আলোর বেগ কত?

মহাবিশ্বের পরিচিত যেকোনো কিছুর চেয়ে আলোর বেগ বেশি। তবে মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে আলোর বেগ পরিবর্তিত হতে পারে! মহাবিশ্বের একটি গতিসীমা আছে। সেই গতিসীমাই আলোর বেগ। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে, আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে আর কিছু ভ্রমণ করতে পারে না। এমনকি আমাদের সেরা মহাকাশযানগুলোও নয়। 

অনেক হেঁয়ালি হলো। চলুন, সংখ্যা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, আসলে আলোর বেগ কত। আলো প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার যেতে পারে। অর্থাৎ ঘন্টায় যেতে পারে প্রায় ১০০ কোটি কিলোমিটারেরও বেশি দূরে । সংখ্যাটির বিশালত্ব হয়তো এখনো বুঝতে পারছেন না। ধরুন, পুরো পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসতে একটি যাত্রীবাহী জেটের ২ দিনেরও বেশি সময় লাগবে। সেখানে আলো মাত্র ১ সেকেন্ডে পৃথিবীকে ৭ বারেরও বেশি ঘুরে আসতে পারে অনায়াসে। বুঝুন তাহলে আলোর গতি!

আলোর বেগ একটি সার্বজনীন ধ্রুবক। পদার্থবিজ্ঞান বা গণিতের সমীকরণে আলোর বেগ বোঝাতে c প্রতীক ব্যবহার করা হয়। আলোর চেয়ে বেশি বেগে যে আর কোনো বস্তু চলতে পারে না, এটা প্রথম বলেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে তিনি এ কথা উল্লেখ করেন। এ তত্ত্ব মতে, পদার্থ আলোর গতির কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে পদার্থের ভর হয়ে যাবে অসীম। আলোর বেগ এতটাই অপরিবর্তনীয় যে মিটারের মতো আন্তর্জাতিক মানের পরিমাপগুলো সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করায় আলোর বেগ।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এ বেগ এত বেশি যে প্রাচীনকালে মনে করা হতো, আলোর চলতে কোনো সময় লাগে না। অর্থাৎ, আলো তাৎক্ষণিকভাবে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। ১৬০০ শতকের শেষদিকে ড্যানিশ বিজ্ঞানী ওলে রোমার বৃহস্পতির চাঁদগুলো পর্যবেক্ষণের সময় প্রথম আলোর গতি পরিমাপ করেন। যদিও তা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। এরপর আলোর বেগ আরও সঠিকভাবে পরিমাপ করতে অনেক বিজ্ঞানী অবদান রেখেছেন। বিজ্ঞানীরা কীভাবে আলোর গতি পরিমাপ করলেন, তা নিয়ে আলাদা একটি লেখা হতে পারে। আজকের আলোচনার বিষয় সেটা নয়।

ড্যানিশ বিজ্ঞানী ওলে রোমার
উইকিপিডিয়া

তবে আলোর বেগ সব সময় একরকম থাকে না। মানে বদলে যায়। আসলে, আলোর বেগ কত হবে, তা নির্ভর করে মাধ্যমের ওপর। অর্থাৎ, আলো কোন মাধ্যমে চলছে— বায়ু, পানি নাকি হীরার ভেতর দিয়ে, তার ওপর। আমরা এতক্ষণ যে আলোর বেগের কথা বলছি, সেটা শূন্যস্থানে। অর্থাৎ এমন একটি স্থান, যেখানে কোনো বাতাস নেই। আগেই বলেছি, এরকম শূন্যস্থানে আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। কিন্তু পানিতে সেটা কমে যায়। পানিতে আলোর বেগ সেকেন্ডে ২ লাখ ২৫ হাজার কিলোমিটার। আবার আপনি আলোর বেগের পার্থক্য বুঝতে পারবেন প্রিজমের মধ্য দিয়ে আলো বের হওয়ার সময়ও।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

মজার বিষয় হলো, আলো কতটা দূরে গেল, তা আমাদের পরিচিত মাইল বা কিলোমিটারের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় না। কারণ অল্প সময়ে আলো এত দূরে চলে যায় যে এসব এককে তা প্রকাশ করা কঠিন। এ দূরত্ব এতই বেশি যে এক্ষেত্রে দূরত্বের একক হিসেবে ব্যবহার করা হয় আলোকবর্ষ। আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, তাই এক আলোকবর্ষ। কিন্তু এর মান কত? আলো বছরে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন মাইল বা ১০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার যেতে পারে। এই পদ্ধতিতেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সব বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করেন। 

আলো বছরে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার যেতে পারে।

আলোকবর্ষ ব্যাপারটা আরও একটু ভালোভাবে বোঝা দরকার। চাঁদ থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে প্রায় ১ সেকেন্ড সময় লাগে। অর্থাৎ, চাঁদ প্রায় ১ আলোকসেকেন্ড দূরে আছে। সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ৮ মিনিট। তার মানে, সূর্য আমাদের চেয়ে সাড়ে ৮ আলোকমিনিট দূরে অবস্থিত। আবার আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের নাম আলফা সেন্টাউরি। সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় ৪ দশমিক ৩ বছর। অর্থাৎ, আলফা সেন্টাউরি ৪ দশমিক ৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। 

আরও পড়ুন

আলোকবর্ষ আসলে কত বড়, তা বোঝার একটি পদ্ধতি বলেছেন মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গ্লেন রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। প্রথমে পৃথিবীর পরিধিকে একটি সরলরেখা হিসেবে কল্পনা করুন। এর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২৪ হাজার ৯০০ মাইল। এরপর এই সরলরেখাটিকে গুণ করুন ৭ দশমিক ৫ দিয়ে। কারণ গুণফল যা হবে, আলো এক সেকেন্ডে তত মাইল যেতে পারে। এবার ওই সরলরেখার পাশাপাশি একই আকৃতির ৩১৬ লাখ সরলরেখা ক্রমান্বয়ে একটার পরে একটা জুড়ে দিন। আলো এক বছরে ওই পরিমাণ দূরত্ব যেতে পারে। অর্থাৎ, ৬ ট্রিলিয়ন মাইল। অঙ্কে লিখলে এর বিশালতা আরেকটু ভালোভাবে বোঝা যাবে—৬,০০০,০০০,০০০,০০০ (মানে ৬ এর পরে ১২টি শূন্য বা ৬×১০১২ মাইল)।

আমাদের সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্র এবং অন্যান্য বস্তু কয়েক আলোকবর্ষ থেকে কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরবর্তী মহাবিশ্বে যা দেখেন, তা আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস। অর্থাৎ, এখন আপনি আলফা সেন্টাউরিতে দূরবিন দিয়ে যে আলো দেখবেন, তা আসলে আজ থেকে ৪ দশমিক ৩ বছর আগের আলো। আর সূর্যের ক্ষেত্রে? আপনি এখন যে সূর্যের আলো দেখছেন, তা আসলে আরও ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডের আগের আলো। তার মানে, আপনি আসলে অতীতের সূর্যের দেখছেন। এভাবেই আমরা মহাবিশ্বের ইতিহাস দেখতে পাই। জানতে পারি, সেই মহাবিশ্বে কীভাবে গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়েছে। এখানেই আলোর বেগের মাহাত্ম্য।

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: স্পেস ডট কম ও লাইভ সায়েন্স 

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন