আয়রনম্যানের স্যুট কতটা বাস্তব, কতটা কল্পনা

আয়রনম্যানকে কে না চেনে? আফগানিস্তানের এক গুহায় বন্দী টনি স্টার্ক তৈরি করেছিল এক অবিশ্বাস্য স্যুট। তারপর বদলে গেছে সুপারহিরো মুভির ধারা। আয়রনম্যান হয়ে উঠেছে বিপুল জনপ্রিয় এক নাম। কিন্তু আয়রনম্যানের স্যুট কি বাস্তবে বানানো সম্ভব? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এর অনেকখানিই বাস্তবে সম্ভব। এই স্যুটের ব্যবচ্ছেদ এবং বাস্তব প্রযুক্তির কথা শোনাচ্ছেন মৃণাল সাহা…

আয়রনম্যান আমাদের ছোটবেলার নায়ক—এ কথা বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না। যদিও ঠিক ‘নায়ক’ নয়, কথাটা হবে সুপারহিরো। এ নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একটি বর্ম বা স্যুটের ছবি। সেই বর্ম পরে মুহূর্তেই সুপারসনিক গতিতে উড়ে যাওয়া যায়, এমনকি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাকাশেও পৌঁছানো সম্ভব। আয়রনম্যান মানেই বিস্ময়কর সব প্রযুক্তি আর বুদ্ধির খেলা। এই স্যুটের আড়ালের মানুষটির প্রথাগত কোনো সুপারপাওয়ার নেই। আয়রন স্যুটটিই তাকে কমিক বইনির্ভর মুভির ইতিহাসে অন্যতম সেরা সুপারহিরোর স্থান দিয়েছে।

এই সুপারহিরোর প্রথম আবির্ভাব ১৯৬৩ সালে, কমিক বইয়ে। কিন্তু আয়রনম্যান তখন ছিল মার্ভেলের দ্বিতীয় সারির সুপারহিরোদের একজন। সেই চরিত্রটিই বড় পর্দায় হাজির হলো ২০০৮ সালে, মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স বা এমসিইউর প্রথম চলচ্চিত্র আয়রনম্যান-এ। সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল কমিক বইনির্ভর মুভি তৈরির ধারা। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল আয়রনম্যান। মুভিতে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের অভিনয় সবার নজর কেড়ে নেয়। এর পেছনের অন্যতম কারণ দারুণ সব প্রযুক্তি-নির্ভর সেই আয়রনম্যান স্যুট। এই স্যুট বানানোর বিভিন্ন ধাপ যখন দেখানো হয়েছে, প্রথমবারের মতো আমরা যখন সেই দৃশ্যগুলো দেখেছি, সেই উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ আসলে ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।

আয়রনম্যান স্যুটের আড়ালে থাকা মানুষটির নাম অ্যান্থনি হাওয়ার্ড স্টার্ক। টনি স্টার্ক নামেই সে বেশি পরিচিত। এই চরিত্রটি মূলত মার্কিন উদ্ভাবক ও ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড হিউজের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে।

আয়রনম্যানের মূল শক্তির উৎস তার স্যুটের আর্ক রিঅ্যাক্টর। এই আর্ক রিঅ্যাক্টর শুধু তার স্যুটকেই শক্তি জোগায় না, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি টনি স্টার্কের জীবনও বাঁচিয়ে রেখেছিল।

সুপারহিরো মুভিগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই গ্রিন স্ক্রিনের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। সুপারহিরোদের বিশেষ ক্ষমতা বা স্যুট—প্রায় সবকিছুই কম্পিউটার গ্রাফিকসের (সিজিআই) মাধ্যমে তৈরি করা হয়। তবে ‘আয়রনম্যান’ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। প্রথম মুভিতে দেখানো আয়রনম্যানের তিনটি স্যুটই (মার্ক ১, মার্ক ২ এবং মার্ক ৩) বাস্তবে তৈরি করা হয়েছিল। যদিও সেগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার ছিল না, কিন্তু হাঁটা-চলা করা থেকে শুরু করে স্যুটের আনুষঙ্গিক অনেক কাজই করা সম্ভব ছিল। অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র প্রথম মুভির শুটিংয়ের একটি বড় অংশ এই বাস্তব স্যুটের ভেতরেই কাটিয়েছেন।

আরও পড়ুন

এবারে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা—আয়রনম্যানের মতো একটা স্যুট কি বাস্তবে বানানো সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব ধাপে ধাপে। প্রথমে বলা যাক স্যুটের শক্তি-উৎসের কথা।

আয়রনম্যানের মূল শক্তির উৎস তার স্যুটের আর্ক রিঅ্যাক্টর। এই আর্ক রিঅ্যাক্টর শুধু তার স্যুটকেই শক্তি জোগায় না, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি টনি স্টার্কের জীবনও বাঁচিয়ে রেখেছিল। ‘আর্ক রিঅ্যাক্টর’ মূলত ক্ষুদ্রাকৃতির একধরনের কোল্ড ফিউশন রিঅ্যাক্টর, যা বিপুল পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। সেই শক্তি ব্যবহার করেই টনি স্টার্ক তার স্যুটের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে।

মজার ব্যাপার হলো, মুভির কাহিনি অনুযায়ী আর্ক রিঅ্যাক্টর টনি স্টার্কের মৌলিক আবিষ্কার নয়। বরং তার বাবা হাওয়ার্ড স্টার্ক ‘ক্লিন এনার্জি’ বা পরিবেশবান্ধব শক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করেছিল। স্টার্ক ইন্ডাস্ট্রিজের বিশাল অস্ত্রের সম্ভার চলত এই আর্ক রিঅ্যাক্টরের শক্তি দিয়েই। টনি স্টার্কের কৃতিত্ব মূলত সম্পূর্ণ রিঅ্যাক্টরটিকে হাতের তালুর মতো ছোট আকারে নিয়ে আসায়। আফগানিস্তানে এক হামলায় মিসাইলের শ্রাপনেলবিদ্ধ হয় টনি। সেই শ্রাপনেলের টুকরোগুলো যাতে তার হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সে একটি তড়িৎ-চুম্বকীয় যন্ত্র তৈরি করে, যা ছিল আর্ক রিঅ্যাক্টরের প্রাথমিক প্রোটোটাইপ। সেই প্রোটোটাইপ থেকেই পরে আধুনিক ও ক্ষুদ্রাকৃতির আর্ক রিঅ্যাক্টর তৈরি করে টনি স্টার্ক। তবে মূল আর্ক রিঅ্যাক্টরের ধারণা ও প্রযুক্তি তৈরির কাজটি সে করেছিল আফগানিস্তানের এক গুহায় বন্দি অবস্থায়। মুভির কাহিনি বলা যেহেতু এখানে মূল উদ্দেশ্য নয়, তাই আগ্রহী যারা এখনো মুভিটি দেখেননি, তারা চাইলে দেখে নিতে পারেন। আমরা বরং এই স্যুটের পেছনের প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলি।

বাস্তবের এই বিশেষ ধরনের ফিউশন রিঅ্যাক্টর ডোনাট আকৃতির। এর নাম ‘টোকামাক’। ইতিহাসের প্রথম টোকামাক তৈরি করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯৫৮ সালে। আয়রনম্যানের রিঅ্যাক্টরটি এই টোকামাকের ওপর ভিত্তি করেই বানানো।

আর্ক রিঅ্যাক্টরের প্রযুক্তি কিন্তু বাস্তবেও বিদ্যমান। এখানে ‘বাস্তবে বিদ্যমান’ কথাটা একটু খুলে বলা দরকার। নক্ষত্রের বুকে হাইড্রোজেন হাইড্রোজেন মিলে তৈরি করে হিলিয়াম। আমাদের সূর্যের কেন্দ্রেই এই বিক্রিয়া হয়। এর নাম ফিউশন—অর্থাৎ দুটি ছোট মৌল মিলে একটি ভারী মৌল তৈরি করে। এ সময় খানিকটা ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমরা জানি, ভর ও শক্তি সমতুল্য। বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্র আমাদের বলে, E = mc2; অর্থাৎ সামান্য ভর (m) থেকেই পাওয়া যেতে পারে বিপুল শক্তি (E)। কারণ, প্রকৃতির নিয়মে শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সময় আলোর বেগের (c) বর্গ দিয়ে ভরকে গুণ করলে পাওয়া যায় সমতুল্য শক্তির মান। আলোর বেগ যে বিশাল এক সংখ্যা, তা সবারই জানা।

আরও পড়ুন

সাধারণত আমরা যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দেখি বিশ্বজুড়ে—বাংলাদেশের রূপপুরেও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে—এগুলোতে নিউক্লিয়ার ফিউশনের বদলে ফিশন বিক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। এতে ইউরেনিয়ামের মতো ভারী মৌল দুটি ছোট বা হালকা পরমাণুতে পরিবর্তিত হয়। ফিশন বিক্রিয়ায় ফিউশনের তুলনায় অনেক কম শক্তি পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন হলো, ফিউশন কেন ব্যবহার করা হয় না?

কারণ, এই প্রযুক্তি এত সহজলভ্য না। বিষয়টা বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সেই শীতল যুদ্ধের সময়ই নিউক্লিয়ার ফিউশন পৃথিবীতে ঘটানোর উপায় বের করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই শক্তি কাজে লাগিয়ে তাঁরা বহু বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করে আসছেন। বাস্তবের এই বিশেষ ধরনের ফিউশন রিঅ্যাক্টর ডোনাট আকৃতির। এর নাম ‘টোকামাক’। ইতিহাসের প্রথম টোকামাক তৈরি করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯৫৮ সালে। আয়রনম্যানের রিঅ্যাক্টরটি এই টোকামাকের ওপর ভিত্তি করেই বানানো।

এই রিঅ্যাক্টরের কেন্দ্রে ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম নামে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপকে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস (1.5 × 10⁸°C) বা তারও বেশি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। এই প্রচণ্ড তাপমাত্রায় গ্যাস প্লাজমা অবস্থায় চলে যায়। তখন একটি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে প্লাজমা মেঘকে ভাসিয়ে রাখা হয়, যাতে এটি রিঅ্যাক্টরের দেয়ালকে গলিয়ে না ফেলে। বাস্তবে এই নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে বটে, তবে টনি স্টার্কের মতো এটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা এখনো সম্ভব হয়নি। কারণ, বাস্তবে এই রিঅ্যাক্টরের আয়তন মুভিতে দেখানো স্টার্ক ইন্ডাস্ট্রিজের টোকামাকটির মতোই বিশাল। তা ছাড়া, টনির স্যুটে যে ‘কোল্ড ফিউশন’ বিক্রিয়া দেখানো হয়, বাস্তবে তা এখনো বিজ্ঞানীরা করতে পারেননি।

মুভিতে টনি স্টার্ক তার স্যুট তৈরির জন্য ‘গোল্ড-টাইটেনিয়াম অ্যালয়’ বা স্বর্ণ-টাইটানিয়াম সংকর ধাতু ব্যবহার করে। এটিই স্যুটটিকে দেয় অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা এবং আইকনিক সোনালি আভা।

কোল্ড ফিউশন কী? এককথায় বললে, ফিউশন বিক্রিয়া ঘটবে, কিন্তু বিকিরিত তাপের মান আশপাশের সব গলিয়ে ফেলার মতো প্রচণ্ড হবে না। একটু আগে যেমন বললাম, টোকামাকের ফিউশন ঘটানো হয় ১৫০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, সেরকম নয়। বরং কোল্ড ফিউশন মানে, ফিউশন বিক্রিয়াই ঘটবে, কিন্তু সাধারণ তাপমাত্রায়। হয়তো বাস্তবে একজন টনি স্টার্ক নেই বলেই এই প্রযুক্তি এখনো আমাদের হাতে আসেনি।

আরও পড়ুন

২.

এবার আসা যাক আয়রনম্যানের স্যুটের কথায়। যে স্যুটের কল্যাণে টনি স্টার্কের ‘আয়রনম্যান’ হয়ে ওঠা, সেই স্যুট মূলত অত্যাধুনিক এক্সোস্কেলেটনের একটি চমৎকার উদাহরণ। বর্তমানে চিকিৎসা, শিল্প ও সামরিক ক্ষেত্রে ছোট পরিসরে এক্সোস্কেলেটন তৈরি ও ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশ কিছু বছর ধরে অনেকেই জেটপ্যাকের মাধ্যমে ওড়ার চেষ্টা করছেন এবং কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। তবে তাদের কেউই আয়রনম্যানের মতো স্যুট পরে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারেন না।

স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে হলে এমন উপাদান দিয়ে স্যুট তৈরি করতে হবে যা হবে হালকা, কিন্তু একই সঙ্গে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে সক্ষম। বর্তমানে এর জন্য বিভিন্ন ধাতব সংকরের পাশাপাশি অন্যান্য হালকা ও শক্তিশালী উপাদান নিয়েও চিন্তাভাবনা এবং পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। কীরকম পরীক্ষানিরীক্ষা? খুলে বলি।

মুভিতে টনি স্টার্ক তার স্যুট তৈরির জন্য ‘গোল্ড-টাইটেনিয়াম অ্যালয়’ বা স্বর্ণ-টাইটানিয়াম সংকর ধাতু ব্যবহার করে। এটিই স্যুটটিকে দেয় অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা এবং আইকনিক সোনালি আভা। তবে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বাস্তবে এমন স্যুট তৈরি করতে হলে ব্যবহার করতে হবে গ্রাফিন (Graphene) এবং কার্বন ন্যানোটিউবের (Carbon Nanotube) মতো উপাদান। গ্রাফিনকে রীতিমতো ‘বিস্ময়কর বস্তু’ বলা হয়, কারণ এটি কাগজের চেয়েও পাতলা, কিন্তু স্টিল বা ইস্পাতের চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। অন্যদিকে কার্বন ন্যানোটিউবও ওজন এবং দৃঢ়তার অনুপাতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পদার্থগুলোর একটি। এই উপাদানগুলো ব্যবহার করে তৈরি স্যুট বা বর্ম হবে হালকা, নমনীয় এবং বুলেটপ্রুফ। বলা বাহুল্য, বর্তমানে এগুলো বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

আয়রনম্যানের যে প্রযুক্তিটি আজ প্রায় সবার হাতে পৌঁছে গেছে, তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)। একসময় টনি স্টার্কের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল জার্ভিস (J.A.R.V.I.S.)। জার্ভিস অবশ্য একটি সংক্ষিপ্ত নাম

তবু কৌতূহল মানুষকে বিস্ময়কর সব কাজের প্রতি তাড়িত করে। ফলে ব্যয় বা অন্যান্য বাধাও মানুষকে দমাতে পারেনি। আয়রনম্যানের স্যুটের ধারণা কমিকস ও মুভি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে ‘প্রায়’ বাস্তব!

বিখ্যাত টিভি শো ‘মিথবাস্টার্স’-এর সঞ্চালক অ্যাডাম স্যাভেজ একটি বাস্তব আয়রনম্যান স্যুট তৈরির প্রকল্পে কাজ করেছেন। তিনি থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে টাইটেনিয়ামের একটি সম্পূর্ণ বুলেটপ্রুফ স্যুট তৈরি করেন। এরপর ব্রিটিশ উদ্ভাবক রিচার্ড ব্রাউনিংয়ের প্রতিষ্ঠান গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি জেট স্যুট ব্যবহার করে তিনি বাতাসে উড়তেও সক্ষম হন। এতে যে কোল্ড ফিউশনক্ষম আর্ক রিঅ্যাক্টর নেই, তা বলা বাহুল্য। এ জন্যই বাস্তবের আগে ওই ‘প্রায়’ ব্যবহার করা।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডারপা (DARPA) সৈন্যদের জন্য ‘ট্যাকটিক্যাল অ্যাসল্ট লাইট অপারেটর স্যুট’ বা ট্যালোস (TALOS) নামে একটি সামরিক স্যুট তৈরির চেষ্টা করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সৈন্যদের জন্য এমন এক এক্সোস্কেলেটন তৈরি করা, যা তাদের অতিরিক্ত শক্তি জোগাবে এবং সুরক্ষা দেবে। যদিও প্রকল্পটি পুরোপুরি সফল হয়নি, তবে এর গবেষণা থেকে পাওয়া প্রযুক্তি বর্তমানে সৈনিকদের জন্য উন্নত বর্ম ও সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মার্ভেল স্টুডিওজের নিজেদের তৈরি করা প্রথম মুভি ছিল ২০০৮ সালের আয়রন ম্যান

প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুভির পর্দায়ও আয়রনম্যানের স্যুট আরও উন্নত হয়েছে। অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার এবং অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম মুভিতে টনি স্টার্ক ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে তার স্যুটকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যান। এই নতুন স্যুটটি ছিল সম্পূর্ণরূপে ন্যানোবট বা ন্যানাইট দিয়ে গঠিত, যা টনির বুকের আর্ক রিঅ্যাক্টর হাউজিংয়ে সংরক্ষিত থাকে। প্রয়োজনে এই ন্যানোবটগুলো বেরিয়ে এসে মুহূর্তের মধ্যে তার শরীরকে ঘিরে একটি সম্পূর্ণ স্যুট তৈরি করতে পারে। বাস্তবে এই প্রযুক্তি এখনো নেই, তবে ন্যানোবট বা ন্যানাইট নিয়ে চলছে নানা ধরনের গবেষণা। এর কোনোটি যে আমাদেরকে ভবিষ্যতে এই স্যুটের দিকে নিয়ে যাবে না, তা কে বলতে পারে?

৩.

আয়রনম্যানের যে প্রযুক্তিটি আজ প্রায় সবার হাতে পৌঁছে গেছে, তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)। একসময় টনি স্টার্কের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল জার্ভিস (J.A.R.V.I.S.)। জার্ভিস অবশ্য একটি সংক্ষিপ্ত নাম, এর পূর্ণরূপ হলো ‘জাস্ট আ র‍্যাদার ভেরি ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম’ (Just A Rather Very Intelligent System)। টনি স্টার্কের এই ব্যক্তিগত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাকে যেমন রিয়েল-টাইমে তথ্য সরবরাহ করত, তেমনই স্যুটের বেশির ভাগ কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণও করত। জার্ভিসের পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে দেখা গেছে ফ্রাইডে-কে (F.R.I.D.A.Y.)।

সবচেয়ে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করেছিল মার্ভেলের আরেক সুপারহিরো ডেয়ারডেভিল। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো: ‘টনি স্টার্ককে একটি মরুভূমিতে বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে দিয়ে আসো।

জার্ভিসকে বর্তমানের এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ রূপ বলা যেতে পারে। সিরি, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা অ্যালেক্সার মতো ডিজিটাল সহকারী, যারা ভয়েস কমান্ড বুঝতে পারে এবং তথ্য অনুসন্ধান করতে পারে, তাদেরই উন্নত সংস্করণ হলো জার্ভিস। তবে জার্ভিস যত সহজে টনি স্টার্কের কথা ও আবেগ বুঝতে পারত, বাস্তবের এআই এখনো ততটা উন্নত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বর্তমানের চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা ক্লডের কথা উল্লেখ করতে হবে। এগুলো যখন আরও উন্নত, ভয়েস কমান্ড পরিচালিত এবং যখন আইওটির সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হবে, তখন হয়তো সত্যিই অনেকখানি বাস্তব হয়ে উঠবে জার্ভিস। সেই পথেই এগোচ্ছি আমরা—কারণ চ্যাটজিপিটি ও জেমিনি ভয়েস কমান্ড ইতিমধ্যেই বোঝে, আর গুগল হোম তো রয়েছেই আইওটি হিসেবে।

তবে যতই প্রযুক্তির মারপ্যাঁচ থাকুক না কেন, আয়রনম্যানের মূল শক্তি আসলে তার মস্তিষ্ক। তাকে সবচেয়ে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করেছিল মার্ভেলের আরেক সুপারহিরো ডেয়ারডেভিল। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো: ‘টনি স্টার্ককে একটি মরুভূমিতে বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে দিয়ে আসো। দেখবে, সে সেখান থেকে ক্যাকটাসের কাঁটা আর বালি দিয়ে স্যুট বানিয়ে উড়ে ফিরে এসেছে! আয়রনম্যানের স্যুট তার শক্তির উৎস নয়; তার শক্তির উৎস হলো তার মস্তিষ্ক।’ আয়রনম্যান স্যুটকে তাই যতই ব্যবচ্ছেদ করা হোক না কেন, মনে রাখতে হবে, টনি স্টার্কের যাত্রা শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানের এক গুহায়, শ্রাপনেলবিদ্ধ অবস্থায় এবং কয়েক বাক্স বাতিল যন্ত্রাংশ নিয়ে।

দিনশেষে আসলে মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে ক্ষুরধার আর কিছু নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্থাপত্য বিভাগ, আহ্‌ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: ডিসকভারি ডটকম, ডিফেন্স ওয়ান ডটকম, এমসিইউ;

গিম, এ. কে (২০০৯); গ্রাফিন: স্ট্যাটাস অ্যান্ড প্রসপেক্টস; সায়েন্স, ৩২৪ (৫৯৩৪), ১৫৩০-১৫৩৪

আরও পড়ুন