মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় আর আকর্ষণীয় বস্তুগুলোর একটি হলো ব্ল্যাকহোল। বাংলায় বলা হয় কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর। মহাকাশের এই রহস্যময় বস্তুর মহাকর্ষের টান এত প্রবল যে সেখান থেকে কোনোকিছুই বেরোতে পারে না। এমনকি মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতি যে আলোর, তাকেও আটকে রাখতে পারে কৃষ্ণগহ্বর। তাই সেখান থেকে কোনো আলোই আমাদের চোখে আসার সুযোগ পায় না। সে কারণে মহাকাশে একে দেখার কোনো উপায় নেই। আমাদের চোখেও তা অদৃশ্য। এসব কারণে একে অনেকে বলেন মহাকাশের কালো গর্ত। অন্ধকুপও বলেন কেউ কেউ।
কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার সূচনা হয়েছিল প্রায় আড়াই শ বছর আগে। সেই ১৭৮৩ সালের দিকে। সেবার নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন মিশেল একটা অদ্ভুত কল্পনা করেছিলেন। তিনি ভাবলেন, একটা নক্ষত্রের ভর যদি খুব বেশি হয় এবং তার মুক্তিবেগ যদি আলোর গতির চেয়েও বেশি হয়, তাহলে কী হবে?
মুক্তিবেগ হলো, একটা গ্রহ বা নক্ষত্র থেকে একটা বস্তুকে যে বেগে ওপরের দিকে ছুড়লে সেটি আর ওই গ্রহ বা নক্ষত্রে ফিরে আসবে না। বরং মহাকাশে চলে যাবে। পৃথিবীর মুক্তিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ১১ কিলোমিটার। তাই পৃথিবী থেকে কোনো বস্তু এই বেগে ওপরের দিকে ছুড়ে দিলে সেটা মহাকাশে চলে যায়। এভাবেই মহাকাশে রকেট পাঠানো হয়।
১৯৬১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মার্কিন পদার্থবিদ রবার্ট এইচ. ডিকি। তিনি আলোচনা করছিলেন ‘গ্র্যাভিটেশনালি কলাপসড স্টার’ বা মহাকর্ষের টানে চুপসে যাওয়া নক্ষত্র নিয়ে।
কাজেই মিশেলের প্রশ্নের উত্তরটা হলো, ওই নক্ষত্র থেকে কোনো আলো বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। ওই নক্ষত্রের ভেতরেই আলো আটকা পড়ায় কোনো আলো আমাদের চোখে পড়বে না। ফলে নক্ষত্রটা আমাদের চোখে অদৃশ্য। মিশেল এমন কাল্পনিক নক্ষত্রের নাম দেন ‘ডার্ক স্টার’। এর প্রায় ১৩৩ বছর পর, কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে চিন্তাভাবনা আরেক ধাপ এগিয়ে নেন জার্মান পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ড। তখন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মাত্রই প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত সেই তত্ত্বের সমীকরণ সমাধান করে কৃষ্ণগহ্বরের মতো একটা বস্তুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব বলে টের পান। একে বলা হলো ফ্রোজেন স্টার।
এরপর কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা ও লেখালেখি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই রহস্যময় বস্তুকে তাঁরা উল্লেখ করেছেন ‘গ্র্যাভিটেশনালী কলাপসড স্টার’, সংক্ষেপে ‘কলাপসড স্টার’। এর সোজা মানে হলো, প্রবল মহাকর্ষের টানে চুপসে যাওয়া নক্ষত্র। এই শব্দগুচ্ছটাই বিজ্ঞানীরা নিয়মিত ব্যবহার করেন। কিন্তু সেটিই একদিন হুট করে ব্ল্যাকহোল নামে বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন ব্ল্যাকহোল?
এর পেছনেও আছে দারুণ এক ইতিহাস। আর তার সঙ্গে জড়িত আছেন আমাদের বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলা।
২.
১৯৬১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মার্কিন পদার্থবিদ রবার্ট এইচ. ডিকি। তিনি আলোচনা করছিলেন ‘গ্র্যাভিটেশনালি কলাপসড স্টার’ বা মহাকর্ষের টানে চুপসে যাওয়া নক্ষত্র নিয়ে। মানে যেসব নক্ষত্র নিজেদের প্রবল মহাকর্ষের টানে চুপসে গিয়ে ছোট হয়ে যায়। এই বস্তুগুলোকে বোঝাতে ডিকি বারবারই একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উদাহরণ দিচ্ছিলেন। সেটি হলো ‘ব্ল্যাকহোল অব ক্যালকাটা’। কিন্তু কলকাতার এই ব্ল্যাকহোল কী?
সেটা জানতে আজ থেকে ২৬৯ বছর পেছনে ফিরে যেতে হবে। সেই নবাব সিরাজ উদ-দৌলার যুগে।
দুপক্ষের বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধের পর একপর্যায়ে হলওয়েলও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ইতিহাসবিদরা বলেন, এ সময় নবাবের বিজয়ী সেনাবাহিনির কিছু সদস্য লুটপাট করলেও তাঁর সৈন্যরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।
ঘটনার সূত্রপাত ১৭৫৬ সালের দিকে। ভারতের কলকাতায় ততদিনে ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে ইংল্যান্ড থেকে আসা ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নিজেদের বাণিজ্য রক্ষার জন্য কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ বানিয়েছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু বাংলার নবাব, সিরাজ উদ-দৌলা এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্রিটিশরা তা মোটেও পাত্তা দিল না। কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে দুর্গের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে থাকে তারা। নির্দেশ অমান্য করার অপরাধে সিরাজ উদ-দৌলার বাহিনী সেই দুর্গ অবরোধ করে।
এর জেরে যুদ্ধ শুরু হয় দুপক্ষের মধ্যে। দুদিন পর ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক নিশ্চিত হন, নবাবের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ১৯ জুন দুর্গের ইংরেজ বাসিন্দাদের বড় অংশ নিয়ে ফুলতা পালিয়ে যান তিনি। ইউরোপীয় ও আর্মেনীয় সেনা ছাড়াও প্রায় ১৭০ জন শ্বেতাঙ্গ সৈন্যের একটি দল নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে থেকে যান ইংরেজ সেনাপতি জে. জেড হলওয়েল।
দুপক্ষের বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধের পর একপর্যায়ে হলওয়েলও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ইতিহাসবিদরা বলেন, এ সময় নবাবের বিজয়ী সেনাবাহিনির কিছু সদস্য লুটপাট করলেও তাঁর সৈন্যরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। এমনকি হলওয়েলের আবেদনের প্রেক্ষিতে নবাব তাঁর নিরাপত্তার আশ্বাসও দেন। তবে ২০ জুন রাতের দিকে কিছু বন্দি ইউরোপীয় সৈন্য নবাব বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে বসে। এতে ক্ষুব্দ হয়ে আক্রমণকারী ইউরোপীয় সৈন্যদের আটক রাখার নির্দেশ দেন নবাব সিরাজ উদ-দৌলা।
ব্রিটিশদের দাবি, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরের ছোট্ট এক কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করা হয়েছিল। এরপর হলওয়েল অভিযোগ করেন, ইউরোপীয় বন্দিদের একটিমাত্র ক্ষুদ্র জানালাবিশিষ্ট ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থের একটি কক্ষে আটকে রাখেন নবাব।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বর্ণনা মতে, জুন মাসের সেই অমানবিক পরিবেশে প্রচণ্ড গরমে সেই রাতে ১২৩ জন ইংরেজের মৃত্যু হয়। অনেকে অবশ্য সংখ্যাটা বাড়িয়ে ২০০ জনের মৃত্যুর কথাও দাবি করেন। ইতিহাসে এ ঘটনাটি ‘অন্ধকুপ হত্যা’ নামে পরিচিত। একেই ইংরেজিতে বলা হয় ‘ব্ল্যাকহোল অব ক্যালকাটা’। মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট থাকলেও, ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন, মাত্র ৬৪ জনকে বন্দী করা হয়েছিল। আর বেঁচে ছিলেন মাত্র ২১ জন। এ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে কলকাতার সেন্ট জনস চার্চে ১৯০১ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভও বানায় ব্রিটিশরা।
প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। সে বছর অ্যান উইন নামে এক সাংবাদিক ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়াম নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন।
তবে বর্তমানে অনেক ইতিহাসবিদ অন্ধকূপ হত্যা কাহিনীর বেশির ভাগই অসত্য, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বলে মনে করেন। কারণ এত ছোট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখার অবাস্তব ও আজগুবি এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে হেয় করতে সম্ভবত এই কাহিনী রচিত ও প্রচারিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ব্রিটিশদের এ ষড়যন্ত্রের জবাবে সিরাজদ্দৌলা নামের এক গবেষণামূলক বই লিখেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় [১৮৬১-১৯৩০ খ্রি.] (এই লিংকে পড়তে পারেন: https://tinyurl.com/y4pcbwyc)। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত এ বইয়ে তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে ব্রিটিশদের দাবি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে সেই ষড়যন্ত্র ঠেকানো যায়নি। পশ্চিমা বিশ্বে ব্রিটিশদের প্রচারিত কাহিনিই প্রচলিত। সে কারণেই মহাকাশের নরকতূল্য বস্তু ব্ল্যাকহোলের নামকরণ হয়েছে এ ঘটনাকে স্মরণ করে।
৩.
১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ব্ল্যাকহোল শব্দটি বিভিন্ন বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট হেনরি ডিকি। এর মধ্যে টেক্সাসে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মেলনের কথা তো আগেই বলেছি। কলকাতার অন্ধকূপ হত্যার সেই ভয়াবহ ঘটনাকে ডিকি ব্যবহার করেছিলেন মহাকর্ষের কারণে পদার্থের সংকুচিত হওয়ার ভয়াবহতা বোঝাতে। তাঁর কাছে, মহাবিশ্বের এই চুপসে যাওয়া তারাগুলো যেন সেই ছোট, অন্ধকার জেলখানার মতো, যা সবকিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়।
প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। সে বছর অ্যান উইন নামে এক সাংবাদিক ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়াম নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন। সায়েন্স নিউজ লেটার পত্রিকায় ‘ব্ল্যাক হোলস ইন স্পেস’ শিরোনামে সেই লেখা ছাপা হয়েছিল। সেটাই ছিল ছাপার অক্ষরে শব্দটির প্রথম ব্যবহার।
তবে বর্তমানে অনেক ইতিহাসবিদ অন্ধকূপ হত্যা কাহিনীর বেশির ভাগই অসত্য, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বলে মনে করেন। কারণ এত ছোট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখার অবাস্তব ও আজগুবি এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে।
তবে, ‘ব্ল্যাকহোল’ নামটি সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল মার্কিন পদার্থবিদ জন হুইলারের। কথিত আছে, ১৯৬৮ সালে এক সেমিনারে ‘মহাকর্ষীয়ভাবে সম্পূর্ণ চুপসে যাওয়া বস্তু’ নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। তাঁকে বারবারই এই দীর্ঘ শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করতে হচ্ছিল। হঠাৎ তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, এই লম্বা নামটি বলা খুব ঝামেলার। তখন শ্রোতাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘ব্ল্যাকহোল শব্দটা কেমন হয়?’
হুইলারের কাছে শব্দটি দারুণ মনে হলো। কারণ এটি সংক্ষিপ্ত, সহজ ও বেশ আকর্ষণীয়। ব্যস! এরপর থেকে ওই শব্দটাই বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং প্রবন্ধে ব্যবহার করতে শুরু করেন হুইলার। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সায়েন্টিস্ট জার্নালে ব্ল্যাকহোল শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি। জার্মানির জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিটার কাফকা ১৯৬৯ সালে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধে শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের মতো বিজ্ঞানীরাও ১৯৭১ সালের মধ্যে শব্দটি ব্যবহার করতে থাকেন। এরপর থেকেই কলকাতার অন্ধকূপ জ্যোতির্বিজ্ঞান, তথা বিজ্ঞানের জগতে পাকাপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নেয়।