কোয়ান্টাম–সুড়ঙ্গে অতিপরিবাহিতা

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত সব ঘটনা পরমাণুর চেয়েও ছোট জগতের সীমা ছাড়িয়ে, দৃশ্যমান জগতেও কি দেখা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। এটাই দেখিয়েছেন এবারের নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ দ্যভোরে ও জন মার্টিনিস...

পদার্থবিজ্ঞানীরা ভূতে বিশ্বাস না করলেও কোয়ান্টাম মেকানিকসের অদ্ভুতুড়ে কাজকর্মকে অস্বীকার করার কোনো উপায় তাঁদের নেই। কোয়ান্টাম মেকানিকসের, বিশেষ করে এর কার্যকরী সমীকরণের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ বছর (২০২৫) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে কোয়ান্টাম বর্ষ—ইয়ার অব কোয়ান্টাম সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। আধুনিক জগতের সব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তত্ত্বগুলোর গভীরতর স্তর দখল করে আছে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান। মৌলিকতম কণা কোয়ার্ক থেকে শুরু করে বিশাল মহাবিশ্ব পর্যন্ত বিস্তৃত কোয়ান্টাম বিজ্ঞান।

কিন্তু কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো মাঝেমধ্যে এত অবিশ্বাস্য যে কোয়ান্টাম মেকানিকসে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানীও বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেন, ‘কোয়ান্টাম জগৎ বলে আসলে কিছু নেই। কোয়ান্টাম দশার অস্তিত্ব আছে শুধু আমার মাথার ভেতর, যা দিয়ে আমি অঙ্ক করি। কোয়ান্টাম অবস্থা বড়জোর কিছু তথ্যের বর্ণনা দেয়—বাস্তব জগতের সঙ্গে তাদের খুব একটা মিল নেই।’ অতি সম্প্রতি কোয়ান্টাম মেকানিকস সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিদ আন্তন জেলিঙ্গার। ২০২২ সালে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতির পরীক্ষামূলক প্রমাণের জন্য পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বর্তমানের আধুনিক মুঠোফোন থেকে শুরু করে নভোস্যাটেলাইট—সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিকস। অথচ এমন একটা সময় ছিল, যখন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করতেন না যে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ব্যবহারিক কোনো প্রয়োগ হতে পারে।

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী- জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে ও জন মার্টিনিস

কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম দুই স্থপতি আরউইন শ্রোডিঙ্গার ও পল ডিরাক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৩৩ সালে। পল ডিরাকের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর, শ্রোডিঙ্গারের ৪৬। সাংবাদিকেরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস মানুষের কী কাজে লাগবে? পল ডিরাক বিরসমুখে জবাব দিয়েছিলেন, ‘কোনো কাজে লাগবে না।’ ভবিষ্যতে কি কোনো কাজে লাগতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরেও তিনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতেও কোনো কাজে লাগবে না।’ অথচ আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে প্রশ্ন করতে হবে, ‘এমন কোনো ক্ষেত্র কি আছে, যেখানে কোয়ান্টাম মেকানিকস কাজে লাগে না?’

শত বছর ধরে কোয়ান্টাম মেকানিকসকে কাজে লাগানোর কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাত ধরে যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের যাত্রা শুরু হয়েছিল শুধু কিছু অদ্ভুত ভুতুড়ে তত্ত্ব হিসেবে, এক শতাব্দী পরই তা রূপ নিয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রযুক্তির বাহন হিসেবে। একুশ শতকে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের স্বপ্নকে বাস্তবে দেখতে চলেছি। আর এই বাস্তবতার মূল কাঠামো কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস বা কোয়ান্ট্রনিকসের অন্যতম তিন কারিগর—জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে ও জন মার্টিনিস পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এ বছর।

কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কার তেমন বিস্ময়কর কোনো নতুন ঘটনা নয়। গত ১০০ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ৪০ জনের বেশি বিজ্ঞানী। ১৯১৮ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে দিয়ে শুরু, শক্তির কোয়ান্টাম স্তরের জন্য প্রথম নোবেল পুরস্কার। তারপর আলবার্ট আইনস্টাইন (১৯২১—ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট), নীলস বোর (১৯২২—পারমাণবিক মডেল), আর্থার কম্পটন (১৯২৭—কম্পটন ইফেক্ট), লুই দ্য ব্রগলি (১৯২৯—বস্তু তরঙ্গ), ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (১৯৩২—অনিশ্চয়তার তত্ত্ব), পল ডিরাক ও আরউইন শ্রোডিঙ্গার (১৯৩৩—কোয়ান্টাম পারমাণবিক তত্ত্ব), উলফগ্যাং পাউলি (১৯৪৫—বর্জন নীতি), ম্যাক্স বর্ন (১৯৫৪—কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশন), সিন–ইতিরো টমোনাগা, জুলিয়ান সুইঙ্গার ও রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯৬৫—কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস), জন বারডিন, লিওন কুপার ও রবার্ট শ্রিফার (১৯৭২—সুপারকন্ডাক্টিভিটি তত্ত্ব–বিসিএস থিওরি), ক্লাউস ফন ক্লিৎঝিং (১৯৮৫—কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট), গার্ড বিনিং ও হেনরিখ রোরার (১৯৮৬—স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ), রবার্ট লাউলিন, হর্স্ট স্ট্রমার ও ড্যানিয়েল সুই (১৯৯৮—কোয়ান্টাম ফ্লুইড), জেরারডুস টি হুফ্ট ও মার্টিনাস ভেল্টম্যান (১৯৯৯—কোয়ান্টাম স্ট্রাকচার অব ইলেকট্রো–উইক ইন্টারঅ্যাকশন), আলেক্সেই আব্রিকসভ, ভিটালি গিনজবার্গ ও অ্যান্থনি লেগেট (২০০৩—সুপারকন্ডাক্টর ও সুপারফ্লুইড তত্ত্ব), রয় গ্লাউবার (২০০৫—কোয়ান্টাম থিওরি অব অপটিক্যাল কোহেরেন্স), সার্জ হারোকি ও ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড (২০১২—স্বতন্ত্র কোয়ান্টাম সিস্টেমের পরীক্ষামূলক পদ্ধতি), এলেইন আসপেক্ট, জন ক্লাউজার, আন্তন জেলিঙ্গার (২০২২—কোয়ান্টাম মেকানিকসের পরীক্ষণ প্রমাণ), এবং জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভোরে ও জন মার্টিনিস (২০২৫—মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং)।

আরও পড়ুন
১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাত ধরে যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের যাত্রা শুরু হয়েছিল শুধু কিছু অদ্ভুত ভুতুড়ে তত্ত্ব হিসেবে, এক শতাব্দী পরই তা রূপ নিয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রযুক্তির বাহন হিসেবে।

দেখতেই পাচ্ছেন, ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কোয়ান্টাম মেকানিকসের জন্য পাওয়া সব নোবেল পুরস্কারই দেওয়া হয়েছে তত্ত্বীয় কাজের ভিত্তিতে। তার কারণও আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৫০ বছরে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সমৃদ্ধ হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে। শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের ওয়েভ ফাংশন বিশ্লেষণ করে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে, যা এত দিন ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিকস দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। যেমন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় আলফা কণা বিকিরণের ঘটনা।

১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ১৯২৭ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ হুন্ড আণবিক শক্তিস্তরের ভেতর কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সম্ভাবনা আবিষ্কার করেন। ওয়েভ ফাংশন বিশ্লেষণ করলে কিছু আপাত–অসম্ভব কাজও তত্ত্বীয়ভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কোয়ান্টাম টানেলিং সেগুলোর মধ্যে একটি। ধরা যাক, কোনো কোয়ান্টাম কণার সামনে এমন একটি উঁচু দেয়াল আছে, যা পার হয়ে অন্যদিকে যাওয়ার জন্য কণাটির যে পরিমাণ শক্তি দরকার, ততটুকু শক্তি তার নেই। এ অবস্থায় ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিকস নিশ্চিতভাবে বলে দেবে যে কণাটির দেয়াল পার হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য; অর্থাৎ কণাটি দেয়ালের এ পাশেই রয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশন অনুযায়ী কণা তরঙ্গের আকারেও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে কণাটি তরঙ্গের আকারে দেয়ালের অন্য পাশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শূন্য নয়। সম্ভাবনা শূন্য না হওয়ার অর্থ হলো, কণাটি দেয়াল ভেদ করে অন্য পাশে চলে যেতে পারে—প্রয়োজনীয় শক্তি না থাকা সত্ত্বেও! নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা।

কিন্তু কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দিয়েই পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো, এডওয়ার্ড কনডন ও রোনাল্ড গারনি আলফা কণার নিউক্লিয়ার ক্ষয়ের ঘটনা ব্যাখ্যা করেন ১৯২৮ সালে। যৌথ গবেষণাপত্রে তাঁরা দেখালেন, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে যখন আলফা কণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গত হতে থাকে, তখন কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমেই তারা বের হয়ে আসে নিউক্লিয়াস থেকে। কীভাবে? একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক।

আমরা জানি, মেরি ও পিয়ের কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। রেডিয়াম–২২৬ আইসোটোপ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলফা কণা নির্গত হয়। রেডিয়াম–২২৬–এর হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু প্রায় ১ হাজার ৬০০ বছর; অর্থাৎ কারও কাছে দুই গ্রাম রেডিয়াম–২২৬ থাকলে, ওটা যেখানে যেভাবেই থাকুক না কেন, ১ হাজার ৬০০ বছর পর এক গ্রাম হয়ে যাবে। রেডিয়াম নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণার নির্গমন ঘটে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে। না হলে আলফা কণার সাধ্য ছিল না রেডিয়াম নিউক্লিয়াসের প্রচণ্ড নিউক্লিয়ার ফোর্স ও বাইন্ডিং এনার্জি অতিক্রম করে বের হয়ে আসার। কোয়ান্টাম মেকানিকসের সব ঘটনার মতোই টানেলিংয়ের ঘটনাও ঘটে সম্ভাবনার ভিত্তিতে; অর্থাৎ রেডিয়ামের পরমাণু থেকে আলফা কণা নির্গত হবে বলে আমরা জানি। কিন্তু একদম সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়, ঠিক কোন সময়, কোন পরমাণু থেকে আলফা কণা নির্গত হবে। কিন্তু অনেকগুলো ঘটনা একসঙ্গে করে আমরা ঘটনাবিন্যাস থেকে আলফা কণা নির্গমনের যে এক্সপোনেনশিয়েল গ্রাফ পাই, তা থেকে বোঝা যায়, আলফা কণা নির্গমনের সম্ভাবনা কখনোই শূন্য হয়ে যায় না। তার মানে, কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটতেই থাকে।

আরও পড়ুন
রেডিয়াম–২২৬–এর হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু প্রায় ১ হাজার ৬০০ বছর; অর্থাৎ কারও কাছে দুই গ্রাম রেডিয়াম–২২৬ থাকলে, ওটা যেখানেই থাকুক না কেন, ১ হাজার ৬০০ বছর পর এক গ্রাম হয়ে যাবে।

সূর্যের কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটছে, যেখানে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একসঙ্গে মিশে গিয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হচ্ছে, সেটাও ঘটছে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে। না হলে দুটি প্রোটনের মধ্যে কুলম্ব বলের প্রভাবে যে বিকর্ষণ বল বিদ্যমান, তা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। জীববিজ্ঞানীরাও এখন নতুন করে ব্যাখ্যা করছেন, আমাদের শরীরের ভেতর বেশির ভাগ জৈব রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ার মূলে আছে কোয়ান্টাম টানেলিং।

বিজ্ঞানী হুন্ড, গ্যামো, কনডন ও গারনি কোয়ান্টাম টানেলিং তত্ত্ব আবিষ্কার করলেও তাঁদের কেউই এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পাননি। তবে কোয়ান্টাম টানেলের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অনেকেই। ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারের মূলেও আছে কোয়ান্টাম টানেলিং।

১৯৫৭ সালে বারডিন, কুপার ও শ্রিফারের সুপারকন্ডাক্টিভিটি থিওরি বা অতিপরিবাহিতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহারিক সম্ভাবনা দ্রুত বাড়তে শুরু করল। বারডিন–কুপার–শ্রিফার (বিসিএস) তত্ত্ব মূলত অতিপরিবাহিতার মাইক্রোস্কোপিক ব্যাখ্যা দেয়।

বিদ্যুৎ পরিবাহিতার স্বাভাবিক ধর্ম থেকে আমরা জানি, বিদ্যুৎ পরিবাহীর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন–প্রবাহের হারকে আমরা কারেন্ট বলি। সে হিসাবে এক অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট হলো এক সেকেন্ডে যদি এক কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হয়। একটি ইলেকট্রনের চার্জ হলো ১.৯ × ১০-১৯ কুলম্ব। এক কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হতে হলে ৬.২৫ × ১০১৮টি ইলেকট্রন প্রবাহিত হতে হবে এক সেকেন্ডে। ছয় বিলিয়ন বিলিয়ন ইলেকট্রন–প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে। ইলেকট্রনের ধর্ম অনুসারে, এই ইলেকট্রনগুলো প্রতিটি প্রতিটির কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। তারপরও বিদ্যুৎ বিভবের কারণে তারা সুশৃঙ্খলভাবে একদিক থেকে অন্যদিকে (টার্মিনাল টু টার্মিনাল) চলাচল করে।

কিন্তু যখনই পরিবাহীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তখনই ইলেকট্রনগুলোর নিজস্ব শক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে তারা অস্থির হয়ে পড়ে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একে অপরের প্রতি বিকর্ষণ বোধ করার কারণে এই বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন–প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই বাধার নাম রেজিস্ট্যান্স। তাই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পরিবাহীর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহের সময় রেজিস্ট্যান্স থাকে। এই রেজিস্ট্যান্সের পরিমাণ অসীম হলে কোনো বিদ্যুৎপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিবাহী হয়ে পড়ে অপরিবাহী বা ইনসুলেটর।

এর উল্টো ঘটনা ঘটলে কী হবে? তাপমাত্রা বাড়লে যদি রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়, তাপমাত্রা অত্যন্ত কমিয়ে দিলে ইলেকট্রনগুলোর ব্যবহার কেমন হবে? দেখা গেল, অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় (পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি) ইলেকট্রনগুলোর ধর্মে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। দেখা যায়, অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় কিছু কিছু পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলো কোনো বাধা ছাড়াই চলাচল করতে পারে। শূন্য রেজিস্ট্যান্সে পরিবাহী হয়ে ওঠে অতিপরিবাহী। তখন ইলেকট্রনগুলো একে অপরের প্রতি আর বিকর্ষণ অনুভব করে না। কীভাবে এটা সম্ভব?

১৯৫৬ সালে বিজ্ঞানী লিওন কুপার আবিষ্কার করলেন অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ‘কুপার পেয়ার’। কুপারের নামানুসারে এই পেয়ার হলো—ইলেকট্রনের যুগলবন্দী অবস্থা। অতিপরিবাহীর ভেতর ইলেকট্রন–প্রবাহ ঘটে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মধ্য দিয়ে। সামান্য একটু পজিটিভ আয়নের উপস্থিতিতে ইলেকট্রন পজিটিভ আয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণের ফলে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মৃদু বিকৃতি ঘটে। ফলে কিছু ধনাত্মক চার্জের একটি অঞ্চল তৈরি হয়, যেখানে অন্য একটি ইলেকট্রন লেগে যায়। ফলে একটি ইলেকট্রনের সঙ্গে অন্য একটি ইলেকট্রনের পরোক্ষ একটি আকর্ষণ বল তৈরি হয়ে দুটি ইলেকট্রনের জোড়া তৈরি হয়, যার নাম ‘কুপার পেয়ার’। কুপার পেয়ার বা কুপার জোড়ের ইলেকট্রনগুলোর স্পিন একে অপরের বিপরীত। ফলে তাদের মোট স্পিন হয়ে পড়ে শূন্য।

তাদের ভরবেগও একে অপরের বিপরীত। ফলে মোট ভরবেগও শূন্য। স্বতন্ত্র ইলেকট্রনের স্পিন ১/২ এবং তারা ফার্মিয়ন হলেও কুপার পেয়ারের ক্ষেত্রে দুটি ইলেকট্রন মিশে গিয়ে স্পিন শূন্য হয়ে তাদের আচরণ হয়ে পড়ে বোসনের মতো। বোসন বোস–আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে এবং যেকোনো জায়গায় অসংখ্য বোসন থাকতে পারে। কোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই। ফলে একই কোয়ান্টাম দশায় লাখ লাখ কুপার পেয়ার কোনো ধরনের সংঘর্ষ ছাড়াই চলতে পারে। এতে তৈরি হয় সুপারকন্ডাক্টিভিটি।

আরও পড়ুন
১৯৫৭ সালে বারডিন, কুপার ও শ্রিফারের সুপারকন্ডাক্টিভিটি থিওরি বা অতিপরিবাহিতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহারিক সম্ভাবনা দ্রুত বাড়তে শুরু করল।

বারডিন–কুপার–শ্রিফার (বিসিএস) তত্ত্ব অনুসারে, যখন বিশালসংখ্যক কুপার পেয়ার একসঙ্গে হয়ে মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম স্টেট তৈরি করতে পারে; যেহেতু ফার্মিয়ন হয়েও তারা বোসনের মতো আচরণ করে, তখন তাদের একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করে চেনা যায় না। তাই একটি বড় আকারের ওয়েভ ফাংশন দিয়ে তাদের সবাইকে একসঙ্গে প্রকাশ করা যায়।

মাইক্রোস্কোপিক স্টেট থেকে মাইক্রোস্কোপিক বা দৃশ্যমান কোয়ান্টাম দশার তত্ত্ব এভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই কাজের জন্য জন বারডিন, লিওন কুপার ও রবার্ট শ্রিফার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭২ সালে। জন বারডিনের ছিল এটি দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার। এর আগে ১৯৫৬ সালে জন বারডিন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ট্রানজিস্টার উদ্ভাবনের জন্য। এখন পর্যন্ত জন বারডিনই একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি পদার্থবিজ্ঞানে দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বিসিএস তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরীক্ষাগারে সুপারকন্ডাক্টর তৈরির গবেষণা শুরু হয়ে গেল। ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ব্রায়ান জোসেফসন ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেছেন। মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের নতুন সম্ভাবনা।

তিনি দেখালেন, দুটি অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টরের মাঝখানে একটি অপরিবাহী বা ইনসুলেটর রাখলে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাধ্যমে ইলেকট্রন একদিকের অতিপরিবাহী থেকে অপরিবাহী পদার্থ ভেদ করে অন্যদিকের অতিপরিবাহীতে প্রবাহিত হতে পারে। তাঁর নামানুসারে এই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হলো জোসেফসন ইফেক্ট। আর এই যান্ত্রিক অংশটির নাম দেওয়া হলো জোসেফসন জাংশন। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া গেল।

এর আগে ১৯৫৭ সালে জাপানের বিজ্ঞানী লিও ইসাকি সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করেছেন ইসাকি ডায়োড বা টানেল ডায়োড। নরওয়ের বিজ্ঞানী ইভার গিয়েইভার সুপারকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে টানেলিং ইফেক্ট প্রমাণ করেছেন। ১৯৭৩ সালে টানেলিং ইফেক্টের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জোসেফসন, ইসাকি ও গিয়েইভার।

কোয়ান্টাম টানেলিং কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ। সে জন্য গার্ড বিনিং ও হেনরিখ রোরার ১৯৮৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

আরও পড়ুন
নরওয়ের বিজ্ঞানী ইভার গিয়েইভার সুপারকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে টানেলিং ইফেক্ট প্রমাণ করেছেন। ১৯৭৩ সালে টানেলিং ইফেক্টের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান জোসেফসন, ইসাকি ও গিয়েইভার।

২.

এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট–সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি বার্কলের ল্যাবে জন ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাত্র জন মার্টিনিস ও পোস্টডক্টরেট ফেলো মিশেল দ্যভোরে আবিষ্কার করেছিলেন মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ইলেকট্রিক সার্কিট—কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস বা কোয়ান্ট্রনিকসের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠছে। ৪০ বছর আগের সেই আবিষ্কারের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের স্বীকৃতি এবারের নোবেল পুরস্কার।

মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম ফেনোমেনা; অর্থাৎ দৃশ্যমান পর্যায়ে কোয়ান্টাম ধর্মাবলি প্রদর্শনের উপায় উদ্ভাবনে জন ক্লার্ক ও তাঁর গবেষক দলের অবদান অনেক। কোয়ান্টাম মেকানিকসের যেসব ভুতুড়ে কাণ্ড চোখের আড়ালে ঘটে যায়, সেগুলো যে চোখের সামনে ঘটতে দেখার ব্যবস্থাও করা যায়, তা তাঁরা প্রমাণ করেছেন। পরীক্ষাগারে তাঁরা তৈরি করেছেন সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম সার্কিট, যা কোয়ান্টাম মেকানিকসের অদ্ভুত ধর্মগুলো তো প্রদর্শন করেই, তার সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বাস্তব পথের অনেকটাই তৈরি করে দেয়।

এ বছরের নোবেলত্রয়ীর দলপতি জন ক্লার্কের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কেমব্রিজে। কেমব্রিজের বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল পার্সে লেখাপড়া শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন স্যার আলফ্রেড ব্রায়ান পিপার্ডের তত্ত্বাবধানে। কনডেনসড ম্যাটার ফিজিকসের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ব্রায়ান পিপার্ড।

পিএইচডি গবেষণার সময়ই জন ক্লার্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল ভোল্টমিটার উদ্ভাবন করেন। তা দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণের ভোল্টেজও মাপা যায়। পরে তিনি এর নাম দেন স্লাগ (SLUG—Superconducting Low-inductance Undulatory Galvanometer)। ১৯৬৮ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে। তারপর আর প্রতিষ্ঠান বদল করেননি তিনি।

সেখানেই ১৯৬৯ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ১৯৭১ সালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ১৯৭৩ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ৬০ বছর ধরে তিনি গবেষণা করছেন সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম ইন্টারফেস ডিভাইস বা স্কুইড নিয়ে (SQUID—Superconducting Quantum Interface Device)।

গবেষণার স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন অনেক। কর্মজীবনের শুরুতেই পেয়েছেন আলফ্রেড স্লোন ফেলোশিপ, তারপর গুগেনহেইম ফেলোশিপ। রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৭ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বর্ষসেরা বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির জোসেফ কিথলি পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের কমস্টক পুরস্কার। ২০০৪ সালে পেয়েছেন রয়্যাল সোসাইটির হিউজেস মেডেল। এ বছর পেলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার।

এ বছরের নোবেলত্রয়ীর দ্বিতীয়জন মিশেল দ্যভোরের জন্ম ফ্রান্সের প্যারিসে, ১৯৫৩ সালে। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘টেলিকম প্যারিস’ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কনডেনসড ম্যাটার ফিজিকসে পিএইচডি করেন। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওরসে (বর্তমান নাম প্যারিস–সুড) থেকে। তাঁর পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ আনাতোলে আব্রাগাম। ১৯৮২ সালে তিনি পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে প্রফেসর জন ক্লার্কের গ্রুপে। সেখানেই প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয় মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট।

আরও পড়ুন
জন ক্লার্ক ১৯৬৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন স্যার আলফ্রেড ব্রায়ান পিপার্ডের তত্ত্বাবধানে। কনডেনসড ম্যাটার ফিজিকসের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ব্রায়ান পিপার্ড।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত মিশেল ছিলেন প্রফেসর জন ক্লার্কের গ্রুপে। এরপর তিনি ফিরে যান ফ্রান্সে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত তিনি কোয়ান্ট্রনিকস গ্রুপের হেড হিসেবে গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত তিনি সেখানকার কোয়ান্ট্রনিকস গ্রুপের হেড ও গবেষণা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সাল থেকে তিনি যুক্ত আছেন আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রফেসর হিসেবে। একই সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা বারবারাতেও রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিট নিয়ে। সেই থেকে ৪৩ বছর ধরে তিনি গবেষণা করছেন এক্সপেরিমেন্টাল সলিড স্টেট ফিজিকস বিষয়ে। উদ্ভাবন করেছেন সার্কিট কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিকস, কোয়ান্টাম অ্যামপ্লিফিকেশন, সিঙ্গেল ইলেকট্রন ট্রানজিস্টার।

গবেষণার বিশ্বজোড়া স্বীকৃতিও পেয়েছেন মিশেল দ্যভোরে। ফেলোশিপ পেয়েছেন আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স এবং ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সের। সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট ও মাইক্রোওয়েভ ফোটনের এনট্যাঙ্গলমেন্টের জন্য ২০১৩ সালে পেয়েছেন জন বেল পুরস্কার, ২০১৪ সালে নিম্ন তাপমাত্রার পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় ফ্রিজ লন্ডন মেমোরিয়াল প্রাইজ, ২০২৪ সালে পেয়েছেন কমস্টক প্রাইজ এবং এ বছর পেলেন নোবেল পুরস্কার।

এ বছরের নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানের তৃতীয় নায়ক জন মার্টিনিস। যে আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন, সেই আবিষ্কার তিনি করেছিলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে। জন মার্টিনিসের জন্ম ১৯৫৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রির পর পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন প্রফেসর জন ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে। ১৯৮৭ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘Macroscopic quantum tunnelling and energy-level quantization in the zero-voltage state of the current-biased Josephson junction.’ নোবেল কমিটি এ বছর নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় যে বাক্যাংশ ব্যবহার করেছে, তার সঙ্গে মার্টিনিসের থিসিসের শিরোনামের আশ্চর্য মিল। মূলত জন ক্লার্ক ও মিশেল দ্যভোরের সহযোগিতায় জন মার্টিনিস তাঁর পিএইচডি গবেষণায় যা আবিষ্কার করেছিলেন, তা–ই এনে দিয়েছে তাঁদের নোবেল পুরস্কার।

পিএইচডি শেষ করার পর মিশেল দ্যভোরের আমন্ত্রণে মার্টিনিস ফ্রান্সের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে যোগ দেন। এরপর আমেরিকায় ফিরে যোগ দেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজিতে।

২০০৪ সালে চলে যান ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা বারবারায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট–সংক্রান্ত গবেষণা চলতে থাকে। ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত জন মার্টিনিস গুগলের কোয়ান্টাম এআই ল্যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণার নেতৃত্ব দেন। ২০২০ সালে মার্টিনিস অস্ট্রেলিয়ার সিলিকন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানিতে যোগ দেন। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রফেসর মিশেল সিমনস ২০১৭ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর এই কোম্পানিতে কাজ করার পর জন মার্টিনিস নিজের কোম্পানি কিউ–ওল্যাব খোলেন ২০২২ সালে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন জন মার্টিনিস।

জন মার্টিনিস ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারের মূল গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন প্রায় ৪০ বছর আগে; অর্থাৎ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে জোসেফসন ইফেক্ট প্রমাণিত হওয়ার পর খুব দ্রুত জোসেফসন জাংশনের নানা প্রয়োগ শুরু হয়, বিশেষ করে চৌম্বকক্ষেত্রের নিখুঁত পরিমাপের ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন
জন মার্টিনিস ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারের মূল গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন প্রায় ৪০ বছর আগে; অর্থাৎ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে।

সে সময় জন ক্লার্ক সবে স্নাতক পাস করে কেমব্রিজে পিএইচডি শুরু করেছেন। আমেরিকার ফোর্ড সায়েন্টিফিক ল্যাবের বিজ্ঞানী জেমস জিমারম্যান ও জন মারসেরেউ এক জোড়া জোসেফসন জাংশন ব্যবহার করে তৈরি করেছেন প্রথম ব্যবহারিক স্কুইড বা সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম ইন্টারফেস ডিভাইস। অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্রও পরিমাপ করতে পারে স্কুইড। জন ক্লার্ক তাঁর পিএইচডি গবেষণায় শুরু থেকেই স্কুইডের ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি এর নানা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটান। বর্তমানে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যক্রম থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যেখানে সূক্ষ্ম চৌম্বকক্ষেত্রের পরিমাপ করতে হয়, সেখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে স্কুইড।

কোয়ান্টাম টানেলিংকে মাইক্রোস্কোপিক পর্যায় থেকে ম্যাক্রোস্কোপিক পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা চলছিল অনেক বছর ধরে। ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্থনি লেগেট ধারণা দেন যে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল পরীক্ষার বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব। সুপারকন্ডাক্টর কিংবা সুপারফ্লুইডের ক্ষেত্রে দুটি দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব স্কুইড, বিশেষ করে শূন্য ডিগ্রি কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রায়।

মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে হিলিয়াম–৩ মৌলের সুপারফ্লুইডের কোয়ান্টাম ধর্মাবলি প্রমাণিত হয়েছে। এই সুপারফ্লুইডের তত্ত্বের জন্য তিনি ২০০৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ধারণা দেন যে মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে কোয়ান্টাম টানেলিং প্রমাণ করা সম্ভব।

১৯৮২ সালে তাঁর ধারণাকে সত্য প্রমাণ করার প্রকল্প গ্রহণ করেন প্রফেসর জন ক্লার্ক। তাঁর গ্রুপে আছেন তরুণ পোস্টডক্টরেট ফেলো মিশেল দ্যভোরে ও পিএইচডি ছাত্র জন মার্টিনিস। জন মার্টিনিসের পিএইচডি প্রকল্প হিসেবেই কাজ শুরু করলেন তাঁরা।

সুপারকন্ডাক্টিং ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট ব্যবহার করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষণ পরিকল্পনা করা হলো। যেন বাইরের কোনো প্রতিবন্ধকতা পরীক্ষণের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে না পারে। কোয়ান্টাম আচরণ প্রত্যক্ষ করার জন্য তাঁরা জোসেফসন জাংশনে খুবই ক্ষুদ্র পরিমাণের বৈদ্যুতিক প্রবাহ প্রেরণ করে ভোল্টেজ পরিমাপ করেন। সেখান থেকে রেজিস্ট্যান্স হিসাব করা সহজ। জোসেফসন জাংশনের প্রাথমিক ভোল্টেজ প্রত্যাশা অনুযায়ী শূন্যই ছিল। এরপর সিস্টেমটি শূন্য ভোল্টেজ থেকে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সাহায্যে বের হয়ে আসতে কত সময় নেয়, তার পরিমাপ করলেন।

কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটলে ভোল্টেজ শূন্য থেকে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কোয়ান্টাম দশা সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল। তাই অনেকগুলো পরিমাপের ডেটা নেওয়া হলো। পরীক্ষণে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাইক্রোওয়েভ শূন্য ভোল্টেজ দশায় প্রেরণ করা হয়। সিস্টেম যখন কিছু মাইক্রোওয়েভ শোষণ করে, তখন সিস্টেমটি উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। সিস্টেমে শক্তি বাড়লে শূন্য ভোল্টেজ অবস্থার স্থায়িত্ব কমে যায়; অর্থাৎ কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটে। পরীক্ষণে প্রমাণিত হলো যে সুপারকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপিক স্কেলের কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটে। ১৯৮৪–৮৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার–এ প্রকাশিত হলো তাঁদের ফলাফল।৩, ৪, ৫ সেটাই তাঁদের এনে দিয়েছে এ বছরের নোবেল পুরস্কার।

এ বছরের নোবেল পুরস্কারের পরীক্ষণ যদিও করা হয়েছিল প্রায় ৪০ বছর আগে, কিন্তু এই ৪০ বছরে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মাইক্রোস্কোপিক ব্যবহারযোগ্যতা অনেক বেশি বেড়েছে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস এখন বাস্তবতা। অদূর ভবিষ্যতে কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের হাতের নাগালে এসে যাবে বলে আশা করা যায়। তখন হয়তো কোয়ান্টাম মেকানিকসের দুর্বোধ্যতার অপবাদ কিছুটা হলেও কমে যাবে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ১. বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২২, সেপ্টেম্বর ২০২৫।

২. প্রদীপ দেব, কোয়ান্টাম ভালোবাসা, মীরা প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৪।

৩. এম এইচ দ্যভোরে, জে এম মার্টিনিস, ডি এসটিভ, জে এম ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৩, পৃ ১২৬০ (১৯৮৪)।

৪. জে এম মার্টিনিস, এম এইচ দ্যভোরে, জে ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৫, পৃ. ১৫৪৩ (১৯৮৫)।

৫. এম এইচ দ্যভোর, জে এম মার্টিনিস, জে ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৫, পৃ. ১৯০৮ (১৯৮৫)।

৬. নোবেল প্রাইজ ডটঅর্গ

আরও পড়ুন