দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি – ৭

মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।

অধ্যায় এক

মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়

বাইরের উজ্জ্বল রোদ থেকে সারঙ্গপানি মন্দিরের বাইরের হলঘরে ঢুকলে চোখ সয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগত। চারপাশ মনে হতো ছায়াময়। হলঘরের গায়ে গায়ে ঘেঁষা স্তম্ভগুলোর ফাঁক দিয়ে সামান্য যেটুকু আলো আসত, তাতেই চোখে পড়ত নিপুণ হাতের কারুকাজ। পাথরের তৈরি সিংহ আর জ্যামিতিক নকশাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠত।

আলো থেকে একটু দূরে, স্তম্ভের আড়ালে ছিল বাদুড়ের রাজ্য। রামানুজন মাঝেমধ্যে তাদের ডানার ঝাপটানি বা কিচমিচ শব্দ শুনতে পেতেন। কখনো কখনো সিলিং থেকে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলোকে হঠাৎ উড়ে যেতে দেখা যেত।

পশ্চিমা গির্জাগুলো যেমন মানুষকে আর্কিটেকচারের মাধ্যমে ওপরের দিকে তাকাতে বাধ্য করে, এখানকার মন্দিরগুলো যেন ভক্তদের আরও গভীরে, আরও ভেতরে টেনে নিয়ে যায়। মন্দিরের উঁচু পাথরের দেয়ালের ভেতরে ছিল বিশাল খোলা চত্বর, তার ভেতরে ছাদযুক্ত স্তম্ভের এলাকা। আরও ভেতরে গেলে দেখা মিলত বিশাল রথের। সেই রথের কয়েক ফুট ব্যাসের চাকাগুলো টানছে পাথরের তৈরি ঘোড়া আর হাতি। দালানের একদম ভেতরে, অন্ধকার এক কুঠুরিতে দিনরাত প্রদীপ জ্বলত। ওটাই গর্ভগৃহ বা পবিত্র স্থান। সেখানে অনন্তকালের প্রতীক বহুফণা সাপের পাশে শুয়ে আছেন হিন্দুদের প্রধান দেবতা, স্বয়ং বিষ্ণু।

মন্দিরের আনাচে-কানাচে জ্বলত ভক্তদের জ্বালানো ছোট ছোট আগুন, শোনা যেত মন্ত্রপাঠ, বাতাসে ভেসে আসত ধূপের গন্ধ। মূল মন্দিরের যত কাছে যাওয়া যেত, পরিবেশটা ততই অন্ধকার, রহস্যময় আর নিবিড় হয়ে আসত। বাইরের কোলাহলমুখর রাজপথ থেকে যেটা উৎসবের জায়গা মনে হতো, ভেতরে ঢুকলেই সেটা হয়ে উঠত একান্ত ব্যক্তিগত উপাসনার স্থান। খালি গায়ের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পাথরের গুহাগুলো ছিল একজন মানুষ ও তার দেবতার একান্ত মিলনের জায়গা।

মন্দিরের আনাচে-কানাচে জ্বলত ভক্তদের জ্বালানো ছোট ছোট আগুন, শোনা যেত মন্ত্রপাঠ, বাতাসে ভেসে আসত ধূপের গন্ধ। মূল মন্দিরের যত কাছে যাওয়া যেত, পরিবেশটা ততই অন্ধকার হয়ে আসত।

বাইরে থেকে দেখা যেত বিশাল গোপুরম বা প্রবেশদ্বার। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে নায়েক রাজাদের তৈরি এই বিশাল তোরণটি ছিল ১২ তলা সমান উঁচু। এর ভিত্তি ছিল ৯০ ফুট চওড়া আর উচ্চতা ১৪৬ ফুট। এত উঁচুতে থাকা মূর্তিগুলো নিচ থেকে ঠিকমতো দেখাই যেত না, অথচ ভাস্কররা সেগুলোর মুখের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে একটুও কার্পণ্য করেননি। সেখানে ছিল পোশাক পরা এবং নগ্ন মানুষ, উপবিষ্ট বা দাঁড়ানো মূর্তি, মানুষ ও পশুর অদ্ভুত সব আকৃতি। নাচ, অশ্বারোহন, প্রেম বা বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মতো মানব জীবনের পুরো চিত্রটাই যেন পাথরে খোদাই করা ছিল।

রামানুজনের কাছে এগুলো শুধু মূর্তি ছিল না। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শোনা রামায়ণ-মহাভারতের গল্পগুলো এখানে যেন জীবন্ত হয়ে উঠত।

শ্রীনিবাস রামানুজন
ছবি: উইকিপিডিয়া

হিন্দু ধর্মের অনুসারী প্রতিটি শিশুই দুষ্টুমি করা ছোট্ট কৃষ্ণের গল্প জানত। কৃষ্ণ তখনো শিশু, দেবতা হয়ে ওঠেননি। দুষ্টু কৃষ্ণের স্নানরতা রমণীদের শাড়ি চুরি করে গাছে ওঠার সেই দৃশ্য তাঁর কল্পনায় ভাসত। রামানুজন শুধু গোপুরমের দিকে তাকালেই দেখতে পেতেন সেই কিংবদন্তির কদম গাছ আর তার ডালে বসে থাকা কৃষ্ণকে।

উৎসবে, পূজায় বা শুধু সময় কাটানোর জন্য হলেও রামানুজন সবসময় এই মন্দিরে আসতেন। তিনি তো এর ছায়াতেই বড় হয়েছেন। নিজের ছোট বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার মাথায় তাকালেই চোখে পড়ত বিশাল গোপুরম। এমনকি তিনি যে রোডে থাকতেন, তার নামও ছিল মন্দিরের নামে—সারঙ্গপানি সান্নিধি স্ট্রিট।

মন্দিরের ভেতরে কথা বলা বারণ ছিল না, তাই রামানুজন প্রায়ই সেখানে গিয়ে আড্ডা জমাতেন। কিন্তু সবকিছুর পরেও সেখানে বিরাজ করত এক অদ্ভুত প্রশান্তি। বাইরে যখন পুরো ভারত কোলাহলে মত্ত, তখন এই পাথরের মরুদ্যানটি ছিল শান্ত।

রামানুজনের কাছে এগুলো শুধু মূর্তি ছিল না। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শোনা রামায়ণ-মহাভারতের গল্পগুলো এখানে যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। 

দুপুরের কড়া রোদ থেকে বাঁচতে রামানুজন এই মন্দিরের স্তম্ভের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতেন। পরিবারের কোলাহল থেকে দূরে, বাইরে ঝলসে ওঠা রোদের থেকে নিরাপদে তিনি মাঝেমধ্যে মন্দিরের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তেন। তাঁর বগলে গোঁজা থাকত গাণিতিক হিজিবিজি লেখা নোটবুক। চারপাশের পাথরের মেঝেতে চকের গুঁড়ো দিয়ে লেখা থাকত অজস্র সমীকরণ।

কুম্বকোনম শহরটা ছিল মন্দিরের শহর। শহর ও আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে ছিল ডজনখানেক বড় মন্দির। প্রতি ১২ বছর পর পর মহামখম ট্যাংকে গঙ্গা নদীর জল এসে মেশে; এই বিশ্বাসটা কুম্বকোনমের মানুষের কাছে কোনো কিংবদন্তি বা গল্প ছিল না, ছিল ধ্রুব সত্য। ভৌগোলিক বইয়ে গঙ্গা যতই দূরে থাকুক না কেন, বিশ্বাসের কাছে সেই দূরত্ব ছিল তুচ্ছ।

শ্রীনিবাস রামানুজন,যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

রামানুজন এমন এক জগতে বড় হচ্ছিলেন, যেখানে আধ্যাত্মিকতা বা অলৌকিকতা জীবনের কোনো প্রান্তিক বিষয় ছিল না, বরং কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় বা মন্দিরে একটু দাঁড়ালেই এমন কাউকে পাওয়া যেত, যে উৎসাহ নিয়ে কোনো দেবতার গুণগান, সংখ্যা ৭-এর অলৌকিক ক্ষমতা বা ভগবদগীতার দর্শন শুনতে আগ্রহী।

তবে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সমাজে জাগতিক বিষয়গুলোও উপেক্ষিত ছিল না। টাকা-পয়সা, আরাম-আয়েশ বা নিরাপত্তার গুরুত্বও ছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি বিষ্ণুর অবতার, উৎসবের নিয়মকানুন বা পূজার সঠিক পদ্ধতিগুলোও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো দৈনন্দিন জীবনের বাইরের কোনো বিনোদন ছিল না, বরং জীবনেরই অংশ ছিল। যেমনটা ছিল ইংরেজদের কাছে বিকালের চা আর ক্রিকেট, কিংবা আমেরিকানদের কাছে তাদের গাড়ি।

রামানুজনের মৃত্যুর অনেক বছর পর, তাঁর কিছু পশ্চিমা বন্ধু বলেছিলেন, রামানুজন আসলে ধার্মিক ছিলেন না। তাঁরা ভাবতেন, রামানুজন কেবল প্রথা বা সংস্কারবশত হিন্দুধর্ম পালন করতেন। তাঁর মন ছিল পুরোপুরি যুক্তিবাদী পশ্চিমাদের মতো।

কিন্তু তাঁদের ধারণাটা আসলে ভুল ছিল।

রামানুজনের মৃত্যুর অনেক বছর পর, তাঁর কিছু পশ্চিমা বন্ধু বলেছিলেন, রামানুজন আসলে ধার্মিক ছিলেন না। তাঁরা ভাবতেন, রামানুজন কেবল প্রথা বা সংস্কারবশত হিন্দুধর্ম পালন করতেন।

বেড়ে ওঠার পুরোটা সময় তিনি একজন খাঁটি হিন্দু ব্রাহ্মণের জীবন যাপন করেছেন। তিনি টিকি রাখতেন, কপাল কামানো থাকত, ছিলেন কট্টর নিরামিষভোজীও। নিয়মিত মন্দিরে যেতেন, বাড়িতে পূজা-পার্বণ করতেন এবং তীর্থযাত্রায় চষে বেড়াতেন দক্ষিণ ভারত। তিনি নিয়মিত তাঁর পারিবারিক দেবী নামাক্কালের নামাগিরির নাম জপতেন। আবার নিজের কাজ বা সিদ্ধান্তের ভিত্তি মনে করতেন দেবীর ইচ্ছাকেই।

তিনি বিশ্বাস করতেন, বিদেশী ভাষার কঠিন গাণিতিক বইগুলো বোঝার ক্ষমতা তিনি পেয়েছেন ঈশ্বরের কৃপাতে। বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ বলতে পারতেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন ব্যাখ্যার বাতিক তিনি অতিপ্রাকৃত বা গুপ্তবিদ্যাও পছন্দ করতেন। তাঁর ভারতীয় বন্ধুরা সব সময়ই তাঁর এই আধ্যাত্মিক ঝোঁকের কথা উল্লেখ করতেন।

শ্রীনিবাস রামানুজন
ছবি: উইকিপিডিয়া

কুম্বকোনমে থাকার সময় বছরে একবার তিনি রেলস্টেশন পার হয়ে পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করতেন। শহরের বাইরে খড়ের চালের মাটির ঘরগুলো কমে আসত। পথের ধারে দেখা যেত খুঁটিতে বাঁধা ষাড়, ঘুরে বেড়ানো ছাগল, ছোট ছোট মন্দির আর সবুজ প্রান্তর। প্রায় চার মাইল হাঁটার পর তিনি পৌঁছাতেন তিরুনাগেশ্বরম শহরে। সেখানে ছিল প্রাচীন উপ্পিলিয়াপ্পান কোভিল মন্দির। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে পূর্ণিমার সময় (আগস্ট মাসের দিকে) তিনি এখানে আসতেন তাঁর পবিত্র পৈতে বদলানোর জন্য।

পাঁচ বছর বয়সে চার দিনের এক যজ্ঞ ও মন্ত্রপাঠের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি পৈতে পেয়েছিলেন। পৈতে মানে তিনটি সুতোয় পাকানো পবিত্র ফিতা, যা বাঁ কাঁধ থেকে তির্যকভাবে ডান কোমরের দিকে ঝুলে থাকে। এই উপনয়ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনি একজন দ্বিতীয় জন্ম নেওয়া ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃতি পান। মনুসংহিতা অনুযায়ী, প্রথম জন্ম হয় মায়ের গর্ভ থেকে, আর দ্বিতীয় জন্ম পৈতে গ্রহণের মাধ্যমে। এরপর থেকেই বেদ পড়ার অধিকার পান তিনি। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে অন্যান্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তিনি এই পৈতে বদলাতেন।

পৈতে মানে তিনটি সুতোয় পাকানো পবিত্র ফিতা, যা বাঁ কাঁধ থেকে তির্যকভাবে ডান কোমরের দিকে ঝুলে থাকে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই রামানুজন একজন দ্বিতীয় জন্ম নেওয়া ব্রাহ্মণ হিসেবে স্বীকৃতি পান।

তাঁর এক বন্ধু পরে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, তিনি এবং রামানুজন একবার চাঁদের আলোয় ছয় মাইল হেঁটে নাচিয়ারকোভিল শহরে গিয়েছিলেন একটি বিষ্ণু মন্দিরের উৎসবে। পুরো পথ রামানুজন বেদ ও শাস্ত্র থেকে শ্লোক আবৃত্তি করেছিলেন। সেগুলোর ব্যাখ্যাও দিচ্ছিলেন।

আরেকবার, একুশ বছর বয়সে তিনি এক শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে কথায় কথায় ঈশ্বর, শূন্য এবং অসীমের মধ্যে সম্পর্কের এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। রাত দুটো পর্যন্ত সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিল। রামানুজনের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটত। দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক আলোচনায় তিনি কল্পনার এমন সব অদ্ভুত জগতে চলে যেতেন যে বন্ধুরা সবটা না বুঝলেও মুগ্ধ হয়ে শুনত। পরে তাদের শুধু মনে থাকত রামানুজনের সেই উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি।

তাঁর সহপাঠী আর. রাধাকৃষ্ণ আইয়ার তাঁকে ‘গভীরভাবে ধার্মিক’ বলেছিলেন। গণিতের অধ্যাপক আর. শ্রীনিবাসন তাঁকে মনে রেখেছিলেন একজন সত্যিকারের মরমী সাধক হিসেবে। জীবনের শেষদিকে পাশ্চাত্যের প্রভাবে হয়তো তিনি কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষ বা যুক্তিবাদী চিন্তার দিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু সেটা অনেক পরের কথা। দক্ষিণ ভারতের এই ঘন ও সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিকতার আবহে বড় হয়ে তিনি এর প্রভাবমুক্ত থাকবেন, এমনটা ভাবাও কঠিন।

রামানুজন কখনোই বিদ্রোহ করেননি। তিনি অদেখা আত্মিক জগতকে অস্বীকার করেননি, বা দূরে ঠেলে দেননি; দুহাতে আলিঙ্গন করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের এই আবহ তাঁর জীবনে কোনো সংঘাত তৈরি করেনি, বরং সেখানকার ছন্দ, অভ্যাস আর প্রবাহের সঙ্গেই তাঁর জীবন সুর মিলিয়ে বয়ে চলেছিল।

চলবে…