সুইট সিক্রেট!

গাছ যে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে—সে তো সবারই জানা। আর সেই রান্নাবান্নার কাজে গাছের ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল হলো সূর্যের আলো—সৌরশক্তি। আরও আছে—মাটি থেকে তুলে আনা পানি আর বাতাস থেকে শুষে নেওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড। ব্যস! রেসিপিটা বেশ সহজ।

এই রেসিপিতেই গাছ প্রতিনিয়ত তৈরি করছে নিজের খাবার—একধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার। রাসায়নিক ভাষায় একে বলে C6H12O6। মানে ৬টি কার্বন, ১২ হাইড্রোজেন এবং ৬টি অক্সিজেন দিয়ে গঠিত বিশেষ সজ্জার একটা যৌগ। আমরা আমজনতা তাকেই জানি গ্লুকোজ বা শর্করা হিসেবে।

এই রান্নার উপজাত হিসেবে গাছ বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে অক্সিজেন নামের একটি গ্যাস। সেটা ঘটে বলে বাঁচোয়া। কারণ সেটাই আমরা শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে নিয়ে বেঁচে আছি। এই সবকিছুর মূলে রয়েছে উদ্ভিদের এক জাদুকরী রান্না প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা এ প্রক্রিয়ার জন্য একটা গালভরা নাম ঠিক করেছেন—সালোকসংশ্লেষণ বা ফটোসিন্থেসিস।

তাই এক অর্থে বলা চলে, পৃথিবীর সব জীব কেলভিন চক্রের ওপর নির্ভর করে বেঁচেবর্তে আছে। যেমন ধরা যাক, হরিণ, গরু বা ছাগলের কথা। এই চতুষ্পদী প্রাণীরা তৃণভোজী। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য এরা পুরোটাই গাছপালার ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু গাছের রান্নাঘর কোথায়? তার অবস্থান পাতায়। মানে সবুজ পাতার ক্লোরোফিলে। এখানেই ঘটে সালোকসংশ্লেষণ। গাছের এই প্রক্রিয়ার কারণেই সকালে ঘুম থেকে উঠে রুটি-ভাত খেতে পারছেন। কিংবা দুপুরে খেতে পারছেন প্রিয় ফলের শরবত বা অন্য কিছু। আর এসবের পেছনে আছে গাছের রান্না করা সেই মিষ্টি স্বাদের রাসায়নিক যৌগ, গ্লুকোজ।

এটুকু তথ্য বিজ্ঞানীরা বেশ আগে থেকেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে কীভাবে? মাত্র সাধারণ কয়েকটা উপাদান থেকে গাছের পাতায় গ্লুকোজ তৈরি হয় কীভাবে? গাছের মিষ্টি তৈরির মিস্ট্রিটা আসলে কী?—তার খুটিনাটি ছিল একসময় রহস্যে ঢাকা। সেটি উদঘাটন করতে বিজ্ঞানীদের লেগেছিল কয়েক দশক। অবশেষে ১৯৫০-এর দশকে প্রক্রিয়াটা প্রথমবারের মতো সনাক্ত করেন মার্কিন বায়োকেমিস্ট্র ড. মেলভিন কেলভিন।

আরও পড়ুন

এই বিজ্ঞানীর নামেই এখন গাছের গ্লুকোজ তৈরির এই চক্রটা কেলভিন চক্র নামে পরিচিত। সালোকসংশ্লেষণের ভেতরের আসল কারিগর আসলে এই চক্র। কেলভিন চক্রের মাধ্যমেই সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে সুগার বা গ্লুকোজে রূপান্তর করে। গাছের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে নানান কর্মকাণ্ডে এই সুগার অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই কেলভিন চক্রের ওপর গাছপালা নির্ভরশীল। আর গাছপালার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল পৃথিবীর তাবৎ প্রাণিকুল।

তাই এক অর্থে বলা চলে, পৃথিবীর সব জীব কেলভিন চক্রের ওপর নির্ভর করে বেঁচেবর্তে আছে। যেমন ধরা যাক, হরিণ, গরু বা ছাগলের কথা। এই চতুষ্পদী প্রাণীরা তৃণভোজী। অর্থাৎ খাদ্যের জন্য এরা পুরোটাই গাছপালার ওপর নির্ভরশীল। আবার খাদ্য শৃঙ্খলের একদম ওপরে থাকা বাঘ বা সিংহের মতো মাংসাসী প্রাণীরা এ ধরনের চতুষ্পদী প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল। কাজেই শেষপর্যন্ত কারোরই আসলে কেলভিন চক্রের চক্কর থেকে কারও নিস্তার নেই।

চলুন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পানি ও সৌরশক্তি ব্যবহার করে গাছের গ্লুকোজ তৈরির সুইট সিক্রেট এবং সেই সিক্রেট উদঘাটনে মেলভিন কেলভিনের গবেষণা সম্পর্কে একটু জানা যাক।

২.

তাঁর পুরো নাম মেলভিন এলিস কেলভিন। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায়, ১৯১১ সালের ৮ এপ্রিল। কেলভিনের জন্মের আগেই রুশ সাম্রাজ্য (বর্তমানের লিথুনিয়া) থেকে পালিয়ে এসেছিল তাঁর পরিবার। স্কুল-কলেজ শেষ করে ভর্তি হন মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে ১৯৩১ সালে রসায়নে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ১৯৩৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি পান মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বার্কলির ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৩৭ সালে। তেজস্ক্রিয় কার্বন নিয়ে সেখানে গবেষণা শুরু করেন তিনি। বার্কলি ক্যাম্পাসের কাঠের একটি ভবন সবার কাছে পরিচিত ছিল—ওল্ড রেডিয়েশন ল্যাব। এই ভবনেই ১৯৪৮ সালের দিকে সালোকসংশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন কেলভিন। এ গবেষণায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন অ্যান্ড্রিউ বেনসন এবং জেমস ব্যাশাম।

গবেষণার শুরুতেই ল্যাবে এককোষী সবুজ শৈবাল চাষ করতে শুরু করেন কেলভিন ও তাঁর সহকর্মীরা। শৈবাল একধরনের জলজ উদ্ভিদ। এরাও সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করতে পারে।

তবে এ বিষয়ে প্রথম গবেষণা শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী স্যাম রুবেন এবং মার্টিন কামেন। বার্কলিতে কার্বন-১৪ আইসোটোপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের কাজটি অসমাপ্ত থেকে যায়। কারণ গবেষণাগারে একটি দুর্ঘটনায় অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যান রুবেন। অন্যদিকে কামেনের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে এফবিআই এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। তবে রেডিয়েশন ল্যাবরেটরির পরিচালক আর্নেস্ট লরেন্স এ দুই বিজ্ঞানীর কাজের জন্য গর্বিত ছিলেন। তা ছাড়া তাঁদের গবেষণাটিকে আরও এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই ১৯৪৫ সালে লরেন্স এবং রসায়ন ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিন ওয়েন্ডেল ল্যাটিমার এ কাজে কেলভিনকে নিয়োগ দেন।

আরও পড়ুন

যা-ই হোক, বার্কলি রেডিয়েশন ল্যাবের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল চিকিৎসা ক্ষেত্রে কার্বন-১৪-এর ব্যবহার এবং চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার জন্য রেডিও-লেবেলযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড ও জৈব বিপাকীয় উপাদান সংশ্লেষণ করা। কেলভিন দেশজুড়ে বিভিন্ন ল্যাব থেকে শক্তিশালী রসায়নবিদদের নিয়োগ দিয়ে ল্যাবটিকে সুসংগঠিত করতে শুরু করেন। এরপর তিনি নিয়োগ দেন অ্যান্ড্রু বেনসনকে। এর আগে রুবেন এবং কামেনের সাথে সালোকসংশ্লেষণ এবং কার্বন-১৪ নিয়ে কাজ করেছিলেন বেনসন। তাই এ কাজে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিটি ছিল বেশ সমৃদ্ধ।

গবেষণার শুরুতেই ল্যাবে এককোষী সবুজ শৈবাল চাষ করতে শুরু করেন কেলভিন ও তাঁর সহকর্মীরা। শৈবাল একধরনের জলজ উদ্ভিদ। এরাও সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করতে পারে। শৈবালগুলোকে ছোট্ট একটা যন্ত্রের মধ্যে রেখেছিলেন তিনি, যাতে সেগুলো আলো ও সাধারণ কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংস্পর্শে থাকে। সেই যন্ত্রটাকে তিনি ডাকতেন ললিপপ নামে।

সালোকসংশ্লেষণ পুরোপুরি সক্রিয় হলে সেগুলোকে একটি লম্বা কাচের নলের মধ্য দিয়ে গরম অ্যালকোহলের মধ্যে প্রবাহিত করা হয়, যাতে শৈবালগুলি তৎক্ষণাৎ মারা যায়। কেলভিন এই ললিপপে আলো ফেললেন এবং কার্বনের তেজস্ক্রিয় রূপ কার্বন-১৪ ব্যবহার করলেন। আসলে শৈবালের ক্লোরোপ্লাস্টে কার্বন ডাই-অক্সাইড কোন পথ অনুসরণ করে, তা শনাক্ত করতেই কার্বন-১৪ ব্যবহার করেন তিনি। শৈবালের সালোকসংশ্লেষণ ঘটে আসলে এই ক্লোরোপ্লাস্টে।

শৈবালগুলোর হাতে মাত্র পাঁচ সেকেন্ড সময় ছিল ওই কার্বন-১৪ নিয়ে কাজ করার জন্য, তারপরই তাদের মৃত্যু ঘটানো হয়। এরপর শৈবালগুলিকে থেঁতো করে তাদের মধ্যে থাকা যৌগগুলো আলাদা করা হয়। সে জন্য ব্যবহার করা হলো পেপার ক্রোমাটোগ্রাফি পদ্ধতি। এতে দেখা গেল, প্রায় ৯০ শতাংশ কার্বন-১৪ মাত্র একটি যৌগেই রয়েছে। আর সেই যৌগের নাম ফসফোগ্লিসেরিক অ্যাসিড। এর অণুতে তিনটি কার্বন পরমাণু থাকে। সেটিই আসলে ৩-কার্বন ফসফোগ্লিসারিক অ্যাসিড (PGA)। এটি ছিল গ্লুকোজ গাঁজনের একটি দীর্ঘ পরিচিত উপায়। রুবেন এবং কামেন বহু বছর আগে সেটি ব্যাখ্যা করেছিলেন।

আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো, কেলভিন একসময় বুঝতে পারলেন, ওই তিনটি কার্বনের মধ্যে কোনটি রেডিওঅ্যাকটিভ কার্বন-১৪। ফলে তিনি স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে পারলেন, এই ফসফোগ্লিসেরিক অ্যাসিড কীভাবে গঠিত হচ্ছে।

প্রথম ধাপে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে একটা কার্বন অণু ৫ কার্বন সমৃদ্ধ অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই অণুকে বলা হয় রাইবুলোজ বাইফসফেট (RuBP)। একটা কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে একটা রাইবুলোজ বাইফসফেট অণুর সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় কার্বন ফিক্সেশন।

এরপর একের পর এক পরীক্ষা চালিয়ে সালোকসংশ্লেষণের জটিল রাসায়নিক ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন কেলভিন ও তাঁর দল। এই পদ্ধতিতে তিনি আবিষ্কার করলেন যে একটা উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কোন কোন ধাপে বা কীভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ক্রমান্বয়ে গ্লুকোজে রূপান্তর করতে পারে।

কথিত আছে, পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে করলে, সমাধান পাওয়া যাবে, তা তাঁর মাথায় এসেছিল হুট করে। গবেষণার শুরু পর থেকে গাছের মিষ্টি তৈরির রহস্য ভেদ করার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতেন তিনি। এমনই একদিন স্ত্রীর সঙ্গে গাড়িতে চেপে বাইরে বেড়াতে গেছেন কেলভিন। এ সময় কী এক কাজে তাঁর স্ত্রী গাড়ির বাইরে গেলেন। আর তাঁর জন্য গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন কেলভিন। বসে বসে আনমনে গাছের মিষ্টি রহস্য নিয়েই ভাবছিলেন তিনি। এমন সময় তাঁর মাথায় এই চক্রাকার প্রক্রিয়ার ধারণাটি আসে। তিনি বুঝতে পারেন, গাছপালা সরল পথে কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে শর্করা তৈরি করে না, বরং এটি একটি চক্রাকার পদ্ধতিতে ঘটে। কী সেই চক্র?

আরও পড়ুন

৩.

কেলভিনের প্রস্তাবিত কেলভিন চক্রের প্রধান ধাপ চারটি। গ্লুকোজ তৈরি করার প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয় এটিপি (ATP) এবং এনএডিপিএইচ (NADPH)। অনেকেরই হয়তো জানা আছে, এটিপি হলো অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেটের সংক্ষিপ্ত রূপ এবং এনএডিপিএইচ হলো নিকোটিনামাইড অ্যাডেনাইন ডাইনিউক্লিওটাইড ফসফেটের সংক্ষিপ্ত রূপ। সূর্যের আলো থেকে গাছ যে শক্তি পায়, তা এই রাসায়নিক যৌগগুলোতে আটকে রাখে।

প্রথম ধাপে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে একটা কার্বন অণু ৫ কার্বন সমৃদ্ধ অণুর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই অণুকে বলা হয় রাইবুলোজ বাইফসফেট (RuBP)। একটা কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে একটা রাইবুলোজ বাইফসফেট অণুর সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় কার্বন ফিক্সেশন। এ পদ্ধতিতে ৬ কার্বন সমৃদ্ধ অণু গঠিত হয়। কার্বন ফিক্সেশনের মাধ্যমে গঠিত হওয়া ৬ কার্বন অণু অচিরেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ৩ কার্বন সমৃদ্ধ অণুতে পরিণত হয়। একে বলা হয় ৩-ফসফোগ্লাইসিরেট বা ৩-পিজিএ (3-PGA)। দ্বিতীয় ধাপে ৩–পিজিএ রূপান্তরিত হয় গ্লিসারালডিহাইড ৩ ফসফেটে বা G3P। এটাই ব্যবহৃত হয় শর্করা তৈরির জন্য। G3P বা জিথ্রিপি তৈরি করাই হলো কেলভিন চক্রের মূল উদ্দেশ্য।

যা-ই হোক, কেলভিন এবং তাঁর সহকর্মীদের এই গবেষণা আধুনিক বিজ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাঁদের আবিষ্কার থেকে বিজ্ঞানীরা সৌরশক্তিকে নবায়নযোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

তৃতীয় ধাপে তৈরি হয় শর্করা। এ সময় কিছু জিথ্রিপি অণু সরাসরি শর্করা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তৈরি গ্লুকোজ, দুটি জিথ্রিপি অণু দিয়ে গঠিত হয়। আর চতুর্থ ধাপে বাকী জিথ্রিপি অণুগলো জটিল কিছু বিক্রিয়ার মাধ্যমে আবারও ৫–কার্বন অণু RuBP–তে রূপান্তরিত হয়। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি আবারও প্রথম থেকে শুরু হয়ে নতুন করে কার্বন ডাই–অক্সাইড থেকে গ্লুকোজ তৈরি হতে থাকে। এভাবে চক্রটি অবিরামভাবে চলতেই থাকে।

১৯৫৭ সালে কেলভিন তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে জার্নাল অব কেমিক্যাল এডুকেশন–এ প্রকাশিত তাঁর পেপারের শিরোনাম ছিল: দ্য পাথ অব কার্বন ইন ফটোসিন্থেসিস। এ আবিষ্কারের জন্য ১৯৬১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান মেলভিন কেলভিন। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে মিস্টার সালোকসংশ্লেষণ উপাধি দেয়।

আরও পড়ুন

কিন্তু এরপরই শুরু হয় বির্তক। তাঁর সহকর্মী অ্যান্ড্রিউ বেনসন এবং জেমস ব্যাশাম দাবি করতে থাকেন কেলভিন চক্র আবিষ্কারের পেছনে তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু শুরু থেকেই নিজের সহকর্মীদের অবদানগুলো একেবারেই অস্বীকার করে গেছেন কেলভিন। এমনকি তাঁর লেখা আত্মজীবনীতেও এসেছে এই গবেষণা প্রসঙ্গ। সেখানেও বেনসন এবং ব্যাশামের কথা স্রেফ এড়িয়ে গেছেন তিনি। এই বিতর্কের পর বর্তমানে এই চক্রকে বলা হয় কেলভিন–বেনসন–ব্যাশাম চক্র।

যা-ই হোক, কেলভিন এবং তাঁর সহকর্মীদের এই গবেষণা আধুনিক বিজ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাঁদের আবিষ্কার থেকে বিজ্ঞানীরা সৌরশক্তিকে নবায়নযোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বর্তমানে ফোটোভোল্টাইক সেল, সৌরশক্তি ঘনীভূতকরণ পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ ছাড়াও বিজ্ঞানীরা কার্বন আটকে ফেলার প্রক্রিয়াকে উন্নত করার চেষ্টা করছেন। সেটাই হয়তো বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন দূর করতে সাহায্য করবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সেটা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আবার এই চক্রের এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু ফসলের ফলন বাড়াতেও সাহায্য করছে। কেলভিন–বেনসন–ব্যাশাম চক্রের এই অসাধারণ আবিষ্কার আমাদের প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য নতুন শক্তির উৎস এবং সবুজ পৃথিবী তৈরির পথও দেখাচ্ছে। কাজেই হলফ করেই বলা যায়, কেলভিন–বেনসন–ব্যাশাম চক্র শুধু গাছদেরই নয়, আমাদের জীবনেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ!

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

ফটোসিন্থেসিস/ আইজ্যাক আসিমভ

উইকিপিডিয়া

নোবল ডট অর্গ

আরও পড়ুন