সুপারম্যান

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি
একটা সুন্দর গ্রহ। নাম—ফিরিন। প্রায় ৩০০ কোটি প্রাণের বাস সেখানে। এরা মানুষ না। তবে মানুষদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে।

শাহ আলীর মাজারের গেটের সামনে এসে নামল একটি উড়োযান। আশপাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষেরা বিরক্ত চোখে একবার তাকিয়ে দেখল ঘটনা কী। আগ্রহ না দেখিয়ে তারপরেই আবার চোখ বুজল সবাই।

সেই উড়োযান থেকে বেশ মোটাসোটা একজন মানুষকে টেনে বের করে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো রাস্তায়। লোকটা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাজারের গেটের সামনে। পরনে শার্ট, জিন্স ও স্যান্ডেল। ফুড়ুৎ করে আবার উড়ে গেল সেই বাহনটি। লোকটা ঢ্যাব ঢ্যাব চোখে উড়ে যাওয়া দেখল শুধু। তার চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠল বিন্দু বিন্দু জল।

লোকটা আশপাশে তাকাল। সবাই ঘুমে। কী করবে না করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। মাঝ রাস্তায় চলে এল। ডান দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। কিছুদূর হেঁটে গেলেই বুদ্ধিজীবী শহীদ মিনারে যাওয়ার রাস্তা। আগেও বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছে। তখন অবশ্য কেউ তাকে এভাবে ফেলে যায়নি। ঘুরতে এসেছিল। হাঁটতে হাঁটতে সেদিকেই গেল সে।

সেখানেও একই দৃশ্য। ফুটপাতে ঘরহীন মানুষের নিদ্রারত অবস্থান। লোকটির খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ঘুমন্ত কাউকে বিরক্ত করতে চাইল না। বিদ্যুতের একটি খাম্বার সামনে দাঁড়িয়ে ওটার সঙ্গেই কথা বলতে শুরু করল!

‘বুঝলি ভাই, সামান্য মোটা হওয়ায় আজ আমাকে নিজের বাড়ি ছাড়তে হলো। এ জীবন রেখে আর লাভ কী? ভাবছি আত্মহত্যা করব। কিন্তু আত্মহত্যা কীভাবে করব, সেটাই বুঝতে পারছি না। তুই কিছু বলবি?’

খাম্বা উত্তর দিল, ‘প্লিজ ভাই আত্মহত্যা করিস না। মোটা হইছিস, তাতে কী? তোর বয়সই-বা কত। বিয়ে–শাদী কর। সংসার কর। এবার নিজেই ভেবে দেখ, কী করবি।’

‘তোর কথায় কোনো লজিক নাই। তারপরও কেন যেন ভালো লাগলো। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খড়-কুটো পেলেও ধরে রাখে। তোর কথা খড়-কুটো টাইপের। আর কিছু বলবি?’

‘না। আমার ঘুম ধরছে। ঘুমাব। তুইও ঘুমা।’

‘ঘুমাব না। কথা বলতে ভালো লাগছে। কিন্তু সবাই ঘুমে। কার সাথে বলব?’

‘একটু ওয়েট কর। তোকে তো সবাই চেনে। তুই তো সেলিব্রেটি। লোকজনের অভাব হবে না। ওয়েট কর ভাই।’

ভেতরে একজন মাত্র গার্ড। বসে বসে ঝিমুচ্ছে। পায়ের কাছে একটা অর্ধেক টানা সিগারেট জ্বলছে লোকটার কালো রঙের জুতার মাথার কাছে।

‘আচ্ছা, যাই। হাঁটি। জীবনে কী আর আছে, হাঁটা ছাড়া।’

‘উদাস উদাস ভাব নিয়ে লাভ নাই। পাত্তা পাবি না। গম্ভীর ভাব নে। অবশ্য এখন টাকা ছাড়া পাত্তা নাই। তোর তো টাকাও নাই। অবশ্য চাইলেই তুই টাকা কামাইতে পারবি। অনেক শক্তিশালী তুই।’

‘তুই তো বাচাল। সেই দিন কি আর আছে? তুই অনেক কথা বলিস। আচ্ছা, তাও তোকে ভালো লাগছে। ঘুমিয়ে থাক। ভালো থাক।’

বলেই লোকটি হাঁটা শুরু করল। শহীদ মিনারের গেটের সামনে এসে উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে ঢোকার কোনো জায়গা আছে কি-না। অবশ্য গেইট ছাড়াও সে উড়ে উড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। সমস্যা হচ্ছে, এখন খুব বেশি ওপরে উড়তে পারে না সে। বড়জোর দশ ফুট উঠতে পারে। গেইটটা দেখে তার কাছে দশ ফুটের কমই মনে হলো। তারপরও সাহস পেল না। যদি দশ ফুটের বেশি হয়, তখন তো ঢুকতে পারবে না। নিজের ওজন নিয়ে এখন নিজেই লজ্জিত। মনে মনে ভাবল একবার চেষ্টা করে দেখবে কি না! তার আবার মানসিক শক্তি প্রবল। মাটি থেকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকল সে। গেট ছাড়িয়ে গেল। উড়ে উড়ে ধীরে ধীরে গেটের ওপারে চলে গেল। আগের মতো গতি আর নেই। তবে উড়তে পারছে, এতেই সে খুশি।

ভেতরে একজন মাত্র গার্ড। বসে বসে ঝিমুচ্ছে। পায়ের কাছে একটা অর্ধেক টানা সিগারেট জ্বলছে লোকটার কালো রঙের জুতার মাথার কাছে। ধোঁয়া উড়ে উড়ে নাকের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ঘুমের তালেই মাঝে মাঝে খুক খুক করে কাশছে সে। সেদিকে আর না তাকিয়ে থেকে বসার জন্য একটা ভালো জায়গা খুঁজল তার দুটো চোখ। এত রাতে গল্প করার কাউকে পাওয়া যাবে না বুঝে হতাশ হলো উড়ন্ত লোকটা। শহীদ মিনারের সামনে চলে এল। সামনে অনেক জায়গা। বাম পাশেই শুয়ে আছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা।

একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে ধপাস করে বসে পড়ল সে। নিচের অংশটুকু ডেবে গেল তার বসার কারণে, যদিও অতটা জোরে বসেনি। বসে বসে নিজের কথা ভাবছে সে—

একটা সুন্দর গ্রহ। নাম—ফিরিন। প্রায় ৩০০ কোটি প্রাণের বাস সেখানে। এরা মানুষ না। তবে মানুষদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। পৃথিবীর মানুষ যদিও এখনও তাদের মতো উন্নতি করতে পারেনি। তবে ধ্বংসের দিক দিয়ে এগিয়ে আছে মানুষ। ১০০ বছর আগেও আমাদের জীবন কত সুন্দর ছিল। কিন্তু এখন মি. হক্স ক্ষমতায় আসার পর সব বদলে গেল। সবার জন্য বিভিন্ন আইন–কানুন বানানো হলো। আগেও যে আইন–কানুন ছিল না, তা নয়। তবে এত কড়া ছিল না।

আরও পড়ুন
সুপারম্যান খাওয়া–দাওয়া শেষে বের হয়ে শ্যামলী ক্যাম্পের দিকে হাঁটা শুরু করে। ওই লোকের কথাবার্তা শুনে কিছুটা হতাশও হয়েছে সে। কিন্তু ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ ক্যাম্পে না গেলেও দুই-একদিনের ভেতরই পুলিশ তাকে ধরে ফেলবে।

ফিরিন গ্রহের প্রাণীদের বলা হয় ফিরি। ফিরিরা খুব প্রাণবন্ত স্বভাবের ছিল। তাদের জীবনে কমবেশি দুঃখ–কষ্ট থাকলেও অসহনীয় পর্যায়ের কিছু ছিল না। আগে প্রশাসনকে কেউ ভয় পেত না। এখন প্রশাসন দেখলেই সবার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে থাকে। ফিরিরা গ্রহ ত্যাগের কথাও ভাবছে। কিন্তু চাইলেই তো ত্যাগ করা যায় না। কেউ কোনো অপরাধ করলেই তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নির্বাসনে। এই যেমন আমাকে পাঠানো হয়েছে। অথচ আমার অপরাধ কী! শুনলে পৃথিবীর মানুষ হাসবে। যেহেতু মনে মনে বলছি, তাই বলি—আমার হাইট প্রায় ৬.৫ ফিট। আমার ওজন তাদের আইন মোতাবেক হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৯০। কিন্তু আমার বর্তমান ওজন ১৪০ কেজি। আমাকে কয়েকবার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার এই ১২০ বছর বয়সে ওজন কমানো প্রায় অসম্ভব। বাঁচব আর কয়দিন! বড়জোর ১৪০। ফিরিরা প্রায় ১৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে গড়ে।

দারোয়ান গোছের একজন এসে ফিরি লোকটির সামনে দাঁড়ায়। সে নিজের ভাবনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে।

‘ভাই, আপনে ক্যারা?’

ফিরি তার কী নাম বলবে ভেবে পায় না। শেষ যখন পৃথিবীতে এসেছিল, সবাই তাকে সুপারম্যান বলে ডাকত। এই নামটাই তার কাছে উপযুক্ত মনে হওয়ায় বলে দিল।

লোকটা নাম শুনে কী করবে বুঝতে পারছে না।

‘সুপারম্যান! আপনে সুপারম্যান। হাহাহা। ছোটকালে সুপারম্যানকে দেখছিলাম। কী সোন্দর দেখতে! আপনে তো মোটার মোটা।’

এবার সুপারম্যান কিছুটা হতাশ হয়ে বলল, ‘আসলেই আমি সুপারম্যান। তখন আমিই এসেছিলাম। তোমাদের বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছি। কিন্তু বয়সের কারণে আজ আমার এই দুর্দশা।’

‘পাগলের অভাব নাই।’ বলেই লোকটা চলে গেল। সুপার‍ম্যান তার দিকে তাকিয়ে থাকল। আবার ডুবে গেল নিজের ভাবনায়—

ফিরি ছাড়াও অন্য গ্রহের অনেক প্রাণীকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীতে তাদের জায়গা দেওয়া হয়, খেতেও দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর ধারণক্ষমতাই-বা কত! সে যাই হোক, সকালে ক্যাম্প যেতে হবে। সেখানে তার মতো এমন অনেকেই আছে। নাম লেখাতে হবে। এ ছাড়া উপায় কী! যদি একটু থাকার জায়গা মেলে।

সুপারম্যান তখন এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে চলে গেল। অন্যদিকে সূর্যমামার আসার সময় হয় হয় করছে। যেকোনো সময় লাল সূর্য তপ্ত রোদে পরিণত হবে। তখন বাইরে থাকা খুব কষ্টের। পৃথিবীর তাপমাত্রা ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। মানুষের লোভের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। বিভিন্ন রকম কল-কারখানা বানিয়ে তারা শুধু পয়সা কামাচ্ছে। অথচ নিজেদের পৃথিবীকে করে ফেলছে বাসের অযোগ্য। যাদের হাতে কোটি কোটি ডলার, তারা তো অন্য কোনো গ্রহে গিয়ে আরামে থাকবে। কিন্তু যারা শাহ আলীর মাজারের আশপাশে এখনও ঘুমায়, তাদের অবস্থা কী হবে!

সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুপারম্যানের ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠেই রওনা হলো ক্যাম্পের দিকে। শ্যামলীতে ক্যাম্প। শ্যামলী স্কয়ার থেকে ডানে গেলেই বড় একটা মাঠ। সেখানেই জড় হয় অন্য গ্রহের বাসিন্দারা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের জায়গা করে নিতে হয়। আগের মতো হলে এক মিনিটেই চলে যেত সুপারম্যান। কিন্তু এখন দশ ফিটের বেশি সে উড়তেই পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, দুই মিনিটের বেশি স্পেসে থাকতে পারে না। হয়তো ওজন বা বয়সজনিত কারণে তার এসব ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। তাই হেঁটেই রওনা হলো। কিন্তু হাঁটতেও অসুবিধা। জিরিয়ে জিরিয়ে হাঁটছে। একটা খাবারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবল, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। তাকে মাত্র পাঁচ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছে, যেন পৃথিবীতে আসার পর দুই-একদিন খেয়ে বাঁচতে পারে। এই দোকানটায় সব গ্রহের প্রাণীদের জন্যই খাবার বানানো হয়। সাইনবোর্ডে এমনটাই লেখা। ভেতরে ঢুকে ফিরিদের জন্য বানানো ফিরি কাটলেটের ওর্ডার দিল। সবচেয়ে কম দামী খাবার এটাই। লোকজন তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। একজন বয়স্ক লোক তাকে দেখে চিনে ফেলল, ‘আরে, আপনি সুপারম্যান না?’

সুপারম্যান কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি চিনলেন কীভাবে?’

‘ছোটবেলায় আমি আপনার ফ্যান ছিলাম। আমার ঘরে এখনও আপনার পোস্টার টানিয়ে রেখেছি। কিন্তু আপনার এই দশা কেন?’

‘বয়স হলে যা হয়।’

কিছুটা হতাশ হয়ে সে জানতে চাইল, ‘আপনি কি ক্যাম্পে যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, এ ছাড়া আর উপায় কী?’

‘কিন্তু সমস্যা আছে। ওড়া ওড়া শোনা যাচ্ছে, পৃথিবীতে নাকি আর ভিনগ্রহের কাউকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে এই গ্রহ।’

‘কী বলেন? আমরা তাহলে যাব কোথায়?’

‘এটা নিয়েই আমরা ভাবি। কিন্তু আমাদের হাতে তো কোনো ক্ষমতা নাই। সব ক্ষমতা যাদের, তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। মনে মনে ভাবলেও ধরে ফেলে।’ বলেই লোকটি জিভ কাটল। এর পাঁচ মিনিটের মাথায় পুলিশ এসে হাজির। ধরে বসল লোকটিকে। জরিমানা করল ১০ হাজার ডলার, সঙ্গে এক মাসের কারাভোগ। সুপারম্যান লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু। কিছুই করতে পারল না। অথচ আগের মতো হলে পুলিশকে এক ঘুষিতে আকাশে পাঠিয়ে দিত। এখন নিজের দুর্বলতা দেখে সুপারম্যানের মরে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তারও কোনো উপায় নেই। গোটা মহাবিশ্ব থেকে আত্মহত্যা শব্দটাই বাতিল করা হয়েছে। কেউ চিন্তা করলেও তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আত্মহত্যা মানে এখন সেই গ্রহের সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব করা।

সুপারম্যান খাওয়া–দাওয়া শেষে বের হয়ে শ্যামলী ক্যাম্পের দিকে হাঁটা শুরু করে। ওই লোকের কথাবার্তা শুনে কিছুটা হতাশও হয়েছে সে। কিন্তু ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ ক্যাম্পে না গেলেও দুই-একদিনের ভেতরই পুলিশ তাকে ধরে ফেলবে। অথচ এই পৃথিবীকে বিরাট বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সে। কিন্তু সেই কথা কি আর এসব লোকের মনে আছে? মনে থাকলেও তারা তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে কেন? এগিয়ে এলেই তো তাদেরও জেল–জরিমানা করা হবে।

আরও পড়ুন
অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর ফলে হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। তখন পুলিশ এসে যাকে যেভাবে খুশি লাঠি দিয়ে বাড়ি দিতে থাকল। সুপারম্যানকেও ছাড়া হলো না। যদিও সে চুপ করেই ছিল। চুপ ছিল বাড়ি খাওয়ার সময়ও।

ক্যাম্পের কাছাকাছি এসেই দেখল অনেক ভিড়। কতরকমের প্রাণী। সব দেখতে মানুষের মতো হলেও পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তাদের বিরাট ফারাক। কেউ কেউ লম্বা, কেউ একদম লিলিপুট, কেউ বা মোটা, আবার কেউ চিকন। একেক গ্রহে একেকরকম প্রাণীর বাস। এদিক দিয়ে মানুষেরা দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু ইদানিং তাদের আর সুন্দর লাগে না। ভয়ংকর লাগে। দেখতে যেমনই হোক, কার্যকলাপ আসলেই ভয়ংকর। না হলে কেউ কি এত সুন্দর পৃথিবীর দশা এরকম করে!

সবার সঙ্গে সুপারম্যানও লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করে, তার সামনে যতজন, পেছনেও ততজন। লাইন যেন কমছেই না। সামনের জনকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’

মিনমিনে গলায় লোকটা জবাব দেয়, ‘এ–ফ থেকে।’

‘কী সমস্যা হয়েছিল?’

‘আর বলবেন না, আমাকে দেখছেনই তো কত সুন্দর দেখতে। কিন্তু আমার একটা দাঁত ভাঙা। এটাই আমার অপরাধ। তাই ছুড়ে ফেলে দিল।’

লোকটার বয়স আন্দাজ ৪০। দেখতেও বেশ। লম্বা, সুঠামদেহী। কিন্তু মাত্র একটা দাঁত ভাঙার কারণে তাকে ফেলে দিল। সুপারম্যান এ বিষয়ে আর কথা বলল না। ভাবল, একটু মোটা হওয়ার কারণে যদি আমাকে ফেলে দিতে পারে, এই লোকের একটা দাঁতই নেই। এটাই হয়তো ওদের নিয়ম। সারা জাহানে এসব কী নিয়ম–কানুন!

লাইনের একজনও এখনও বের হয়নি। তার মানে সামনে বসে যে নাম–ঠিকানা লেখে, সে কারও নামই লেখেনি। মাঠ পুরো ভরে গেছে। সামনের লোকটাকে দেখা যাচ্ছে, এক মনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। এতগুলো প্রাণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কষ্ট করছে, তাদের প্রতি কোনো মায়া নেই যেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, লাইনের প্রাণীগুলো কিছু বলতে পারছে না। কারণ তারা এই পৃথিবীর কেউ না। শরনার্থী। ভিনগ্রহের প্রাণী। তারা এসেছে একটু আশ্রয়ের খোঁজে। যদি ওই লোকের কথাই সত্য হয়, তাহলে এসব প্রাণীর কী হবে! হয়তো এতক্ষণে আরও অনেক অনেক প্রাণী পৃথিবীতে এসেছে। এই মাঠেও জায়গা হবে না হয়তো। কিন্তু তারা তো কিছু একটা জানাবে।  

অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর ফলে হই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। তখন পুলিশ এসে যাকে যেভাবে খুশি লাঠি দিয়ে বাড়ি দিতে থাকল। সুপারম্যানকেও ছাড়া হলো না। যদিও সে চুপ করেই ছিল। চুপ ছিল বাড়ি খাওয়ার সময়ও। এ ছাড়া আর কীই–বা করবে। পুলিশের বাড়ি খেয়ে অনেকেই আহত হয়েছে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হলো সঙ্গে সঙ্গে। কী একটা অবস্থা! সুপারম্যানের কাছেও ডাক্তার গোছের একজন এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কোনো অসুবিধা আছে কি না।

চুপ করে ছিল সে। বলবেই-বা কী। সমস্যার মধ্যেই তো আছে।

আরও ঘন্টাখানেক পর ঘোষণা করা হলো—দয়া করে আপনারা বসে পড়ুন। আসলে আমাদের একটা দীর্ঘ মিটিং মাত্রই শেষ হলো। পৃথিবী আর ভিনগ্রহী প্রাণীদের আশ্রয় দেওয়ার অবস্থায় নেই। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। আশা করি, আপনাদের মঙ্গলই হবে এতে।

আরও পড়ুন
সুপারম্যানের ভাবনার মধ্যে এখন আর কিছুই নেই। শুধু তার শৈশবের কথা মনে পড়ছে। কীভাবে তার বাবা তাকে উড়তে শিখিয়েছে। তার মায়ের আদর। ভাইয়ের আদর।

মাঠের সবার মধ্যে হা–হুতাশ। এখন কি আবার যার যার গ্রহে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? এমন হলে তো তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হবে। উড়ন্ত কারাগার। যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না। আমৃত্যু থাকতে হবে মহাবিশ্বের কোনো জায়গায়। এমন কারাগারের কথা এরা চিন্তাও করতে পারছে না। উড়ন্ত কারাগার সব গ্রহেই আছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে উড়ন্ত কারাগারে আটকে রাখা হয়। চরম শাস্তি ভোগ করে তারা। না খাবার, না অন্য কিছু। শুধু শরীরটা ঢুকানো যায় এমন একটা সেল বানানো আছে, সেখানে আটকে দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় আসামীদের। নিজ গ্রহ থেকে বের করে দিলে আবার যদি কেউ সেই গ্রহে ফিরতে চায় বা পালিয়ে আসে, তার জন্যও একই শাস্তি।

সুপারম্যানের শরীরে কাঁটা দিল। উড়ন্ত কারাগারে যাওয়ার চেয়ে এখানেই আত্মহত্যা করা ভালো। বারবার সে আত্মহত্যার চিন্তা করছে। যদি সাতবার হয়, তাহলেও সমস্যা। তাকেও উড়ন্ত কারাগারে পাঠানো হবে, তা সে যেখানেই থাকুক না কেন।

একটু পরে আরেকটি ঘোষণা—আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। পৃথিবীর শাসকেরা আপনাদের এখানে আশ্রয় দিতে আর সক্ষম না। তাই আপনাদের নিজ নিজ গ্রহে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের রাজিও করানো হয়েছে। তারা আপনাদের ফেরৎ নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের জন্য উড়োযান চলে আসবে। যার যার গ্রহের যানে উঠে পড়বেন দয়া করে। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। পৃথিবীতে অন্য গ্রহের যত প্রাণী আছে, তাদেরকেও পাঠিয়ে দেওয়া হবে খুব শিগগিরই।

এই ঘোষণায় কেউ খুশি হলো না। কারণ তারা এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যদি সত্যিই এমন হয়, তাহলে নিশ্চয় যার যার গ্রহের উড়োযানই তাদের ফেরৎ নিতে আসবে। যদি আসে, তাহলে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করা যায়।

সুপারম্যানের ভাবনার মধ্যে এখন আর কিছুই নেই। শুধু তার শৈশবের কথা মনে পড়ছে। কীভাবে তার বাবা তাকে উড়তে শিখিয়েছে। তার মায়ের আদর। ভাইয়ের আদর। এমন নানা কিছু। সময় চলে যাচ্ছে, আর তার ভাবনার মধ্যে শৈশব যেন জড়িয়ে পড়ছে ওতপ্রোতভাবে।

একটু পর সত্যিই নানা গ্রহের উড়োযানগুলো একে একে মাথার ওপরে এসে থামতে লাগল। বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন রঙের। সবাই উৎফুল্ল। কিন্তু উঠবে কি না, দোটানায় পড়ে যাচ্ছে অনেকে। তবে কিছু করার নেই। উঠতেই হলো। সুপারম্যানও নির্দিষ্ট বাহনে উঠে বসল। তার সঙ্গে আরও শ-খানেক ফিরি। জানে না তাদের গন্তব্য। বাহনটি উড়তে শুরু করল। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য বাহনগুলো উড়ে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে।

অনেকদূর ওড়ার পর...বাহনগুলো (জানালা দিয়ে সুপারম্যান দেখছে) একটা জায়গায় স্থির হলো। স্থির হয়েই থাকল। এক চুলও নড়ছে না। সবার মাঝেই উত্তেজনা। শোরগোল শুরু হয়ে গেল। চেঁচামেচি। কেউ কেউ বলছে, এমনই হবে জানতাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বাহনগুলো একটা নির্দিষ্ট গতিতে উড়তে থাকলে। কিন্তু তার দিক ওদের নিজ নিজ গ্রহ নয়, অন্য কোথাও। অন্য কোনো ঠিকানা পানে।

আরও পড়ুন