কেমন হলো নতুন সুপারম্যান, কী বার্তা দিল, কতটা বৈজ্ঞানিক

বিশ্বজুড়ে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে সুপারম্যান (২০২৫)। গত তিন দিনে মুভিটি আয় করেছে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। ডিসি ইউনিভার্সের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, এ জন্য মুক্তির আগে থেকেই এই মুভি নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ছিল আকাশচুম্বী। সমালোচনাও ছিল, ছিল আশঙ্কাও। তবে সুপারম্যান ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, এখনো মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। নিজের ভেতরে লালন করা আশা, এবং ছোট্ট শিশুটিকে মানুষ ভুলতে চায় না। জেমস গান এই চিরঅম্লান আশার বার্তাই তুলে এনেছেন সুপারম্যান মুভিতে।

মুভির শুরুতে আমরা দেখি, মেটাহিউম্যান বা ‘সুপার’হিউম্যানের অস্তিত্ব প্রথম আবিষ্কৃত হয় ৩০০ বছর আগে। আর ৩০ বছর আগে ক্রিপ্টন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় কাল এল, যে প্রায় ৩ বছর আগে ‘সুপারম্যান’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিন সপ্তাহ আগে সুপারম্যান বোরাভিয়া ও জারহানপুর নামে দুটি দেশের মধ্যকার সংঘাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর তিন ঘণ্টা আগে ‘দ্য হ্যামার অব বোরাভিয়া’ নামে এক ভিলেনের হাতে মার খেয়ে, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় আছড়ে পড়ে অ্যান্টার্কটিকায়, খুঁজে ফেরে নিজের ফোরট্রেস অব সলিটিউড।

বিধ্বস্ত, তবু আশান্বিত, মানবিক এক সুপারম্যানের গল্প আমরা এই মুভিতে পাই। দেখি, পরিচালক এখানে প্রতীকী অর্থে তুলে এনেছেন রাজনৈতিক বার্তা। কোথাও বলা নেই, তবু জারহানপুরের ওপর বোরাভিয়ার হামলা যেন ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জারহানপুরকে সুপারম্যান বা পরে ‘জাস্টিস গ্যাং’ রক্ষার চেষ্টা করলেও দর্শক মনে আফসোস তৈরি হয় আশার সূত্র ধরেই যে বাস্তবে আমাদের কোনো সুপারম্যান নেই।

গুজব আছে, এরকম খুদে মহাবিশ্ব বা ব্ল্যাকহোল বানিয়েছেন লার্জ ল্যাড্রন কলাইডারে কর্মরত বিজ্ঞানীরা। এই গুজব ছড়ানোর পেছনের কারণ, বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে উপপারমাণবিক কণাদের সংঘর্ষ ঘটিয়ে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা তৈরি করতে পারেন স্বল্প সময়ের জন্য।

এই মুভিতে সুপারম্যানের শত্রু কে কে, তা সরাসরি বলে স্পয়লার দিতে চাই না। তবে আগ্রহীরা জানেন, মূল ভিলেন এখানে লেক্স লুথর নামের এক বৈজ্ঞানিক। অতিমানবীয় ক্ষমতাধারী সুপারম্যানকে সে ঘৃণা করে। চায়, পৃথিবীতে মানুষ সুপারম্যানকে ভালো না বাসুক, পছন্দ না করুক। অথচ মানুষ তো বরাবরই অপরকে পরম আপন করে নেয়। এই আশার কথা, স্পয়লার বা মুভির বিস্তারিত গল্পে না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, সুপারম্যান মুভিটি সুপারহিরোপ্রেমীদের আশা জাগানোর মতো। এটা অবশ্য বক্স অফিসের ফলাফলও বলে দিচ্ছে। কাজেই এই লেখায় আমরা বরং একটু ভিন্ন আলাপ করার চেষ্টা করি। বোঝার চেষ্টা করি, সুপারম্যানের এই মুভির কিছু বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান কী বলে।

আরও পড়ুন

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হবে ‘পকেট ইউনিভার্স’-এর কথা। এরকম একটি পকেট ইউনিভার্সে ঘটনাচক্রে আটকা পড়ে সুপারম্যান। কিন্তু পকেট ইউনিভার্স কি সত্যিই সম্ভব? তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার কিছু সম্ভাব্য তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস তেমনটাই দাবি করে।

আমরা জানি, স্ট্রিং থিওরি বহুমহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্সের কথা বলে। বলে ভিন্ন মাত্রার কথা। বিজ্ঞানীরা জানেন, আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। (বিগ ব্যাং কী, জানতে বিস্তারিত পড়ুন: আপনার ঘরের প্রতিটি বিন্দুতেও ঘটেছে বিগ ব্যাং) এর পরে, মহাবিশ্বের সূচনার ১০-৩৫ থেকে ১০-৩৩ সেকেন্ড সময়কালে হঠাৎ করেই প্রচণ্ড বেগে, বিপুলভাবে প্রসারিত হয় আমাদের মহাবিশ্ব। এর নাম কসমিক ইনফ্লেশন বা বা মহাজাগতিক স্ফীতি। এরপর এই প্রসারণের হার আবার কমে আসে। পরে সেটি আবার বাড়তে শুরু করে, যখন মহাবিশ্বের বয়স প্রায় সাড়ে ৭ বিলিয়ন (সাড়ে ৭০০ কোটি) বছর, তখন। এখনো মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। এ জন্য দায়ী করা হয় একধরনের অজানা শক্তিকে, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ডার্ক এনার্জি।

‘সুপারম্যান’–এর দৃশ্য
ছবি: আইএমডিবি

এই ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্ব বেশ কিছু মহাজাগতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে। যেমন মহাবিশ্বে মনোপল বা একমেরু চুম্বক নেই কেন, কেন মহাবিশ্বের সবদিকে তাপমাত্রার মান সুষম ইত্যাদি। কাজেই বাস্তবে শতভাগ প্রমাণিত না হলেও ইনফ্লেশনকে থিওরিই বলা হয়। জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা এটিকে ‘বর্তমানে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা’ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।

সুপারম্যান শেষ পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী এলিয়েন বা সুপারহিরোর গল্প নয়, এটি মানুষের গল্প, আশার গল্প। শেষ দৃশ্যে একটি শিশু যখন সুপারম্যানের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমাদের ভেতরের শিশুটিও আশায় বুক বাঁধে।

মাল্টিভার্স বা বহু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে, এটা যদি আমরা ধরে নিই; এবং এর সঙ্গে যদি ইনফ্লেশনকে এক সুতোয় গাঁথি—তাহলে পকেট ইউনিভার্সকে তত্ত্বীয়ভাবে অসম্ভব বলা যায় না। স্থানকালের কোথাও যদি ভিন্ন হারে ইনফ্লেশন ঘটে, আমাদের মহাবিশ্বের বাইরে সে ক্ষেত্রে গড়ে উঠতে পারে ছোটখাটো মহাবিশ্ব। এগুলোকে ‘বাবল ইউনিভার্স’ এবং ‘পকেট ডাইমেনশন’ও বলা হয়। যেখানে ভৌত তত্ত্ব বা মহাবিশ্ব পরিচালনাকারী নিয়মগুলো আমাদের মহাবিশ্বের মতো নয়, ভিন্নরকম। এ ধরনের ছোটখাটো মহাবিশ্বে থাকতে পারে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল, এমনকি ব্ল্যাকহোলই হতে পারে এ ধরনের মহাবিশ্বের মূল দ্বার। কিংবা কাজ করতে পারে বীজ হিসেবে, যেখানে—লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বমতে—কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুর বদলে গড়ে উঠবে ছোটখাটো এক আস্ত মহাবিশ্ব!

আরও পড়ুন

এরকম কোনো মহাবিশ্বের দ্বার যদি খুলে যায় পৃথিবীর কোনো স্থানে, যুক্ত হয়ে যায় দুটি মহাবিশ্ব, তাহলে পকেট ইউনিভার্স কি গিলে নিতে পারে আমাদের বাস্তবতা? সোজা-সাপ্টা উত্তর হলো, এটা পুরোপুরি কল্পনা বা ফ্যান্টাসি। তবে সুপারম্যান মুভিতে যে পকেট ইউনিভার্স দেখানো হয়েছে, সে বিষয়ে একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলা হয়েছে মুভিতেই। বলা হয়েছে, এই পকেট ইউনিভার্স বানিয়েছে মুভির ভিলেন লেক্স লুথর। কিন্তু একটা পকেট ইউনিভার্স বা ব্ল্যাকহোল কি চাইলে কেউ বানাতে পারে?

‘সুপারম্যান’–এর দৃশ্য

গুজব আছে, এরকম খুদে মহাবিশ্ব বা ব্ল্যাকহোল বানিয়েছেন লার্জ ল্যাড্রন কলাইডারে কর্মরত বিজ্ঞানীরা। এই গুজব ছড়ানোর পেছনের কারণ, বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে উপপারমাণবিক কণাদের সংঘর্ষ ঘটিয়ে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা তৈরি করতে পারেন স্বল্প সময়ের জন্য। এভাবে তাঁরা শিশু মহাবিশ্বটা কেমন ছিল, তা জানতে চান। কিন্তু না, পকেট ইউনিভার্স বা ব্ল্যাকহোল বর্তমান প্রযুক্তিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যায় না। গেলে, বোতলে পুরে এরকম ব্ল্যাকহোল পকেটে নিয়ে ঘোরাই যেত, কী বলেন?

এ ছাড়াও আরও অনেক বিষয় উঠে এসেছে এই মুভিতে। যেমন হিউম্যান (আসলে এলিয়ন) ক্লোনিং। বাস্তবে এরকম কিছু এখনো করা হয়নি, প্রমাণিতও নয়। তবে ১৯৯৬ সালে ডলি নামের একটি ভেড়া তৈরি করা হয়েছিল গবেষণাগারে, ক্লোনিং পদ্ধতিতে। মানুষের ক্ষেত্রে এরকমটা অমানবিক, নৈতিকভাবে নিন্দনীয় এবং আইনিভাবে নিষিদ্ধ। তবে স্টেমসেল থেকে মানুষের অঙ্গাণু তৈরির চেষ্টা চলমান রয়েছে। চিকিৎসায় এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

এ ছাড়াও সুপারম্যানের উড়ে চলা, পৃথিবীর সূর্য থেকে শক্তি নিয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠা—এসব প্রশ্ন তো রয়েছেই। সেগুলোর উত্তর আলাদা করে বলব না। এ নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায়, কিছু উত্তর পাবেন এই লেখাতেও

আরও পড়ুন
মাল্টিভার্স বা বহু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকতে পারে, এটা যদি আমরা ধরে নিই; এবং এর সঙ্গে যদি ইনফ্লেশনকে এক সুতোয় গাঁথি—তাহলে পকেট ইউনিভার্সকে তত্ত্বীয়ভাবে অসম্ভব বলা যায় না।

লেখা শেষ করার আগে আবার মুভির কথায় ফিরি। এই মুভিতে ডেভিড কোরেনসোয়েটের অভিনয় এককথায় অনবদ্য। তাঁর অভিনয়ে ফুটে উঠেছে ক্রিপ্টনের শেষ সন্তানের নিঃসঙ্গতা এবং মানবজাতির প্রতি অসীম আশাবাদ। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন র‍্যাচেল ব্রসনাহ্যান, লোইস লেন চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। আর লেক্স লুথরের চরিত্রে নিকোলাস হল্টের অভিনয় ছিল অবিশ্বাস্য সুন্দর।

‘সুপারম্যান’–এর দৃশ্য
ছবি: আইএমডিবি

কিন্তু সুপারম্যান শেষ পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী এলিয়েন বা সুপারহিরোর গল্প নয়, এটি মানুষের গল্প, আশার গল্প। শেষ দৃশ্যে একটি শিশু যখন সুপারম্যানের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমাদের ভেতরের শিশুটিও আশায় বুক বাঁধে। বিশ্বাস করে, সুপারহিরো হতে অশেষ শক্তির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন মানবিকতার। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।

আরও পড়ুন