তৃতীয় মাত্রার অন্ধকার

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঠিক পাঁচটায় গান থেমে যায়। তারপর খুব বেশি দেরি হয় না, দুই কি তিন মিনিট, তারপরই হল্লার মতো একটা শব্দ তুলে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে ছেলেমেয়েগুলো। আর ওর মধ্যেই মেয়েগুলো কেমন! হাঁটছে আর কলস্বরা হয়ে একেকজন পারে তো আরেকজনের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। সে অবাক হয়ে দেখে ওদের—প্রতিদিন একই দৃশ্য—কিন্তু একই রকম বিস্ময় নিয়েই ওদের দেখে সে। হাত নেড়ে নেড়ে কী এত কথা! ও রকম বয়স তো তারও একদিন ছিল। কিন্তু কই বন্ধুদের সঙ্গে তো তার এত হা-হা-হি-হি হয়নি! খানসামার হাত ধরে স্কুলে যাও আর খানসামার হাত ধরেই বাসায় ফেরো।

প্রতিদিন একই রুটিন। আর মিশনারি স্কুলের মাঝখানের যেটুকু সময়; তা–ও ছিল কঠোর এক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। ফলে কারও সঙ্গেই এই মেয়েদের মতো, এ রকম মাখামাখি, খোলামেলা উচ্ছল বন্ধুত্ব তার কোনো দিনই গড়ে ওঠেনি। আর পাকিস্তানের গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর মেয়ে বলে তার সঙ্গে আড় ভেঙে কেউ কখনো সহজভাবে মেশেওনি, ফলে পুরো শৈশবটাই তার কেটেছে বন্ধুহীন, চরম নিরানন্দে। আর এখন জীবনের এই শেষবেলায়ও তার কোনো বন্ধু নেই।

তবে কোনো একদিন তার কেউ একজন ছিল, সে কি তার বন্ধু ছিল না-কি—আজও সে বোঝে না। এই মিউজিক কলেজেরই দোতলার, ওই কোনার ঘরটায় তার মৃতদেহ পাওয়া গেল। রহস্যময় মৃত্যু। ওই ঘটনার পর থেকেই তার জীবনটা কেমন লন্ডভন্ড হয়ে গেল।

এক জীবনে ওই মানুষটার সঙ্গেই তার যত স্মৃতি, যত কথা, কিন্তু সব ধুয়েমুছে গিয়ে শুধু মৃত্যুটাই বড় হয়ে গেল!

মিউজিক কলেজটা তখনো শুরু করেনি ও, দোতলার ওর কোনার ঘরটার একেবারে বিপরীতে প্রান্তে, দক্ষিণের কোণের ঘরটা ছিল ওর ঠাকুর্দার ঘর। আর নিচে যেখানে এখন সুধীন দাস গানের ক্লাস নেন, এটা ছিল ওর ঠাকুর্মার ঘর। আর নাচের ঘরটা ছিল ওদের হলরুম—ওরা বলত বৈঠকখানা। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর ঠাকুর্মা ওপরের ঘরটায় উঠে গেল। হলরুম এবং পাশের কামরাটা নিয়ে ও মিউজিক কলেজ চালু করল। শুরুতে ছাত্রছাত্রী তেমন একটা ছিল না, কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই বেশ জমে গেল স্কুলটা।

আর কীভাবে কবে যেন গান আর সে—এই দুটোই হয়ে গেল ওর জীবনের সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু ঠাকুর্মা তা মানল না। গান, ঠিক আছে; তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠল তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু ও যখন বিয়ের কথাটা পাড়ল ঠাকুর্মার কাছে, তা শুনেই মূর্ছা গেল ঠাকুর্মা। তারপরই ওই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল। ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায়ও দিব্যি সুস্থ ও। মিউজিক কলেজের এই বটগাছটার তলায় তাদের বিকেলে দেখা হয়েছে; কথা হয়েছে, ওর হাত ধরে কত হাসল! ও বরাবর খুব প্রগল্‌ভ, ফলে সবই স্বাভাবিক ঠেকেছে, একবার বুকে অম্বলের ব্যথার উত্পাতের কথা বলল, হাসতে হাসতে, তারপর আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।

এই বিরান বাড়ি, সারা দিনের নিঝুম নীরবতা, কেবল দুপুরের পর গানের ছেলেমেয়েদের আগমনে সরব হয়ে ওঠা, তারপর, ওরা চলে যাওয়ার পর আবার যে কে সেই; রাতের আঁঁধারমাখা একটা ভুতুড়ে বাড়ি তখন। কিন্তু সে বাড়ির প্রতিটি কোণে, বালুকণায় ওর উপস্থিতি টের পায়।
আরও পড়ুন

কিন্তু পরদিন সকালে ওই খবরটা শুনেই ছুটে এসেছিল সে, পথে বারবার মনে হয়েছে এটা সত্যি নয়, এটা সত্যি হতে পারে না। এটা কারও নির্মম ঠাট্টা। ও এভাবে চলে যেতে পারে না! কিন্তু ওর এই চাওয়া, ওর এ বিশ্বাসের কিছুই সত্যি হয়নি। সাদা পায়জামা আর হাফহাতা সুতি গেঞ্জি পরা ওর নিথর দেহটা খাটের ওপর শোয়ানো। মুখময় এক দেবশিশুর আভা নিয়ে ঘুমাচ্ছে ও। এ চিরনিদ্রা ভেঙে ও আর কোনো দিনই জাগল না।

দরজায় আকুল হয়ে কাঁদছিল ঠাকুর্মা, তাকে দেখেই চোখ-মুখ স্থির হয়ে গেল তার, তারপর আচমকা ঠাকুর্মা সাপের মতো হিসহিস করে বলে উঠল, অপয়া! অলক্ষ্মী!

স্তম্ভিত, বিমূঢ় হয়ে গেল সে।

ঠাকুর্মার সঙ্গে ও বাড়িতে ওই তার শেষ দেখা, এর মাস ছয়েক পরই ঠাকুর্মা কলকাতা চলে গেল। তার যাওয়ার দিনও এই জায়গায়, এই বটগাছটার নিচেই সে এসে দাঁড়িয়েছিল। ঠাকুর্মা এক্কা ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় তাকে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকাল, সেদিনও তার চোখে-মুখে দপ করে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল; কিছু না বলে সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠল ঠাকুর্মা।

আজও, এত বছর পরও নির্ভুলভাবে ওই দৃশ্য তার মনে গেঁথে আছে। কিন্তু ঠাকুর্মার ওই ক্রোধ, আর তার নিজের জীবনের পঁচিশ বছরের অসীম ব্যর্থতা—কোনো কিছুই এক দিনের জন্যও তাকে ওর কাছে, মানে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করতে পারেনি তার।

এই বিরান বাড়ি, সারা দিনের নিঝুম নীরবতা, কেবল দুপুরের পর গানের ছেলেমেয়েদের আগমনে সরব হয়ে ওঠা, তারপর, ওরা চলে যাওয়ার পর আবার যে কে সেই; রাতের আঁঁধারমাখা একটা ভুতুড়ে বাড়ি তখন। কিন্তু সে বাড়ির প্রতিটি কোণে, বালুকণায় ওর উপস্থিতি টের পায়।

সুধীন দাসই ওর গানের স্কুলটা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। বড় গুণী লোক। কিন্তু কত দিন? এই লোকটার সঙ্গেই তার এক-দুই দিন, মাঝেসাঝে যা একটা-আধটু কথাবার্তা হয়, আর কারও সঙ্গেই তো কোনো কথাবার্তা নেই। পুরো পাড়ায়, কি পরিচিত মহলে; দিনে দিনে তার পরিচয় দাঁড়িয়েছে এক উন্মাদ বুড়ির। চণ্ডালে রাগের এক বুড়ি। সবাই তাকে এড়িয়েই চলে, শৈশবেও সে যেমন পারিবারিক বনেদিয়ানার কারণে একলা ছিল, পরিণত বয়সেও সে সবার বিরাগভাজন, ব্রাত্য এবং একলা।

মাঝখানে সুধীনদা একদিন বলছিলেন, ঠাকুর্মার কলকাতার আত্মীয়রা বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছে, বিক্রি হয়ে গেলে মিউজিক কলেজটা হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে। এ রকম বিনে পয়সার বাড়ি তাকে আর কে দেবে! সুধীন দাসের বিমর্ষ গলা তাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই স্কুল নিয়ে তার কোনো আবেগ নেই। মানুষটাই নেই, স্কুল দিয়ে সে কী করবে!

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

বন্ধ হলে হবে। বাড়িটা অন্য কারও দখলে চলে গেলে, নিশ্চিত ভেঙে ফেলবে, নতুন ইমারত গড়বে। আর না ভাঙলেও তার প্রতিদিন হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে এখানে আসা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। সেই বরং ভালো হবে। শুধু স্মৃতি হাতড়েই তো একটা জীবন পার করে দিল।

আর কটা দিনও এমনি পার হয়ে যাবে। আসলে কোনো কিছুই তো চিরস্থায়ী না। এই সবুজ একচিলতে মাঠ, ঘাসের ওপর তাদের উচ্ছল পদচারণার সুখস্মৃতি—এসবের কোনো কিছুই কি চিরন্তন! হুইলচেয়ারে বসে চোখ বন্ধ না করেও তার চোখের সামনে এক লহমায় গোটা অতীতটাই ছুটে যায় ঘোড়দৌড়ের মতো, কিন্তু সে কোনো বিশিষ্টতা খুঁজে পায় না। তার ফ্রক পরা বেণি দোলানো সেসব দিন, তার পাশে গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীতের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে হাত ধরে থাকা সেই উজ্জ্বল যুবা পুরুষ, মা-বাবার মৃত্যু—আর তার পরেরটুকু? সে তো শুধুই তার আত্মীয়-পরিজনহীন হয়ে ঘরবন্দী একলা জীবন। কাজেই সে ভালো করেই জানে, এসব কিছুই চিরস্থায়ী নয়।

তাই ঠাকুর্মার সেই কথাটাও খুবই সত্যি মনে হয় তার, নিষ্ফলা, অপয়া একটা জীবন পারই তো করে গেল সে!

নিজেকে সে তাই অপয়াই বলবে, জীবনের অনন্ত এক ক্ষুধা নিয়ে একজনকেই তো আরাধ্য করেছিল সে, সে–ও ছেড়ে গেল তাকে। জীবনের সব রূপরসও যেন সঙ্গে করে নিয়ে গেল সে। কিন্তু সব ধকল সয়ে, সমাজের সব ভ্রুকুটি সয়ে সে ঠিকই বেঁচে থাকল।  অনেকেই ভেবেছিল, ছেলেটার অকালমৃত্যুতে সে  এসে পৌঁছেছে উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে বসবে। কিন্তু সে পথে সে যায়নি। গত পঁচিশটা বছর মনের মধ্যে এক ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এখন সে জীবনসায়াহ্নে। এই পথপরিক্রমায় নিজের বাবা–মাকেও খেল (পাড়ার মানুষের কথা এটা), তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাও গেল, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসল, তারপরও তাকে পাড়ার মানুষ পয়া বলবে! সে অপয়া, ঠাকুর্মার অলক্ষ্মীই।

সেগুনবাগিচার রাস্তায় হুইলচেয়ারে, তাকে দেখে এখনো পাড়ার লোকজনের দৃষ্টি আড়ষ্ট হয়ে যায়, এখনো তারা সেই আগের মতোই খরচোখে তাকায় তার দিকে। ঠাকুর্মার মতো ওদের কাছেও সেন পরিবারের ছেলেটার মৃত্যুর জন্য দায়ী তার মন্দ ভাগ্য। অপয়া, অলক্ষ্মী বলে ঠাকুর্মা চিরকালের জন্য সেটাই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে। এর বাইরে তার একলা, একরোখা পরোয়াহীন জীবনও অনেকের কাছে পছন্দের না।

কিন্তু কোনো কিছুই সে কোনোকালে ভ্রুক্ষেপ করেনি, গত পঁচিশ বছরে একটা রুটিনে পুরো জীবনটাকেই সে বেঁধে নিয়েছিল, সেই রুটিনে মিউজিক কলেজের এই বটগাছটার নিচে এসে সে দাঁড়িয়েছে, প্রতিদিন—এখনো, এই দুদণ্ডই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তাই এক দিনের জন্যও তার এই রুটিনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি গত পঁচিশ বছরে, কি ঝড় কি বৃষ্টিতে; সবার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ঠিকই সে তার রুটিন মেনে গেছে। এখানে এসে স্মৃতি হাতড়ানো ছাড়া তার কিছু তো করার নেই।

রোববারে সাধারণত কোনো ক্লাস থাকে না ছেলেমেয়েদের, কেউই আসে না। মিউজিক কলেজের পুরো চত্বর হাহাকার, ফাঁকা পড়ে থাকে। হুইলচেয়ারে ঠিক পাঁচটায় এসে হাজির হয় শুধু সে। বটগাছটার নিচে স্থাণু হয়ে বসে থাকে। এক ঘোরের মধ্যে ও আসে স্মৃতির মেঘ থেকে।

গানের ক্লাস থাকে যেদিন, ক্লাস শেষে ছেলেমেয়েরা চলে যায়, সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর তার ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা; এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হুইলচেয়ার চালানো সহজ না। সামান্য পথ, কিন্তু ওটুকুই পেরোতে পেরোতেই টায় টায় আধঘণ্টা লেগে যায় তার। বিমর্ষ, উদ্‌ভ্রান্ত রাজকন্যা তার প্রাসাদপুরীতে ফিরে আসে ঠিক সাড়ে সাতটায়, পঁচিশ বছর ধরে এই রুটিনের একচুলও এদিক-ওদিক হয়নি। কিন্তু এই প্রথম আজই তার ব্যত্যয় ঘটল।

এমন নয় যে, সে আজ ভিন্ন কোনো পথে ফিরেছে। সেই একই পথ: মিউজিক কলেজের লোহার গেটটা পেরোলে, সামনে নির্মাণাধীন শিল্পকলা একাডেমির বিশাল মাঠ। ঘাস-ঝোপ-জঙ্গলে ছাওয়া। তারপরই খালটা, এটা সেই মতিঝিল থেকে পল্টনকে চিরে দুই ভাগ করে দিয়ে রমনা পার্কের হ্রদের সঙ্গে গিয়ে মেশা খাল।

খালটার পাশ দিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিলে, প্রথমেই পরে পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী ছিলেন হাফিজুর রহমানের বাড়ি। তাঁর একটা ছেলে বিরাট অর্থনীতিবিদ হয়েছে এখন, সেও ওর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাইত। তারপর ওর আরেক গানের সঙ্গী জাহিদুর রহীমদের বাড়ি। সে-ও বেঁচে নেই, ও মারা যাওয়ার বছরখানেক পরে জাহিদও কী রোগে ভুগে যেন মারা গেল, মনে নেই। ওদের দুটো বাড়ি পরেই কাজী শহিদুল্লা সাহেবের বাড়ি, তারপর একটা চৌমাথা; শিল্পকলা আর রমনা পার্কের দিক থেকে আরেকটা রাস্তা এসে মিশেছে এখানে— এ রাস্তাটাই পুব দিকে এগিয়ে গিয়ে পড়েছে বিজয়নগরে। কাজী শহিদুল্লার বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িটাই তার বাবার বানানো খান মঞ্জিল, যার একলা বাসিন্দা এখন শুধু সে।

আরও পড়ুন

খালের পার ধরে হাফিজুর রহমানের বাড়ির সামনে এসে বরাবরের মতো দম নেওয়ার জন্য একটু থামল সে। এখান থেকে পরবর্তী ১৫ মিনিটে সে তার বাড়ির গেটে পৌঁছে যাবে। কোনো হুড়োহুড়ির ব্যাপার নেই। ৭টা ৩০, ঘরে ঢুকে দেয়ালঘড়িটায় দেখবে সে, একনজর।  প্রতিদিনের মতো।

রাস্তার এই পুরো সময়টায় কারও সঙ্গেই তার কোনো কথা হয় না। এমনকি জাহিদদের বাড়ির মোড়ের দোকানির সঙ্গেও না, হুইলচেয়ারটা সে দোকানের সামনে নিয়ে গিয়ে থামায়, দোকানের ভেতর থেকে দোকানি প্রতিদিনের মতো পাউরুটির ঠোঙাটা বাড়িয়ে দেয়। আর এর বিপরীতে দোকানি যদু মিয়া দোকানের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাওনা টাকাটা তুলে নেয়—লেনদেনের এই পুরো সময়টুকুতে সময় লাগে বড়জোর মিনিটখানেক। এই তো, তারপর কোলের ওপর রুটির ঠোঙাটা রেখেই, হুইলচেয়ারের দুই পাশের চাকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার দুই হাত।

ঠাকুর্মার মতো সেগুনবাগিচার লোকজনও সেই যে তাকে অপাঙ্‌ক্তেয় করল, তার আর ওই চক্কর থেকে আর বেরোনো হলো না। এতটা বছর পেরিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে সে দেখে, সেগুনবাগিচায় তার কোনো বন্ধু নেই, কোন সুহৃদ নেই। কাউকে সে দোষ দেয় না, ওই দুর্বহ সময়ে, তার একলা হওয়া খুব দরকার ছিল, নইলে ওই ধাক্কা সে সামলে উঠতে পারত না। তাই সে সব সময়ই নিজেকে বলে এসেছে, সেগুনবাগিচাবাসী তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পরোক্ষে আসলে তার উপকারই করেছে। ঠাকুর্মার কথা আমলে নিয়ে পাড়ার মহিলারা কখন যে তাকে একলা করে দিল, সেটা সে বুঝেছে আরও অনেক পরে এসে। পুরোনোদের প্রায় অনেকেই দেহ রেখেছেন, কিন্তু সে-ই কেবল এখনো টিকে আছে! বৃদ্ধ হাফিজুর রহমান সাহেব, তাঁর স্ত্রী বেঁচে নেই, সে ১৫-১৬ বছর তো হবেই, কাজী শহিদুল্লা, তাঁর স্ত্রী আগেই মারা গেছেন। শিক্ষাবিদ মজিদ সাহেবও নেই, তাঁর নিজের মা–বাবাও দুনিয়া ছেড়েছেন আরও বছর অনেক আগে। সেন পরিবারকে যারা চিনত তাদের অনেকেই নেই, কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছেও সে একজন উন্মাদ বায়ুগ্রস্ত মহিলাই। এখনো জীবিত বয়োজ্যেষ্ঠদের চোখে তার এখনকার হুইলচেয়ারে মিশে থাকা ক্ষীণকায় শরীরটার চেয়ে তার একদার প্যান্টের ওপর লম্বা ঝুলের শার্ট, গলায় ফুলছাপা রুমাল, আর পিঠে ছড়ানো লম্বা চুলের কিম্ভূত বেশবাশের অহংকারী মেয়েটার স্মৃতিই হয়তো এখনো দুঃস্বপ্নের মতোই বেঁচে আছে। সেই একরোখা চিবুক উঁচিয়ে চলা মেয়েটা তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কার, তখনো চাকরিটা সে ছাড়েনি, তখনো সে দুই পায়ে স্বচ্ছন্দেই চলাফেরা করে।

জোহারা কাজীর বাড়ির পর একটু ফাঁকা মাঠ মতন, তারপর বিলেতি টমাস রিডের ডন স্কুল, ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত এটাই একমাত্র ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। টমাসের বাড়ির বিহারি কাজের লোকটা বেশ জোরে ভলিউম দিয়ে রেডিও শুনছে, উর্দু কার্যক্রম।

সেগুনগাছের ফাঁক গলে বিশাল একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারির শেষাশেষি চলছে এখন, বাতাসে এখনো শীতের তীব্র কামড় টের পাওয়া যায়। রুটির ঠোঙাটা তুলে কোলের পশমি শালটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল। আরেকটা মনোরম রাত আসছে, হুইলচেয়ারের চাকায় হাত দ্রুত চালাতে চালাতে ভাবল সে, তখনই চোখে পড়ল: জাহিদুর রহীমদের বাড়ির কোণের স্ট্রিট লাইটটা জ্বলছে না, বিকল হলো কবে! বাতি না থাকায় ওই জায়গাটুকুজুড়ে কেমন ছায়া ছায়া একটা অন্ধকার। খেয়াল করল, সামনে-পেছনে কোনো লোক নেই রাস্তায়। রোববারের রাত আজ। বন্ধবার।

অন্ধকারটুকু পেরোতে পেরোতে তার হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, আজ কি সে মিউজিক কলেজ থেকে এই পথটুকু একটু তাড়াতাড়িই পেরিয়ে এসেছে। রশিদ মিয়ার সাইকেল সারাইয়ের দোকানটা এখনো খোলা, সাড়ে ছয়টার পর ওটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

আবরার সাহেবের বাড়ি পেরিয়ে আসতেই বেগম জোহরা কাজীর বাড়ির সামনের বাগান থেকে প্রতিদিনের মতো ডোবারম্যান কুকুরটা তেড়ে এল ঘেউ ঘেউ করতে করতে, কাছে এসে তাকে চেনার পর ঘেউ ঘেউ থামল ওটার। প্রতিদিনের মতো জোহরা কাজীর বাড়ির গেটটা পেরোনোর সময় কুকুরটার উদ্দেশে মৃদু ধমক দেয় সে, আজও বলল, যাহ! জবাবে কুকুরটা শুধু কুঁই–কুঁই করে বার দুই ককিয়ে উঠল।

জোহারা কাজীর বাড়ির পর একটু ফাঁকা মাঠ মতন, তারপর বিলেতি টমাস রিডের ডন স্কুল, ঢাকা শহরে এখন পর্যন্ত এটাই একমাত্র ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। টমাসের বাড়ির বিহারি কাজের লোকটা বেশ জোরে ভলিউম দিয়ে রেডিও শুনছে, উর্দু কার্যক্রম। ‘ইয়ে মুসিবত কাহাছে আয়া, আজনবি, জাহা জাহা মাকান...গায়েব হো যাতা...।’

কোনো আজগুবি কথিকা চলছে বোধ হয়। বিরক্ত লাগল তার। উর্দু সে একদম বোঝে না। পাকিস্তানের অংশ হলেও উর্দুর প্রতি তার একরকম বিতৃষ্ণা আছে। পারতপক্ষে উর্দু থেকে দূরে থাকতে চায় সে। তার বাড়িটা সন্ধ্যার অন্ধকার মেখে কেমন নিঝুম হয়ে আছে। বাড়ির সামনের লোহার গেটের পর থেকে ইট বিছানো বাগানপথ, গেট খুলে ভেতরে ঢুকে বারান্দার গোল মোটা থামটার গায়ে লাগানো সুইচ টিপে বাতি জ্বালল সে। এরপর হুইলচেয়ার নিয়ে সোজা উঠে এল, দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ঘরের বাতি জ্বালল। তারপর প্রতিদিনের অভ্যাসমতো নিজের অজান্তেই দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। আর তাকিয়েই চোখ স্থির হয়ে গেল তার।

ধীরে ধীরে তার চোখ কুঁচকে উঠল। ঘড়ি সময় দেখাচ্ছে ৭টা ১৫!

অনেকক্ষণ ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই থাকল সে। নিজের চোখকেও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে ঠিক দেখছে তো? ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা ঠিকঠাক মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, আর নীরব ঘরে টিকটিক আওয়াজটা স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে সে। কোনো ভুল হচ্ছে না। পেন্ডুলামের কাঁটাটাও দুলছে ডাইনে-বাঁয়ে।

আজ, ১৫ মিনিট আগেই বাড়িতে পৌঁছে গেছে সে! তার বাড়িতে ঢোকার কথা ৭টা ৩০ মিনিটে। পঁচিশ বছর ধরে, এক দিনের জন্যও এই নিয়মের কোনো এদিক-সেদিক হয়নি। প্রতিদিন দম দেওয়া পুতুলের মতো ঠিক পাঁচটায় সে বাড়ি ছেড়ে বেরোয়ে, ঠিক সাড়ে সাতটায় ঘরে ঢোকে। ঘড়িতে  সময় দেখায় কাঁটায় কাঁটায় ৭টা ৩০।

ঠিক এ সময় প্রবল বিস্ময় নিয়ে আরও একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল সে, শুধু ঘড়ির গড়বড়ই না, আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। আজ সে তার প্রিয় নেশা, পান কিনতে ভুলে গেছে। এই একটুই পানের নেশা তার, জর্দা দেওয়া সাঁচি পান। এই ভুলটা হলো কী করে তার! গত পঁচিশ বছরে এই প্রথম দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাসচ্যুতি হলো তার। যদু মিয়ার দোকানের পর, দুটো বাড়ি, তারপরেই যতীনের পানের দোকান। রুটি কেনার পরেই পান কেনার জন্য থামে সে ওখানে। আজ কী হলো? ওই পথেই সে এসেছে, এমন না যে আজ ভিন্ন কোনো পথে ফিরেছে সে, তাহলে যতীনের দোকানে সে থামেনি কেন?

শোয়ারঘরে ঢুকে শালটা খুলে বিছানায় রাখল। হুইলচেয়ার থেকে শরীরটা তুলে নিয়ে তার প্রিয় রকিং চেয়ারটায় বসল। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। এই চেয়ারটা তার মায়ের। রাতে এই চেয়ারে দুলতে দুলতে মা সেলাইয়ের কাজ করত। আর সে এই চেয়ারে বসে বই পড়ে, প্রতিদিনের রুটিন। অনেকে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে, সে পারে না। পাশের বিছানায় রাখা বইয়ে যতটুকু পড়েছে সেখানে বুকমার্কার দেওয়া আছে। এখন পানের পুঁটলিটা খুলে বইটা কোলের ওপর টেনে নেওয়ার কথা ছিল তার। একটা পানের তেতো রসের দারুণ মৌতাত নিয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বইয়ে ডুবে থাকার কথা ছিল! কিন্তু দুটো ঘটনা তার প্রতিদিনের নিয়মে বড় একটা ব্যাঘাত ঘটাল। আজই তার মনে হলো, পুরোনো অভ্যাসগুলো সে সব ছাড়ান না দিলেও পারত। কত দিন কোনো গান শোনে না। দেয়ালের ঘড়িটা ঘরময় শুধু ক্লান্তিকর টিকটিক শব্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কোনো  একটা গানের যন্ত্র থাকলে মন্দ হতো না।

একসময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ারও খুব নেশা ছিল। তাদের দুই বাড়ি পরেই তার বাবার সমবয়সী স্থপতি মোশারফ সাহেবের মেয়ে জিনিয়া মেয়েদের একটা মাসিক পত্রিকা বের করত, শুরুতে কিছুদিন সে-ও লিখেছে ওতে। কিন্তু জীবন ওলটপালট করে দেওয়া তার ওই ঘটনার পর সব ছেড়েছে সে।

একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিংবা নিদেনপক্ষে একটা রেডিও থাকলেও এখন শুনতে পারত। পঁচিশ বছর পর আজ এই  প্রথমবারের মতো তার মনে হচ্ছে—আরেকজন কেউ পাশে থাকলে বোধ হয় এত নিঃসঙ্গ আর একলা লাগত না। একসময় কী ভীষণই না গানের নেশা ছিল তার! গান, গানের মানুষের সঙ্গেই তো ছিল তার দিন–রাতের যত দোস্তি। গানের মানুষটাকে কেড়ে নেওয়ার পর গানও তাকে চিরতরে ছেড়ে গেল।

কদিন আগে, কার মুখে যেন, রাস্তায় কারও টুকরো আলাপেও হতে পারে; শুনল ভিয়েতনামে নাকি ধুন্ধুমার যুদ্ধ বেধে গেছে! আমেরিকা ভিয়েতনামে কেন আক্রমণ করেছে ভেবে পায়নি সে, তাই খবরটায় কোনো গুরুত্বও দেয়নি।

একসময় পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ারও খুব নেশা ছিল। তাদের দুই বাড়ি পরেই তার বাবার সমবয়সী স্থপতি মোশারফ সাহেবের মেয়ে জিনিয়া মেয়েদের একটা মাসিক পত্রিকা বের করত, শুরুতে কিছুদিন সে-ও লিখেছে ওতে। কিন্তু জীবন ওলটপালট করে দেওয়া তার ওই ঘটনার পর সব ছেড়েছে সে। স্বেচ্ছানির্বাসনে, যত দিন গেছে নিজের চারপাশে ততই সে একের পর এক দুর্ভেদ্য সব প্রাচীরই গড়ে তুলে গেছে।

রকিং চেয়ার ছেড়ে বিছানায় এসে শুল সে, ভেতরের অস্থিরতাটুকু কাটছে না। আজকের দুটো অসম্ভব আর তীব্র কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা মন থেকে সরাতে পারছে না। বারবার মনে পড়ছে—আজ ১৫ মিনিট আগে বাড়িতে ফিরেছে সে এবং তার একমাত্র নেশা—পান কিনতে ভুলে গেছে। কোথাও কোনো একটা বড় গড়বড়ের ঘটনা ঘটেছে, যা সে এই মুহূর্তে ঠিক ধরতে পারছে না। তবে একটা সন্দেহ মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠছে, ধীরে ধীরে। আর ওই সন্দেহটাকে যতই সে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে, ততই সেটা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ফিরে আসছে: সেকি মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে? দীর্ঘদিন একলা কাটানোর কারণে তার মাথায় কি গোলমাল দেখা দিচ্ছে... পাগল হয়ে যাচ্ছে সে?

না, না, তা কী করে হয়! এই ঘরটাকেই উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক না। এই ঘর, এই বাড়ি—প্রতিটি কোনা তার নিজের হাতের তালুর মতোই মুখস্থ। দেয়ালসংলগ্ন ওই মেহগনি খাটের বিশাল আলমারি, জানালার ধারের একপেয়ে গোল টেবিলটা, বিছানার পাশের ঘষা কাচের টেবিল ল্যাম্পটা, দেয়ালের বুড়ো ঘড়ি, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যা ক্লান্তিহীন সময় দিয়ে চলেছে। আর বিছানার ওপরে মাথার কাছে অবন ঠাকুরের ওই পেইন্টিংটা—বিস্তৃত ধূসর এক প্রান্তে একাকী এক নৌকা, একজন মাত্র যাত্রী। তার মতো, একলা, অকূল এক পাথারে।

আরও পড়ুন

২.

পরের দিন ঠিক পাঁচটায় হুইলচেয়ার নিয়ে বেরোল সে। গতকালের অস্বস্তিটা বুকের মধ্যে জমে আছে আজও। তবে রাস্তায় বেরিয়ে বার কয়েক বিড়বিড় করে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল: ‘আজ ফেরার সময় যেন কিছুতেই ভুল না হয়! যতীনের দোকানে থেমে অবশ্য অবশ্যই পান কিনতে হবে তাকে!’

আজ কেউ গানের ক্লাসে আসেনি, সুধীন দাসও না। কেন? আজ ওদের ক্লাস নেই কেন? আজ গানের ক্লাস হবে না, কাল কি এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে? নাকি, আজ কোনো ছুটিছাটা? কত বছর ধরেই তো ক্যালেন্ডারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মাস, বছরের কোনো হিসাবই সে রাখে না বহুদিন।

আজ একলা একলাই মিউজিক কলেজের মাঠটায় ঘুরল সে। এখানে সেনরা যখন থাকত খুব সাজানো-গোছানো ছিল। মাঠের ঘাস সব সময় সুন্দর করে ছাঁটা থাকত, মাঝখানে একচিলতে বাগান ছিল। ওই বাগানের গোলাপ কতবার তার খোঁপায় গুঁজে দিয়েছে সে।

বটগাছটার নিচে এসে ক্লান্ত হয়ে বসে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর দ্রুতই সন্ধ্যা নামল, শীতের সন্ধ্যা দেখতে দেখতে কালোয় ঢেকে গেল চারদিক। ফিরতি পথ ধরল সে, মিউজিক কলেজ থেকে বেরিয়ে তার বাসার পথ বাঁ দিকে। সামনে শিল্পকলা একাডেমি। খালের যে জায়গায় একটা কংক্রিটের ব্রিজ, সেখান থেকে শিল্পকলার দিক থেকে আসা রাস্তাটা প্রেসক্লাবের দিকে চলে গেছে, ওখানেই আরেকটা রাস্তা খালের পাড় ধরে পুবমুখী হয়েছে, বিজয়নগর হয়ে এই একই রাস্তা গিয়ে উঠেছে পল্টনে, তারপর মতিঝিল। ওদিকটা এখনো প্রায় বুনো। এখনো জঙ্গল, কিছু কিছু বাড়িঘর হচ্ছে। খালপাড়ের ব্রিজ থেকে বাঁক নিয়ে বিজয়নগরমুখী রাস্তাটা ধরে কিছুদূর এসে সে আবারও বাঁয়ে বাঁক নিল। ঠিক এই কোণের বাড়িটাই জাহিদুর রহীমদের বাড়ি। তারপর আর কিছুদূর গেলেই তার রুটি কেনার কনফেকশনারি, যদু মিয়ার দোকান। ওটা পেরিয়ে আরও তিন-চার বাড়ির পর আবরার সাহেবের বাড়ি, ওটার লাগোয়া, জোহরা কাজীর বাড়ির সামনেই যতীনের পানের দোকান।

কিন্তু বাঁক ঘুরে জাহিদদের বাড়ি পেরোনোর পরই ধাক্কাটা খেল সে, জাহিদুর রহীমদের বাড়িটা ঠিক আছে, কিন্তু যদু মিয়ার কনফেকশনরি মায় মুদি দোকানটা উধাও।

মানে কী! কালই তো যদু মিয়ার কাছ থেকে রুটি কিনেছে সে। যতীনের পানের দোকান থেকে পান কিনতে ভুলে গিয়েছিল...কিন্তু তক্ষুনি প্রশ্নটা তীব্র চাবুকের মতো মাথায় এল তার: কাল সে পানের কথা ভুলে গিয়েছিল, নাকি যদু মিয়ার কনফেকশনারির মতো যতীনের মুদি দোকানটাও কালই গায়েব হয়ে গেছে!

কী হচ্ছে এসব? ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। যদু মিয়া কোথায় কিংবা যতীন?

হুইলচেয়ারের চাকায় দ্রুত হাত চালিয়ে বাসায় ফিরল সে। বারান্দা থেকেই চারপাশে গভীরভাবে নজর করে দেখল, আশপাশের বাড়িঘরগুলো কেমন অচেনা লাগছে। কাজী শহিদুল্লার বাড়িটা গেল কোথায়! তার বারান্দা থেকে গ্রিলঘেরা নিচের বারান্দাটা চোখে পড়ত তার, কাজী সাহেব বেঁচে থাকতে ওখানে হাঁটতেন। কিন্তু কোথায়, কিসের বারান্দা? তার জায়গায় কেমন ছায়ার মতো একটা পর্দা যেন ঝুলে আছে। অনেক গাছ ছিল বাড়িটা ঘিরে—সেসব কিচ্ছু নেই।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডজুড়ে কি কিছু ঘটছে, যা সে জানে না? ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালল। শীত শীত লাগছে, কিন্তু এই শীত প্রকৃতির না, ভয়ের...হুইলচেয়ার চালিয়ে আবার বারান্দায় এল, চাঁদের রুপালি আলো রাস্তায় গাছপালার সঙ্গে মিশে ছোপ ছোপ ছায়া ফেলেছে। কিন্তু ওই মায়াবী আলোয় সে দেখল বাড়ির সামনের রাস্তাটা খানিক আগের সেই রাস্তা যেন নেই, মনে হচ্ছে কেউ জায়গায় জায়গায় রাস্তাটাকে উল্টে দিয়েছে। ত্রিমাত্রিক আয়তনে কিছু একটা ঘটে গেছে, রাস্তায়, তার বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের বাড়িটাতেই যেন কোনো লন্ডভন্ড ঘটনা ঘটে গেছে। বাড়িটার আকৃতি বদলে গেছে, কেউ যেন দানবীয় কোনো হাতে বাড়িটাকে উল্টো করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলল সে। কী ঘটছে এসব? নাকি সে ভুল দেখছে, এটা তার চোখের ভুল হয়তো। ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করার আগে আরেকবার পেছন ফিরে তাকাল সে: বাড়িটা এখনো উল্টো হয়েই আছে...সঙ্গে জোর করে আরও কিছু বাড়িকে যেন সংকুচিত করে এনে ওটার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কে জমে যেতে যেতে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল সে। হুড়কোও তুলে দিল।

বিকেলের দিকে আরও ঘটনা ঘটল, শহরের দিগন্তরেখার আরও বদল ঘটে গেছে। বিশাল বিশাল স্টিলফ্রেমের দালান, কাচের বিল্ডিং, কোত্থেকে যেন এসে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাইরের আকাশ ধোঁয়াটে, আর চোখ জ্বালা করা এক বাতাস বইছে থেকে থেকে। বাইরে রাস্তায় কোনো লোক নেই।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে করতে পারল না, দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড়িয়ে আচমকা উঠে বসেছে সে। সারা শরীর ঘেমে একসা। জানালা দিয়ে ভোরের ধোঁয়াটে আলো এসে ঢুকেছে ঘরে। দেয়ালঘড়িতে সাড়ে ছয়টা দেখাচ্ছে। হুইলচেয়ারে বসে জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল: বাইরে কিছুই নেই। না ছায়া, না কোনো শীতের ধোঁয়াশা। কিছু গাছপালা চোখে পড়ছে, একটা রেখার মতো কিছু বাড়িঘরের অবয়ব...কিন্তু এগুলো তার চেনা প্রতিবেশীদের বাড়ি না। দিগন্তের কাছাকাছি ছায়া ছায়া আরও কিছু দালানকোঠা, বিশাল বিশাল, আকাশছোঁয়া! ঢাকায় এত বড় বাড়ি কোনোকালে ছিল না। তাহলে?

দ্রুত বুকশেলফটার কাছে এগিয়ে গেল সে। তাকের ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে একটা বই বের করে আনল। লেখক আইনস্টাইন না, তার বিভিন্ন থিওরি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করেছে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। এখানে একটা বেশ মজার অধ্যায় ছিল, অনেক বছর আগে পড়া, কিন্তু তার এখনকার পরিবর্তিত-পারিপার্শ্বিকতা বইটার কথা তাকে এত দিন পর মনে করিয়ে দিয়েছে। পাতা উল্টে উল্টে একটা জায়গায় এসে থামল সে, একটা অনুচ্ছেদের ওপর এসে চোখ আটকে গেল, এই অনুচ্ছেদটা কত বছর আগে পড়া! তখন পড়তে গিয়ে ভীষণ রকম অবিশ্বাস্য আর অবাস্তব ঠেকেছে, কিন্তু আজ আর তা মনে হচ্ছে না: মানুষই পৃথিবীর অবয়ব নির্ধারণ করে। এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও। কোটি কোটি সত্তা গাছকে গাছ রূপে দেখছে, বাড়িকে বাড়ি, রাস্তাকে রাস্তা...অন্য আর কিছু না। মনই এসব রূপকে নির্ধারণ করে, মনই এদের আকৃতি ধরে রাখে...এই মনকে ধ্বংস করে দিলে পরিচিত অবয়বও নতুন চেহারা পাবে...আর আধুনিক বিজ্ঞান আরেকটা সম্ভাবনার কথা বলেছে...হ্যাঁ সম্ভবত...আরও কতগুলো ডাইমেনশনের অস্তিত্বমান, আমরা যে জায়গা ধরে আছি তার সমান্তরালেই সময়ের আরও কতগুলো বন্ধনী ঢুকে রয়েছে, একেবারেই অসম্ভব না...

একটা পিনকে যদি একটি ছায়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ওই ছায়া কি পিনের কথা জানবে? জানবে না, এখানে ছায়া দ্বিমাত্রিক, পিন ত্রিমাত্রিক। কিন্তু দুটোই একই স্থান দখল করে আছে। তারপরই এই মারাত্মক অনুচ্ছেদটা: আমরা একদিন হয়তো এমন একসময়ে উপনীত হব, হয়তো দূর কোনো ভবিষ্যতে, যখন আমাদের বায়ুযান, আমাদের জগৎ আমাদের পায়ের তলাতেই মিলিয়ে যাবে, আমাদের চোখের সামনেই হয়তো আরও কোনো শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তা আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতে ঢুকে পড়ে বদলে দেবে সব...।

বিকেলের দিকে আরও ঘটনা ঘটল, শহরের দিগন্তরেখার আরও বদল ঘটে গেছে। বিশাল বিশাল স্টিলফ্রেমের দালান, কাচের বিল্ডিং, কোত্থেকে যেন এসে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাইরের আকাশ ধোঁয়াটে, আর চোখ জ্বালা করা এক বাতাস বইছে থেকে থেকে। বাইরে রাস্তায় কোনো লোক নেই। খালের রেখার মতো সরু প্রবাহটাও আর নেই। করোগেটেড টিনের আগ্রাসী একটা বেড়া ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আবরার সাহেবের বাড়িটাও নাই হয়ে গেছে, কাজী শহিদুল্লা সাহেবের বাড়ি? নেই। সব সেঁধিয়ে গেছে ওই শূন্যতার গহ্বরে!

চারপাশটা ক্রমশ বিলীয়মান, সব মুছে যাচ্ছে। ভয়াল এক শূন্যতা এখন তার দিকেই যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে, ঘরের সামনের দেয়ালটা নেই, একপেয়ে টেবিলটা, রকিং চেয়ার...এখন সে তার নিজের পালার জন্য অপেক্ষা করছে।

তার ইট বাঁধানো বাগানপথটাও সংকুচিত হয়ে হারিয়ে গেছে, তারপর? তারপর তার ঘর অদৃশ্য হবে, তারপর?

বারান্দা থেকে বৈঠকখানায় ফিরে এল সে, হুইলচেয়ার চালিয়ে পাশের শোয়ারঘরের দরজাটা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে আর্তচিত্কারটা বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। তার শোয়ারঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তার সাবেকি আমলের লোহা কাঠের খাটটার জায়গায় শুধু ধোঁয়ার মতো এক শূন্যতা ঝুলে আছে। সে দ্রুত দরজা থেকে পিছিয়ে এসে একসময় পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত ঘরটার দরজা খুলল। এখানেও যা দেখবে ভেবেছিল...তাই! পড়ার ঘর বলে কিছু নেই এখানে, টেবিল-চেয়ার বইয়ের তাক—পরিচিত কিছুই নেই।

কিচ্ছু না...

রাস্তাটা মুছে গেছে। তার বাড়ির বড় একটা অংশই নেই। শুধু বৈঠকখানাটা এখনো স্বরূপে আছে। কিন্তু বুকশেলফটা প্রায় খালি, বইগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে...এরপর যাবে একপেয়ে টেবিলটা, দেয়ালের ঘড়ি, অবন ঠাকুরের পেইন্টিং...

চারপাশটা ক্রমশ বিলীয়মান, সব মুছে যাচ্ছে। ভয়াল এক শূন্যতা এখন তার দিকেই যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে, ঘরের সামনের দেয়ালটা নেই, একপেয়ে টেবিলটা, রকিং চেয়ার...এখন সে তার নিজের পালার জন্য অপেক্ষা করছে।

ঘরে-বাইরে কোথাও কোনো হল্লাচিল্লা, কারও আর্তনাদ নেই। সব নীরবে বদলে যাচ্ছে। চারপাশে শুধুই অসীম অখণ্ড, স্তব্ধতা। হঠাৎ শেষ একটা টিক শব্দ করে ঘড়িটা থেমে গেল। আজব...৩০ বছরে এই প্রথম। কিন্তু ওটা থেমে গেল না অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হলো!

বৈঠকখানার দরজাটা মনে হচ্ছে শূন্যে ভেসে আছে, ঠিক তক্ষুনি দরজায় মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, তার আরেক জীবনের অতি চেনা কেউ! অসীম শূন্যতা থেকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। ওই তো! সত্যি? না, আতঙ্কে কল্পনা করছে? যাচাই করা হলো না। পায়ের দিক থেকে একটা ঝনঝনানির মতো বিদ্যুত্প্রবাহ উঠতে শুরু করল যেন শরীরের ওপরের দিকে। বুঝল এবার সে যাচ্ছে...

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০১৮ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন