অতীতের ছায়া – ৫

জলাশয়টাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য অনেক চেষ্টা করা হলো। কিন্তু সবই বৃথা। অদৃষ্টপূর্ব এই দুর্ঘটনায় অভিযান এখন চরম ব্যর্থতায় পরিণত হতে চলেছে। দলের লোকেদের প্রাণের ঝুঁকি নিকিতিন কী করে নেয়?

ক্লান্ত ও ভগ্নমনোরথ নিকিতিন পাহাড়ের বুকে নিরুদ্দেশভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘোড়ার পিঠের মতো একটা পাহাড়ের কালো দিকটায় এক সরু অথচ গভীর গিরিবর্ত্ম। নিকিতিন সেখান দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে। রোদে পোড়া কালো দেয়ালগুলো থেকে হাঁপ ধরান গরম হাওয়ার ঝাপটা এসে তার নাকে মুখে লাগছে। নিকিতিন দাঁড়িয়ে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল মস্ত একটা পাথরের ওপর পা মুড়ে বসে আছে মিরিয়াম। কোলের খোলা খাতাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে একমনে কী যেন ভাবছে। নিকিতিনকে সে দেখতেও পায়নি। মাথাটা যেন তার মোটা বেণীর ভারেই নুয়ে পড়েছে। মুখে ধীর প্রশান্তি। পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সে কী সুন্দর মানিয়ে গেছে! তরুণ জীবাশ্মবিজ্ঞানী মুগ্ধ। নিকিতিনের এতক্ষণে মনে হলো মিরিয়াম সত্যিই তার দেশের মেয়ে। বাইরের দুর্বলতার আড়ালে সঞ্চিত রয়েছে শক্তি ও স্থৈর্য। পাছে মিরিয়ামের নির্জনতায় ব্যাঘাত ঘটে তাই নিকিতিন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

এ যা দেশ, এখানে কিছুই সহজে পাওয়ার উপায় নেই। অনেক দিনের সাধনার ফলেই এই নিষ্ঠুর প্রকৃতি জয় করা সম্ভব। হঠাৎ ক্ষেপে উঠে কিছু করতে শুরু করলে কোনো লাভ হবে না। সফল হতে হলে ধৈর্য আর পরিশ্রমের প্রয়োজন। নতুন বাধার মুখোমুখি হয়ে তাকে জয় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ বাজিমাত করার যে স্বাভাবিক ইচ্ছা মানুষের মনে দেখা দেয়, তার ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

তার দিকে কেউ চেয়ে আছে সেটা অনুভব করে মিরিয়াম ঘুরে তাকাল। নিকিতিনকে দেখেই লাফিয়ে উঠে এগিয়ে এল তার দিকে। তারপর নিকিতিনের চোখের দিকে তাকিয়ে তার স্বাভাবিক টানা টানা ভঙ্গিতে বলল, ‘কী হয়েছে, সের্গেই পাভলভিচ, কিছু গোলমাল হয়েছে কি?’

আরও পড়ুন

তার গলার স্বরের আন্তরিক উৎকণ্ঠা নিকিতিন ধরতে পারল। মুহূর্তের আবেগে সে মন খুলে মিরিয়ামের কাছে প্রকাশ করল তার সব দুশ্চিন্তা। জানাল, অভিযানের সংকটজনক অবস্থা। মেয়েটি কিছুক্ষণ একটি কথাও বলল না। তারপরে ক্যাম্পে ফেরার মুখে সলজ্জভাবে, যেন নিজের মনেই ভাবতে ভাবতে বলল, ‘গত বছর দ্যুর্ত-কিরে ডিনামাইটের সাহায্যে ঝরনার পানি বাড়ানো হয়েছিল। একটা ডিনামাইট যদি...’

‘কেন, এমোনাল তো আছে।’ নিকিতিন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ‘তার আউটলেটটা উড়িয়ে দিলেই হলো। তাতে অবশ্য সবসময় কাজ হয় না, কিন্তু... ব্যাপারটা আমার মাথাতে একেবারেই আসেনি। এক্ষুণি চেষ্টা করে দেখব।’ নিকিতিন তখন হাসিমুখে, বড় বড় পা ফেলে চলেছে, অনেকটা চার্জ করতে হবে! দেখা যাক কী হয়!’

বিস্ফোরণের ভীষণ গর্জনে পাহাড় কেঁপে উঠল। একটা মস্ত ধুলোর স্তম্ভ উৎসের ওপর ব্যাঙের ছাতার মতো লাফিয়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো চারপাশের পাহাড়গুলোয় যেন প্রচন্ড ধ্বংস নেমেছে। অভিযাত্রীরা সবাই উৎসের দিকে ছুটে গিয়ে মুখ বুজে পাথর সরাতে লাগল। নিকিতিন আর মিরিয়াম যখন পানি মাপতে শুরু করল তখন তো চারপাশের নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠেছে।

অভিযানের দলপতি হঠাৎ খাড়া হয়ে বসে মিরিয়ামের হাত চেপে ধরে বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ, মিরিয়াম!’

দলের ছেলেরা সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওয়া মিরিয়াম কি—ফতে!’

আরও পড়ুন

মিরিয়াম লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে সিনিয়র ড্রাইভারের বিরাট পিঠের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ড্রাইভার বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠল:

‘ছোকরারা সব পালাও!’

‘এস্‌ফল্ট দেখা যাচ্ছে, মিরিয়াম?’ নিকিতিন হেসে জিজ্ঞেস করল।

‘খুব অদ্ভুত সঞ্চয়, বুঝেছেন সের্গেই পাভলভিচ। তার ওপর এটা এস্‌ফল্টও নয় এক জাতীয় খুব শক্ত রজন।’

‘কাল একবার দেখব। এখন আমরা কী খুঁড়ে পেলাম তা দেখুন।’

চারিদিকে শুধু খুঁড়ে তোলা মাটির ঢিবি। একজায়গায় আগুন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। তৈরী হচ্ছে হাড় জোড়া লাগানর আঠা। মার্তিন মার্তিনভিচের পরনে শুধু হাফপ্যান্ট। খালি গা রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। একমনে সে জীর্ণ হাড়গুলোকে আঠায় ভিজিয়ে চলেছে। একটা ছোট্ট দল সমতলের ঠিক মাঝে একটা বড় জায়গা নিয়ে কাজ করছে। ওপরের মাটির স্তরটা এর মধ্যেই খুঁড়ে ফেলে চারপাশে খাল কাটা হয়ে গেছে। এদের কাজ হলো কঙ্কালের চারপাশের মাটিটা কেটে সরিয়ে ফেলা। বাকি থাকবে কেবল ‘মোনোলিথ’, মানে কঙ্কালকে যে মাটির অংশটুকু ঢেকে রাখে সেইটুকু। পরে কাঠের ফ্রেম করে সেটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। দুজন লোক বড় বড় ছুরি দিয়ে আলগা বালিপাথর কেটে জায়গাটাকে তিন ভাগে ভাগ করছে। মারুসিয়া বের করা খুলিটার ভাঙা জায়গাগুলোয় চাঁচগালা ঢালছে।

(চলবে…)

* ইভান ইয়েফ্রেমভ একজন রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।

আরও পড়ুন