হলোগ্রাম প্রযুক্তি মস্তিষ্কে, চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা
প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা একটি নতুন আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এই প্রযুক্তি মস্তিষ্কের একাধিক জায়গায় একই সময়ে উদ্দীপনা তৈরি করতে পারে। এই আবিষ্কারটি ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে আলঝেইমার, পার্কিনসনস বা বিষণ্নতার মতো মস্তিষ্কের রোগের চিকিৎসা নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
আমরা সাধারণত জানি, আল্ট্রাসাউন্ড দিয়ে গর্ভের শিশুর ছবি তোলা হয়। কিন্তু এই প্রযুক্তির ক্ষমতা আরও অনেক বেশি। ফিজিওথেরাপিস্টরা দীর্ঘদিন ধরে টিস্যু গরম করতে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করেন। ক্যান্সার চিকিৎসকেরাও উচ্চ ক্ষমতার আল্ট্রাসাউন্ড দিয়ে শরীরের ভেতরে তাপ তৈরি করে টিউমার ধ্বংস করেন।
গত দশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কম তীব্রতার আল্ট্রাসাউন্ড নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁরা দেখছেন, এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন আনা যায় কিনা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘নিউরোমডুলেশন’। আলঝেইমার, মৃগীরোগ বা কম্পনজনিত রোগের উপসর্গ কমাতে এটি কার্যকর কিনা, তা জানতে এরই মধ্যে প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ ও ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা এই পদ্ধতিকে আরও উন্নত করেছেন।
গত দশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কম তীব্রতার আল্ট্রাসাউন্ড নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁরা দেখছেন, এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন আনা যায় কিনা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘নিউরোমডুলেশন’।
যন্ত্রে নতুন কী যুক্ত হয়েছে
বিজ্ঞানীরা এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা মস্তিষ্কের তিন থেকে পাঁচটি নির্দিষ্ট জায়গায় একসঙ্গে উদ্দীপনা দিতে পারে। তাঁদের গবেষণাপত্রে এটি প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে এমনটা করা গেলেও তাতে নির্ভুলতা অনেক কম ছিল।
সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ এবং ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রাজানস্কি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্ক মূলত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে। তাই একই সময়ে একাধিক জায়গায় উদ্দীপনা দেওয়া গেলে নির্দিষ্ট মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ককে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করা সহজ হয়।
এই পদ্ধতিতে যন্ত্রটি মাথার ওপরে বসানো হয়। এরপর খুলির ভেতর দিয়ে করা হয় নিউরোমডুলেশন। এটি একটি নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি। অর্থাৎ, এর জন্য খুলি কাটা বা কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না।
পরীক্ষাটি কীভাবে করা হলো
গবেষকেরা পরীক্ষাগারে ইঁদুরের ওপর এই নিউরোমডুলেশন পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা ইঁদুরের মাথা একটি হুডের মাঝখানে রেখে কয়েকশ আল্ট্রাসাউন্ড ট্রান্সডিউসার লাগিয়েছিলেন। এই ট্রান্সডিউসারগুলো গবেষকদেরই তৈরি। আল্ট্রাসাউন্ড ট্রান্সডিউসার হলো এমন একটি যন্ত্র, যা বিদ্যুৎ শক্তিকে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তর করে। আবার সেই শব্দ তরঙ্গ কোনো বস্তু থেকে ফিরে এলে, সেটিকে বিদ্যুৎ সংকেতে রূপান্তর করে বিশ্লেষণের জন্য পাঠায়।
অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকসের সাহায্যে ট্রান্সডিউসারগুলো সংক্ষিপ্ত আল্ট্রাসাউন্ড স্পন্দন তৈরি করে। মস্তিষ্কের ভেতরে সেই আল্ট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। ব্যাপারটা অনেকটা হলোগ্রামের মতো। হলোগ্রাম হলো একটি ত্রিমাত্রিক ছবি, যা আলোর তরঙ্গের মিথস্ক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়। এই নতুন পদ্ধতিতেও অনেকগুলো আল্ট্রাসাউন্ড তরঙ্গ একসঙ্গে মিলে মস্তিষ্কের ভেতরে আলাদা আলাদা ফোকাল পয়েন্ট বা কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করে।
মস্তিষ্কের একাধিক জায়গায় একসঙ্গে কাজ করতে পারার একটি বড় সুবিধা আছে। গবেষকেরা এখন আগের চেয়ে কম তীব্রতার আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করতে পারেন। ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রাজানস্কি বলেন, ‘আল্ট্রাসাউন্ড যত কম তীব্র হয়, মস্তিষ্কের জন্য এই প্রক্রিয়া তত বেশি নিরাপদ।’
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রাজানস্কি বলেন, ‘আল্ট্রাসাউন্ড যত কম তীব্র হয়, মস্তিষ্কের জন্য এই প্রক্রিয়া তত বেশি নিরাপদ।’
আগের পদ্ধতির কী সমস্যা কী ছিল
আল্ট্রাসাউন্ড দিয়ে নিউরোমডুলেশনের পুরোনো পদ্ধতিতে কিছু সমস্যা ছিল। আল্ট্রাসাউন্ড খুব দুর্বল হলে কোনো প্রভাব পড়ত না। আবার অতিরিক্ত তীব্র হলে পুরো মস্তিষ্ক অনিয়ন্ত্রিতভাবে উত্তেজিত হয়ে যেত। এতে মস্তিষ্কের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ত। এছাড়া, তীব্র আল্ট্রাসাউন্ড রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারত এবং খুলিতে অতিরিক্ত তাপ তৈরি করত।
কম তীব্রতার আল্ট্রাসাউন্ড কিছু স্বল্পমেয়াদী প্রভাব ফেলে। যেমন, এটি নির্দিষ্ট এলাকায় সামান্য তাপমাত্রা বাড়ায়। এছাড়া ধারণা করা হয়, এটি নিউরনের পৃষ্ঠে থাকা আয়ন চ্যানেলগুলোকেও প্রভাবিত করে। তবে কোন প্রক্রিয়া ঠিক কীভাবে কাজ করে, তা জানতে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
এই নতুন পদ্ধতি শুধু মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক সক্রিয়ই করে না। এটি একই সঙ্গে ইমেজিংয়ের মাধ্যমে সেই সক্রিয়তার ছবিও তৈরি করতে পারে। ফলে গবেষকেরা তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পারেন, মস্তিষ্কের কোন নেটওয়ার্কগুলো সক্রিয় হয়েছে। নেচার বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালে প্রকাশিত এই সাম্প্রতিক গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল প্রযুক্তিটি উন্নত করা, কোনো চিকিৎসা প্রয়োগ নয়। মূল নিবন্ধটি পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন।
আল্ট্রাসাউন্ড ট্রান্সডিউসার হলো এমন একটি যন্ত্র, যা বিদ্যুৎ শক্তিকে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তর করে। আবার সেই শব্দ তরঙ্গ কোনো বস্তু থেকে ফিরে এলে, সেটিকে বিদ্যুৎ সংকেতে রূপান্তর করে বিশ্লেষণের জন্য পাঠায়।
এই গবেষণার তহবিলের একটি বড় অংশ এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ থেকে। অধ্যাপক রাজানস্কি জানান, সংস্থাটি বর্তমানে রাজনৈতিক চাপের মুখে আছে। তারা এখন আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগীদের তহবিল দিচ্ছে না। এই কারণে আগের মতো সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। তবে তিনি অন্যান্য উৎস থেকে তহবিল জোগাড় করে এই কাজ যতটা সম্ভব চালিয়ে যেতে চান।
এরপর বিভিন্ন প্রাণী মডেলে এই প্রযুক্তি পরীক্ষা করতে চান গবেষকেরা। আলঝেইমার, কম্পন ও মৃগীরোগ ছাড়াও বিষণ্নতা, পার্কিনসনস এবং স্ট্রোকের চিকিৎসায় এটি কাজে লাগতে পারে।
অধ্যাপক রাজানস্কি বলেন, ‘আমরা আমাদের গবেষণার জন্য প্রাণীর ওপর নির্ভর করি। এত প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের ওপর এই গবেষণা করা সম্ভব হবে না। আমাদের প্রথমে শিখতে হবে, কীভাবে এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটি মস্তিষ্কের রোগের চিকিৎসার জন্য নিরাপদ ও কার্যকর কিনা, তাও নিশ্চিত করতে হবে।’
এই নতুন প্রযুক্তি মস্তিষ্কের জটিল রোগের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে। তবে মানুষের ওপর প্রয়োগের আগে এখনো অনেক গবেষণা প্রয়োজন।