রাইনোভাইরাস ও কয়েকটি গবেষণা
এই তো মাত্র সোয়া শ বছর হলো ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পেরেছে মানুষ। তার আগপর্যন্ত এই অদৃশ্য শত্রু সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। কয়েক হাজার বছর বয়সী মানবসভ্যতার তুলনায় একে খুব অল্প কালই বলা যায়। কিন্তু ভাইরাস আসলে জীব নাকি জড়?—এই প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি। এর উত্তরে এখনো বিজ্ঞানীরা দুই দলে বিভক্ত।
দুই পক্ষের তর্কবির্তকের পেছনে কারণও অবশ্য যথেষ্টই আছে। যেমন ভাইরাসকে পূর্ণাঙ্গ কোষ বলা চলে না। প্রাণী বা উদ্ভিদকোষে যেমন নিউক্লিয়াসসহ আরও নানা কলকবজা (যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোজোম, গলজি বডি ইত্যাদি) থাকে, ভাইরাসের তেমন কিছুই নেই। শুধু একটুকরা ডিএনএ কিংবা আরএনএ-ই তার একমাত্র সম্বল।
তাই এ অবস্থায় ভাইরাস আসলে নিষ্ক্রিয়—একদম জড় পদার্থের মতো অচল। জীবের কোনো বৈশিষ্ট্যই থাকে না। এরা খায় না, শ্বাস নেয় না, নিজে নিজে নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই। একে আর যা–ই হোক, জীবিত কোষ বলা চলে না কিছুতেই।
কিন্তু মানুষ বা অন্য জীবদেহে ঢুকলে ভাইরাসের অন্য চেহারা। অমনি এদের ভেলকিবাজি শুরু হয়। কিছুক্ষণ আগে স্রেফ ধূলিকণার মতো পড়ে থাকা সেই খুদে বস্তুটাই তখন হয়ে ওঠে ভয়ংকর সজীব। ভাইরাস তখন পূর্ণমাত্রায় জৈবিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথম সুযোগেই প্রাণী বা উদ্ভিদকোষের যন্ত্রপাতি বা কলকবজা দখল করে ফেলে এরা। সেগুলো ব্যবহার করতে থাকে ফটোকপি মেশিনের মতো (কথাটা আক্ষরিক অর্থে নেবেন না)। অবিরাম নিজের হাজার হাজার কপি বানাতে থাকে। এভাবে ঝড়ের গতিতে নিজের বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে ভাইরাস। কিন্তু দেহকোষের বাইরে গেলেই তার সব ক্যারিশমা শেষ। আবারও অন্য কোনো পোষকের দেহে ঢোকার অপেক্ষায় থাকতে হয়।
ভাইরাসকে পূর্ণাঙ্গ কোষ বলা চলে না। প্রাণী বা উদ্ভিদকোষে যেমন নিউক্লিয়াসসহ আরও নানা কলকবজা যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোজোম ইত্যাদি থাকে, ভাইরাসের তেমন কিছুই নেই।
তবে অপেক্ষায় থাকতে এদের মোটেও আপত্তি নেই। ব্যাকটেরিয়ার মতো ভাইরাসরাও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকায় ওস্তাদ। খুব গরম, খুবই ঠান্ডা, অ্যাসিডিক কিংবা লবণাক্ত জায়গার মতো চরম পরিবেশেও এরা হার মানে না। হারপিস ভাইরাসের কথাই ধরা যাক। এরা প্রায় কয়েক কোটি বছর ধরে টিকে আছে। সুবিধামতো কারও দেহে ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে।
কোনো রোগ সৃষ্টি না করেই দীর্ঘদিন, এমনকি সারা জীবন সুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কারও দেহে লুকিয়ে থাকার গুপ্তবিদ্যা এদের ভালোই জানা আছে। কিংবা মেরু অঞ্চলে সাগরের বরফের নিচে বা পারমাফ্রস্টের মধ্যে কিছু ভাইরাস হাজার হাজার বছর হিমায়িত অবস্থায় টিকে থাকতে পারে।
কিন্তু ভাইরাস এতই ছোট যে সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এদের দেখাই যায় না। সে জন্য দরকার হয় ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ। সে জন্যই দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল এরা। ১৯৩৯ সালে এই যন্ত্র ব্যবহার করে তামাকের মোজাইক ভাইরাসের প্রথম স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হয়। সেবারই মানবেতিহাসে প্রথম ভাইরাস দেখার ঘটনা ঘটে। কিন্তু ভাইরাস কতটা ছোট?
বেশির ভাগ ভাইরাসের ব্যাস সাধারণত ২০ থেকে ৪০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। [মনে করিয়ে দিই, ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ হলো ১ ন্যানোমিটার। একটা আলপিনের ডগা ১০ লাখ ন্যানোমিটার চওড়া হতে পারে। আর মানুষের চুলের গড় ব্যাস ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ন্যানোমিটার।] ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে এদের আকার সাধারণত ১০০ ভাগ ছোট।
বেশির ভাগ ভাইরাসের ব্যাস সাধারণত ২০ থেকে ৪০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে এদের আকার সাধারণত ১০০ ভাগ ছোট।
অতি খুদেদের জগতে ব্যাকটেরিয়াকে যদি বিশাল দানব হিসেবে ধরা হয়, তাহলে ভাইরাস তার সামনে নস্যি। এদের আকারের তফাতটা বোঝাতে উদাহরণ দিই। ধরা যাক, একটা ভাইরাসকে বড় করে টেনিস বলের সমান বানানো হলো। তাহলে সেই অনুপাতে একজন মানুষকে লম্বায় হতে হবে প্রায় ৫০০ মাইল! একই অনুপাতে একটা ব্যাকটেরিয়া হবে একটা বড়সড় বিচ বলের সমান। বুঝলেন ব্যাপারটা?
ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৯৮ সালের দিকে। সেবার ডাচ উদ্ভিদবিদ মার্টিনাস বেইয়ারিঙ্ক তামাকগাছের মোজাইক রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই অতিক্ষুদ্র বস্তু আবিষ্কার করেন। শুরুতে তিনি এ রহস্যময় বস্তুর একটা খটমটে নাম দেন—কন্টাজিয়াম ভাইভাম ফ্লুইডাম। পরে নাম বদলে রাখেন ভাইরাস vīrus। লাতিন থেকে আসা এ শব্দের অর্থ ‘বিষাক্ত’ বা বিষ। সংস্কৃতেও কাছাকাছি একটা শব্দ আছে বিষ (viṣa, এখান থেকেই বাংলায় এসেছে বিষ)।
বেইয়ারিঙ্কের ধারণা ছিল, তামাকগাছের জন্য এই রস বিষাক্ত। তাই এমন নামকরণ। ভাইরাস সম্পর্কে দারুণ এক বর্ণনা দিয়েছেন ব্রিটিশ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পিটার মেদাওয়ার। তাঁর মতে, ভাইরাস হলো প্রোটিনের মোড়কে মোড়ানো একটুকরা দুঃসংবাদ।
সব ভাইরাসই অবশ্য আমাদের জন্য দুঃসংবাদ নয়। কারণ, পৃথিবীতে মানুষের জন্য কিছু উপকারী ভাইরাসও আছে। যেমন ব্যাকটেরিওফাজ। কেবল ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করে এরা, আমাদের কোনো ক্ষতি করে না। আসলে পৃথিবীর হাজারো ভাইরাসের মধ্যে মাত্র ২৬৩টি প্রজাতি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। আর ৫৮৬টি ভাইরাস প্রজাতি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আক্রমণ করে।
যেসব ভাইরাস রোগ তৈরি করে না, সেগুলো নিয়ে গবেষণা প্রায় হয় না বললেই চলে। এসব নিরীহ ভাইরাস নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই তাদের সম্পর্কে আমরা অল্পই জানি। তবে ভাইরাস নিয়ে আজ পর্যন্ত গবেষণার সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম নয়। তারই একটি করেছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের শিক্ষার্থী লিটা প্রক্টর।
ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৯৮ সালের দিকে। সেবার ডাচ উদ্ভিদবিদ মার্টিনাস বেইয়ারিঙ্ক তামাকগাছের মোজাইক রোগ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই অতিক্ষুদ্র বস্তু আবিষ্কার করেন।
কী মনে করে ১৯৮৬ সালে সমুদ্রের পানিতে ভাইরাস খুঁজতে নামেন তিনি। কিন্তু মেয়েটার কাণ্ডকারখানা স্রেফ পাগলামি ভেবেছিল সবাই। কারণ, সে যুগে সবার ধারণা ছিল, সমুদ্রে কোনো ভাইরাস নেই। কিন্তু লিটার গবেষণার ফল প্রকাশ হতেই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন বিজ্ঞানীরা। সবাইকে চমকে দিয়ে লিটা দেখান, ১ লিটার সমুদ্রের পানিতে প্রায় ১০ হাজার কোটি ভাইরাস থাকতে পারে! চমকের এখানেই শেষ নয়!
কিছুদিন পর আরেক গবেষণায় সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির ডানা উইলনার দেখলেন, মানুষের সুস্থ ফুসফুসেও বাসা বেঁধে আছে প্রায় ১৭৪ প্রজাতির ভাইরাস। এদের ৯০ শতাংশই বিজ্ঞানীদের অজানা। বিজ্ঞানীদের মতে, সাগরের সব ভাইরাসকে যদি একটার পর একটা সাজানো হয়, তবে সেই লাইন এক কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত লম্বা হবে! ভাবা যায়? এত দিন আমরা ভেবেছিলাম, পৃথিবী গাছগাছালি আর মানুষের দখলে—কিন্তু এই সবুজ গ্রহটা আসলে ভাইরাসের দখলে!
আরেকটা মজার গবেষণা হয়েছিল ভাইরাস নিয়ে। তার ডাকনাম রাইনোভাইরাস। রাইনো শব্দটা শুনলে অনেকে হয়তো রাইনোসেরোস বা গন্ডারের কথা ভেবে বসতে পারেন। অবশ্য ভাষাগত দিক থেকে এর সঙ্গে গন্ডারের দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। কারণ, দুটি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে একই গ্রিক উৎস থেকে। শব্দটি হলো রাইনো (Rhino)। গ্রিকে এর অর্থ ‘নাক’। আর সেরোস অর্থ ‘শিং’। কাজেই রাইনোসেরোস অর্থ ‘নাকের ওপর শিং যার’—গন্ডার। আর রাইনোভাইরাসের অর্থ নাকের ভাইরাস বা নাকের বিষ।
এই অর্থে রাইনোভাইরাসের নামকরণ সার্থক। কারণ, এ ভাইরাসই আমাদের সাধারণ সর্দি বা কমন কোল্ডের জন্য দায়ী। একে বলা চলে মানুষের পুরোনো শত্রু। সেই আদিম সভ্যতা থেকেই এর সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। কিন্তু একে পরাস্ত করতে চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো ব্যর্থ।
শব্দটি হলো রাইনোসেরোস। গ্রিকে এর অর্থ নাক। আর সেরোস অর্থ শিং। কাজেই রাইনোসেরোস অর্থ নাকের ওপর শিং যার—গন্ডার। আর রাইনোভাইরাসের অর্থ নাকের ভাইরাস বা নাকের বিষ।
গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতে সর্দি বেশি হয়। আমরা বলি ‘ঠান্ডা লেগেছে’। কিন্তু ঠান্ডা লাগলে কেন সর্দি হয়—বিজ্ঞানীরা আজও নিশ্চিত নন। রোগ হিসেবে সর্দি মানবসভ্যতার সমান বয়সী হলেও এখনো এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। তার কারণও আছে।
আসলে ঠান্ডা কোনো একক রোগ নয়—একগুচ্ছ উপসর্গ। এসব উপসর্গ সৃষ্টির জন্য দায়ী শত শত ভাইরাস প্রজাতি। আর এদের পালের গোদা হলো রাইনোভাইরাস। রাইনোভাইরাসের ধরনও আছে এক শর বেশি। এদের প্রতিটির আবার আক্রমণের নিজস্ব রাসায়নিক ও জেনেটিক কলাকৌশল রয়েছে। এত সব বৈচিত্র্যের কারণে সর্দির জন্য এমন কোনো ওষুধ বা টিকা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব, যা দায়ী সব ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর। আবার রাইনোভাইরাস খুব দ্রুত নিজেদের রূপ ও কলাকৌশল বদলে ফেলতে পারে। সে কারণে একটা দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর নিরাময় খুঁজে পাওয়াও কঠিন।
তাই একবার সুস্থ হলেই যে পরেরবার আর ঠান্ডা লাগবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, একটি রাইনোভাইরাসের আক্রমণে আপনার দেহে যে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে, তা আরেক ধরনের রাইনোভাইরাসের বিরুদ্ধে আর কাজ করে না। একই কারণে কোনো ওষুধেও সর্দি কমানো যায় না। সাধে তো আর বলে না, ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তাহে। তাই সর্দি ও হাঁচি থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কিন্তু সাধারণ সর্দিতে বারবার হাঁচি আসে কেন?
গবেষকেরা বলেন, রাইনোভাইরাস নাকের গহ্বরে আবরণ কোষে আক্রমণ করার সময় স্নায়ুর শেষ প্রান্তে সুড়সুড়ি দেয়। আরও ভালোভাবে বললে, নাকের ভেতরের মিউকাস মেমব্রেনকে উত্তেজিত করে তোলে। এ কারণে সেখানে একধরনের জ্বালাপোড়া হতে থাকে। ঠিক তখন আমাদের দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
গবেষকেরা বলেন, রাইনোভাইরাস নাকের গহ্বরে আবরণ কোষে আক্রমণ করার সময় স্নায়ুর শেষ প্রান্তে সুড়সুড়ি দেয়। আরও ভালোভাবে বললে, নাকের ভেতরের মিউকাস মেমব্রেনকে উত্তেজিত করে তোলে।
নাক বা শ্বাসযন্ত্রের পথ থেকে বিরক্তিকর ভাইরাস বা অন্য কোনো কণা সজোরে বাইরে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করে আমাদের দেহ। সে জন্য সেখানে অতিরিক্ত শ্লেষ্মা বা মিউকাস তৈরি হতে শুরু করে। এ শ্লেষ্মাই নাকের ছিদ্রপথে আরও অস্বস্তি তৈরি করে। ভাইরাস, অতিরিক্ত মিউকাস ও অন্য কণা বের করে দিতে মস্তিষ্ক থেকে হাঁচি দেওয়ার সংকেত আসে। তাতেই শুরু হয় বিকট একটা বিস্ফোরণ—হ্যাঁচ..চো! এই বিস্ফোরণ বা হাঁচির সময় বিপুল পরিমাণ ভাইরাস বহনকারী মিউকাসের ফোঁটার পুঞ্জ সজোরে বের করে দেয়।
হিসাব কষে দেখা গেছে, এই হাঁচির গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কিলোমিটার। জানেন হয়তো, কোনো এলাকায় এই গতিবেগে বাতাস বয়ে গেলে, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের ১১ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেওয়ার নিয়ম! নাকের ভেতর বসে থাকা ভাইরাসের জন্য এই হাঁচিও সম্ভবত মহাবিপদ। তাই নাক থেকে সজোরে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় অসংখ্য ভাইরাস। সেগুলো অন্য উপযুক্ত কোনো পোষক শ্বাসের সঙ্গে ভেতরে টেনে নেওয়ার আগপর্যন্ত বাতাসে ভাসতে থাকে। সেটা রাইনোভাইরাসের জন্য লাভজনক।
কারণ, জনবহুল এলাকায় কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে কেউ যদি হাঁচি দেয়, তাহলে অন্যদের দেহেও সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে রাইনোভাইরাস। তাই সর্দি-মৌসুমে রাইনোভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আরেকটি কথা। সাধারণ সর্দির লক্ষণ কমাতে অনেক সময় চিকিৎসকেরা অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। এরও কারণ আছে। আসলে সর্দি লাগলে দেহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিছু রাসায়নিক নিঃসরণ করে। এর মধ্যে একটির নাম হিস্টামিন। এ ছাড়া আছে ব্র্যাডিকাইনিন। অ্যালার্জির ক্ষেত্রেও দেহ হিস্টামিন নিঃসরণ করে।
হিস্টামিন নাকের রক্তনালিগুলো স্ফীত করে ও প্রদাহ তৈরি করে। অতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরিতেও উৎসাহিত করে। ফলে বারবার হাঁচি আসে। নাক দিয়েও অনবরত পানি ঝরতে থাকে। অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ দেহের এই হিস্টামিনের কার্যকলাপে বাধা দেয়। কিন্তু অ্যান্টিহিস্টামিন সরাসরি ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে না; বরং কিছু ক্ষেত্রে হাঁচি ও নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। তাতে কিছুটা আরাম মিলতে পারে, এ–ই যা!
সর্দি লাগলে দেহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিছু রাসায়নিক নিঃসরণ করে। এর মধ্যে একটির নাম হিস্টামিন। এ ছাড়া আছে ব্র্যাডিকাইনিন। অ্যালার্জির ক্ষেত্রেও দেহ হিস্টামিন নিঃসরণ করে।
এবার আসল কথায় আসি। যুক্তরাজ্যে একসময় ‘কমন কোল্ড ইউনিট’ নামে একটা গবেষণাকেন্দ্র ছিল। কিন্তু বহু মেধা খরচ করে আর বহু টাকা ঢেলেও সেখানে সর্দির কোনো প্রতিকার বা ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তাই শেষমেশ ১৯৮৯ সালে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে তার আগেই সর্দি নিয়ে সেখানে কিছু মজার গবেষণা হয়েছিল। যেমন একবার এক স্বেচ্ছাসেবকের নাকে বিশেষ একটা যন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেটা থেকে অনবরত সর্দি পড়ার মতো একই হারে তরল বের হতো। তবে ওই তরলে মেশানো ছিল বিশেষ ধরনের এক রং। সাধারণ আলোতে রংটা চোখেই পড়ে না, শুধু অতিবেগুনি রশ্মিতেই দেখা যায়।
ওই অবস্থায় ওই স্বেচ্ছাসেবককে আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে এক ককটেল পার্টিতে মিশতে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর অতিবেগুনি আলো জ্বালানো হলো। দেখা গেল, পার্টিতে আসা সবার গায়ে, হাতে, মাথায়, জামায়, গ্লাসে, দরজার হাতলে, সোফার কুশনে, এমনকি বাদামের বাটিতেও সেই বিশেষ রং ছড়িয়ে আছে! অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না!
এর ব্যাখ্যায় গবেষকেরা বললেন, একজন মানুষ ঘণ্টায় গড়ে ১৬ বার নিজের মুখে হাত দেয়। আর প্রতিবার সেই স্পর্শ নকল রোগজীবাণুকে এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই সর্দি-কাশির রোগজীবাণু নাক থেকে অন্যদের এবং স্ন্যাকের বাটিতে, দরজার হাতলসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সর্দি-আক্রান্ত মানুষও সুস্থদের মধ্যে সর্দির ভাইরাস এভাবেই দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। তাই চিকিৎসকেরা সর্দি-মৌসুমে মুখ স্পর্শ না করার পরামর্শ দেন। কারণ দেখলেনই তো, হাতের মাধ্যমে চোখ, নাক ও মুখ দিয়েই ভাইরাস আমাদের দেহে ঢুকে পড়ে।
গবেষকেরা বললেন, একজন মানুষ ঘণ্টায় গড়ে ১৬ বার নিজের মুখে হাত দেয়। আর প্রতিবার সেই স্পর্শ নকল রোগজীবাণুকে এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দেয়।
প্রায় একই ধরনের একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটিতে। গবেষণার শুরুতেই একটি অফিস ভবনের ধাতব দরজার হাতল রাইনোভাইরাসে সংক্রমিত করা হলো। পরে গবেষকেরা দেখতে লাগলেন, সেটা ছড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ লাগে। তাঁদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল, পুরো ভবনে ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়তে লেগেছে মাত্র চার ঘণ্টা।
তাতে ওই ভবনের অর্ধেকের বেশি কর্মচারী সংক্রমিত হয়েছিলেন। পাশাপাশি ফটোকপিয়ার ও কফি মেশিনের মতো যেসব যন্ত্র সবাই ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন, সেগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। আরেক গবেষণামতে, এ ধরনের সংক্রমণ তিন দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। তাই সবাই যেসব যন্ত্র ব্যবহার করে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করাই ভালো।
আরও মজার ও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সর্দির জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে কম কার্যকর উপায় হলো চুমু খাওয়া। এ গবেষণা চালানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির একদল স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের সর্দির ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, চুমু খাওয়ার মাধ্যমে সঙ্গীর মধ্যে ভাইরাসটি তেমন ছড়ায় না। কিন্তু তার কারণটা এখনো অজানা। রহস্যময়ও কি বলা যায় না!
ভাইরাস কোথায় বেশি থাকে—তা নিয়েও তল্লাশি চালিয়েছেন গবেষকেরা। দেখা গেছে, সাবওয়ের ট্রেনের ধাতব পোল বা হাতল ভাইরাসের জন্য তেমন আরামদায়ক নয়; বরং ট্রেনের সিটের কাপড়ে বা প্লাস্টিকের হাতলই তাদের স্বর্গরাজ্য। এ গবেষণা চালানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের সাবওয়ে ট্রেনে। তাই শীতের সময়ে বাসে, ট্রেনে বা মেট্রোর সিটে বসার আগে অন্তত দুবার ভাববেন।
গবেষকেরা দেখতে লাগলেন, সেটা ছড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ লাগে। তাঁদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল, পুরো ভবনে ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়তে লেগেছে মাত্র চার ঘণ্টা।
আর ভাইরাস ছড়ানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম কী, তা জানেন? সেটা হলো ভাঁজ করা টাকা এবং নাকের শ্লেষ্মা বা সর্দিকণার যৌথ উপস্থিতি। সুইজারল্যান্ডে ২০০৮ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, টাকার নোটে যদি সামান্য সর্দির কণাও লেগে থাকে, তাহলে ভাইরাসটা সেখানে প্রায় আড়াই সপ্তাহ পর্যন্ত দিব্যি হেসেখেলে ‘বেঁচে’ থাকতে পারে।
তবে সেটা রাইনোভাইরাস নয়, সর্দির জন্য দায়ী আরেকটি ভাইরাস—ফ্লু ভাইরাস। তবে সর্দিকণা ছাড়া শুকনা টাকায় এরা কয়েক ঘণ্টার বেশি টিকতে পারে না। তাই পরেরবার নাকভর্তি সর্দি নিয়ে টাকা গোনার সময় একটু সাবধান থাকবেন! নাকে-মুখে একটা মাস্ক পরে নিতে ভুলবেন না। আর বাইরে থেকে আসার পর, খাওয়ার আগে ও হাঁচি বা কাশির পর নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন। কারণ, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
