এসেছে সেবিকা রোবট, বুড়ো বয়সে আপনার যত্নের ভার কি যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেবেন

বুড়ো বয়সে আপনার যত্নের ভার কি যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেবেন?ছবি: বিবিসি

লন্ডনের এক কোণায় একটা ল্যাবের বেঞ্চে রাখা আছে তিনটি কালো রোবটিক হাত। ঠিক মানুষের মতোই পাঁচটি আঙুল আছে। কিন্তু আঙুলে নেই কোনো নখ। হাতগুলো ধীরে ধীরে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।

দৃশ্যটা গা ছমছমে হলেও শ্যাডো রোবট কোম্পানির পরিচালক রিচ ওয়াকার হেসে বলেন, ‘ভয় পাবেন না, আমরা টার্মিনেটর বানাচ্ছি না!’

রিচ ওয়াকারকে দেখলে কোনো টেক বিশেষজ্ঞ মনে হয় না। লম্বা চুল আর দাড়িতে তাঁকে একজন আধুনিক হিপির মতোই মনে হয়। হিপি মানে এমন মানুষ যারা বাঁধাধরা নিয়মে বিশ্বাস করেন না। নিজের মতো করে বাঁচতে চান। মাঝেমধ্যে একটু অগোছালো জীবনযাপন করেন। তো এমন একজন মানুষ গর্বের সঙ্গে বলছিলেন, ‘আমরা এমন একটা রোবট বানাতে চেয়েছিলাম, যে হবে আপনার ব্যক্তিগত সহকারী। যে ঘরের সব কাজ করবে এবং আপনার জীবনকে সহজ করে দেবে।’

জাপানের ফুজি কর্পোরেশনের তৈরি নার্সিং-কেয়ার রোবট 'হাগ' তৈরি করা হয়েছে মানুষকে সাহায্য করার জন্য
ছবি: গেটি ইমেজ

কিন্তু এই রোবটের লক্ষ্য শুধু এতটুকুই নয়। ব্রিটেনের মতো দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বয়স্কদের সেবা করা। ব্রিটেনে বয়স্কদের সেবা দেওয়ার জন্য কর্মীর অনেক অভাব। গত বছর এক রিপোর্টে দেখা গেছে, এই পদের জন্য প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার পদ খালি পড়ে আছে। আর প্রায় লাখ বয়স্ক মানুষ ঠিকমতো যত্নই পাচ্ছেন না। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশটির প্রতি চারজন মানুষের একজনই হবেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। তখন এই চাপ সামলাবে কে?

আরও পড়ুন
বিছানা থেকে কাউকে তুলে হুইলচেয়ারে বা টয়লেটে বসানোর মতো কাজ করে দেয় রোবট হাগ

দুই

ঠিক এই প্রশ্নের উত্তরেই আসে রোবটের কথা। এখনকার কাহিনি শুনলে মনে হবে, কল্পগল্প বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আসলেই তাই! কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ সরকারই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা রোবট তৈরির গবেষণায় ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করছে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, আগামী ২০ বছরের মধ্যেই রোবট আমাদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠবে।

কিন্তু এটা কি মুভির কাহিনির মতো মনে হচ্ছে না? একজন রোবট আপনার বৃদ্ধ বয়সে সেবা করবে। হয়তো পানি এগিয়ে দেবে, ওষুধ খেতে সাহায্য করবে। কিন্তু এর কোনো অনুভূতি থাকবে না। আপনি কি সত্যিই একটা শক্তিশালী যন্ত্রের হাতে নিজেকে সঁপে দিতে পারবেন? 

প্রিয় পাঠক, এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আপনিই একটু ভাবতে থাকুন, ততক্ষণে আমরা একটু এর ভবিষ্যতের এক ঝলক দেখে নিই। সেজন্য আমাদের তাকাতে হবে জাপানের দিকে। জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু সেবাকর্মী কম। তাই প্রায় দশ বছর আগেই তাদের সরকার কেয়ার হোম বা বৃদ্ধাশ্রমে রোবট ব্যবহারের জন্য ভর্তুকি দেওয়া শুরু করে।

পেপার রোবট হাত নেড়ে ব্যায়ামের নির্দেশ দিতে ও দেখাতে পারে। তবে যারা এটি ব্যবহার করেছেন, তাদের কেউ কেউ বলছেন এর কণ্ঠটা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ
ছবি: গেটি ইমেজ

জেমস রাইট নামে একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিশেষজ্ঞ সাত মাস ধরে জাপানের একটি কেয়ার হোমে এই রোবটদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করেন। সেখানে তিনি তিন ধরনের রোবট দেখেছিলেন। প্রথমটির নাম হাগ (HUG)। এটি দেখতে খুব আধুনিক ওয়াকিং ফ্রেমের মতো। এর কাজ ছিল সেবাকর্মীদের সাহায্য করা। বিশেষ করে বিছানা থেকে কাউকে তুলে হুইলচেয়ারে বা টয়লেটে বসানোর মতো কাজ করে দেওয়া। দ্বিতীয়টির নাম পারো (Paro)। এটি দেখতে একটা ছোট্ট সাদা সিল মাছের বাচ্চার মতো। ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়া রোগের রোগীদের শান্ত রাখার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। কেউ একে আদর করলে বা স্ট্রোক করলে এটি নড়াচড়া করত এবং শব্দ করত। আর তৃতীয়টির নাম পেপার (Pepper)। ছোট্ট এবং বন্ধুসুলভ। দেখতে একটা হিউম্যানয়েড রোবটের মতোই। এর কাজ ছিল ব্যায়ামের ক্লাসে নির্দেশ দেওয়া এবং হাত-পা নেড়ে ব্যায়াম দেখানো।

ডক্টর রাইট এই গবেষণা শুরু করার আগে ভেবেছিলেন, রোবটগুলো নিশ্চয়ই দারুণ কাজ করছে। যেখানে সেবাকর্মীরা কাজের চাপে দিশেহারা, সেখানে রোবট নিশ্চয়ই তাদের কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি যা দেখলেন, তা ঠিক তাঁর ভাবনার উল্টো।

প্যারো দেখতে ছোট একটি সিল মাছের বাচ্চার মতো। আদর করলে এটি নড়াচড়া করে এবং শব্দের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখায়
ছবি: গেটি ইমেজ

তিনি আবিষ্কার করলেন, রোবটগুলো কর্মীদের সময় বাঁচানোর বদলে উল্টো সময় নষ্ট করছিল! কর্মীদের সবচেয়ে বেশি সময় চলে যাচ্ছিল এই রোবটগুলোকে পরিষ্কার করতে এবং চার্জ দিতে। আর যখনই এগুলো বিগড়ে যাচ্ছিল, তখন তা ঠিক করতেও অনেক সময় চলে যেত!

কয়েক সপ্তাহ পর সেবাকর্মীরা রোবটগুলো ব্যবহার করাই কমিয়ে দিলেন। কারণ, এগুলো ব্যবহার করার মতো সময়ই তাঁদের হাতে ছিল না। রোবটগুলো সাহায্যের বদলে অসুবিধাই বেশি করছিল। ‘হাগ’ রোবটটা সারাক্ষণ সবার চলার পথে বাধা হয়ে থাকত। ‘পারো’ সিল মাছটাকে নিয়ে হয়েছিল আরেক বিপদ। একজন রোগী এর প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যে, সেটি সরিয়ে নিলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। আর ‘পেপার’ রোবট ব্যায়াম ক্লাসের জন্য ছিল বড্ড খাটো। পেছনের মানুষেরা ওটাকে দেখতেই পেত না। আর ওর গলার স্বর এতই চিকন ছিল যে, বয়স্করা শুনতেও পেতেন না!

আরও পড়ুন
আপনার হয়তো কাচি ব্যবহার করতে করতে এখন স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়। কারণ কিছু কাটার সময় আপনার আঙুলগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে কাঁচিতে চাপ দেয়।

তিন

অবশ্য এই গবেষণার পর রোবট নির্মাতারা বলেছেন, তারা তাদের ডিজাইন উন্নত করেছেন। হাগ এখন আরও ছোট। পারোর কার্যকারিতার পক্ষেও নাকি অনেক প্রমাণ আছে, আর পেপারের সফটওয়্যারও পুরোপুরি আপডেট করা হয়েছে।

কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ রোবট নয়, মানুষের চাহিদা। লন্ডনের সেই শ্যাডো রোবট কোম্পানির রিচ ওয়াকার মনে করেন, জাপানের ওই অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। কারণ, আগামী প্রজন্মের রোবটগুলো আরও অনেক বেশি দক্ষ হবে।

ইংল্যান্ডের নটিংহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্রমিন্দা ক্যালেব-সোলি ঠিক এই কাজটাই করছেন। রোবটকে ল্যাব থেকে বের করে বাস্তব দুনিয়ায় কাজের উপযোগী করেছেন। তিনি বয়স্ক মানুষদের কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করছেন, তারা রোবটের কাছে ঠিক কী চান।

উত্তরগুলো ছিল খুব মজার এবং বাস্তব। কেউ বলেছেন, রোবটকে কথা বলতে পারতে হবে এবং দেখতে ভয়ংকর হওয়া চলবে না। তবে সবচেয়ে বড় দাবিটা ছিল খুব সাধারণ, রোবটকে অবশ্যই নিজের চার্জ নিজে দিতে হবে এবং নিজেকে নিজে পরিষ্কার করতে হবে। একজন সাফ বলে দিয়েছেন, রোবটের দেখাশোনা আমরা করতে চাই না। আমরা চাই রোবট আমাদের দেখাশোনা করুক!

রিচ ওয়াকার বলেন, ‘রোবট বানানোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিখুঁত রোবটিক হাত তৈরি করা। রোবটকে যদি আসলেই কাজের হতে হয়, তবে ওটার হাতও মানুষের হাতের মতোই দক্ষ হতে হবে।’

কেয়ারমার্ক 'জিনি' নামে একটি ছোট ভয়েস-অ্যাকটিভেটেড রোবটের পরীক্ষা চালাচ্ছে
ছবি: কেয়ারমার্ক

তাঁর ল্যাবের রোবটিক হাতটি বেশ চটপটে। এটি এক হাতে রুবিকস কিউবও সমাধান করতে পারে! কিন্তু তারপরও এটি মানুষের মতো সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে না। যেমন, একটা কাঁচি দিয়ে কিছু কাটা বা খুব সাবধানে ভাঙা জিনিস মেঝে থেকে তুলতে পারে না।

আপনার হয়তো কাচি ব্যবহার করতে করতে এখন স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ নয়। কারণ কিছু কাটার সময় আপনার আঙুলগুলো খুব সূক্ষ্মভাবে কাঁচিতে চাপ দেয়। তারপর হাত থেকে সেই তথ্য চলে যায় মস্তিষ্কে। সে অনুযায়ী আপনি আপনার কাটার ভঙ্গি বদলে ফেলেন। একটা রোবটকে আপনি এই অনুভূতির কথা বোঝাবেন কীভাবে?

এই সমস্যার সমাধানের জন্য অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন এজেন্সি বা এরিয়া নামে একটি সরকারি সংস্থা রোবট ডেক্সটারিটি প্রোগ্রাম শুরু করেছে। পশুপাখিরা কীভাবে নড়াচড়া করে, তা নিয়ে গবেষণা করছে তারা। কারণ, প্রাণীদের নড়াচড়ার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ আছে, যা রোবটের জন্য খুব দরকারি।

আরও পড়ুন
কোম্পানিগুলো যদি নিজেরাই ব্যবসার চিন্তা করে এসব প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে, তাহলে ৬০ বছর বয়সে আপনার দায়িত্ব রোবটদের হাতে না দিয়ে হয়তো আর উপায় থাকবে না।

চার

এই প্রজেক্টে কাজ করছেন ডেনমার্কের ইঞ্জিনিয়ার গুগি কোফোড। তিনি রোবটের জন্য মোটরের বদলে কৃত্রিম পেশি বানাচ্ছেন। এই পেশিগুলো নরম এক ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি। এতে বিদ্যুতের সংযোগ পেলে ঠিক আমাদের আসল পেশির মতোই সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। গুগি এই কাজে নেমেছেন ব্যক্তিগত তাগিদ থেকে। কারণ তাঁর কাছের বেশ কয়েকজন মানুষ ডিমেনশিয়ায় ভুগে মারা গেছেন। ডিমেনশিয়ায় ভোগা রোগীদের যত্ন নেওয়া খুব কঠিন। তাই তিনি এমন রোবট বানাতে চেয়েছেন, যা তাঁদের জীবনকে একটু সহজ করবে। 

এই কৃত্রিম পেশিগুলো রোবটের হাতকে মোটরের মতো যান্ত্রিক না রেখে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল করে তুলবে। হাতটা তখন ঠিক মানুষের আঙুলের ডগার মতোই বুঝতে পারবে, একটা জিনিস ধরতে ঠিক কতটুকু চাপ দিতে হবে এবং কখন থামা দরকার। 

রোবট উন্নয়নের জন্য ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল জাপান সরকার
ছবি: গেটি ইমেজ

এতসব আশার গল্পের মাঝে জাপানে গবেষণা করা সেই ডক্টর জেমস রাইট কিন্তু একটা বড় দুশ্চিন্তার কথা শুনিয়েছেন। তাঁর ভয়টা অন্য জায়গায়। তিনি মনে করেন, রোবট যদি সফল হয়েও যায়, তবে তা হয়তো মানুষের (পড়ুন সেবাকর্মীদের) জীবনকে আরও খারাপ করে দেবে। তাঁর যুক্তি হলো, রোবটের পেছনে এত টাকার খরচ তুলতে হলে কেয়ার হোমগুলোকে বিশাল বড় আর একই ছাঁচে ফেলতে হবে, যাতে রোবটের কাজ করতে সুবিধা হয়। আর তখন সেবাকর্মীদের বেতন কমিয়ে দেওয়া হবে। তাদের মূল কাজ আর মানুষের যত্ন নেওয়া থাকবে না, বরং রোবটদের দেখাশোনা করাই হবে তাঁদের আসল কাজ। এককথায় সেবাকর্মীরা হয়তো রোবটদের পরিষ্কার করবে আর সময়মতো চার্জ দেবে!

এই চিত্রটা কিন্তু ‘রোবট মানুষের সময় বাঁচিয়ে দেবে’ স্বপ্নের ঠিক উল্টো। তখন বেশি বেশি রোবট মানুষের যত্ন নেবে, এবং মানুষ যত্ন নেবে রোবটের!

তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা এতটাও হতাশ নন। অধ্যাপক গোপাল রামচরণের মতে, সেবাকর্মীর যে বিশাল ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তাতে এই রোবট শিল্প একদিন অনেক বড় হবেই। তিনি ইলন মাস্কের অপ্টিমাস রোবটের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘রোবট আসছেই। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন।’

রোবটকে সত্যিকারে কার্যকর হতে হলে মানুষের মতোই পৃথিবীর সঙ্গে মেলামেশা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। রোবটের হাত ও পা হতে হবে নমনীয়
ছবি: গেটি ইমেজ

এই ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচতে হলে বড় বড় টেক কোম্পানিগুলোকে বিশেষজ্ঞদের থেকে মতামত নিতে হবে। কোম্পানিগুলো যদি নিজেরাই ব্যবসার চিন্তা করে এসব প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে, তাহলে ৬০ বছর বয়সে আপনার দায়িত্ব রোবটদের হাতে না দিয়ে হয়তো আর উপায় থাকবে না। এখন শুনতে অদ্ভুত লাগলেও ভবিষ্যতে হয়তো এটাই স্বাভাবিক মনে হবে। 

আপনি কি আসলেই তখন রোবটদের হাতে নিজেকে তুলে দেবেন? প্রশ্নটা আপনার জন্যই তোলা থাক!

সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন