এলবেডো রিফট
সাল ২৭০৩। মানবজাতি বহু শতাব্দী আগেই পৃথিবী ত্যাগ করেছে। সূর্যের জ্বালানি হ্রাস ও কার্বন বিষক্রিয়ার কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে ট্রাপিস্ট-১ই নামে একটি শীতল গ্রহে বসতি গড়েছে হোমো লাক্স সভ্যতা। এই গ্রহটি তার লাল বামন নক্ষত্রের চারদিকে আবর্তিত হচ্ছে। গ্রহটির এক পাশ সব সময় আলোকিত থাকে, আর অন্য পাশ অন্ধকার। আলোকিত অংশেই লুমেনরা বাস করে। বিশেষ কোনো মহাজাগতিক ঘটনা ছাড়া ওই অংশে কখনো রাত হয় না।
লুমেনদের বাহ্যিক গঠন অনেকটা মানুষের মতো হলেও এদের পরিপাকতন্ত্র নেই। তাই খাবার নিয়ে চিন্তা করা বা খাবার বানানোর পেছনে সময় খরচ করতে হয় না বলে তারা জীবনের অনেক সময় উদ্ভাবনী কাজে ব্যয় করতে পারে।
মিরালিন একজন প্রোগ্রামার। তবে শহরের মানুষ তাকে নিজের নামে কম চেনে। তারা ডাকে ‘মিরালিন কোর’ নামে। শহরের ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তার একটাই কাজ; মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাচীন জিনিস ও কোডের উৎস ঘেঁটে হারিয়ে যাওয়া তথ্য উদ্ধার করা।
একদিন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি নভোযানের মধ্যে কাজ করার সময় হঠাৎ মিরালিনের চোখে পড়ল একটি বড়, রহস্যময় চেম্বার। মিরালিন ধীরে ধীরে সেটি খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু খেয়াল করল, এটি কোনো সাধারণ কন্টেইনার নয়। সেন্সর দ্বারা সুরক্ষিত, পাসওয়ার্ড ছাড়া খোলা সম্ভব নয়। বহু চেষ্টা করেও সে চেম্বারটি সেদিন খুলতে পারল না।
মিরালিন পাসওয়ার্ডটি খুঁজে পেতে ধ্বংসপ্রাপ্ত নভোযানটিতে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে লাগল। এভাবে কয়েক দিন কেটে গেলেও কোনো সঠিক নির্দেশনা পাওয়া গেল না।
চারদিকে রাতের নীরবতা ও অন্ধকার নেমে এলেও ল্যাব-৪৬ এখনো নীলাভ আলোয় ভাসছে। আজ মিরালিন কাজ করছে তার গোপন ও মৌলিক সফটওয়্যার ChronaXloop-এ। সফটওয়্যারটির নাম ChronaXloop দেওয়ার একটি বিশেষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রয়েছে। সে আপাতত কারণটি কাউকে জানাতে চায় না।
নতুন একটা ফেজ ওপেন করে মিরালিন কিছু এলোমেলো ইনপুট নিচ্ছিল।
ইনপুট: ১০০% ৪ + ৪৬২
আউটপুট: ১০০
ইনপুট: ৫০০% ০ + ৬৮৩
আউটপুট: ৫০০
ইনপুট: ৯% ৮ + ২০১৬০
আউটপুট: ৯
অদ্ভুত ব্যাপার! ChronaXloop-এ তো % মানে মডুলাস অপারেশন, কিন্তু এখানে % চিহ্নের পরের মানগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হচ্ছে। এটা কি কোডের ভুল, নাকি ChronaXloop-এর নতুন ফেজের একটি অদ্ভুত নিয়ম? মিরালিন ভাবল, ব্যাপারটি নিয়ে এলিসানের সঙ্গে আলাপ করলে কেমন হয়! এলিসান হলো মিরালিনের এক পুরনো বন্ধু। সে-ও প্রাচীন জিনিসগুলো নিয়ে গবেষণা করে।
লুমেনদের বাহ্যিক গঠন অনেকটা মানুষের মতো হলেও এদের পরিপাকতন্ত্র নেই। তাই খাবার নিয়ে চিন্তা করা বা খাবার বানানোর পেছনে সময় খরচ করতে হয় না।
পরদিন মিরালিনকে ল্যাবে ঢুকতে দেখেই এলিসান বলে উঠল, ‘আরেহ মিরালিন, তুমি এসেছ? আমি তো তোমার কাছেই...’
না শুনেই মিরালিন বলতে শুরু করল, ‘শোনো, গত রাতে কী হয়েছে...’ ChronaXloop সফটওয়্যারটির কথা উল্লেখ না করেই সে কোডের রহস্য বলতে লাগল।
পুরো ব্যাপারটা এলিসান কতটুকু বুঝেছে কে জানে! কথা শেষ করে মিরালিন বলল, ‘তুমি কিছু একটা বলতে চেয়েছিলে এলিসান। বলো এখন।’
‘এখন তো ভুলে গেছি! তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।’
মিরালিন আবারও বলল, ‘নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তুমি আমার নাম ধরে ডেকে কথা বলা শুরু করেছিলে। কেউ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে কথা বলতে চাইলে শুরুতে নাম ধরে ডাকে। মনে করার চেষ্টা করো কথাটা।’
‘এখন মনে পড়ছে,’ এলিসান বলল, ‘নভোযান থেকে উদ্ধার হওয়া সেই বাক্সটি আমরা এক্স-রে করেছি। স্ক্যান দেখার পর বোঝা গেছে, ভেতরে কিছু মানুষসদৃশ জীব আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দিক থেকে পুরোপুরি মানুষ বলা যাবে না। মনে হচ্ছে এটি ছিল এক প্রকার ক্রায়োজেনিক বা সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন কক্ষে রাখা প্রাণী।’
‘ক্রায়োজেনিক মানে কী?’ মিরালিন প্রশ্ন করল।
‘ক্রায়োজেনিক বলতে আমরা বোঝাই এমন প্রযুক্তি, যেখানে জীবনকে প্রায় স্থির বা নিদ্রার মধ্যে রাখা হয়, খুব কম তাপমাত্রায় বা বিশেষ পরিবেশে। এতে মানবদেহ শতাব্দী ধরে জীবিত থাকতে পারে, যদিও আসলে ঘুমিয়ে থাকে।’
‘আর কন্টেইনারটিকে কার্বন ডেটিং করা হয়েছে। দেখা গেছে এটি প্রায় ৬০০ বছর আগের।’
মিরালিন অবাক হয়ে বলল, ‘মানে... কেউ ছয় শ বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল?’
‘হ্যাঁ,’ বলল এলিসান, ‘যদিও বাস্তবিক জীবনচক্র অনুযায়ী এটা সম্ভব নয়। ক্রায়োজেনিক বলেই সম্ভব হয়েছে।’
‘বলো কী! তাহলে তো বাক্সটি অবশ্যই দ্রুত খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।’
মিরালিন দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে খুবই দুর্বল অনুভব করতে লাগল। কোডের অদ্ভুত সমস্যাটা ঠিক করতে করতে বহুদিন ধরে আলো নেয়নি সে। তাই তার শরীরের ভেতরের উজ্জ্বল রেখাগুলো এখন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এনার্জি প্রায় শেষ। তাকে এখনই আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াতে হবে। নক্ষত্রের আলো না পেলে তার দেহ আর কাজ করবে না।
কিছু দূর পর পর নির্দিষ্ট একটা জায়গা রাখা আছে। সেখানে গিয়ে লুমেনরা গ্রহের লাল আলো শোষণ করে। মাটি সেখানে অদ্ভুত ঝকঝকে, আর চারপাশ খুব শান্ত। প্রতিদিন একটি বিশেষ সময়ে লাল নক্ষত্রের আলো সোজা সেই মাঠে পড়ে। তখন লুমেনরা সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। তেমনি মিরালিন সাইলোরা প্লাটো নামের একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
‘এখন মনে পড়ছে,’ এলিসান বলল, ‘নভোযান থেকে উদ্ধার হওয়া সেই বাক্সটি আমরা এক্স-রে করেছি। স্ক্যান দেখার পর বোঝা গেছে, ভেতরে কিছু মানুষসদৃশ জীব আছে।'
লুমেনদের স্নায়ুতন্ত্র ফোটনিক। খাদ্য নয়, লুমেনরা নক্ষত্রের আলো শোষণ করে বেঁচে থাকে। তাদের শরীর আলো ও বাতাস থেকে সরাসরি শক্তি শোষণ করতে পারে। বিশেষ একধরনের বায়োফোটনিক ক্রিস্টাল ত্বকের নিচে থাকে, যা নক্ষত্রের আলোকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করে। আলোর ছোঁয়ায় তার শরীর ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যেন সে আবার শক্তি ফিরে পাচ্ছে।
ল্যাবে বসে আবারও কোডটা নিয়ে কাজ করতে বসল মিরালিন। আবারও একবার ইনপুট দিয়ে চেক করল।
ইনপুট: ২০২৫% ২৮ + ৬৩
আউটপুট: ২০২৫
একই রকমই আসছে আউটপুট।
হঠাৎ মিরালিনের মাথা থেকে এক অদ্ভুত আলোক বিচ্ছুরণ শুরু হলো। লুমেনদের নিউরনের বদলে থাকে লুমিনন নামে এক বিশেষ আলোকসংবেদনশীল কোষ, যার মাধ্যমে তারা টেলিপ্যাথির মতো যোগাযোগ করতে পারে।
মিরালিন মুহূর্তেই বুঝতে পারল, কেউ তাকে দ্রুত লুমিনেথ কাউন্সিলে যেতে বলছে। লুমিনেথ কাউন্সিল হলো সেই প্রাচীন গবেষণা কেন্দ্র, যেখানে রহস্যময় প্রাচীন জিনিসপত্র এবং অজানা প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা হয়।
গবেষণাগারে গিয়েই জানতে পারে বাক্সের যেখানে পাসওয়ার্ড দেবে, তার পাশেই একটি সবুজ বাতি জ্বলছে। তার মানে, মডুলাস ভেঙে গিয়ে সিকিউরিটি কোড নিজ থেকে ওপেন হয়ে গেছে। ব্যাপারটি তার বুঝতে আর বাকি থাকে না। আর এটা হয়েছে তার কোডের কারণেই।
নভোযানের ওই কক্ষটি থেকে পাওয়া গেছে একটি থ্রিডি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিমুলেশন। তা থেকে জানা যায়, পৃথিবী নামে গ্রহে মানবসভ্যতা ধ্বংসের আগে বিজ্ঞানীরা স্পেসশিপে করে বিভিন্ন মানুষকে নতুন গ্রহের সন্ধানে পাঠিয়েছিলেন। এই স্পেসশিপটিও তেমন। নভোযানটি গ্রহাণুর ধাক্কায় ভেঙে গেছে। এ কক্ষটি সম্পূর্ণ অক্সিজেনসমৃদ্ধ ছিল, যেন বাক্সে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো উঠলে অক্সিজেন স্বল্পতা না থাকে। গবেষণা কেন্দ্রের লুমেনরা বুঝতে পারল, বাক্স থেকে মানুষটি যদি বেরিয়ে আসে, তাহলে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচবে না। কারণ ট্রাপিস্ট-১ই গ্রহে অক্সিজেন খুবই কম অথবা নেই বললেই চলে। লুমেনদের এই নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ তাদের অক্সিজেন লাগে না।
তাই গবেষণা কেন্দ্রে সম্পূর্ণ আগের মতো একটি কক্ষ বানানো হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে। ক্রায়ো-চেম্বারের স্বচ্ছ প্রাচীর ধীরে ধীরে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যেতে শুরু করল, আর তার ভেতর থেকে দেখা দিল নিস্তব্ধ এক তরুণীকে।
লুমিনেথ কাউন্সিল হলো সেই প্রাচীন গবেষণা কেন্দ্র, যেখানে রহস্যময় প্রাচীন জিনিসপত্র এবং অজানা প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা হয়।
দীর্ঘ ক্রায়ো-ঘুমে সেল-মেটাবলিজম প্রায় শূন্যে নেমে গেছে। হঠাৎ বুকের মাঝখানে ক্ষুদ্র স্পন্দন! জীবন্ত হার্টবিট! লুমেনদের সবাইকে থমকে দিল। মিরালিন অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘সে আলো-শক্তি নিচ্ছে না...এটা জৈব-শ্বাস।’ এলিসান বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘তাহলে সে মানুষ? প্রাচীন মানুষের মতো?’
হঠাৎ তরুণীর আঙুল কেঁপে উঠল। তার দৃষ্টি প্রথমে ঝাপসা, তারপর স্পষ্ট। চোখ খুলতেই দেখা গেল, মানুষের অপটিক্যাল রেটিনা, কালো মণি। লুমেনদের আলোকরেখা-মণ্ডিত মুখ দেখে তার শ্বাস হঠাৎ দ্রুত হয়ে উঠল। স্ক্যানার সক্রিয় হতেই অ্যালার্ম বেজে উঠল—‘মেটাবলিক অর্গান সিস্টেম শনাক্ত!’ হলোগ্রামে ভেসে উঠল লিভার, হৃৎপিণ্ড, পূর্ণ পরিপাকতন্ত্র, যা লুমেনদের জগতে বিলুপ্ত ইতিহাস! আরেকটি শিট দেখাল, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৪%, বায়োলজিক্যাল বয়স ২১!
পরিপাকতন্ত্রসম্পন্ন মানুষের অস্তিত্বের কথা চারদিকে প্রকাশিত হতেই পুরো হোমো লাক্স সভ্যতায় যেন আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেছে! পাশাপাশি গবেষণাগারে চলছে বহু শতাব্দী আগের মানুষটিকে নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা!
ল্যাবে এলিসান লুমেনদের টেলিপ্যাথিক সংকেত ব্যবহার করে তরুণীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার নাম কী? তোমার পরিচয় জানাও।’
‘আমার নাম আই। ২০৯৫ সালে আমি সহ আরও কিছু মানুষ পৃথিবী গ্রহ থেকে নভোযানে করে নতুন গ্রহের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। দীর্ঘ এত বছর ক্রায়ো-ঘুমের কারণে আমার তেমন কিছু মনে নেই।’ একটি ট্রান্সলেশন ডিভাইস ব্যবহার করে লুমিনন-নিউরাল ইন্টারফেসের মাধ্যমে আইয়ের কথা লুমেনরা বোঝার চেষ্টা করে।
আই আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কোথায় আছি?’
এলিসান বলল, ‘ট্রাপিস্ট-১ই নামে একটি গ্রহে রয়েছ। এখন ২৭০৩ সাল। এই গ্রহে মানবসভ্যতা এতই বদলে হয়ে গেছে, হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে হোমো লাক্সের তেমন কোনো মিল নেই।’
লুমিনেথ কাউন্সিলে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করল, আইয়ের শরীর এখনো মানুষের মতো। তার পরিপাকতন্ত্র সক্রিয়। লুমেনদের যেহেতু পরিপাকতন্ত্র নেই, তাদের খাবার নিয়ে কোনো ধারণা নেই। তবে তারা জানে, আইকে পৃথিবীর মতো আর্টিফিশিয়াল খাবার বানিয়ে দিলেই সে শক্তি পাবে, বেঁচে থাকবে। পাকস্থলীর নমুনা পরীক্ষা করে সেই ডেটার ভিত্তিতে তৈরি করা হলো সাপ্লিমেন্টযুক্ত ফুড, যা বহু শতাব্দী পর আইয়ের শরীরে শক্তির উৎস হলো।
এলিসান বলল, ‘ট্রাপিস্ট-১ই নামে একটি গ্রহে রয়েছ। এখন ২৭০৩ সাল। এই গ্রহে মানবসভ্যতা এতই বদলে হয়ে গেছে, হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে হোমো লাক্সের তেমন কোনো মিল নেই।’
এভাবে আইসোলেটেড রুমে আইয়ের কয়েক দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে লুমিনেথ কাউন্সিলের সব গবেষকের সঙ্গে আইয়ের পরিচয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে মিরালিন এবং এলিসানের সঙ্গে তার ভালোই সখ্য গড়ে উঠেছে।
‘আমরা ভেবেছিলাম মানবদেহ শুধু আমাদের থেকে ভিন্ন, কিন্তু এটা ঝুঁকি! অস্তিত্বগত ঝুঁকি!’ লুমিনেথ কাউন্সিলের ল্যাবে দুজন সিনিয়র বিজ্ঞানী আইয়ের দেহের হোলোগ্রাফিক স্ক্যানের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল। পাকস্থলী, রক্তনালি, জৈব কণিকা ম্যাট্রিক্সের মতো ভেসে উঠছিল পর্দায়। মানব পাকস্থলীর বিক্রিয়াগুলো অস্থির জৈব-কম্পন সৃষ্টি করছে। এগুলো সরাসরি আলো-চক্রের স্থির ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাচ্ছে। আই যদি এই গ্রহে দীর্ঘ সময় থাকে, এই অস্থির জৈব-কম্পন লুমেনদের শক্তিকোরে ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ তৈরি করবে। আলো-নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়বে। লুমেন সভ্যতা অচল হয়ে যাবে।
লুমিনেথ কাউন্সিলে হঠাৎ একটি ইমার্জেন্সি সভা ডাকা হয়। সেখানে সব প্রবীণ বিজ্ঞানী এক সিদ্ধান্তে পৌঁছান, প্রায় ৬০০ বছর আগের এই মানবী লুমেনদের অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তার কক্ষের অক্সিজেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। মৃত্যুর পর তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করা হবে এবং মস্তিষ্কের ওপর চালানো হবে গবেষণা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করেন মিরালিন, এলিসান এবং আরও কয়েকজন গবেষক।
মিরালিন এটি মেনে নিতে পারছে না যে আইকে মেরে ফেলা হবে। কী করা যেতে পারে, সে ভেবে পাচ্ছিল না। কক্ষের বাইরে তাকে বের করা সম্ভব নয় এবং অক্সিজেন স্বল্পতায় সে মারা যাবে। আবার কোনো নিরাপদ গ্রহ বা স্থানও এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেখানে আইকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।
লুমিনেথ কাউন্সিলে হঠাৎ একটি ইমার্জেন্সি সভা ডাকা হয়। সেখানে সব প্রবীণ বিজ্ঞানী এক সিদ্ধান্তে পৌঁছান, প্রায় ৬০০ বছর আগের এই মানবী লুমেনদের অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
মিরালিন তার সফটওয়্যারটির নাম ChronaXloop দিয়েছিল, কারণ Chronos শব্দ থেকে এসেছে Chrona। এর অর্থ সময়। আর X অজানা অথবা অসীম। লুপ একটি বৃত্ত। পুরোটার অর্থ দাঁড়িয়েছে—কোনো অসীম সময়ের বদ্ধচক্র। মিরালিন বহু দিন ধরে গোপনীয়তার সঙ্গে পোর্টাল ওপেন করার কাজ করছিল। বলা যায়, কাজ প্রায় শেষ।
ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে এলিসান তথ্য সংগ্রহ করেছে, পৃথিবী ধ্বংসের এত শতাব্দী পরে পৃথিবীতে আবারও প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। পৃথিবী প্রায় বাসযোগ্য। মিরালিন সিদ্ধান্ত নেয়, আইকে তার ওই পোর্টালটি ওপেন করে পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।
মিরালিন আইয়ের অক্সিজেননিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রবেশ করে। ইতিমধ্যে রুমে অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। আই অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করছে। মিরালিন আইকে তার আসন্ন বিপদের কথা জানিয়ে সতর্ক হতে বলল। এটাও জানাল, তাকে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর জন্য মিরালিন ব্যবস্থা করেছে।
পোর্টাল ওপেন করার জন্য তার ল্যাবে টাইমার সেট করে এসেছে মিরালিন। হঠাৎ আইয়ের কক্ষে দেয়ালের একপাশে কম্পন শুরু হয়। দেখা যাচ্ছে, দেয়ালের সবুজ লাইট প্যানেল জ্বলে উঠল। বাতাস যেন ভাঁজ হতে শুরু করল, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে সময়কে ভাগ করে ফেলছে। একটি গোল বৃত্ত দৃশ্যমান হলো এবং ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠল। রুমের দেয়ালে যেন একটি অদৃশ্য দরজা খুলে গেল।
যেহেতু প্রথমবারের মতো মিরালিন পোর্টালের ব্যবহার করছে, তাই নিরাপদে আইকে পৃথিবীতে পৌঁছে দিতে মিরালিন সিদ্ধান্ত নেয়, সে-ও সঙ্গে যাবে। পরে আবার ফিরে আসবে এখানে।
আই আর মিরালিন পোর্টালে প্রবেশ করতেই সেখানে আলো এবং বাতাসের যেন ঘূর্ণন শুরু হয়ে গেল। প্রতিটি অণু কাপতে থাকে। আই ধীরে ধীরে নতুন পৃথিবীর দিকে এগোতে থাকল। কিন্তু মিরালিন! আলোকনির্ভর লুমিনন কোষ পোর্টালের সময়-নিয়ন্ত্রিত লুপে আটকা পড়ে গেছে। মিরালিনের শরীরের আলো পোর্টালের কণার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পোর্টালেই অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল মিরালিন!