গণিত গবেষণায় ২০২৫ সাল ছিল বেশ ঘটনাবহুল। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারছে। গণিত নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এ বছর। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব আলোচিত গবেষণা। পাশাপাশি বছর শেষে কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন, সায়েন্টিফিক আমেরিকানসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে সারা বছরের আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা। সেখান থেকে আলোচিত ১০টি গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে। এই তালিকায় গুরুত্ব অনুযায়ী গবেষণাগুলোর ক্রমবিন্যাস করা হয়নি। শুধু লেখার সুবিধার্থে ক্রমসংখ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
শুরুতেই পরিচয় করিয়ে দিই এক নতুন জ্যামিতিক আকৃতির সঙ্গে, যার নাম দেওয়া হয়েছে নপারথেড্রন। এই অদ্ভুত আকৃতিটির ৯০টি শীর্ষবিন্দু, ২৪০টি ধার এবং ১৫২টি তল আছে। মজার ব্যাপার হলো, জ্যামিতিতে এত দিন একটা ধারণা ছিল যে একই রকম দেখতে দুটি আকৃতির একটির মধ্যে যদি ছিদ্র থাকে, তবে অন্যটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই ছিদ্র দিয়ে গলে যেতে পারবে। অনেকটা চাবি যেমন তালার মধ্যে ঢুকে যায়, তেমন। কিন্তু নপারথেড্রন এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। আপনি একে যতই ঘোরান বা বাঁকান না কেন, একটি নপারথেড্রন কখনোই হুবহু একই আকৃতির আরেকটি নপারথেড্রনের ছিদ্র দিয়ে গলে যেতে পারবে না। যেন এক জটিল জ্যামিতিক তালা, যার কোনো চাবি নেই! এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন এই লেখাটি: নিজের ভেতর দিয়ে যেতে পারে না এমন জ্যামিতিক আকৃতি প্রথমবার খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা
মৌলিক সংখ্যা গণিতবিদদের কাছে চিরকালই এক রহস্য। সংখ্যা যত বড় হয়, নতুন মৌলিক সংখ্যা খুঁজে পাওয়া তত কঠিন হয়ে পড়ে। এত দিন ভাবা হতো, এরা বুঝি এলোমেলোভাবে আসে। কিন্তু এ বছর গণিতবিদেরা এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, মৌলিক সংখ্যাগুলোর মধ্যেও একধরনের সম্ভাবনার নকশা লুকিয়ে আছে। আর এই নকশার সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে কেওস থিওরি এবং জ্যামিতিক ভগ্নাংশের। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হলেও, মৌলিক সংখ্যার পেছনেও একধরনের গাণিতিক শৃঙ্খলা কাজ করছে।
পদার্থবিজ্ঞানে যেমন সব বলকে এক সুতোয় গাঁথার জন্য থিওরি অব এভরিথিং খোঁজা হয়, গণিতেও তেমন কিছু আছে। এ বছর ৯ জন গণিতবিদ মিলে প্রায় ১০০০ পৃষ্ঠার ৫টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সেখানে তাঁরা জিওমেট্রিক ল্যাংল্যান্ডস কনজেকচার প্রমাণ করেছেন। সহজ কথায়, এটি গণিতের ভিন্ন ভিন্ন জগতকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এটি ল্যাংল্যান্ডস প্রোগ্রামের অংশ। একে বলা হয় গণিতের গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি। এটি প্রমাণ হওয়া মানে গণিতের এক বিশাল বিজয়। ধরুন, এত দিন জ্যামিতি আর বীজগণিত ছিল দুটি আলাদা বিষয়, কিন্তু এখন তাদের মধ্যে একটা মজবুত সেতু তৈরি হলো।
আপনার জুতোর ফিতা বা হেডফোনের তারে প্যাঁচ লাগলে কী হয়? মেজাজ খারাপ হয় নিশ্চয়ই? এত দিন গণিতবিদেরা ভাবতেন, আপনি যদি দুটি জটিল গিঁট একে অপরের সঙ্গে জুড়ে দেন, তবে নতুন গিঁটটি আরও বেশি জটিল হবে। কিন্তু এ বছর সেই ধারণা ভেঙে গেছে। গবেষকেরা এমন একটি গিঁট খুঁজে পেয়েছেন, যা দুটি গিঁট জোড়া লাগানোর পর আগের চেয়ে সরল হয়ে গেছে! অর্থাৎ, মাঝেমধ্যে যোগ করলে জটিলতা কমেও যেতে পারে।
ফিবোনাচ্চি ধারার কথা মনে আছে? ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮...। অর্থাৎ, প্রতিটি সংখ্যা আগের দুটির যোগফল। প্রকৃতির ফুলে-ফলে, শামুকের খোলসে এমনকি গ্যালাক্সির ঘূর্ণনেও এই ধারা দেখা যায়। কিন্তু এ বছর গণিতবিদেরা একে নতুন কাজে লাগিয়েছেন। গণিতবিদেরা একটি ক্লাসিক সমস্যার সমাধান করেছেন এই ফিবোনাচ্চি দিয়ে। সমস্যাটি হলো, আপনার কাছে যদি ০ থেকে ১-এর মধ্যে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের এলোমেলো কাঠি থাকে, তবে কোনো তিনটি কাঠি দিয়ে ত্রিভুজ তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? অদ্ভুত শোনালেও এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে সেই ফিবোনাচ্চি ধারার ভেতরেই।
বর্তমানে জানা সবচেয়ে বড় মৌলিক সংখ্যাটি হলো ২১৩৬,২৭৯,৮৪১ – ১। এটি এত বড় যে লিখলে ৪ কোটিরও বেশি অঙ্ক লাগবে! একটা বইয়ে এই সংখ্যাটা ছাপতে গেলে বইটাই কয়েক হাজার পৃষ্ঠার হয়ে যাবে। কিন্তু গণিতবিদেরা এতেও সন্তুষ্ট নন। তাঁরা আরও বড় সংখ্যা চান। এ বছর গবেষকেরা সংখ্যা বিভাজন পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন মৌলিক সংখ্যা খোঁজার এক উপায় বের করেছেন। কোনো সংখ্যাকে কতভাবে যোগফল আকারে লেখা যায়, সেটাই এই পদ্ধতির মূল চাবিকাঠি।
১৯০০ সালে বিখ্যাত গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট ২৩টি সমাধানহীন সমস্যার কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে গাণিতিকভাবে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। বিশেষ করে তরল পদার্থ বা গ্যাস কীভাবে চলাচল করে, তার গাণিতিক ব্যাখ্যা। এ বছর গবেষকেরা দাবি করেছেন, তাঁরা তরল পদার্থের গতি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ভৌত তত্ত্বকে একত্রিত করতে পেরেছেন। এটা যদি সত্য হয়, তবে ১২৫ বছরের পুরোনো সেই সমস্যার সমাধানের দিকে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবো। আবহাওয়ার পূর্বাভাস আরও নিখুঁত করতে এই সূত্র কাজে লাগতে পারে।
একটা ত্রিভুজকে কেটে টুকরো টুকরো করে কি বর্গক্ষেত্র বানানো সম্ভব? ১৯০২ সালে এক ব্যক্তি দেখিয়েছিলেন, ৪ টুকরো করলে এটা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, ৪ টুকরোর কমে কি সম্ভব? অর্থাৎ মাত্র ৩ টুকরো করে কি এই কাজ করা যাবে? ১০০ বছরেরও বেশি সময় পর এ বছর গণিতবিদেরা প্রমাণ করলেন, এটা সম্ভব নয়। একটি ত্রিভুজকে কেটে বর্গ বানাতে হলে আপনাকে অন্তত ৪টি টুকরো করতেই হবে।
বাসা বদলানোর সময় সরু করিডরের মোড় দিয়ে বড় সোফা ঢোকাতে গিয়ে ঘাম ছুটেছে? গণিতবিদেরা একে বলেন মুভিং সোফা প্রবলেম। প্রায় ৬০ বছর ধরে তাঁরা খুঁজছিলেন সবচেয়ে বড় কোন আকৃতির সোফা একটি সমকোণ বা ৯০ ডিগ্রি করিডর দিয়ে ঘোরানো সম্ভব? এ বছর গবেষকেরা শেষমেশ এই সমস্যার একটি গাণিতিক সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। অর্থাৎ, সোফা কত বড় হলে আটকাবে না, তার উত্তর এখন গণিতের খাতায় আছে।
মৌলিক সংখ্যা নিয়ে এ বছর কাজের শেষ নেই। গবেষকেরা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কতগুলো মৌলিক সংখ্যা থাকতে পারে, তা অনুমান করার নতুন পদ্ধতি বের করেছেন। তাঁরা প্রথমে অন্য মৌলিক সংখ্যার গুণিতকগুলো বাদ দেন। এরপর যেসব সংখ্যা একাধিকবার বাদ পড়েছে, সেগুলোর হিসাব ঠিকঠাক করেন। তবে গবেষকেরা এটাও জানিয়েছেন, আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, মৌলিক সংখ্যার সঠিক সংখ্যা বা অবস্থান ১০০ ভাগ নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয়। কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যাবে।
গণিতের এই আবিষ্কারগুলো হয়তো আমাদের দৈনন্দিন দিনে কাজে লাগবে না, কিন্তু মহাবিশ্বের নিয়মগুলোকে বোঝার জন্য এগুলো বড় হাতিয়ার। কে জানে, আজকের এই তাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়তো আগামী দিনের কোনো যুগান্তকারী প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে দিচ্ছে!