কোন গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করবে, কীভাবে হিসাব করা হয়

চলতি বছর ২৬ মার্চ নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ২৪ ওয়াইআর৪ নামে একটি গ্রহাণুর ছবি তুলেছে। ছবিগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে, গ্রহাণুটি প্রায় ১৫ তলা ভবনের সমান বড়নাসা

‘বাসের আকৃতির গ্রহাণু ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে’, ‘এই মাসে পৃথিবীর পাশ দিয়ে উড়ে যাবে ৩টি বিশাল গ্রহাণু’—এ ধরনের খবর আমরা প্রায়ই দেখি। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে একটি গ্রহাণুর খবর পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর নাম ছিল ২০২৪ ওয়াইআর৪ (2024 YR4)। প্রথমে বলা হলো, এ গ্রহাণুটির পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু পরে পর্যবেক্ষণে দেখা গেল, সে আশঙ্কা সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। 

এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে। আর আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে। বিজ্ঞানীরা কীভাবে এই সম্ভাবনা হিসাব করেন। মানে, কোন গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানবে, আর কোনটি পাশ দিয়ে উড়ে যাবে, তা বোঝেন কীভাবে? আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত করার সম্ভাবনা কমে কেন?

বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের সময় এই সম্ভাবনার হিসাব প্রতিদিন বদলাতে থাকে। যেমন ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.১ শতাংশ হওয়ার পর পরের দিনই আবার কমে ১.৫ শতাংশ হয়ে যায়। এরপর ক্রমাগত কমতে কমতে ২৪ ফেব্রুয়ারি তা নেমে আসে ০.০০৪ শতাংশে।

কয়েকটি ধাপে বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি বুঝতে পারেন। যেমন বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কাছাকাছি কোনো গ্রহাণুর সন্ধান পেলে শুরু হয় এর ওপর অবিরাম নজরদারি। টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতিপথ বোঝার চেষ্টা করেন। এই পদ্ধতির নাম অ্যাস্ট্রোমেট্রি। তবে শুরুর দিকে যেহেতু তথ্য কম থাকে, তাই গ্রহাণুর ভবিষ্যত নিয়ে থাকে অনিশ্চয়তা।

আরও পড়ুন

এই অনিশ্চয়তার কারণে বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথের বদলে সম্ভাব্য সব কক্ষপথ মিলিয়ে একটি পরিসর তৈরি করেন। একে একটি ডিম্বাকৃতি বলয়ের মতো ভাবা যেতে পারে। এই বলয়ের মধ্যে যেকোনো জায়গায় গ্রহাণুটি থাকতে পারে। একে বলা হয় ‘এরর এলিপস’ বা ‘ত্রুটির বলয়’। পৃথিবীতে আঘাতের সম্ভাবনা নির্ভর করে এই বলয়ের মধ্যে পৃথিবী আছে কি না, তার ওপর।

প্রাথমিকভাবে, তথ্য যখন কম থাকে, তখন এই অনিশ্চয়তার বলয়টি হয় অনেক বড়। একটি বিশাল বলয়ের মধ্যে পৃথিবী ঘটনাক্রমে ঢুকে পড়তে পারে। ফলে তৈরি হয় সংঘর্ষের সম্ভাবনা। যদিও গ্রহাণুটির আসল গতিপথ হয়তো পৃথিবীর অনেক দূর দিয়ে যাওয়ার কথা।

‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ গ্রহাণুটির ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই হয়েছিল। ২০২৪ ওয়াইআর৪ গ্রহাণুটির ব্যাস প্রায় ১৯৬ ফুট। একটি ১৫ তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা। জানুয়ারিতে এর পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা ১ শতাংশ থাকলেও, ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে তা বেড়ে ৩.১ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যায়। কারণ, নতুন তথ্যের ভিত্তিতে অনিশ্চয়তার বলয়টি ছোট হচ্ছিল। কিন্তু পৃথিবী তখনও তার ভেতরেই ছিল। আর তুলনামূলক ছোট বলয়ের মধ্যে পৃথিবী থাকার অর্থ হলো, সংঘর্ষের সম্ভাবনা আরও ঘনীভূত হওয়া।

পৃথিবীকে গ্রহাণুর আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে, এমন কোনো বস্তু দেখলে মহাকাশে থাকা অবস্থায় সেগুলোর গতিপথ বদলে দেওয়ার সক্ষমতা এখন মানুষের আছে।

বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের সময় এই সম্ভাবনার হিসাব প্রতিদিন বদলাতে থাকে। যেমন ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.১ শতাংশ হওয়ার পর পরের দিনই আবার কমে ১.৫ শতাংশ হয়ে যায়। এরপর ক্রমাগত কমতে কমতে ২৪ ফেব্রুয়ারি তা নেমে আসে ০.০০৪ শতাংশে। জুন মাসের মধ্যে এই সম্ভাবনা ০.০০০০০৮১ শতাংশের চেয়েও কম হয়ে যায়।

২৪ ওয়াইআর৪ গ্রহাণুটির কক্ষপথ গাণিতিকভাবে পৃথিবীর কাছাকাছি আসলেও এর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম
নাসা
আরও পড়ুন

তবে মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদে আঘাত হানার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি এই সম্ভাবনা ছিল ১.৭ শতাংশ, যা এপ্রিল মাসে বেড়ে ৩.৮ শতাংশ হয়ে যায়।

আঘাত হানার সম্ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তবে শুধু এই সংখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ঝুঁকির মাত্রা বোঝানো সহজ নয়। ‘২০২৪ ওয়াইআর৪’ গ্রহাণুর ক্ষেত্রে এই সমস্যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা এখন ভাবছেন, কীভাবে এ ধরনের তথ্য আরও ভালোভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো যায়। সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে আরও বেশি পর্যবেক্ষণের জন্য অপেক্ষা করা। অথবা ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য নতুন পদ্ধতি চালু হতে পারে।

কয়েকটি ধাপে বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি বুঝতে পারেন। যেমন বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর কাছাকাছি কোনো গ্রহাণুর সন্ধান পেলে শুরু হয় এর ওপর অবিরাম নজরদারি। টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতিপথ বোঝার চেষ্টা করেন।
ত্রুটির বলয় যত ছোট হতে থাকে, গ্রহাণুর পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা তত কমে যায়
তোশি হিরাবায়াশি

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া। প্রথম দিকের কোনো তথ্য চূড়ান্ত নয়। আরও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সত্যিকারের চিত্র বোঝা যায়। তাই শুধু একটি সংখ্যা দিয়ে ঝুঁকি বোঝানোর বদলে, এর পেছনের প্রেক্ষাপট এবং অনিশ্চয়তার বিষয়টি সহজভাবে বুঝিয়ে বলা অত্যন্ত জরুরি। না হলে সঠিক তথ্য দেওয়ার বদলে মানুষের মধ্যে কেবল বিভ্রান্তি আর ভয় ছড়াবে। 

অবশ্য পৃথিবীকে গ্রহাণুর আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে, এমন কোনো বস্তু দেখলে মহাকাশে থাকা অবস্থায় সেগুলোর গতিপথ বদলে দেওয়ার সক্ষমতা এখন মানুষের আছে। এ জন্য আলাদা একটি প্রকল্পই রয়েছে নাসার। নাম ডার্ট মিশন। ইতিমধ্যে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, এই প্রকল্পের অধীনে বানানো বিশেষ নভোযান দিয়ে আঘাত করে বড় গ্রহাণুর গতিপথ বদলে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সেটি আর পৃথিবীতে এসে পড়বে না, অন্যদিকে সরে যেতে বাধ্য হবে। তাই পৃথিবীতে গ্রহাণু আছড়ে পড়া নিয়ে ভয় পাবেন না, আতঙ্কিত হবেন না।

সূত্র: পপুলার সায়েন্স ও লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন