ঘাসগুলো গান গেয়ে তাকে ডাকছে প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে। কিন্তু তা এতই গভীরে লুকানো যে প্রাত্যহিক অভ্যাসে জড়ানো আমাদের মন তার নাগাল পায় না। সে রহস্য সম্বন্ধে আমরা ভালো করে সচেতন হই কেবল বিশেষ কয়েকটি দুর্লভ মুহূর্তে।
মানুষ যতটা জানে প্রকৃতি আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ, একথা উপলব্ধি করে নিকিতিন অভিভূত হয়ে পড়ল। জ্ঞান হচ্ছে কঠোর সাধনার ব্যাপার। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আর নিরন্তর সংগ্রামের ফলেই মানুষ তার রহস্য ভেদ করতে পারে। কিন্তু তবু এ কাজে সফল হতে হলে অনুসন্ধানীর মনটা হওয়া চাই খাঁটি, মহৎ। প্রকৃতির রাগিণীর স্বরলিপি ধরতে হলে হৃদয়টি হওয়া চাই বাজনার মতো নিখুঁত সুরে বাঁধা।
নিকিতিন ধীরে ধীরে চোখ তুলতে মিরিয়ামের চোখে চোখ পড়ল। অদ্ভুতভাবে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘাসের রহস্যময় সংগীত ডুবিয়ে দিয়ে বলে উঠল:
‘এবার যেতে হয়, মিরিয়াম!’ গলার স্বরটা নিকিতিনের নিজের কানেই বড় কর্কশ শোনাল।
মিরিয়াম উঠে পড়ল। ছোট্ট শান্ত উপত্যকাটার দিকে নিকিতিন একবার তাকাল।
‘এমন সুন্দর জায়গাটার মাধুর্য এতদিন একা একা ভোগ করেছেন, আপনি বড় স্বার্থপর,’ হেসে বলল নিকিতিন।
‘আপনি যা ব্যস্ত ছিলেন,’ নম্রভাবে জবাব দিল মেয়েটি।
‘কাল পাহাড়ে স্তম্ভের কাছে ক্যাম্প নিয়ে আসব,’ নিকিতিন দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল, ‘এখন তো ওর কাছেই খোঁড়ার কাজ শুরু হবে!’
দক্ষ হাতে হাতুড়ির এক জোর ঘায়ে মার্তিন মার্তিনভিচ শেষ বাক্সটার গায়ে শেষ পেরেকটা পুঁতে হেসে বলে উঠল:
‘ব্যস, সের্গেই পাভলভিচ।’
‘আচ্ছা,’ জবাবে বলল নিকিতিন, ‘কাল আমাদের ছুটি। তারপর তৈরি হয়ে সন্ধ্যার দিকে বাড়িমুখো রওনা। আর এখানে থাকা নয়।’
‘সের্গেই পাভলভিচ,’ মারুসিয়া নিকিতিনের কাছে আব্দার ধরল, ‘আপনি বলেছিলেন এই জন্তুগুলোর কথা আমাদের বলবেন।’ চারপাশের বাক্সগুলো দেখিয়ে মারুসিয়া বলল, ‘এবার সময় হয়েছে। এখন তো মাত্র তিনটা বাজে।’
‘ঠিক আছে। খাবারের পর উপত্যকায় গিয়ে বলব,’ অভিযানের নেতা রাজী হয়ে গেল।
অভিযাত্রীদলের ১৪ জনই নিকিতিনকে ঘিরে বসল তার কথা শোনার জন্য। বহু প্রাচীন কাল থেকে জীবের লাখ লাখ বছরের অভিব্যক্তির ইতিহাস সে বলে চলে সুন্দর করে, দরদ দিয়ে। পৃথিবীতে প্রাণ চতুষ্পদ উভচর প্রাণী আর সরীসৃপের আকারে এক সময় যে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল তার ব্যাখ্যাও সে দেয়। একে একে জানায়, প্রাকৃতিক বাছাইয়ের অমোঘ নিয়ম কীভাবে নির্মম হাতে দুর্বল আর অনুপযুক্তদের হটিয়ে দিয়ে জীবজননের অনন্ত স্রোতকে বাধামুক্ত করে রেখেছে।
১৫ কোটি বছর আগে মধ্যজীবীয় যুগের শুরুতে পৃথিবীতে ছিল সরীসৃপের বাস। এরপর আসে স্তন্যপায়ী জীব। এই অত্যন্ত উন্নত প্রাণীর অভিব্যক্তিতে প্রভাব পড়েছিল অবসৃত পুরাজীবীয় যুগের কঠোর অবস্থার। পুরাজীবীয় যুগের পরের যুগে কঠোর ও প্রতিকূল আবহাওয়ার জায়গায় দেখা দিল উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া। পৃথিবী ঢেকে গেল উদ্ভিদ সম্পদের প্রাচুর্যে। চারপাশের অবস্থা হয়ে উঠল অনেক সহজ আর প্রাণের বিকাশের উপযোগী। এল সরীসৃপ যুগ। মাটি সমুদ্র আকাশ জয় করে নিয়ে সরীসৃপরা আকারে আর সংখ্যায় বিপুল পরিমাণে বেড়ে উঠতে শুরু করল।
শিকারি জন্তুদের তৃপ্তিহীন লোভের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য বিরাটকায় নিরামিষাশী জন্তুদের মাথায় গজাল বিরাট বিরাট শিং, গায়ে শক্ত হাড়ের বর্ম আর কাঁটার আবরণ। অন্যরা অনেকে লুকালো হ্রদ আর উপহ্রদে। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তাদের দৈর্ঘ্যের মাপ হবে অন্তত একশ ফুট। ওজন ৬০ টন। আকাশ তখন ছেয়ে গেছে ডানাওয়ালা সরীসৃপে। সেখানে তাদের অবিসংবাদিত প্রাধান্য, কারণ তাদের ডানার পরিসর সবচেয়ে বেশি।
হিংস্র জন্তু মোটা লেজের সাহায্যে ভারসাম্য বজায় রেখে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটত। সামনের পা দুটো তাই তাদের ক্রমশ দুর্বল হয়ে অকেজো হয়ে পড়ল। বড় বড় দাঁতে ভরা মুখ নিয়ে তাদের বিরাট মাথাটা হয়ে উঠল মারাত্মক অস্ত্র। প্রায় ২০ ফুট লম্বা এই তিন পেয়ে বুদ্ধিহীন দৈত্যগুলো হয়ে উঠল অত্যন্ত শক্তিশালী আর হিংস্র যুদ্ধযন্ত্র।
এই অপ্রীতিকর সঙ্গীদের সঙ্গেই বাস করত প্রাচীন স্তন্যপায়ী জীব। ইঁদুর বা হেজহগের (শজারু) চেয়ে তারা বেশি বড় নয়, মারাত্মকও নয়। মধ্যজীবীয় যুগটা হচ্ছে সরীসৃপদের পরাক্রমের যুগ। স্তন্যপায়ী জীবদের তারা প্রায় নিঃশেষই করে ফেলেছিল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই প্রায় দশ কোটি বছরের যুগটাকে অন্ধ প্রতিক্রিয়ার কাল বলা যেতে পারে। প্রাণী জীবনের প্রগতি এই সময় ব্যাহত হয়েছে।