বিজ্ঞানচিন্তার চোখে বছরজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানের আলোচিত আবিষ্কার

পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় ২০২৫ সাল ছিল বেশ ঘটনাবহুল। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারছে। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এ বছর। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব আলোচিত গবেষণা। পাশাপাশি বছর শেষে ফিজিকস ওয়ার্ল্ড এবং কোয়ান্টা ম্যাগাজিনসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে সারা বছরের আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা। সেখান থেকে আলোচিত ৮টি গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে। এই তালিকায় গুরুত্ব অনুযায়ী গবেষণাগুলোর ক্রমবিন্যাস করা হয়নি। শুধু লেখার সুবিধার্থে ক্রমসংখ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

ছবি: কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন

সিঙ্গেল নেকেড ব্ল্যাকহোল

ছবি: নিউ সায়েন্টিস্ট

ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ চমকপ্রদ এক আবিষ্কার করেছে। এর তোলা মহাবিশ্বের শুরুর দিকের এক ছবি তোলপাড় শুরু করেছে বৈজ্ঞানিক মহলে। আগে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের ১০০ কোটি বছরে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা তথ্য সরাসরি জানার বা দেখার সুযোগ বিজ্ঞানীদের ছিল না। জেমস ওয়েব কাজ শুরু করার পর এ ধারা বদলে গেছে। এই টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের একেবারে শৈশবকালে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট রহস্যময় আলোর বিন্দু দেখতে পায়। বিজ্ঞানীরা এগুলোর নাম দিয়েছেন লিটল রেড ডটস বা ছোট লাল বিন্দু। এদের সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা বিজ্ঞানীদের ছিল না। তবে চলতি বছর বিজ্ঞানীরা সেগুলোর একটার রহস্য বুঝে ফেলেছেন।

জেমস ওয়েবের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা যাচাই করে দেখেছেন, ওই লাল বিন্দুর মধ্যে একটি আসলে ব্ল্যাকহোল। তা-ও যেনতেন ব্ল্যাকহোল নয়, নেকেড ব্ল্যাকহোল। এর ভর প্রায় পাঁচ কোটি সূর্যের সমান। কেন একে নেকেড ব্ল্যাকহোল বলা হচ্ছে? কারণ, এ ধরনের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সাধারণত গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে। কিন্তু ওই লাল বিন্দুর মতো ব্ল্যাকহোলের চারপাশে কোনো গ্যালাক্সির অস্তিত্ব নেই। এই ব্ল্যাকহোলটি একা দাঁড়িয়ে আছে তরুণ মহাবিশ্বে।

খুব পাতলা এক গ্যাসস্তর যেন একে হালকা করে ঢেকে রেখেছে। এই একটিমাত্র ব্ল্যাকহোলই মহাবিশ্বের শুরুর ইতিহাস নিয়ে আমাদের পুরোনো ধারণা উলটপালট করে দিচ্ছে। এত দিন বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, আগে গ্যালাক্সি তৈরি হয়, তারপর গ্যালাক্সির ভেতরের বড় বড় নক্ষত্র ভেঙে পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। সেগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধীরে ধীরে আরও বড় ব্ল্যাকহোল গড়ে তোলে।

কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। প্রশ্ন উঠছে, এত অল্প বয়সে মহাবিশ্বে এমন একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি হলো কীভাবে? এমনও কি হতে পারে, এটি আদিম ব্ল্যাকহোল, যা সরাসরি বিগ ব্যাংয়ের সময়েই জন্ম নিয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো জানা নেই। গবেষকরা শুধু এটুকুই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন, এই আবিষ্কার ভীষণ রোমাঞ্চকর!

আরও পড়ুন

ডার্ক এনার্জির দুর্বলতা

ডার্ক এনার্জি
ছবি: নাসা

২০২৫ সালে অ্যাস্ট্রোফিজিকসের অন্যতম বড় খবর ছিল ডার্ক এনার্জির দুর্বলতা। এটা ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় মাউন্ট পালোমারে অবস্থিত ৪ মিটার ডেসি (DESI) টেলিস্কোপে। ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইনস্ট্রুমেন্ট বা ডেসি পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক কোলাবরেশনের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির নেতৃত্বে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এই কোলাবরেশনের সঙ্গে যুক্ত।

ডেসি টিম ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মহাবিশ্বের একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। তাতেই আভাস মিলেছিল ডার্ক এনার্জির দুর্বলতার বিষয়টি। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে মানচিত্রটিকে আরও উন্নত করা হয়। ২০২৪ সালে যেখানে ৬০ লাখ গ্যালাক্সির তথ্য ছিল, ২০২৫ সালে সেখানে যুক্ত করা হয় প্রায় দেড় কোটি গ্যালাক্সির তথ্য। এই বিস্তারিত মানচিত্র আমাদের জানাচ্ছে, ডার্ক এনার্জি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের একটা প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব হলো মহাবিশ্বের প্রসারণ। দিন দিন এটা বাড়ছে বলেই প্রমাণ ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। মহাবিশ্বের প্রসারণের জন্য দায়ী ডার্ক এনার্জি। ডার্ক এনার্জি যদি দুর্বল হতে থাকে, তবে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি কমতে থাকবে। যা প্রচলিত ধারণার বিপরীত।

ডার্ক এনার্জি মহাশূন্যজুড়ে খুব হালকাভাবে ছড়িয়ে আছে। এক ঘনমিটারে এর পরিমাণ কয়েকটি পরমাণুর ভরের মতোই সামান্য। ডার্ক এনার্জি মহাশূন্যের নিজের শক্তি। কিন্তু এই শক্তি কোথা থেকে আসে, কেন এটা এত ছড়িয়ে থাকে—এই প্রশ্নগুলোর পরিষ্কার উত্তর আজও বিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। এখন যদি সত্যিই দেখা যায় যে প্রতি ১০০ কোটি বছর পরপর ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব কমছে, তাহলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল বদলে যেতে পারে। আর যদি এর ঘনত্ব একই থাকে, তাহলে ব্যাখ্যাও হবে একেবারে ভিন্ন। তবে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। বিজ্ঞানীদের আরও প্রমাণ দরকার।

আরও পড়ুন

দ্বিমাত্রিক ধাতব পাত

চাইনিজ বিজ্ঞান একাডেমির পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের একজন গবেষক দ্বিমাত্রিক ধাতব পাত নিয়ে গবেষণা করছেন
ছবি: চাইনিজ বিজ্ঞান একাডেমির পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউট

দ্বিমাত্রিক পাত তৈরির ঘটনা প্রথম নয়। ২০০৪ সালে গ্রাফিন তৈরি করা হয়। এটি আসলে দ্বিমাত্রিক বস্তু। তারপর বিজ্ঞানীরা অনেক দ্বিমাত্রিক বস্তু তৈরি করেছেন। কিন্তু গ্রাফিনের মতো সেগুলোও সব অধাতু। ধাতব দ্বিমাত্রিক বস্তু তৈরি করা খুব কঠিন ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য। কারণ, ধাতুর প্রতিটি পরমাণুর চারপাশে অসংখ্য পরমাণু খুব শক্তভাবে লেগে থাকে। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন করেছেন চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফিজিকস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ঝাং গুয়াংইউ, দু লুয়োজুন ও তাঁদের সহকর্মীরা। তাঁরা প্রথমবারের মতো ধাতুর দ্বিমাত্রিক পাত তৈরি করেছেন।

গবেষকেরা বিশুদ্ধ ধাতুর গুঁড়া দুই স্তরের মলিবডেনাম ডাই-সালফাইড ও স্যাফায়ার অ্যানভিলের মাঝে রেখে উত্তপ্ত করে গলিয়েছেন। এরপর উচ্চ চাপ প্রয়োগ করে তাঁরা বিসমাথ, টিন, সিসা, ইন্ডিয়াম ও গ্যালিয়ামের অত্যন্ত পাতলা ধাতব দ্বিমাত্রিক শিট বা পাত তৈরি করেছেন। উল্লেখ্য, দ্বিমাত্রিক বস্তুর শুধু দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ থাকে, উচ্চতা থাকে না। তাই সব দ্বিমাত্রিক বস্তু আসলে পাতের মতোই হবে।

আরও পড়ুন

পরমাণুর সর্বোচ্চ রেজল্যুশনের ছবি

ছবি: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

এমন একটা সময় ছিল, যখন আলাদা করে একটা পরমাণুর ছবি তোলা ছিল অসম্ভব। এমনকি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু একসময় বিজ্ঞানীরা পরমাণুর ছবি তুলতে সক্ষম হন। এখনো একক পরমাণুর ছবি তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কারণ, আগে যত পরমাণুর ছবি তোলা হয়েছে, কোনোটাই অত স্পষ্ট নয়। সেটা সংগত কারণেই। তবে দিন যত যাচ্ছে, পরমাণুর আরও নিখুঁত ও স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছে। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ইচাও ঝাং এবং ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিনশেন হুয়াংয়ের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী একক পরমাণুর নতুন একটি ছবি তুলেছেন। এখন পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ রেজল্যুশনের ছবি।

এই ছবি তুলতে বিজ্ঞানীরা ইলেকট্রন টাইকোগ্রাফি নামে এক উন্নত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা ১৫ পিকোমিটার রেজল্যুশনের ছবি তুলেছেন। রেজল্যুশনের মান যত ক্ষুদ্র হয়, ছবি তত হয় নিখুঁত। যেমন ক্যামেরার মেগাপিক্সেল যত বেশি, ছবিটাকে তত ক্ষুদ্র পিক্সেলে ভাগ করে তোলা সম্ভব। তাই ছবির রেজল্যুশনও তত ভালো হয়। ১৫ পিকোমিটার হলো পরমাণুর আকারের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ পরমাণুর ভেতরের গঠনও প্রায় স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হয়েছে এই ছবিতে।

ছবি তুলতে গবেষকেরা টাংস্টেন ডাইসেলেনাইড নামের যৌগ ব্যবহার করেছেন। এই যৌগের দুটি অতি পাতলা পরমাণুস্তর আলাদা করে নেন তাঁরা। তারপর স্তর দুটি একে অপরের তুলনায় সামান্য ঘুরিয়ে বসানো হয়। এর ফলে একটি বিশেষ নকশা তৈরি হয়। একে ময়েরে সুপারল্যাটিস বলা হয়। এই সুপারল্যাটিসের ঘূর্ণনের কোণ একটু বদলালেই এদের বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্যে বড় পরিবর্তন দেখা যায়। ছবি তোলাও তাই সহজ হয়।

সূক্ষ্ম রেজল্যুশন ব্যবহার করে গবেষকেরা সুপারল্যাটিসের ভেতরে একধরনের সম্মিলিত কম্পন দেখতে পেয়েছেন। এগুলোর নাম ময়েরে ফেসন। এগুলো অনেকটা ফোননের মতো। ফোনন হলো শব্দ তরঙ্গের জন্য প্রস্তাবিত কোয়ান্টাম কণা। ময়েরে ফেসনের অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবে ছিল, কিন্তু এত দিন সরাসরি দেখা যায়নি। এবারই প্রথম গবেষকেরা নতুন ছবির সাহায্যে তা চাক্ষুষ করতে সক্ষম হয়েছেন। ময়েরে ফেসনসহ অন্যান্য ল্যাটিসের কম্পনের ভূমিকা আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে এই ছবি ও গবেষণা। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে ব্যবহারযোগ্য নতুন নতুন যৌগ তৈরিও সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন

অ্যান্টিপ্রোটনে কোয়ান্টাম নিয়ন্ত্রণ

অ্যান্টিপ্রোটন হলো প্রোটনের বিপরীত কণা
ছবি: সায়েন্স নিউজ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কণাপদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র সার্নের বেস গবেষণা দলের বিজ্ঞানীরা একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁরা প্রথমবারের মতো একটি মাত্র অ্যান্টিপ্রোটনের ওপর সমন্বিত স্পিন স্পেকট্রোস্কপি করেছেন। অ্যান্টিপ্রোটন হলো প্রোটনের বিপরীত কণা, অর্থাৎ প্রতিকণা। এই গবেষণার মাধ্যমে অ্যান্টিপ্রোটনের চৌম্বক বৈশিষ্ট্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণা কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল যাচাই করতে কাজে লাগতে পারে।

এই পরীক্ষায় প্রথমে একটি ত্বরক যন্ত্রে খুব উচ্চশক্তির অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি করা হয়। এরপর এগুলোকে খুব ঠান্ডা করা হয়, অর্থাৎ গতি কমিয়ে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নামানো হয়। মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রাকে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রা বলে। এত কম তাপমাত্রায় ঠান্ডা করার সময় বিজ্ঞানীদের খেয়াল রাখতে হয়েছিল, যেন এগুলো ধ্বংস হয়ে না যায়। তারপর একটি মাত্র অ্যান্টিপ্রোটনকে অত্যন্ত ঠান্ডা তড়িৎচৌম্বকীয় ফাঁদে আটকে রাখা হয়। সেখানে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ দিয়ে তার স্পিন নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এই পরীক্ষায় যে কম্পনের সর্বোচ্চ বিস্তার পাওয়া গেছে, তা আগের যেকোনো মাপজোখের তুলনায় ১৬ গুণ বেশি সরু। এর ফলে পরিমাপের নির্ভুলতা অনেক বেড়েছে। এত উচ্চমাত্রার কোয়ান্টাম নিয়ন্ত্রণের ফলে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং প্রতিকণাদের বৈশিষ্ট্য খুব সূক্ষ্মভাবে তুলনা করা সম্ভব হবে। সেই তুলনায় যদি অপ্রত্যাশিত কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়, বদলে যেতে পারে হিসাব। তখন হয়তো কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাইরে নতুন কোনো তত্ত্বের আভাস পাওয়া যেতে পারে। তেমনি দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রতিপদার্থের তুলনায় পদার্থের পরিমাণ এত বেশি কেন—এ প্রশ্নের উত্তরও মিলতে পারে।

আরও পড়ুন

প্রথম সুপারফ্লুইড অণু

হাইড্রোজেন অণুর সুপারফ্লুইড ঘটনা
ছবি: ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড

সুপারফ্লুইড মানে অতিপ্রবাহী। এ ধরনের পদার্থ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয়। কিন্তু কঠিন পদার্থের প্রবাহী ক্ষমতা নেই। শুধু তরল ও গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু প্রবাহী ও অতিপ্রবাহীর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। প্রবাহী সাধারণ কাজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অতিপ্রবাহী ব্যবহৃত হয় কোয়ান্টাম জগতে। সুপারফ্লুইড তৈরি অত সহজ ছিল না। আণবিক পর্যায়ের কণাদের নিয়ে এটা তৈরি করা আরও কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন কাজটি করেছেন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তাকামাসা মোমোসে এবং জাপানের রিকেন অ্যাটমিক মলিকিউলার অ্যান্ড অপটিক্যাল ফিজিকস ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী সুসুমু কুমা।

তাঁরা হাইড্রোজেন অণুর মধ্যে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। পৃথিবীর সরলতম অণু হলো হাইড্রোজেন অণু। এর অণুতে দুটি মাত্র পরমাণু থাকে। মৌলিক কণার সংখ্যাও এতে সবচেয়ে কম—দুটি প্রোটন আর দুটি ইলেকট্রন। তবু কাজটা সহজ ছিল না। তাত্ত্বিক হিসাব ছিল, ১ থেকে ২ কেলভিন তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন সুপারফ্লুইডে পরিণত হয়। কিন্তু বাস্তবে ১৩.৮ কেলভিন তাপমাত্রাতেই হাইড্রোজেন জমে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। তাই এর প্রবাহী ক্ষমতা ২ কেলভিনে পৌঁছানোর অনেক আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য গবেষকেরা ব্যবহার করেন তরল হিলিয়ামের ন্যানোড্রপলেট বা ন্যানো আকৃতির ফোঁটা। এই হিলিয়াম ফোঁটার মধ্যে তাঁরা হাইড্রোজেন অণুর ছোট ছোট গুচ্ছ আটকে রাখেন। সেই গুচ্ছের ভেতর বসানো হয় মিথেন অণু। এরপর তাপমাত্রা কমালেও হাইড্রোজেন আর জমাটবদ্ধ হতে পারে না। তখন বিজ্ঞানীরা মিথেন অণুর ঘূর্ণন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন হাইড্রোজেন অণুগুলো সুপারফ্লুইডে পৌঁছে গেছে। আর এই কাজে সফল হতে তাঁদের লেগেছে ২০ বছর।

এটি পদার্থবিজ্ঞানের জন্য বড় ঘটনা। কণাদের আচরণ ক্লাসিক্যাল মেকানিকস থেকে ঠিক কখন কোয়ান্টাম মেকানিকসে বদলে যায়, সেই সীমারেখাটা বোঝা সম্ভব এই গবেষণার মাধ্যমে। অন্তত দুই গবেষক তা-ই মনে করছেন।

আরও পড়ুন

কোয়ান্টাম বায়োসেন্সিংয়ের জন্য প্রোটিন কিউবিট

গবেষকেরা প্রোটিন কিউবিট নিয়ে গবেষণা করছেন
ছবি: জেসনস্মিথ ডট কম

চলতি বছর বিজ্ঞানীরা কিউবিট তৈরি করেছেন। বায়োসেন্সিংয়ের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এই কাজটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিটজকার স্কুল অব মলিকিউলার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষক পিটার মাউরার ও ডেভিড আওশালম এবং তাঁদের সহকর্মীরা। এ ধরনের কিউবিট সরাসরি জীবন্ত কোষের ভেতরেই তৈরি করা যায় এবং চৌম্বক ক্ষেত্র মাপার সেন্সর হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। বর্তমানে বেশির ভাগ বায়ো-কোয়ান্টাম সেন্সর তৈরি হয় হীরার ভেতরে নাইট্রোজেন-ভ্যাকেন্সি সেন্টার বা এনভি দিয়ে। কিন্তু এগুলো আকারে তুলনামূলক বড়। তাই জীবন্ত কোষের ভেতরে নির্দিষ্ট জায়গায় এগুলো বসানো খুব কঠিন।

এই সমস্যা সমাধানে গবেষক দলটি ব্যবহার করেছে ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন। এসব প্রোটিনের আকার মাত্র তিন ন্যানোমিটার। এর জন্য বিজ্ঞানীদের কোনো পরিশ্রম করতে হয় না, জৈব কোষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট জায়গায়, প্রায় পরমাণু-নির্ভুলতায় এই প্রোটিন তৈরি করতে পারে। এই প্রোটিনগুলোর আলোক ও স্পিন ধর্ম অনেকটাই এনভি সেন্টারভিত্তিক কিউবিটের মতো। এদের একটি বিশেষ অবস্থা আছে, যাকে বলা হয় মেটাস্টেবল ট্রিপলেট স্টেট।

গবেষকেরা নিয়ার ইনফ্রারেড লেজার পালস ব্যবহার করে একটি হলুদ ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর প্রোটিনের ট্রিপলেট স্পিন স্টেট পড়তে সক্ষম হন। এতে স্পিন কনট্রাস্ট পাওয়া যায় প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত। পরে তাঁরা জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই প্রোটিনকে ব্যাকটেরিয়ার জীবন্ত কোষের ভেতরে প্রকাশ করান। সেখানে প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কনট্রাস্টসহ সিগন্যাল মাপা সম্ভব হয়।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবন্ত কোষের ভেতরেই সরাসরি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স বা চৌম্বকীয় প্রভাব পরিমাপ করা যাবে। হীরার এনভি সেন্টার দিয়ে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। তাই ভবিষ্যতে জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় এই প্রোটিন কিউবিট নতুন এক দরজা খুলে দিতে পারে।

আরও পড়ুন

পদার্থবিজ্ঞানে এআই

ছবি: কোয়ান্টা ম্যাগাজিন

এখন চারপাশে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার। পদার্থবিজ্ঞানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এখানেও ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। কোয়ান্টা ম্যাগাজিন-এর বিজ্ঞান লেখক অনিল অনন্তস্বামী ২০২৫ সালের জুলাই মাসে পদার্থবিজ্ঞানে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে একটি অনুসন্ধানী ফিচার লিখেছিলেন। ফিচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পদার্থবিজ্ঞানে এআই কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা বিশ্লেষণ করা। সেখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে চোখে পড়ে। কম্পিউটার বা এআই এমন কিছু অদ্ভুত ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষার কথা ভাবতে পারছে, যেগুলো মানুষ সাধারণত কল্পনাই করতে পারে না। পরীক্ষাগুলো অদ্ভুত হলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেগুলো কাজ করে।

এআইয়ের আরেকটি প্রভাবও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেটা হলো চ্যাটবট দিয়ে এমন সব হিসাব আর প্রমাণ তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো বাইরে থেকে একদম ঠিকঠাক আর বৈজ্ঞানিক মনে হয়, কিন্তু ভেতরে আসলে কোনো অর্থই নেই। অনন্তস্বামীর সন্দেহ হয়েছিল, কেউ সত্যিই কি ইয়াং-মিলস মাস গ্যাপ প্রবলেম সমাধান করেছে, নাকি করেনি? এই সমস্যাটি সবল নিউক্লিয়ার বলের সঙ্গে জড়িত এবং এতটাই কঠিন যে এর সমাধানের জন্য এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা আছে। আরজিভ ডট অর্গ নামের পদার্থবিজ্ঞানের প্রিপ্রিন্ট সাইটে দেওয়া একটি প্রবন্ধে দাবি করা হয়, সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তা হয়নি।

ওই প্রবন্ধের সব সূত্র আর গণনা ছিল এআই দিয়ে তৈরি করা অর্থহীন সব ডেটা। তবু সেই লেখা আরজিভের স্বয়ংক্রিয় ফিল্টার ফাঁকি দিয়ে প্রকাশিত হয়। সাইটটির প্রশাসক ও পদার্থবিজ্ঞানী পল গিন্সপার্গ বলেন, ‘২০২৩ সালের পর থেকে বাতিল লেখার স্তূপ অনেক বড় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেটা আরও দ্রুত বাড়ছে।’ তাঁর মতে, ‘এর পেছনে মূল কারণ হলো প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ লোকেদের তৈরি এআই-ঘেঁটে কিছু অপ্রয়োজনীয় লেখা।’ গিন্সপার্গ স্পষ্ট করে বলেন, ‘এ ধরনের আবর্জনা আরজিভের পুরো সিস্টেমের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি তৈরি করছে।’

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন