্টার এবং বিভিন্ন ধরনের তার। এই সব কম্পোনেন্টকে একটি বিশেষ ফ্রিজের মধ্যে রাখা হয়, যা অত্যন্ত অল্প তাপমাত্রায়ও কাজ করে। এটি মূলত একটি ক্রায়োজেনিক যন্ত্র। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের যন্ত্রাংশগুলো সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় চরম ঠান্ডা পরিবেশ নিশ্চিত করাই এর কাজ।

এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্রমানুসারে কাজ না করে করে সমান্তরালে বা একসঙ্গে একাধিক গণনা সম্পন্ন করতে পারে
ছবি: লাইভ সায়েন্স

এর পেছনের ওপেন-সোর্স সফটওয়্যার অক্টোপাস আসলে একগুচ্ছ ওপেন-সোর্স টুলের একটি সেট। কোয়ান্টাম প্রোগ্রাম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু সরবরাহ করে এটি। এর মধ্যে রয়েছে প্রধান প্রোগ্রামিং ইঞ্জিন, ক্লাউড মডিউল এবং ব্যবহারকারীবান্ধব গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেস। এটি কোয়ান্টাম প্রসেসিং ইউনিট এবং অন্যান্য কন্ট্রোল হার্ডওয়্যারের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়। বিশ্বের দ্রুততম সুপার কম্পিউটারগুলোকেও কাজের দিক থেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সাধারণ কম্পিউটার যেখানে বিটের ওপর নির্ভর করে কাজ করে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেখানে কাজ করে কিউবিটের ওপর ভিত্তি করে। (এই কিউবিট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বিট থেকে কিউবিট, ডিজিটাল থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।) এই কম্পিউটার এমন সব জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, যা হয়তো বেশির ভাগ সুপারকম্পিউটারের পক্ষে সম্ভবও নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোয়ান্টাম কম্পিউটার নতুন ওষুধ আবিষ্কার, শহরের যানজট কমানো ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর জন্য সবচেয়ে ভালো ডেলিভারি রুট খুঁজে বের করার মতো বিভিন্ন কাজে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুন
১৪ থেকে ২০ আগস্ট ওসাকায় অনুষ্ঠিত এক্সপো ২০২৫-এ জাপানের প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটারটি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীতে এর মূল কম্পোনেন্ট বা যন্ত্রাংশগুলো দেখানো হয়। সেখানে দর্শনার্থীরা ক্লাউডের মাধ্যমে সিস্টেমটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাধারণ কোয়ান্টাম প্রোগ্রাম চালান।

এর কারণ হলো, এটি কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতি ব্যবহার করে গণনা করে। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্রমানুসারে কাজ না করে করে সমান্তরালে বা একসঙ্গে একাধিক গণনা সম্পন্ন করতে পারে। একটি সিস্টেমে যত বেশি কিউবিট যোগ করা যায়, সিস্টেমটি তত বেশি শক্তিশালী হয়। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে শুধু কিউবিটের সংখ্যা বাড়ালেই হয় না। কারণ গণনার সময় এতে বড় ধরনের ত্রুটি দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে এই ত্রুটি কমানোর চেষ্টা করছেন। এ কারণেই বর্তমানে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ গবেষণার মূল বিষয় কোয়ান্টাম ত্রুটি সংশোধন (Quantum Error Correction বা QEC) ।

এর আগে জাপানের প্রকৌশলীরা বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড কোয়ান্টাম সুপারকম্পিউটার চালু করেন। ২০-কিউবিটের এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের নাম ‘রেইমেই’। দ্রুতগতির দিক থেকে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ সুপারকম্পিউটার ‘ফুগাকু’র সঙ্গে একে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন এ হাইব্রিড সুপারকম্পিউটার প্রচলিত সুপারকম্পিউটারের চেয়ে জটিল হিসাব করতে পারবে আরও দ্রুততম সময়ে।

এ ছাড়াও বিশ্বের প্রথম ‘জেটা-ক্লাস’ সুপারকম্পিউটার নির্মাণ শুরুর পরিকল্পনা করেছে জাপান। প্রস্তাবিত এই সুপারকম্পিউটার বর্তমান যেকোনো সুপারকম্পিউটারের চেয়ে ১ হাজার গুণ দ্রুত কাজ করবে। এই সুপারকম্পিউটার নির্মাণের কাজ শুরু হবে এ বছরেই। প্রযুক্তি খাতে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে জাপান। এটা তারই অংশ। জাপান এর মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন দেশগুলোর শুরুর দিকে জায়গা করে নিতে চায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন