সালতামামি ২০২৫
বিজ্ঞানচিন্তার চোখে বছরজুড়ে প্রযুক্তির আলোচিত ১০
প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারছে। প্রযুক্তি নিয়ে এ বছর হয়েছে প্রচুর গবেষণা। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব আলোচিত গবেষণার খবর। পাশাপাশি বছর শেষে নানা ম্যাগাজিনসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে সারা বছরের আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা। সেখান থেকে আলোচিত ১০টি গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে।
গত কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে শুরু করে মুখে মুখে একটা কথা বারবার শোনা গেছে। ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগুলো শিগগিরই আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে। শোনা গেছে, এআই আমাদের জীবন বদলে দেবে, চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে নিত্যদিনের গ্যাজেটগুলো পর্যন্ত বুঝতে পারবে আমাদের মনের ভাব, কাজ করবে ঠিক সেভাবেই।
২০২৫ সালের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সেই ভবিষ্যৎ আর ‘আসছে’ না, বরং চলে এসেছে। না, লেখককে খ্যাপা ভাববেন না। এজিআই বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্সের মতো ‘প্রযুক্তি জগতের হলি গ্রেইল’ এখনো বহু দূর। একটু কাব্য করে বলাই যায়, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। কিন্তু তবু ‘ভবিষ্যতের প্রযুক্তি চলে এসেছে’ বলাটা মোটেও ভুল হচ্ছে না।
এআই ‘বাজ’ বলি বা বিপ্লব, শুরুটা হয়েছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। সে হিসেবে বলা যায়, ২০২৩ সালে এআই কথা বলতে শিখেছে, ২০২৪ সালে এসে দেখতে ও চিনতে শুরু করেছে। আর ২০২৫ সালে এটি অবশেষে ‘কাজ করতে’ শুরু করেছে।
এ বছরের প্রযুক্তি নিয়ে আলাপ করার ক্ষেত্রে আমরা তাই মোট চার ভাগে আলোচনাটা করব। আমরা দেখব, শুধু ডিজিটাল দুনিয়াটাই না, বাস্তব পৃথিবীতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। এআইয়ের কাজ করা থেকে শুরু করে ইনজেকশন বা সুইয়ের বিকল্প, পরিবর্তন এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই। চমক বা এআই ম্যাজিকের চেষ্টা বাদ দিয়ে এখন শুরু হয়েছে দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর সমাধান।
সারা বছরের এসব আলোচিত প্রযুক্তির কোনোটি উঠে এসেছে মার্কিন প্রযুক্তি ও ব্যবসাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের তালিকায়, কোনোটি আবার জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচার থেকে শুরু করে ফোর্বস বা ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ইকোনোমিক টাইমস, এমনকি বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের তালিকাতেও। এসব তালিকা থেকে বাছাই করা কিছু উদ্ভাবন নিয়ে এই আলোচনা। ক্রমবিন্যাস বা ভাগ করা হয়েছে শুধু আলোচনার সুবিধার্থে, গুরুত্বের কম-বেশির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
চলুন তাহলে, দেখে নেওয়া যাক ২০২৫ সাল কীভাবে আমাদের সামনে ভবিষ্যতের দরজাটা মেলে ধরেছে।
এআই বাজ বলি বা বিপ্লব, শুরুটা হয়েছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। সে হিসেবে বলা যায়, ২০২৩ সালে এআই কথা বলতে শিখেছে, ২০২৪ সালে এসে দেখতে ও চিনতে শুরু করেছে।
প্রথম ভাগ: এআই যখন সব কাজের কাজি
১. এজেন্টিক এআই
মনে আছে, ২০২২ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালেও এআই মূলত ছিল চ্যাটবট। আপনি প্রশ্ন করতেন, এআই সেই প্রশ্নের উত্তর দিত। এখন সেটা বদলে গেছে অনেকাংশেই। কারণ, এ বছর পথচলা শুরু করেছে এজেন্টিক এআই।
কেউ কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই শুরুতেই বলে দিই, আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (এজিআই) বা সরাসরি চিন্তাক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা এখানে মোটেও বলা হচ্ছে না। বরং এজেন্টিক এআইকে আপনি ভাবতে পারেন নিজের ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা কর্মী। আপনার অফিসের কর্মীকে আপনি যেমন নির্দেশ দেন, এই কর্মীকেও সেভাবে নির্দেশ দিতে পারবেন। বাকি কাজটা সে নিজেই করবে। ঠিক ধরেছেন, এআই এখন আর শুধু টাইপিস্ট বা চ্যাটবট নয়, ‘কথা কম কাজ বেশি’ নীতিতে চলে এসেছে এটি।
ধরুন, একটি ‘ট্যুর প্ল্যানার এআই এজেন্ট’কে বললেন, অফিসের ২০ জনের জন্য একটা ট্যুরের সব কাজ গুছিয়ে দাও। কয়দিনের জন্য, কোথায় যেতে চান, একটু ধারণাও দিয়ে দিলেন। এরপর সে নিজেই ক্যালেন্ডার মিলিয়ে নেবে, আপনার পছন্দ অনুসারে বাস, ট্রেন বা বিমানের টিকেট কাটবে, পেমেন্ট করে দেবে এবং সব ব্যবস্থা করে আপনাকে জানাবে, ‘কাজ শেষ!’
না, এআই নিজে নিজে আপনার অনুমতি ছাড়া এসব করতে পারবে না। আগে থেকে তাকে সেই অনুমতি দিয়ে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিতে হবে। ঠিক অফিসের কর্মীটিকে যা যা বলে দিতেন, সে রকম।
এজেন্টিক এআইকে আপনি ভাবতে পারেন নিজের ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা কর্মী। আপনার অফিসের কর্মীকে আপনি যেমন নির্দেশ দেন, এই কর্মীকেও সেভাবে নির্দেশ দিতে পারবেন।
২. দ্য থিংকিং মডেল এবং এআইয়ের চিন্তা করার শুরু
এআইয়ের এই পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে এর কার্যপদ্ধতির পরিবর্তন। মানুষ হলে সহজেই বলা যেত, বদলে গেছে তার চিন্তাধারা। কিন্তু এআই সেই অর্থে চিন্তা করে না, যুক্তি বা প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। এই কাজের ধারাই বদলে গেছে ২০২৫ সালের একদম শুরুতে।
হয়তো মনে আছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঝড় তুলেছিল চীনা এআই ডিপসিক। এনভিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে একদম নাজেহাল করে দিয়েছিল এই এআই। এর ‘ডিপসিক আর১’ মডেলটি সে সময় গোটা বিশ্বকে চমকে দেয়। এরপর একে একে এসেছে জিপিটি-৫ এবং জেমিনাই-৩। আগের মডেলগুলো যেখানে তাড়াহুড়ো করে একটা শব্দ দেখে পরের শব্দ অনুমান করত, এই মডেলগুলো সেটা করে না। ‘রিজনিং মডেল’ বলা হয় এগুলোকে। এই রিজনিং বা চিন্তা এবং নিজের লজিক যাচাই করার জন্য এগুলো প্রথমে একটু থামে, নিজের উত্তরটা নিজেই যাচাই করে, এরপর জবাব দেয়। ফলে জটিল বেশির ভাগ কাজই প্রায় নির্ভুলভাবে করতে পারে এসব মডেল।
এ ধরনের মডেলের কার্যপদ্ধতিকে কম্পিউটারবিজ্ঞানীরা তিনটা ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগের নাম মিক্সচার অব এক্সপার্টস বা এমওই কাঠামো। একে ব্যাখ্যা করতে সহজ বাংলায় বলা যায়, ‘একজন বিশেষজ্ঞের চেয়ে একাধিক বিশেষজ্ঞের সামষ্টিক মূল্যায়ন বেশি সঠিক।’ কথাটার মানে তো বুঝতেই পারছেন, একজন নয়, একটা কাজে একাধিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিলে সেটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই মডেলগুলো সেটাই করে। প্রতিটি জটিল কাজকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভেঙে নেয় প্রথমে। এরপর কেবল একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএমের বদলে কাজ অনুসারে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন উপমডেলের সহায়তা নেয়।
মানে ধরুন, আপনার অফিসের একজন গান ভালো পারেন, একজন ভালো লিখতে পারেন, একজন ভালো আঁকতে পারেন। আরেকজন ‘সব কাজের কাজি’—তিনি একাই ভালো গাইতে পারেন, একই সঙ্গে আঁকতেও পারেন, আবার লিখতেও পারেন। কিন্তু একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে আপনি সেই ‘সব কাজের কাজি’ একজনকে দায়িত্ব না দিয়ে তিনজনকে দায়িত্ব দিলেন যেন কাজটা ভালো হয়। এটাই করে এ ধরনের মডেলগুলো।
দ্বিতীয় ভাগের নাম ‘চেইন অব থট’ রিজনিং। অর্থাৎ পুরো কাজটা যে বিভিন্ন ভাগে ভাঙা হলো, এরপর সেটাকে ধারাবাহিকভাবে ধাপে ধাপে করা। উল্টাপাল্টা না করা বা সব একসঙ্গে করার চেষ্টা না করা। তৃতীয় ভাগের নাম ‘অটোমেটিক ভেরিফিকেশন লুপ’। অর্থাৎ মডেলটি প্রথমে একটা প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করে। এরপর সব কর্মীর কাজকে এক করে নিজেই যাচাই করে দেখে, প্রাথমিক কাঠামোটি কতটা সঠিক। সে অনুযায়ী এটি কাঠামোটিকে নতুনভাবে তৈরি করে, গুছায় এবং এরপর সেই উত্তরটা আপনাকে দেয়।
এই যে বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন মডেলকে ভাগ করে দেওয়া, বা একটা কাজের জন্য বিশেষভাগে তৈরি মডেল—এটাই সেই এজেন্টিক এআইয়ের ভিত্তি। কারণ এ ক্ষেত্রে, খেয়াল করে দেখুন, এজেন্টটিকে একটা বড় কাজের জন্য (ট্যুর প্ল্যান) অনেকগুলো ছোট কাজ (টিকেট কাটা, পেমেন্ট করা) করতে হয়। এভাবেই এজেন্ট ওসব কাজ করে।
৩. অ্যাপ থেকে ওএসে
প্রথমে এসব এআই মডেল ছিল শুধু নির্দিষ্ট অ্যাপের ভেতরে। কিন্তু আপনিও জানেন, এখন এসব মডেল বা এআই শুধু অ্যাপে আর সীমাবদ্ধ নেই, চলে এসেছে সরাসরি অপারেটিং সিস্টেম বা ওএসে।
অ্যাপল, মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অপারেটিং সিস্টেমেই সরাসরি এআই জুড়ে দিয়েছে। ফলে আপনার পুরো ফোন বা কম্পিউটার হয়ে গেছে একটি একক সত্তার মতো, আপনার নির্দেশে যেটি পিডিএফ থেকে তথ্য বের করে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিতে পারে, ব্রাউজারে গিয়ে টিকেট কাটতে পারে এবং করতে পারে এমন আরও অনেক কিছু।
রিজনিং মডেলগুলো রিজনিং বা চিন্তা এবং নিজের লজিক যাচাই করার জন্য প্রথমে একটু থামে, নিজের উত্তরটা যাচাই করে, এরপর জবাব দেয়।
দ্বিতীয় ভাগ: হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিতে বিপ্লব
৪. বহুতল ভবনের মতো শক্তিশালী মনোলিথিক থ্রিডি চিপ
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফটওয়্যার নিয়ে আলাপ করি। এআই মডেল, এজেন্ট বা ওএস—সবই সফটওয়্যার। কিন্তু এসব ভারী বা শক্তিশালী জিনিস চালাতে শক্তিশালী হার্ডওয়্যারও তো চাই! হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিতে সেরকমই দুটি বড় বিপ্লবের একটি এই মনোলিথিক থ্রিডি চিপ।
অনেক গভীরে না গিয়ে বিষয়টা একদম সহজ করে বোঝা যাক। এত দিন আমরা চিপ বানাতাম সমতল জমির মতো, ছড়িয়ে। অর্থাৎ চিপের ভেতরে প্রসেসর এবং মেমোরি থাকত পাশাপাশি। এ ধরনের চিপগুলোকে বলা হতো দ্বিমাত্রিক চিপ (যদিও এগুলো বাস্তবে ত্রিমাত্রিকই)। কিন্তু এআই চালাতে প্রসেসিং পাওয়ার লাগে অনেক বেশি। আর সে জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ চিপ। কিন্তু এত চিপ পাশাপাশি বসানোর জায়গা কোথায়?
জায়গা সমস্যার সমাধানে প্রকৌশলীরা তাই চিপগুলোকে পাশ থেকে ছোট করে ফেলতে চাইলেন। সে জন্য তাঁরা ভাবলেন, প্রসেসর আর মেমোরিকে পাশাপাশি না বসিয়ে একটার ওপর আরেকটা বসালে কেমন হয়? ব্যাপারটা অনেকটা একতলা বাড়ির বদলে বহুতল ভবন বানানোর মতো। কাজটা যেরকম বলছি, মোটেও এত সহজ না। তবে আমরা এ আলাপে আর জটিলতায় যাব না। শুধু এটুকু বলি, এর ফলে চিপ যেমন ছোট হয়ে এল আকারে, তেমনি ডেটা আদান-প্রদানের পথও ছোট হয়ে গেল। তাতে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের চিপে শক্তি খরচ কমে গেছে প্রায় ১ হাজার গুণ! এই সেই মনোথিলিথিক ‘থ্রিডি’ চিপ—থ্রিডি মানে ত্রিমাত্রিক না ঠিক, বোঝানো হচ্ছে প্রসেসর আর মেমোরি পাশাপাশি না বসে লম্বালম্বি বসেছে, অর্থাৎ উচ্চতার মাত্রাটি এবারে কাজে লাগছে সরাসরি। এই চিপের কল্যানে এখন সুপারকম্পিউটারের মতো কাজ আপনার ছোট ডিভাইসেই করা সম্ভব হচ্ছে।
৫. বিপুল শক্তির জোগান
কিন্তু এই যে এআই, এগুলো পরিচালনার জন্য দরকার বিপুল শক্তি। এআই মডেলগুলো যত বড় হচ্ছে, ডেটা সেন্টারগুলোর বিদ্যুতের ক্ষুধাও যেন তত বাড়ছে। বাতাস বা সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে এই বিপুল চাহিদা চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই প্রযুক্তি বিশ্ব ফিরে গেছে পারমাণবিক শক্তির কাছে। উঁহু, বিশাল সব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, আমাজন বা মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দ্বারস্থ হচ্ছে ‘স্মল মডিউলার রিঅ্যাক্টর’ বা এসএমআরের।
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক হোসে এন রেয়িস জুনিয়র এ ধরনের রিঅ্যাক্টর বানানোর পরিকল্পনা করেন। পরে ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটি, আইডাহো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং নিউস্কেল, রোলস-রয়েসের মতো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের রিঅ্যাক্টরকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে বড় পরিসরে এগুলো এতদিন সেভাবে ব্যবহৃত হয়নি। এখন, এআইয়ের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে এ ধরনের রিঅ্যাক্টরের।
জিনিসগুলো অনেকটা প্যাকেটজাত ছোট নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের মতো—নিরাপদ এবং সহজে বসানো যায়। ডেটা সেন্টারের পাশেই এগুলো বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে এআই বিপ্লব সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। কিন্তু এসব রিঅ্যাক্টর কাজ করে কীভাবে?
সহজ করে বললে, প্রচলিত বিশাল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে এগুলোর মূল তফাৎ হলো, এগুলো কারখানায় তৈরি করে লরি বা জাহাজে করে নিয়ে গিয়ে যেকোনো জায়গায় বসিয়ে দেওয়া যায়, অনেকটা লেগো ব্লকের মতো। এসএমআরের কার্যপদ্ধতিকে তিনটি ধাপে ভাগ করা যায়। এক, এগুলোর ভেতরে বিশেষ জ্বালানি রড (সাধারণত ইউরেনিয়াম) থাকে। পরমাণু ভেঙে সেখানে প্রচুর তাপ তৈরি করা হয় ফিশন প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই, তবে আকারের জন্য এটাকে আপনি চাইলে বড় আকারের প্রেসার কুকারের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। দ্বিতীয় ধাপে এই তাপ ব্যবহার করে ভেতরে থাকা পানিকে ফুটিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। আর তৃতীয় ধাপে সেই প্রচণ্ড গতির বাষ্প গিয়ে একটা টারবাইন বা পাখাকে জোরে ঘোরায়, সেই ঘূর্ণন থেকেই জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি হয়।
এর সবচেয়ে বড় সুবিধা দুটি। একটি তো ছোট আকার, আরেকটি হলো নিরাপত্তা। বড় রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা রাখতে বিশাল সব পাম্প আর সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ লাগে। পাম্প বন্ধ হলে যে বিপদ, তা ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্ঘটনায় পৃথিবী ভালোভাবেই দেখেছে। কিন্তু এসএমআরে এরকম কিছুর দরকার পড়ে না। এতে ব্যবহার করা হয় ‘প্রাকৃতিক সঞ্চালন প্রক্রিয়া’ বা ন্যাচারাল সার্কুলেশন। মানে, কোনো কারণে বিদ্যুৎ যদি চলেও যায়, তবু স্বাভাবিকভাগেই গরম পানি ওপরে উঠবে (এর অণুগুলো হালকা হয়) আর ঠান্ডা পানি নিচে নামবে। এই প্রাকৃতিক নিয়মেই এসএমআরের ভেতরের রিঅ্যাক্টর নিজে নিজেই ঠান্ডা হতে থাকে। বুঝতেই পারছেন, জিনিসটা কতটা কাজের!
তৃতীয় ভাগ: চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে দৈনন্দিন জীবনে
৬. ইনজেকশনের দিন ফুরাল
এ বছরের সবচেয়ে মানবিক উদ্ভাবন সম্ভবত অ্যালার্জি রোগীদের সুইভীতি থেকে মুক্তি। যাঁদের মারাত্মক অ্যালার্জি আছে এবং সুই ভয় পান, তাঁদের জন্য এপিপেন ছিল এক আতঙ্কের নাম। জীবন বাঁচাতে বিশাল এক সুই নিজের উরুতে ফোটানো—ভাবলেও শিউরে ওঠেন অনেকে। ২০২৫ সালে এফডিএ অনুমোদন দেয় নেফি’কে। এটি একটি ন্যাজাল স্প্রে। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে নাকে শুধু একটু স্প্রে করলেই হলো, ব্যস!
৭. চালের মতো ছোট পেসমেকার
এ বছর হৃদরোগের চিকিৎসাও হয়েছে অনেক সহজ। যাঁদের হৃৎপিণ্ড ঠিকভাবে এবং সঠিক ছন্দে স্পন্দিত হয় না (বিজ্ঞানের ভাষায়, ঠিকভাবে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল পাঠাতে পারে না), তাঁদের হৃৎপিণ্ডে ‘পেসমেকার’ নামে একধরনের যন্ত্র বসাতে হয়। এই পেসমেকার বসাতে এখন আর বুক কেটে চামড়ার নিচে ব্যাটারি বসাতে হচ্ছে না। নতুন ‘লেডলেস পেসমেকার’ দেখতে অনেকটা বড় ভাতের দানা বা ক্যাপসুলের মতো।
কোনো তার বা সার্জারি ছাড়াই এটি ক্যাথেটারের মাধ্যমে সরাসরি হৃৎপিণ্ডের ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হয়। কম্পিউটার বা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা যেমন বলি ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’—অর্থাৎ মাউস বা এ ধরনের যন্ত্র পিসিতে লাগালেই কাজ শেষ, সে রকম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হলো, একে তো সার্জারি লাগছে না, তার ওপর তার নষ্ট হওয়ার ভয়ও নেই। একবার বসিয়ে দেওয়ার পর আপনার আর ও নিয়ে ভাবতেও হবে না তেমন।
৮. রোবটেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ভরসা
২০২৫ সালের অন্যতম সুন্দর উদ্ভাবন বলা হচ্ছে একে। আমরা মানুষেরা বর্জ্য বা রিসাইক্লিংয়ের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন; প্লাস্টিক আর কাগজ আলাদা করতে আমাদের রাজ্যের আলসেমি।
এই বছর সেই দায়িত্বটা পুরোপুরি নিয়ে নিয়েছে রোবট। বিশ্বের বড় বড় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে এখন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এআইনির্ভর রোবটিক বাহু কাজ করছে।
কনভেয়ার বেল্টের ওপর দিয়ে যাওয়া হাজারো আবর্জনার মধ্য থেকে চোখের পলকে এরা প্লাস্টিক, ধাতু বা কাগজ আলাদা করে ফেলছে নিখুঁতভাবে। এতে রিসাইক্লিং বা বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে আবার ব্যবহার করা সহজ হয়ে গেছে অনেকখানি। গোটা বিশ্বের ভবিষ্যৎ, বৈশ্বিক উষ্ণায়নসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এটি যে কত বড় আশীর্বাদ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
নতুন লেডলেস পেসমেকার দেখতে অনেকটা বড় ভাতের দানা বা ক্যাপসুলের মতো। কোনো তার বা সার্জারি ছাড়াই এটি ক্যাথেটারের মাধ্যমে সরাসরি হৃৎপিণ্ডের ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হয়।
চতুর্থ ভাগ: মিথ্যার মোকাবেলা ও সত্যের সুরক্ষা
৯. ডিসইনফরমেশন সিকিউরিটি
এআইয়ের এই সময়ে আমাদের ডিজিটাল দুনিয়াটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এআই দিয়ে তৈরি ‘ডিপফেক’ ভিডিও এখন এত নিখুঁত যে নিজের চোখে দেখেও আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এই সমস্যা মোকাবেলায় ২০২৫ সালে গড়ে উঠেছে প্রযুক্তির একটি নতুন শাখা—ডিসইনফরমেশন সিকিউরিটি। কম্পিউটারে যেমন ভাইরাস আটকাতে অ্যান্টিভাইরাস থাকে, তেমনি এই সফটওয়্যারগুলো ভিডিও বা অডিও স্ক্যান করে বলে দেয়, জিনিসটা আসল নাকি এআই দিয়ে বানানো। বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার পর্যন্ত এখন এগুলোর ওপর ভরসা করতে শুরু করেছে।
তবে এই শাখাটি এখনো কেবল গড়ে উঠছে, অনেক দূর যাওয়া বাকি। সুনির্দিষ্ট কোনো সফটওয়্যার বা অ্যালগরিদমের নাম বলছি না, তবে একটু উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। হয়তো খেয়াল করেছেন, ফেসবুক এখন পোস্ট দেওয়ার সময়ই জিজ্ঞেস করে আপনার কনটেন্ট এআই দিয়ে বানানো কি না (এআই লেবেলিং)। কাজটা শুরু হয়েছে উল্টাদিক থেকে। আপনার ফোন বা কম্পিউটারে এখন আপনি যে কোনো ছবি বানান, ভিডিও তৈরি করেন বা নরমালি ক্যামেরায় ভিডিও করেন—কনটেন্ট তৈরির সময়ই এর ভেতরের কোডে (কম্পিউটারবিজ্ঞানের ভাষায় এর গালভরা নাম, মেটাডেটা) একধরনের ‘ট্যাগ’ বসিয়ে দেওয়া হয়। এই ট্যাগ দেখে সহজেই বোঝা যায়, এই কনটেন্ট কীভাবে তৈরি। এর ফলে ওপেনএআই বা গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এ জন্য নিজেদের বানানো এআই কনটেন্টে ‘এআই লেবেলিং’ করছে। নিজেরা নিরাপদে থাকতেই এ উদ্যোগ নিয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে শুধু এগুলোই নয়, স্বতন্ত্র আরও বেশ কিছু অ্যালগরিদম ও সফটওয়্যারও আছে এই সত্যতা নির্ণয়ের জন্য।
১০. পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি
শিগগিরই যদি কেউ উদ্ভাবন করে ফেলে ব্যবহারযোগ্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার, তাহলে ভেঙে পড়তে পারে বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার বেশির ভাগ এনক্রিপশন। ফলে হ্যাকারদের ভবিষ্যৎ আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে এ বছরেই। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ভবিষ্যতে আমাদের সব পাসওয়ার্ড ভেঙে ফেলতে পারে—এই ভয়ে ইন্টারনেট জগত ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে ‘পোস্ট-কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি’ নিয়ে। হ্যাকাররা যাতে আজকের চুরি করা তথ্য ভবিষ্যতে ডিক্রিপ্ট করতে না পারে, তার জন্যই এই আগাম সতর্কতা। ইতিমধ্যে গুগল থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজি এ ধরনের এনক্রিপশন ব্যবহারও করতে শুরু করেছে। এটা সবার জন্যই অত্যন্ত আশার ব্যাপার।
এ ছাড়াও কৃষি, মহাকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতেই প্রযুক্তিতে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। ব্যাটারি প্রযুক্তি, মিঠা পানি ও নোনা পানির মিশ্রণ ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে স্নায়বিক রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন প্রযুক্তিসহ অনেক কিছু মিলে ২০২৫ বেশ আশা জাগানো একটি বছর। তবে সব প্রযুক্তি নিয়ে তো আর একসঙ্গে বলার উপায় নেই, তাই গুরুত্বপূর্ণ ১০টি প্রযুক্তির কথা সংক্ষেপে বললাম।
প্রযুক্তির কাজ এখন আর শুধু আমাদের স্বপ্ন দেখানো নয়। ২০২৫ আমাদের দেখিয়েছে, এর কাজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করে জীবনটাকে একটু সহজ আর সুন্দর করে তোলা।
