সিডি ডিস্ক কীভাবে কাজ করে
আপনি হয়তো এখন স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিক বা ইউটিউবে গান শোনেন। এক ক্লিকেই হাজার হাজার গান হাজির হয়। কিন্তু আগে গান শোনা এত সহজ ছিল না। এককালে গান শোনার জন্য মানুষ চকচকে গোল চাকতির মতো ডিস্ক কিনত। পিসি বা ডিভিডি প্লেয়ারের ট্রেতে সেই চাকতিটা ঢোকানোর পর যে শোঁ শোঁ শব্দটা হতো, তা ছিল এক অদ্ভুত ভালো লাগা।
আজকের ওয়্যারলেস প্রযুক্তির যুগে সিডি বা কমপ্যাক্ট ডিস্ককে হয়তো বাতিল প্রযুক্তি বলা হয়। বর্তমান জেনারেশনের কাছে এটা পুরোনো যুগের বস্তু মনে হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ৪০ বছর আগে আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তিটি ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক বিস্ময়! বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ একটা প্লাস্টিকের চাকতি মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অবিশ্বাস্য বিজ্ঞান। কী সেই বিজ্ঞান, চলুন জানা যাক।
অনেকেই ভাবেন, সিডি বুঝি ক্যাসেটের মতোই কাজ করে, শুধু আকারে ছোট। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ক্যাসেট বা ভিনাইল রেকর্ড ছিল অ্যানালগ, আর সিডি হলো ডিজিটাল। সিডির সেই চকচকে পৃষ্ঠের আড়ালে লুকিয়ে থাকত কত গল্প!
আপনি যখন একটা সিডির উল্টো পিঠের দিকে তাকান, তখন কী দেখেন? রংধনুর রঙে জ্বলজ্বল করা একটা আয়নার মতো মসৃণ পৃষ্ঠ। কিন্তু কোনো শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ওই পৃষ্ঠের দিকে তাকালে চমকে যেতে হয়। কারণ ওটা মোটেও মসৃণ নয়।
সিডির ওই পৃষ্ঠে আসলে কোটি কোটি ছোট ছোট গর্ত এবং সমতল জায়গা আছে। ইঞ্জিনিয়াররা এদের নাম দিয়েছেন পিটস বা গর্ত। আর সমতল অংশকে বলে ল্যান্ডস বা সমতল পৃষ্ঠ।
সিডির উল্টো পিঠ মনে হয় রংধনুর রঙে জ্বলজ্বল করা একটা আয়নার মতো মসৃণ পৃষ্ঠ। কিন্তু কোনো শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ওই পৃষ্ঠের দিকে তাকালে চমকে যেতে হয়। কারণ ওটা মোটেও মসৃণ নয়।
এই পিটস এবং ল্যান্ডসগুলো এতই ছোট যে খালি চোখে দেখার কোনো উপায়ই নেই। এদের আকার মাপা হয় মাইক্রোমিটারে। ১ মাইক্রোমিটার মানে ০.০০১ মিলিমিটার। মানুষের চুলের চেয়েও কয়েক গুণ সরু এই পিটগুলো। এগুলোই আসলে গানের কোড।
কম্পিউটার বা ডিজিটাল দুনিয়া চলে বাইনারি পদ্ধতিতে, মানে শুধু ০ ও ১ দিয়ে। সিডির গায়ে থাকা এই পিটস এবং ল্যান্ডস আসলে সেই ০ আর ১-এর প্রতিনিধিত্ব করে। পুরো গানটাই কোটি কোটি ০ আর ১-এর সমষ্টি হয়ে ওই চাকতির গায়ে খোদাই করা থাকে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই গর্তগুলো থেকে গান বাজে কীভাবে? এখানে ক্যাসেটের মতো কোনো পিন বা কাঁটা সিডির গায়ে ঘষা খায় না। বরং এখানে ব্যবহার করা হয় লেজার রশ্মি। আপনি যখন সিডি প্লেয়ারে ডিস্ক ঢোকান, তখন ডিস্কটি প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে শুরু করে। আর নিচ থেকে একটি খুব সূক্ষ্ম লেজার বিম বা আলোক রশ্মি সিডির ওই গর্ত আর সমতল জায়গার ওপর ফেলা হয়।
লেজারের আলো যখন কোনো সমতল জায়গায় পড়ে, তখন সেটা আয়নার মতো প্রতিফলিত হয়ে সোজা সেন্সরে ফিরে আসে। কিন্তু যখন আলো কোনো গর্তে বা পিটে পড়ে বা কিনারা দিয়ে যায়, তখন আলোটা ঠিকঠাক ফিরে আসে না কিংবা ছড়িয়ে যায়।
সিডির গায়ে থাকা এই পিটস এবং ল্যান্ডস আসলে সেই ০ আর ১-এর প্রতিনিধিত্ব করে। পুরো গানটাই কোটি কোটি ০ আর ১-এর সমষ্টি হয়ে ওই চাকতির গায়ে খোদাই করা থাকে।
সিডি প্লেয়ারের সেন্সর এই আলোর ফিরে আসা আর না আসার তফাতটা ধরতে পারে। ওটা বোঝে কখন আলো আছে আর কখন নেই। ধরুন, আলো থাকা মানে ১, এবং আলো না থাকা মানে ০। এই আলোর সংকেতগুলোকে মুহূর্তের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে। আর সেই বৈদ্যুতিক সংকেত স্পিকারের মাধ্যমে আমাদের কানে পৌঁছায় সুমধুর গান বা ভিডিও হয়ে। ভাবুন তো, সেকেন্ডের মধ্যে কত কোটিবার এই ঘটনাটি ঘটছে, অথচ আমরা টের পাচ্ছি না!
২০০০-এর দশকের ছেলেমেয়েদের কাছে সিডি বার্ন ছিল খুব পরিচিত একটা শব্দ। কম্পিউটারে খালি সিডি ঢুকিয়ে পছন্দের গানের প্লে-লিস্ট বানিয়ে বলা হতো, সিডিটা বার্ন করছি। কিন্তু আসলেই কি সেখানে আগুন জ্বালানো হতো?
ব্যাপারটা আসলে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এর পেছনেও বিজ্ঞান আছে। সাধারণ সিডি, মানে যেগুলো দোকান থেকে গানসহ কেনা হয়, সেগুলো তৈরি করা হয় কারখানায় ছাঁচে ফেলে। সেই সিডিতে পিটগুলো আগে থেকেই খোদাই করা থাকে। কিন্তু ব্ল্যাঙ্ক সিডিতে কোনো পিট থাকে না।
এগুলোর ওপর থাকে বিশেষ একধরনের আলোক-সংবেদনশীল ডাই বা রাসায়নিকের প্রলেপ। আপনি যখন কম্পিউটারে বার্ন অপশন চাপেন, তখন সিডি রাইটারের লেজারটি সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই শক্তিশালী লেজার ওই রাসায়নিক স্তরের ওপর পড়ে সেটাকে গরম করে ফেলে। একেই বলে বার্ন করা। গরমে ওই রাসায়নিক স্তরটি গলে গিয়ে ছোট ছোট কৃত্রিম গর্ত বা পিট তৈরি করে।
সাধারণ সিডি, মানে যেগুলো দোকান থেকে গানসহ কেনা হয়, সেগুলো তৈরি করা হয় কারখানায় ছাঁচে ফেলে। সেই সিডিতে পিটগুলো আগে থেকেই খোদাই করা থাকে।
লেজার দিয়ে সিডির গায়ে নিজের মতো করে পিট ও ল্যান্ডস তৈরি করা যেত, যাতে পরে সিডি প্লেয়ার সেটা বুঝতে পারে। আর বার বার লেখা যায় এমন সিডির ক্ষেত্রে ওই রাসায়নিক স্তরটিকে আবার লেজার দিয়ে গরম করে রাসায়নিক স্তরটির গঠন পরিবর্তন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। অনেকটা মোম গলিয়ে সমান করার মতো।
ভিনাইল রেকর্ড আর সিডির মূল পার্থক্যটা হলো স্পর্শে। ভিনাইল রেকর্ডে একটা পিন বা স্টাইলাস সরাসরি রেকর্ডের খাঁজে ঘষা খায়, যা অ্যানালগ শব্দ তৈরি করে। ঘর্ষণের ফলে ক্যাসেটের রেকর্ড সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সিডিতে যেহেতু লেজার আলো ব্যবহার করা হয় এবং কোনো কিছুই সিডির পৃষ্ঠ স্পর্শ করে না, তাই সিডি অনেক দিন টেকে; যদি না ওটায় স্ক্র্যাচ পড়ে!
বর্তমান সময়ে হয়তো সিডিকে আমরা সেকেলে ভাবি। কিন্তু মাত্র ১২ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটা প্লাস্টিকের চাকতিতে লেজার দিয়ে তথ্য পড়ার এই প্রযুক্তিই আমাদের আজকের ডিজিটাল দুনিয়ার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল!