নবম গ্রহের রহস্য

শিল্পীর কল্পনায় নবম গ্রহ, দূরের উজ্জ্বল তারাটি আমাদের সূর্যছবি: ব্রিটানিকা

একটা ভজকট দেখা দিয়েছে আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের দিকে। নেপচুনের কক্ষপথ পেরিয়ে যে বিস্তৃত অঞ্চলে প্রচুর ছোটখাটো বস্তুর ভিড়, সেখানে কোথাও একটা জটলা পাকাচ্ছে। অন্তত সে রকম কিছু হচ্ছে বলে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর ধারণা। তাঁদের মতে, এ জন্য দায়ী এক অনাবিষ্কৃত গ্রহ। সৌরমণ্ডলের ‘নবম গ্রহ’!

এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে বিজ্ঞানীমহলে। এই গ্রহ সত্যিই আছে কি না, তার ছবি তোলা যাবে কি না, এ নিয়ে একদল বিজ্ঞানী গবেষণায় ব্যস্ত। আরেক দলের মতে, নবম গ্রহের চিন্তাটা সোনার হরিণের মতো। তার পেছনে ধাওয়া করা বৃথা।

সে যা–ই হোক, অনেক বছর পর আবার যেন সৌরমণ্ডল নিয়ে গবেষণায় তাত লেগেছে। গ্রহ নিয়ে বেড়েছে আগ্রহ। লেগেছে রোমাঞ্চের ছোঁয়া। রহস্যের খোঁজে যে সব সময় কৃষ্ণগহ্বর আর বিগ ব্যাংয়ের পেছন ধাওয়া করতে হবে, তেমন নয়। কে জানে, হয়তো সৌরমণ্ডলের সীমার মধ্যেই এক বিশাল আবিষ্কারের সম্ভাবনা আছে! (অনেকে অবশ্য এখানেও কৃষ্ণগহ্বরের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন—এই নবম গ্রহ যদি ছোট কৃষ্ণগহ্বর হয়, তাহলে কী হবে, সেই চিন্তায় মশগুল তাঁরা!)

কিসের জটলা

নেপচুনের বাইরে সৌরমণ্ডলের অবস্থা কেমন যেন ছন্নছাড়া। সেখানে অগুনতি বস্তুপিণ্ডের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যেগুলোকে গ্রহ বলতে তাঁরা নারাজ। যেমন প্লুটো। হায়, প্লুটোকে এককালে গ্রহ বলে গণ্য করা হতো, কিন্তু যখন দেখা গেল তার মতো আরও অনেক বস্তুপিণ্ড সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন গ্রহের সংজ্ঞা না পাল্টে তাকে গ্রহের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

অনেকের মতে, এটা প্লুটোর মতো একদা-গ্রহের প্রতি নিগ্রহ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু তার কারণ ছিল। না হলে আরও বেশ কয়েকটা বস্তুকে গ্রহের মর্যাদা দিতে হতো। আর প্লুটোর কক্ষপথটাও কেমন বেয়াড়া ছিল। মাঝেমধ্যে নেপচুনের কক্ষপথের ভেতর ঢুকে পড়ত।

একটি হলেও নাহয় ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা যেত; কিন্তু যখন দেখা গেল সেখানকার আরও অনেক বস্তুর রকমসকমই এই, তখন বোঝা গেল, আসলে প্লুটো অন্য গ্রহদের মতো নয়, সেটি অন্য দলের সদস্য। এই নেপচুন-পারের (বিজ্ঞানীদের ভাষায়, Trans-Neptunian objects) বস্তুগুলোর গঠনও আলাদা।

আরও পড়ুন
প্লুটোকে এককালে গ্রহ বলে গণ্য করা হতো, কিন্তু যখন দেখা গেল তার মতো আরও অনেক বস্তুপিণ্ড সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন গ্রহের সংজ্ঞা না পাল্টে তাকে গ্রহের তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

ইউরেনাস-নেপচুনের মতো গ্যাসে মোড়া নয়; বরফ ও পাথর দিয়ে তৈরি। এগুলো যদি কোনোক্রমে ধাক্কা খেয়ে সৌরমণ্ডলের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে, তাহলে সেই বরফ বাষ্প হয়ে লেজের মতো দেখা দেবে, অর্থাৎ এগুলো ধূমকেতুর আত্মীয়গোছের। গ্রহদের বংশভুক্ত নয়।

এদের মধ্যে প্লুটো এবং আরও কয়েকটি বস্তু বেশ বড়সড়। এসব বস্তুকে একেবারে বেনামি না রেখে দিয়ে এদের জন্য একটা আলাদা বর্গ তৈরি করা হয়েছে—নাম দেওয়া হয়েছে বামন গ্রহ। এমন প্রায় ৫০০টি বামন গ্রহ আছে সৌরমণ্ডলে। (সেগুলো যে সব নেপচুন-পারের বস্তু, তা নয়। এর মধ্যে কয়েকটি হলো মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝামাঝি গ্রহাণু।)

কিন্তু ওই অঞ্চলের অন্য অনেক বস্তুর কোনো বিশেষ নাম নেই। কারণ, সেগুলোর তালিকা বেশ লম্বা—সংখ্যায় দুই হাজারের বেশি। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি এমন বড় যে তাদের নিজস্ব উপগ্রহ আছে। ছোটখাটো জমিদার বলা যায়, কিন্তু গ্রহদের মতো মনসবদারি নেই।

এই নেপচুন-পারের বস্তুগুলোর মধ্যে কয়েকটি একেবারে পেছনের সারির। এদের কক্ষপথ পৃথিবীর তুলনায় ১৫০ গুণ বড় বা তার বেশি। অর্থাৎ একবার সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসতে এদের অন্তত দুই হাজার বছর লাগে। সৌরমণ্ডলের ক্লাসে এরা ব্যাকবেঞ্চার। আর ক্লাসে পেছনের সারির দুষ্টুমিতে ভরা ছাত্রদের মতো সৌরমণ্ডলের এই প্রান্তিক বস্তুগুলো নিয়েও বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। এদের কাণ্ডকারখানা দেখেই বিজ্ঞানীদের মনে নবম গ্রহের ধারণা হয়েছে।

আরও পড়ুন
ইউরেনাস-নেপচুনের মতো গ্যাসে মোড়া নয়; বরফ ও পাথর দিয়ে তৈরি। এগুলো যদি কোনোক্রমে ধাক্কা খেয়ে সৌরমণ্ডলের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে, তাহলে সেই বরফ বাষ্প হয়ে লেজের মতো দেখা দেবে।

সেডনা-রহস্য

এমন একটি প্রান্তিক বস্তুর নাম সেডনা। সাইজে প্লুটোর অর্ধেক এই বস্তুকে বামন গ্রহের তালিকায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তার কক্ষপথটি কিম্ভূতকিমাকার। অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথের সঙ্গে তুলনা করলে এর এই অদ্ভুত আকারটা বুঝতে সুবিধা হয়। যদি পৃথিবী ও সূর্যের অন্তর্বর্তী দূরত্বকে একক ধরা হয় (একে বলা হয় অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, সংক্ষেপে এইউ; বাংলায় বলতে পারি সৌরজাগতিক একক), তাহলে সেই হিসাবে নেপচুনের কক্ষপথ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ একক, অর্থাৎ পৃথিবীর তুলনায় সূর্য থেকে ৩০ গুণ দূরে অবস্থিত। তার কক্ষপথ মোটামুটি বৃত্তাকার—একটু এদিক-সেদিক হয়, ২৯ দশমিক ৮ থেকে ৩০ দশমিক ৩—এটুকুমাত্র হেরফের। বলতে গেলে প্রায় ১ শতাংশের তফাত।

কিন্তু সেই তুলনায় সেডনার কক্ষপথ বেশ বেঢপ আকারের। তার কক্ষপথ কখনো ৭৬ একক আর কখনো ৯৪০ এককে পৌঁছায়। অর্থাৎ একদিকে লম্বা, অন্যদিকে চ্যাপটা। অনেকটা পটোলের মতো চেহারা তার। এই মুহূর্তে সূর্য থেকে সেডনার দূরত্ব ৯০ একক। সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছাবে ২০৭৫ সাল নাগাদ। আগেরবার যখন সেডনা এখানে এসেছিল, অর্থাৎ ১২ হাজার বছর আগে, তখন ছিল মানব ইতিহাসের প্রস্তরযুগ। পৃথিবীর শেষ তুষারযুগের সময়। গুহামানবদের যুগে।

অনুমান করা হয়, নবম গ্রহটি আমাদের সৌরজগতের একটি দূরবর্তী এবং বিশাল গ্রহ
ছবি: নাসা

এর গতিপথ সত্যি অদ্ভুত। একদিকে চলার সময় তার দৃষ্টি উদাসী, সুদূর পিয়াসী, আবার অন্যদিকে চলার সময় সে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে যেতে চায় অফিসফেরতা কেরানির মতো। গ্রহদের গতিপথ থেকে একেবারে আলাদা। গ্রহগুলোর কক্ষপথও উপবৃত্তাকার। কিন্তু সেডনার মতো বেঢপ নয়। একঝলক দেখলে বৃত্ত বলেও মনে হতে পারে। অর্থাৎ গ্রহদের চলার ক্ষেত্রেও উড়ু উড়ু ভাব আছে, কিন্তু খুব সামান্য। ওই ১ শতাংশের মতো। কিন্তু সেডনার কথা আলাদা। ঘরের বাঁধনে থেকেও তার দৃষ্টি জানালার বাইরে। নষ্টনীড়-এর চারুলতার মতো। তার ঘর যে এখনো কেন ভাঙেনি, সেটাই রহস্য।

অর্থাৎ প্রশ্ন হলো, এমন একটি নেহাত ছোট নয় বামন গ্রহ পৃথিবীর তুলনায় ৯৪০ গুণ দূরত্বে পৌঁছে যাচ্ছে, অথচ সৌরমণ্ডল থেকে ছিটকে পড়ছে না কেন? সেখানে গিয়ে সেডনার গতিবেগ কম হওয়ার কথা এবং সৌরমণ্ডলের বাইরের হাতছানিও আছে। সেখানে অন্য কিছুর আকর্ষণে আটকা পড়তেই পারত।

আরও পড়ুন
সেডনার কক্ষপথ বেশ বেঢপ আকারের। তার কক্ষপথ কখনো ৭৬ একক আর কখনো ৯৪০ এককে পৌঁছায়। অর্থাৎ একদিকে লম্বা, অন্যদিকে চ্যাপটা। অনেকটা পটোলের মতো চেহারা তার।

যেন দুষ্টুমি করতে গিয়ে পেছনের সারির এক ছাত্র ক্লাসের দরজার সামনে দৌড়ে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে, অথচ বাইরে বেরিয়ে পড়ছে না! তাকে আটকাচ্ছে কে? সৌরমণ্ডলের কোনো অদৃশ্য সদস্য? এতে নেপচুনের হাত থাকতে পারে না। কারণ, দেখা গেছে, সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসার সময়ও সেডনা নেপচুন থেকে প্রায় আড়াই গুণ দূরে থাকে।

প্রথমে এ–ও ভাবা হয়েছিল, সেডনার এই বেয়াড়া কক্ষপথের জন্য নিকটবর্তী কোনো নক্ষত্র দায়ী। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, সংক্ষেপে ক্যালটেকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ও তাঁর সহকারীদের আবিষ্কার ছিল এই সেডনা। ব্রাউন এবং আরও দুই বিজ্ঞানী ডেভিড রাবিনোভিৎস ও চ্যাডউইক ট্রহিও মিলে একটি প্রস্তাব খাড়া করেছিলেন। সৌরমণ্ডলের জন্মের সময় কল্পনা করা যাক, যখন সূর্যের সহোদর নক্ষত্রগুলো কাছাকাছি ছিল।

নক্ষত্র কখনোই একটি করে জন্ম নেয় না। একসঙ্গে কয়েকটি নক্ষত্রের উৎপত্তি হয়। সূর্যের সঙ্গে জন্মানোর পর সেই নক্ষত্রগুলো এখন অনেক দূরে চলে গেছে, কিন্তু সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলো যখন ধীরে ধীরে সঠিক আকার নিচ্ছিল, তখন তারা কাছেপিঠেই ছিল। এমনও হতে পারে যে সেই নক্ষত্রগুলোর একটির মহাকর্ষের আকর্ষণে সেডনার কক্ষপথ এমন বেখাপ্পা হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সেডনার কক্ষপথ হয়তো আসলে সৌরমণ্ডলের জন্মমুহূর্তের এক আঘাতের চিহ্ন।

সম্প্রতি এমন একটি নক্ষত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে, যেটি হয়তো সূর্যের সহোদর ছিল। তার পোশাকি নাম—এইচডি ১৬২৮২৬ (HD 162826)। এখন তার দূরত্ব ১১০ আলোকবর্ষ। তার ভর, আয়তন ও আলোর রং মোটামুটি সূর্যের মতোই এবং নিজস্ব এক গ্রহমণ্ডল আছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু ২০১২ সালে ব্রাজিলের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী রডনি গোমেজ আরেক প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, সেডনার কক্ষপথের জন্য সৌরমণ্ডলেরই কোনো অজানা গ্রহ দায়ী। কারও উড়ু উড়ু গতিপথের জন্য সব সময় যে বাইরের ভিলেনের কথা ভাবতে হবে, এমন নয়; পরিবারের অমলই যথেষ্ট।

আরও পড়ুন
সম্প্রতি এমন একটি নক্ষত্রের খোঁজ পাওয়া গেছে, যেটি হয়তো সূর্যের সহোদর ছিল। তার পোশাকি নাম—এইচডি ১৬২৮২৬। এখন তার দূরত্ব ১১০ আলোকবর্ষ।

সেডনার অনুচরদের গতিবিধি

এ প্রশ্নের সূত্র ধরে বিজ্ঞানীদের নজর পড়েছে আরও প্রায় আধডজন প্রান্তিক বস্তুর গতিবিধির ওপর। সেখানে ধরা পড়েছে আরেকটি রহস্য। ২০১৬ সালে মাইকেল ব্রাউন ও তাঁর এক সহকর্মী কন্সট্যান্টিন ব্যাটিগিন লক্ষ করেন, সেডনা এবং আরও পাঁচটি প্রান্তিক বস্তুর কক্ষপথের মধ্যে নজর কাড়ার মতো একটি মিল আছে। আমরা যদি কোনো উপবৃত্তের কথা ভাবি, তাহলে তার চেহারা হবে একদিকে চ্যাপটা এবং অন্যদিকে লম্বা। দেখা গেল, এই ছয়টি বস্তুর কক্ষপথের লম্বা দিকগুলো আকাশের এক দিকে মুখ করে আছে।

শুধু তা–ই নয়, এদের গতিবিধির মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য। সৌরমণ্ডলে গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি একটি সমতলে অবস্থিত। গ্রামোফোন রেকর্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। গ্রহগুলোর কক্ষপথ যেন গ্রামোফোন রেকর্ডের একেকটা খাঁজের মতো। তফাত শুধু এই যে কক্ষপথগুলো বৃত্তাকার নয়। তবে এই তফাতের পরিমাণ খুব কম।

কিন্তু সেডনার অনুচর সেই বস্তুগুলোর কক্ষপথ অন্য রকম। সেগুলো যেন এই গ্রামোফোন রেকর্ডের নিচ থেকে ওপরে যায়, আবার ফিরে আসে। মজার কথা হলো, সেই বস্তুগুলো যখন সূর্যের কাছে আসে, তখন সব কটিই নিচ থেকে ওপরে ওঠে (এখানে অবশ্য নিচ-ওপর ব্যাপারটা আপেক্ষিক—বলা উচিত, সূর্যের কাছে এসে তাদের গতিবিধি এক রকম)। ওঠানামার কায়দায় মিল, আর কক্ষপথগুলো এক দিকে মুখ করে আছে।

সম্ভাব্য নবম গ্রহের কল্পিত কক্ষপথ। এর প্রভাবেই কি সেডনা ও কাছের বামন গ্রহগুলো এমন বেহাল?

ব্যাটিগিন ও ব্রাউন ভেবেছিলেন, এটা হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু অঙ্ক করে দেখা গেল, সেটার সম্ভাবনা এক লাখ ভাগের সাত ভাগ। অর্থাৎ অতি নগণ্য। আর যদি কোনো কারণে এমন কাঁধে কাঁধ মেলানো কক্ষপথ শুরুর দিকে থেকেও থাকে, সেটা বেশি দিন থাকার কথা নয়। ১০ কোটি বছরের মধ্যে এলোপাতাড়ি ছড়িয়ে পড়ার কথা। কারণ, সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে আকর্ষণের টানাপোড়েনে এসব কক্ষপথ পাল্টাতেই থাকে।

তার মানে এর পেছনে কোনো বিশেষ প্রক্রিয়া কাজ করছে। তাদের প্রথমেই মনে হয়েছিল, হয়তো কোনো বড় অথচ অদৃশ্য গ্রহের আকর্ষণে এমন জটলা বাঁধছে। এ রকম ঘটনার উদাহরণ হরদম পাওয়া যায়। সৌরমণ্ডলেই আছে। এ রকম গ্রহকে বলে ‘রাখাল গ্রহ’। এদের মহাকর্ষের টানে অন্য কয়েকটি বস্তু বিশেষ কক্ষপথে চলে। তাদের চলার পথ ঠিক করে দেয়। মহাকর্ষের অদৃশ্য লাগাম টেনে রাখে।

তখন তাঁরা অঙ্ক করে বের করলেন এমন রাখাল গ্রহ কত বড় হওয়া উচিত এবং তার নিজস্ব কক্ষপথই–বা কেমন হওয়া দরকার। তাঁদের মতে, এই ‘নবম গ্রহ’ পৃথিবীর তুলনায় অনেক বড়, ৫ থেকে ২০ গুণ ভারী। তবে তার কক্ষপথ অন্য ৮টি গ্রহের মতো টেবিলের ওপর বসবে না—২০ ডিগ্রি কাত হয়ে থাকবে। আর তার আকার বেশ বেঢপ হওয়ার কথা। সূর্যের কাছাকাছি থাকার সময় তার দূরত্ব হবে পৃথিবী-সূর্যের দূরত্বের মাপে ৩০০ একক বা ৩০০ এইউ, আর সবচেয়ে দূরে পৌঁছানোর সময় সেটা হবে হাজার এককের বেশি।

আরও পড়ুন
সৌরমণ্ডলে গ্রহগুলোর কক্ষপথ মোটামুটি একটি সমতলে অবস্থিত। গ্রামোফোন রেকর্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়। গ্রহগুলোর কক্ষপথ যেন গ্রামোফোন রেকর্ডের একেকটা খাঁজের মতো।

চাক্ষুষ প্রমাণ

কিন্তু শুধু প্রস্তাব দিলেই প্রমাণিত হয় না; হাতেনাতে তার ছবি তুলতে হবে। অর্থাৎ দুরবিনে তার থেকে বিকিরিত আলো ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিক দিয়ে সৌরমণ্ডলের প্রান্তিক বস্তুগুলোর দর্শন পাওয়া সহজ নয়। অমন কোনো বস্তুর দূরত্ব দুই গুণ বাড়িয়ে দিলে তার ঔজ্জ্বল্য কমে যায় ষোলো গুণ। প্রথমত, তার তাপমাত্রা কমে যাবে চার গুণ। কারণ, সূর্যের তাপেই তো তার উষ্ণতা। দ্বিতীয়ত, সেই তাপমাত্রায় বস্তুটি থেকে যত আলো বিকিরিত হবে, সেটার চার ভাগের এক ভাগ ধরা পড়বে পৃথিবীতে। কারণ, আলোর উৎসটাই দূরে।

এই হিসাব করলে দেখা যায়, নবম গ্রহটি যদি সূর্য থেকে ৬০০ সৌরজাগতিক একক দূরে থাকে—অর্থাৎ নেপচুন থেকে ২০ গুণ দূরে—তাহলে নেপচুনের তুলনায় তার ঔজ্জ্বল্য হবে দেড় লাখ ভাগের এক ভাগ! সেটি যখন সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে পৌঁছাবে, তখন তাকে নেপচুনের তুলনায় দশ লাখ ভাগের এক ভাগ উজ্জ্বল দেখাবে। এমন ক্ষীণ আলোর উৎস কি আদৌ আধুনিক দুরবিনের পক্ষে ধরা সম্ভব?

সূর্যের চারদিকে তার একবার ঘুরে আসতে সময় লাগবে ১০ থেকে ২০ হাজার বছর। ফলে যদি এমন হয় যে এই মুহূর্তে সেটি সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে রয়েছে, তাহলে সূর্যের কাছাকাছি আসতে, অর্থাৎ পৃথিবীর দুরবিনের দৃষ্টিগোচর হতে হতে বেশ কয়েক হাজার বছর লেগে যাবে।

তবু বিজ্ঞানীরা দমে নেই। কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর কয়েকটা বড় দুরবিনের সাহায্যে নবম গ্রহের খোঁজ চলছে। যেমন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত জাপানিদের নির্মিত বিশাল সুবারু দুরবিন এই গবেষণায় শামিল হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার দেখা পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন
নবম গ্রহটি যদি সূর্য থেকে ৬০০ সৌরজাগতিক একক দূরে থাকে—অর্থাৎ নেপচুন থেকে ২০ গুণ দূরে—তাহলে নেপচুনের তুলনায় তার ঔজ্জ্বল্য হবে দেড় লাখ ভাগের এক ভাগ!

মরীচিকা নয় তো

অন্য বিজ্ঞানীরা অবশ্য এই নবম গ্রহের প্রস্তাবটাকে আরেকটু খতিয়ে দেখতে চান। তাঁদের মতে, ব্রাউন ও ব্যাটিগিনের এই প্রস্তাবের মূলে রয়েছে কয়েকটা প্রান্তিক বস্তুর কক্ষপথের জটলা পাকানো। কোনোরকমের দৃষ্টিবিভ্রম কি এই জটলা পাকানোর সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী? ধরা যাক, তাঁরা কোনো কারণে শুধু বিশেষ কয়েকটি প্রান্তিক বস্তুর দিকে নজর দিয়েছেন, যেগুলোর কক্ষপথ কাঁধে কাঁধ মেলানো। হয়তো আরও অনেক বস্তু আছে সেই অঞ্চলে, যেগুলোর কক্ষপথ একেবারে অন্য রকম এবং হয়তো সেই বস্তুগুলো তাঁদের নজরে পড়েনি।

কে জানে, হয়তো কোনো কারণে দুরবিন সেদিকে তাক করা হয়নি। অনেক সময় আকাশ মেঘলা থাকার জন্য আকাশের কিছু কিছু অংশ বিজ্ঞানীদের অধরা থেকে যায়। অর্থাৎ এমনও তো হতে পারে যে সৌরমণ্ডলের প্রান্তিক বস্তুগুলোর প্রকৃত শুমারি এখনো করা হয়ে ওঠেনি। তাই হাতে গোনা কয়েকটা বস্তুর বিশেষ কক্ষপথ দেখে অবাক লাগছে। অন্য প্রান্তিক বস্তুর কক্ষপথ দেখলে এমনটা মনে হতো না।

ভোটের পর যখন ফোন করে লোকজনের কাছে জানতে চাওয়া হয় তাঁরা কাকে ভোট দিয়েছেন এবং সেই তথ্য থেকে আন্দাজ করা হয় কে জিততে চলেছেন, তখন সেই পরিসংখ্যানে কিছু সাবধানতা অবলম্বন না করলে আন্দাজ ভুল হতে পারে। তখন দেখা উচিত, যাঁদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তাঁদের বয়স, বাসস্থান, কাজকর্মের ধরন, ধর্ম, জাত ইত্যাদির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ বৈচিত্র্য রয়েছে কি না। তা না হলে সীমিত ও অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান থেকে যা আন্দাজ পাওয়া যাবে, সেটি হবে পক্ষপাতদুষ্ট।

সৌরমণ্ডলের প্রান্তিক বস্তুর কক্ষপথের হিসাবে কি সে রকম কিছু ফাঁক রয়ে গেছে? তাহলে সেই হিসাব বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী এই যুক্তি নিয়ে তর্কে নেমেছেন।

যেমন ‘আউটার সোলার সিস্টেম অরিজিন সার্ভে’র সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা। তাঁরা চেষ্টা করছেন যাতে আকাশের প্রতিটি অংশ আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সৌরমণ্ডলের বাইরের দিকের বস্তুগুলোর বিশদ তালিকা তৈরি করা যায়। এখনো তাঁরা আকাশের মাত্র ৫ শতাংশ খুঁজে দেখেছেন। তবু তাঁদের সন্দেহ হচ্ছে যে ব্রাউন-ব্যাটিগিনের তালিকা অসম্পূর্ণ। এদের গতিবিধি থেকে সেখানকার সার্বিক অবস্থা আন্দাজ করে নেওয়াটা পক্ষপাতদুষ্ট হবে। ভোটের পর এক্সিট পোলের পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তির মতো।

আরেক দল বিজ্ঞানী, যাঁরা মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও নেমে পড়েছেন এ বিতর্কে। তাঁদের লক্ষ্য হলো সুদূর মহাবিশ্বের নক্ষত্রের বিস্ফোরণ, যার নাম সুপারনোভা। এসব সুপারনোভার ঔজ্জ্বল্য থেকে তাঁরা মহাবিশ্বের প্রসারণের হার বাড়ছে, না কমছে, নাকি একই রকম থাকছে, সেটা জানার চেষ্টা করছেন।

সেই গবেষণায়ও আকাশের বিভিন্ন অংশ তন্নতন্ন করে দেখতে হচ্ছে। দুরবিনে তোলা ছবিতে দূরের নক্ষত্রের বিস্ফোরণের চিহ্ন যেমন থাকবে, তেমনই সৌরমণ্ডলের অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের চোরাগোপ্তা গতিবিধিও ধরা পড়ার কথা। এই বিজ্ঞানীদের মতেও, হয়তো নবম গ্রহের প্রস্তাবে ফাঁক রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন
আরেক দল বিজ্ঞানী, যাঁরা মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও নেমে পড়েছেন এ বিতর্কে। তাঁদের লক্ষ্য হলো সুদূর মহাবিশ্বের নক্ষত্রের বিস্ফোরণ, যার নাম সুপারনোভা।

গ্রহ, না আরও কিছু

আবার কয়েকজন বিজ্ঞানী নবম গ্রহ ছাড়াই সৌরমণ্ডলের প্রান্তিক বস্তুগুলোর কক্ষপথ ব্যাখ্যা করা যায় কি না, তা ভাবছেন। এ প্রসঙ্গে ভালকানের কথা মনে পড়ে। সপ্তদশ শতাব্দীতে একটা ধুয়া উঠেছিল যে সূর্য ও বুধের মাঝখানে একটা ছোট্ট গ্রহ আছে। কারণ, বুধের কক্ষপথের হিসাবে কিছু গরমিল দেখা গিয়েছিল। নিউটনের হিসেবে তার কক্ষপথ যে রকম হওয়া উচিত, সে রকম নয়। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, অন্যান্য গ্রহ, যেমন শুক্র, পৃথিবী, এমনকি বৃহস্পতি, শনি ইত্যাদির প্রভাবে এ রকম হচ্ছে। কিন্তু সূক্ষ্ম হিসাব করেও দেখা গেল, বুধের কক্ষপথের চেহারা মিলছে না। এক জায়গা থেকে শুরু করে আবার ওই জায়গায় সে ফিরে আসে না। ফলে তার কক্ষপথ একটু একটু করে সরতে থাকে।

তখন বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, হয়তো সূর্য ও বুধের মাঝখানের গ্রহটি টানাটানি করছে বলে এমনটি হচ্ছে। হয়তো সেই উপগ্রহ কোনো কারণে দেখা যাচ্ছে না। তার নামও দেওয়া হয়েছিল একটা—ভালকান। সেই থেকে এ নিয়ে কত কল্পবিজ্ঞানের গল্পও বেরিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। স্টার ট্রেক-এর সেই মিস্টার স্পককে মনে আছে? যার তির্যক ভুরু আর চোখা কান ছিল মার্কামারা। গল্পে সে ছিল ভালকান গ্রহের বাসিন্দা।

কিন্তু সেই ভালকান প্রকল্পকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তিনি মহাকর্ষ নিয়ে তাঁর নতুন তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন, সূর্যের খুব কাছে থাকার জন্য বুধের কক্ষপথের চলনটাই অন্য রকম। একরকমের বুধাদিত্যযোগ! ফলে ভালকানের কথা বিজ্ঞানীরা ভুলে গেলেন। আর কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা ভালকানের বাসিন্দাদের কানের আদল নিয়ে ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়লেন! এই নবম গ্রহের ব্যাপারেও এমন কিছু ভুল হচ্ছে না তো?

শিল্পীর কল্পনায় সৌরজগতের বাইরের প্রান্তে বামন গ্রহ সেডনার ছবি
ছবি: গেটি ইমেজ

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অ্যান-মেরি ম্যাডিগানের মাথায় একটা অন্য চিন্তা কাজ করছে। তাঁর মতে, সৌরমণ্ডলের সীমান্তে কেবল সামান্য কয়েকটি প্রান্তিক বস্তুই নেই, কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি ছোট ছোট বস্তুপিণ্ড কিলবিল করছে সেখানে। এমনিতে মহাকর্ষের হিসাবে ছোট বস্তুর আকর্ষণের জোর কম হওয়ার কথা। তাই নগণ্য বলে সরিয়ে রাখা যায়। কিন্তু যদি এ রকম অনেক বস্তু জড়ো হয়? আর তাদের মিলিত প্রভাব যদি জটিল হয়, তাহলে? এই অঙ্ক হাতে–কলমে করা কঠিন। কম্পিউটারের সাহায্যেও সদুত্তর পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু সেই চেষ্টা চলছে।

এমনও তো হতে পারে যে তাদের জন্য কয়েকটা বড় প্রান্তিক বস্তুর কক্ষপথে জটলা বেঁধেছে? সেই ক্ষেত্রে নবম গ্রহের খোঁজ করা সোনার হরিণ খোঁজার মতো হবে। অন্যরা যখন ম্যাডিগানের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য বলেন যে এমন ছোট ছোট বস্তুর অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই, তখন তিনিও পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোমাদের নবম গ্রহেরই–বা প্রমাণ কোথায়?

এখন তাই অপেক্ষার পালা; বিজ্ঞানীদের গবেষণায় কি সৌরমণ্ডলের এক অজানা বাসিন্দার চেহারা ধরা পড়বে? নাকি নবম গ্রহের চিন্তা একসময় ভালকানের মতো কল্পবিজ্ঞানের জগতে পর্যবসিত হবে? আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

লেখক: জ্যোতির্বিদ, রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বেঙ্গালুরু, ভারত

* লেখাটি পূর্বপ্রকাশিত, লেখকের অনুমতিক্রমে আবারও প্রকাশিত হলো

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন